কিয়ামতের আলামাত — পর্ব -৪
ইমাম মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী নিদর্শনসমূহ
মাওলানা মাসউদ কাওসার
(কিয়ামতের পূর্বে এমন কিছু অবস্থা ও প্রেক্ষাপট তৈরি হবে যার সাথে মুমিনদের জান্নাত ও জাহান্নামের সম্পর্ক। শেষ যমানার ব্যাপারে সবচেয়ে সত্যবাদী সংবাদ প্রদানকারী নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিসের সারাংশ হল শেষ যমানায় পুরো পৃথিবী দুইটি তাবুতে বিভক্ত হয়ে যাবে। একটি হবে মুমিনদের তাবু যেখানে নিফাকের অস্তিত্ব থাকবে না। আরেকটি তাবু হবে মুনাফিকদের তাবু যেখানে ইমানের অস্তিত্ব থাকবে না। মাওলানা মাসউদ কাওসার মা: জি: এর এই আলোচনাটি সেই সফলতা ও ব্যর্থতার সাথেই সম্পৃক্ত। এই বয়ানটিতে মুমিনদের চিন্তার খোরাক রয়েছে। মাওলানা সাহেব আলোচনাটি একটি সাধারণ মজলিসে করেছিলেন। যেখানে সম্মানিত ভাই হাফেজ শাহযাদ (মুহিব্বুল্লাহ) শহিদ রহ. উপস্থিত ছিলেন। ভাই হাফেজ শাহযাদ শহিদ রহ. অনেক গুরুত্বসহকারে বয়ানটি রেকর্ড করেন। আর অডিও সেই দরসগুলো ভাই খাইরুদ্দীন লেখার আকৃতিতে নিয়ে আসেন। ইনশাআল্লাহ এই দরসগুলো ধারাবাহিকভাবে আপনাদের সামনে পেশ করা হবে।)
إن الحمد لله نحمده و نستعينه ونستغفره ونؤمن به و نتوكل عليه ونعوذ بالله من شرور أنفسنا و من سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادي له ونشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له ونشهد أن سيدنا ومولانا محمدا عبده ورسوله أما بعد..
হযরত মাহদি রা. কবে আসবেন?এটি অনেক বড় একটি প্রশ্ন যে, তিনি কবে আসবেন?
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক হাদিসেই তার আগমনের পূর্বের আলামতগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন যে, তোমরা এই ঘটনা দেখে নাও, এটি দেখে নাও! ওটি দেখে নাও। যখন এই ঘটনাগুলো পূর্ণ হয়ে যাবে তখন দুনিয়াতে ইমাম মাহদি রা. আগমন করবেন। এরকম সাতেরও অধিক ঘটনা হাদিসের কিতাবগুলোতে উল্লেখ আছে। কিন্তু সহিহ সনদে বর্ণিত অধিকাংশ ঘটনা হাদিসের ছয়টি বিশুদ্ধে গ্রন্থে বর্ণিত আছে বা অন্যান্য নির্ভরযোগ্য হাদিসের কিতাবে বর্ণিত আছে। সেখান থেকে চার পাঁচটি আলামত আপনাদের সামনে তুলে ধরছি যাতে করে আপনারা বুঝতে পারেন যে, মাহদি রা. এর আগমনের যুগ কোনটি এবং তিনি কবে আসবেন? এই আলামতগুলোর একটি আলামত স্বতন্ত্র এবং বাকি তিন চারটি আলামত হল ধারাবাহিক। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলো ধারাবাহিক বিন্যাসের সাথে পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করেছেন। কারণ, এগুলো সময়ের ধারাবাহিকতার সাথে সংঘটিত হবে।
একটি আলামত: নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে দুনিয়াতে মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং অভাব ব্যাপক আকার ধারণ করবে। জামে’ তিরমিজিতে বর্ণিত আছে যে, দুনিয়াতে দরিদ্রতা ও অভাব-অনটনের হার বেড়ে যাবে। এই আলামতটি প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এর পূর্ণতা চলতেই থাকবে এবং দিন দিন এটি বাড়তেই থাকবে।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণিত এই আলামত পূর্ণতা পেয়েছে এবং দুনিয়ার গরিব থেকে গরিব রাষ্ট্র এবং ধনী থেকে ধনী রাষ্ট্র পর্যন্ত একথা বলে কান্না করছে যে, মুদ্রাস্ফীতি লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বেকারত্ব ব্যাপকতা লাভ করছে। শিক্ষিত হয়েও চাকরি পাচ্ছে না। এটি গরিব এবং মাধ্যমিক রাষ্ট্রগুলোরই সমস্যা নয়, বরং ধনী এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোরও সমস্যা।
দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ ও পঞ্চম আলামতগুলো একটি শিকলের মতো। যা একটি বিশেষ বিন্যাস ও সময়ের সাথে সাথে বাস্তবায়িত হবে।
দ্বিতীয় আলামত: নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটিকে একটি মালার আকৃতিতে কালানুক্রমে বর্ণনা করেছেন। দুই বা তিনটি হাদিস মিলিয়ে আমরা তার সারাংশ এই বের করেছি যে, হযরত মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশ হবে দশই মর্হরম বা নয় মহররম। কিন্তু যে কোন সালে হতে পারে। আর এই আলামতগুলোর ধারাবাহিকতা চার মাস পূর্বেই শুরু হবে। মর্হরম থেকে আরও পিছনে আসেন। মর্হরমের পূর্বে কোন মাস? জিলহজ্জ এবং জিলহজ্জের পূর্বে জিলকদ, জিলকদের পূর্বে হল শাওয়াল এবং শাওয়ালের পূর্বে হল রমাজান। রমাজানের পূর্বে শা’বান। অর্থাৎ যে মহররমে হযরত মাহদি রা. আত্মপ্রকাশ করবেন সে মহররমের পূর্বে জিলহজ্জ মাসে কিছু নিদর্শন দেখা যাবে এবং জিলহজ্জের পূর্বের মাস জিলকদ মাসে কিছু নিদর্শন দেখা যাবে এবং তার পূর্বে শাওয়াল মাসে কিছু এবং রমাজান মাসে কিছু এবং শা’বান মাসেও কিছু নিদর্শন দেখা যাবে। এই ধারাবাহিকতার সাথেই নিদর্শনগুলো প্রকাশিত হবে। কিন্তু এর মাঝে একটি নিদর্শন এই সময়ের ধারাবাহিকতা থেকে পৃথক। আর সেটি হল ফুরাত নদী শুকিয়ে যাওয়া। আরেকটি আলামত পিছনে বলেছি যে, অভাব-অনটন ব্যাপকতা লাভ করবে। দ্বিতীয়টি হল ফুরাত নদী শুকিয়ে যাওয়া।
ফুরাত নদী হল দুনিয়ার বড় বড় নদীগুলো থেকে একটি। প্রসিদ্ধ আছে যে, আল্লাহ তাআলা যখন থেকে দুনিয়াতে মানুষকে আবাদ করেছেন কিছু নদী তখন থেকেই প্রবাহিত হচ্ছে। হাদিস শরিফেও বর্ণিত আছে যে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,“আল্লাহ তাআলা চারটি নহর (নদী) সৃষ্টি করেছেন। দু’টি নহর জান্নাতে প্রবাহিত করেছেন এবং দু’টি নহর দুনিয়াতে প্রবাহিত করেছেন। জান্নাতে যে দু’টি নহর প্রবাহিত করেছেন তা হল الجيحون والسيحون (আল-জাইহুন এবং আস-সাইহুন)। আর দুনিয়াতে যে দু’টি নহর প্রবাহিত করেছেন তা হল النيل والفرات (নীলনদ এবং ফুরাত)। মেশকাত শরীফে এই হাদিসটি আছে।
ফুরাত অনেক পুরাতন একটি নদী এবং আমরা জানি এটি ইরাকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর মূল উৎস ও কেন্দ্র হল তুরস্কের আর্মেনিয়া পর্বতমালা। তুরস্কের আর্মেনিয়া পর্বতমালা থেকে যে বরফ গলে তা থেকেই এই নদী অস্তিত্বে আসে। তুরস্ক হল এর উৎস এবং আর্মেনিয়ার আরারাত পর্বতমালা থেকে এটি প্রবাহিত। এটি হল সেই পর্বতমালা যেখানে এসে নুহ আ. এর নৌকা থেমেছিল। জুদি পাহাড়ও আর্মেনিয়া ও তুরস্কের সীমান্তে অবস্থিত। এর সাথেই নুহ আ. এর কিশতি এসে লেগেছিল। এখান থেকেই ফুরাত নদী প্রবাহিত হয় এবং তুরস্ককে সেচ দিয়ে ইরাকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়েছে। এখানে বুঝার বিষয় হল তার অধিকাংশ সেচের অংশ থেকে ইরাকবাসী সেচের কাজ করে। কিন্তু তার উৎস হল তুরস্ক। ফুরাত নদী শুকিয়ে যাওয়ার এই আলামত বহু হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
ফুরাত নদী কিভাবে শুকিয়ে যেতে পারে, অথচ তা মানব ইতিহাসের সাথে সাথেই চলে আসছে? কিন্তু বর্তমান যুগে এর একটি সম্ভাব্য সুরত স্পষ্টভাবে নজরে আসছে।
পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার মাঝে যেমন পানি নিয়ে আলোচনা ও মিটিং চলছে, তেমনিভাবে পানির সমস্যা নিয়ে তুরস্ক ও ইরাকের মাঝেও উত্তপ্ত ও যুদ্ধাংদেহী কথাবার্তা চলছে। তুরস্কের কথা হল যেহেতু এই নদী তুরস্ক থেকে বের হয়েছে তাই আমরাই এই পানির বেশি হকদার। আমরা যদি সমস্ত পানি আটকিয়ে দেই তাহলে এটি আমাদের ইচ্ছা এবং যদি সব পানি ছেড়ে দেই তাহলেও এটি আমাদের ইচ্ছা। আর কখনও যদি আটকিয়ে দেই এবং কখনও ছেড়ে দেই তাহলেও আমাদের ইচ্ছা। যখন মন চাইবে পানি ছেড়ে দেব। তুরস্কের ভিতরে ফুরাত নদীর তীরে তুর্কি সরকার পৃথিবীর অনেক বড়, বরং সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মান করছে, যা পূর্ণতার শেষ পর্বে আছে। নতুন সংবাদ অনুযায়ী এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং যে কোন মূহুর্তে বাঁধকে পানি দিয়ে পূর্ণ করার জন্য ফুরাত নদীকে তাতে ঢেলে দেওয়া হবে। এটি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাঁধ। ৮১৬ বর্গকিলোমিটারের এই বাঁধ কামাল আতাতুর্কের নামে আছে। যদি তুর্কি সরকার ফুরাত নদীর পানি ঢেলে দেয় তাহলে কয়েক ঘণ্টার ভিতরে ইরাকের ফুরাত নদীর পানি শুকিয়ে যাবে। আর এটিই তুর্কি সরকারের ইচ্ছা। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস অনুযায়ী এটিও হতে পারে বা আরেকটি সুরতও হতে পারে যে, বরফ গলা বন্ধ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে যে কোন কিছু করতে পারেন। কিন্তু সম্ভাব্য এই সুরতগুলো হতে পারে। বিশেষ করে প্রথম যে সুরতটি বর্ণনা করা হল সেটির সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর বর্তমান পৃথিবীতে এটিই সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে।
এই আলামতটির পর মাহদি রা. এর প্রকাশের অন্যান্য যে সব আলামত আছে তা তার আত্মপ্রকাশের নিকটবর্তী সময়ে সংঘটিত হবে। মুহাররমে তার আত্মপ্রকাশ ঘটলে জিলহজ্জ, জিলকদ, শাওয়াল, রমাজান এবং শা’বান মাসে কিছু কিছু করে আলামত প্রকাশ পাবে। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: যে মুহাররাম মাসে মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশ ঘটবে তার পূর্বের শাবান মাসে মুসলমান ও কাফেরদের মাঝে একটি বড় ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হবে। একটি যুদ্ধকে হাদিসে الملحمة العظمى يا الملحمة الكبرى (মহাযুদ্ধ বা সবচেয়ে বড় যুদ্ধ) বলা হয়েছে। কিন্তু শা’বান মাসের এই যুদ্ধটি মহাযুদ্ধ নয়। বরং এটি অন্য একটি যুদ্ধ। যে যুদ্ধকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বলেছেন সেটিকে “মা’মাহা’র যুদ্ধ বলা হয়। কিন্তু শা’বান মাসের যে যুদ্ধটি তবরানি শরীফের হাদিস অনুযায়ী সেটি অন্য একটি যুদ্ধ। এটি হল সেই যুদ্ধ যাকে “হারমাজিদ্দুন” বা ইংরেজিতে অৎসধমবফফড়হ (আরমাগেডনের) যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধটি হযরত মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের কয়েক মাস পূর্বে সংঘটিত হবে। এটি মুসলিম ও কাফেরদের মাঝে সংঘটিত হবে। আর এর একটি সম্ভাব্য সুরতও রেডি হয়ে গেছে। শামের ভূমিই হচ্ছে যুদ্ধের ক্ষেত্র এবং সেটিকেই হারমাজিদ্দুন বলা হয়। “ওয়াও” ও “নুন” বৃদ্ধি করা হয়েছে ভাষার কারণে। “হার” বলা হয় পাহাড়কে। এটি সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা। মাজিদ্দু হল ফিলিস্তিনের একটি বসতি। উন্মুক্ত ময়দানের বসতির নাম। এটিকে মাজিদ্দু বলা হয়। তাহলে হারমাজিদ্দুন এর অর্থ হল ফিলিস্তিনের মাজিদ্দু বসতির পর্বতমালার কাছে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। এটি মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের একটি নিদর্শন। যখন শা’বান মাস বা তার কাছাকাছি তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হবে তখন বুঝতে হবে যে, হারমাজিদ্দুনের লড়াই হয়ে গেছে। এখন মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের সময় খুবই কাছাকাছি। তবরানি শরীফের হাদিসে বিষয়টি উল্লেখ আছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। আর এই যুদ্ধটি কিছু দিন যাবত অব্যাহত থাকবে।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে,শা’বানের পরে হল রমাজান। আর রমাজানে দুই/তিনটি আলামত প্রকাশ পাবে। যা এই বিষয়ের নিদর্শন যে, এটি মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী রমাজান। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: الأول من رمضان قد خسف القمر রমাজানের প্রথম তারিখে চন্দ্রগ্রহণ হবে। অবাক করার বিষয় হল এক তারিখের চাঁদ হয়ই বা কতটুকু! তারপর আবার সেটিতে গ্রহণ লাগবে। দ্বিতীয়ত জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে এক তারিখের চাঁদে কখনও গ্রহণই হতে পারে না। বরং সব সময় চাঁদের মাঝামাঝি তারিখে গ্রহণ হয়। জ্যোতির্বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ লোকেরা ইলমুত ফিতান এবং এই হাদিসের ব্যাপারে বলেন যে, আমাদের জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তি হল অভিজ্ঞতা। অথচ ইলমুল ফিতান এবং ইলমুল হাদিসের ভিত্তি হল ওহীর উপর। আর যেখানে ওহীর সম্পর্ক সেখানে আকলের ঘোড়া দৌড়ানো যায় না। এটি চূড়ান্ত কথা। সাধারণ অবস্থা ও ঘটনা এবং রুটিন থেকে পৃথক হয়ে চন্দ্র গ্রহণ হওয়াটাই আলামত। যদি মধ্যম তারিখগুলোতে চন্দ্রগ্রহণ হত তাহলে তো এটি সাধারণ চন্দ্রগ্রহণ হত। যাকে আপনি আলামত বলতে পারেন না। এক তারিখে চন্দ্রগ্রহণ হল অসম্ভব বিষয়ের সম্ভব হওয়া যা এই বিষয়ের আলামত যে, এখন দুনিয়াতে এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে যা অসম্ভব থেকে সম্ভব হবে এবং দুনিয়া ভিন্ন একটি দিকে মোড় নেবে। দুনিয়া এখন ভিন্ন একটি পরিবেশে প্রবেশ করছে। উক্ত ঘটনা এই বিষয়ের আলামত হবে। আর বিষয়টি এতটাই আকস্মিক ঘটবে যে, ফিতনার হাদিসের আলিম এবং উম্মতের আলিমগণ বলেন যে, জ্যোতির্বিদ্যায় দক্ষ লোকেরাও হয়রান ও পেরেশান হয়ে যাবে। কয়েক বছর আগেই চন্দ্রগ্রহণ ও সময় নির্দিষ্টকারী বিজ্ঞানীরাও পেরেশান হয়ে যাবে যে, হঠাৎ চাঁদের মাঝে এই পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হল। হঠাৎ এই পরিবর্তন এবং ঘটনার বিপরীত এই পরিবর্তন এবং চন্দ্রগ্রহণ এটাই আলামত যে, এই চন্দ্রগ্রহণ সাধারণ কোন গ্রহণ নয়। তাই আগত দিনগুলোও সাধারণ কোন দিন নয়। বরং পৃথিবীর নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে; যাতে পৃথিবীর ইতিহাস নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় একটি আলামত উল্লেখ করেছেন যে, পনেরো তারিখে সূর্য্যগ্রহণ হবে। আর সূর্য্যগ্রহণ চাঁদের মাঝ তারিখে হয় না। বরং চন্দ্রমাসের শেষের দিকে সূর্য্যগ্রহণ হয়ে থাকে। কিছু কিছু বর্ণনায় এটাও আছে যে, রমাজানুল মুবারকে দুইবার চন্দ্রগ্রহণ হবে। আর এধরনের গ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে, মানব ইতিহাসে কখনও হয়নি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেকটি আলামতও উল্লেখ করেছেন যে, যখন রমাজানের অর্ধেক চলে যাবে এবং অর্ধমাসের রাত হবে অর্থাৎ রমাজানের পনেরো তারিখের রাত হবে তখন আসমান থেকে একটি তীব্র আওয়াজ আসবে এবং তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে। এমনকি এই আওয়াজ মানুষের কান এবং অন্তর ফাটিয়ে দেবে। কিছু জায়গায় এই আওয়াজ প্রকট হবে এবং কিছু জায়গায় আস্তে হবে। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই আওয়াজের তীব্রতা ও প্রকটতায় ঐ রাতে সত্তর হাজার লোক মারা যাবে। পরের দিন সকালবেলা মানুষ ঘুম থেকে উঠে খবর পাবে যে, এই আওয়াজে সত্তর হাজার লোক মারা গেছে। মু’জামুল কাবিরের সপ্তম খ-ে এই হাদিসটি ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এরকম আওয়াজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা অতীতের অনেক জাতিকে মৃত্যু দিয়েছেন। কিয়ামতের সূচনাও এভাবেই হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন:
فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ
“কিন্তু প্রচ- আওয়াজ তাদেরকে পাকড়াও করল।”অর্থাৎ আমি তাদেরকে বিকট আওয়াজের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছি এবং অন্য কোন শাস্তি আনয়ন করিনি। না পাথর বর্ষণ করেছি, আর না ভূমিকম্প দিয়েছি, আর না অন্য কোন আজাব নিয়ে এসেছি। পাথরের বৃষ্টি হয়নি এবং জনবসতিগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হয়নি। বরং
فَأَخَذَتْهُمُ الصَّيْحَةُ
একটি আওয়াজ এসেছিল যা ধীরে ধীরে তাদের কান এবং অন্তর বন্দ করে দিয়েছিল। কিয়ামতের সূচনা হবে ইসরাফিল আ. এর সিঙ্গার ফুৎকারে। ঠিক এই আওয়াজ এবং চিৎকারের মাধ্যমেই তা হবে। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি এবং মেজায একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আওয়াজকে সহ্য করতে পারে। কারও কানের কাছে হৈচৈ বা বারবার হরণ বাজালে তার স্বভাব এটি সহ্য করতে পারবে না। তার অন্তর ও মস্তিষ্ক প্রভাবিত হবে। আর এভাবে যদি আওয়াজ বাড়তে থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে বাজতে থাকে তাহলে তা অন্তর ও মস্তিষ্ক কেটে ফেলবে এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেবে যা অন্তর ফেটে যাওয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হবে। দিলের উপর এই আওয়াজের এতটা প্রেসার আসবে এবং মস্তিষ্কে এতটা প্রেসার আসবে যে, তার চাপের কারণে, প্রেসারের কারণে মৃত্যু চলে আসবে। এটি ইমাম মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের অনেক বড় একটি আলামত।
রমাজানের পর শাওয়াল মাস। শাওয়াল মাসে কী হয়? আমরা সবাই জানি যে, হজ্জ্বের প্রস্তুতি চলে এবং রমাজানের পর পরই হজ্জ্বের কাফেলাগুলো রওয়ানা শুরু করে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, মাঝামাঝি যে সময়টা, অর্থাৎ রমাজান ও জিলকদ মাসের মাঝের যে সময়টা তাতে আরবের শাসকের মৃত্যু ঘটবে। তার মৃত্যুর পর তার তিন সন্তানের মাঝে বাদশাহি নিয়ে লড়াই হবে। কে আমির হবে? কে বাদশাহ হবে? এ নিয়ে ঝগড়া হবে এবং তার তিন পুত্র পরস্পর লড়াই শুরু করবে। প্রত্যেকেই নিজেকে শাসক দাবি করবে। এমনকি জিলহজ্জ্ব মাসের হজ্জ্ব কোন বাদশাহ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হবে। তাদের লড়াই এত দীর্ঘ ও বেশি হবে যে, তাদের সিদ্ধান্ত তখনও পর্যন্ত হবে না। হজ্জ্ব চলে আসবে এবং হজ্জ্বের মৌসুমও চলে যাবে, আর এই হ্জ্জ্ব কোন বাদশাহ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হবে। এখানে আরবের কোন শাসক থাকবে না। এই তিন শাহযাদা যখন লড়াই করবে তখন তো নিশ্চিতভাবেই নিরাপত্তা হারিয়ে যাবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, হজ্জ্বের পথ নিরাপদ থাকবে না এবং নিরাপত্তাহীনতা ও যুদ্ধের ফলে খুব কম লোকই হজ্জ্বের জন্য গমন করবে। আর যেহেতু সেখানে কানুন শেষ হয়ে যাবে এবং গভর্মেন্ট অথরিটি শেষ হয়ে যাবে এবং গৃহ ও গোত্র যুদ্ধ চলবে তাই যারা হজ্জ্বের জন্য শাওয়াল মাসে গমন করবে তাদের কাফেলা লুট করা হবে।
শাওয়ালের পর হল জিলকদ মাস। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, জিলকদ মাসে এখানে অবস্থান করা হাজিদের যে কাফেলাগুলো থাকবে তারা পরস্পর লড়াই শুরু করবে। কেউ পাকিস্তান থেকে এসেছে তো কেউ অন্য কোথাও থেকে এসেছে। এক গ্রুপ বলবে, অমুকের বাদশাহ হওয়া উচিত এবং আরেকজন বলবে, না অমুকের হওয়া উচিত। সুতরাং তারা দলবদ্ধ হয়ে এক একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে ঝগড়া করবে। হুজুরে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, আমি নবুওয়াতের নুরের মাধ্যমে সে যমানা দেখতে পাচ্ছি, আমি মদিনার ভূমিতে নিজ উম্মতের রক্ত ঝরতে দেখছি যারা নিজেদের মাঝে লড়াই করবে।
জিলকদের পর যখন জিলহজ্জ্ব মাস আসবে তখন খুব কম সংখ্যক মানুষই হজ্জ্বে অংশ গ্রহণ করবে। তারা হজ্জ্ব আদায় করবে। কিন্তু সেখানে কোন বাদশাহ, কোন আমির এবং কোন শাসক থাকবে না। খুব গোলাটে পরিস্থিতি হবে এবং নিরাপত্তা থাকবে না। মানুষ যত জনই থাকবেন তারা হজ্জ্ব আদায় করবেন। গণহত্যা হবে এবং খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। বলার মতো নয় এমন একটি পরিস্থিতিতে কোন রকমে নিরাপত্তাহীন হজ্জ্ব আদায় করা হবে। হত্যা, ডাকাতি, রক্তপাত, লুটতরাজ এবং বিশৃঙ্খলা অবস্থায় হজ্জ্ব হবে এবং উম্মতের বহুত রক্ত এই হজ্জ্বের মৌসুমে প্রবাহিত হবে। খুবই করুণ অবস্থায় হজ্জ্ব পালিত হবে।
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জিলহজ্জ্বের পর মুহাররাম মাস আমার উম্মতের জন্য রহমত হয়ে আগমন করবে। যখন মুহাররাম মাসের আগমন ঘটবে তখন উম্মতের নেতৃস্থানীয় লোকেরা যারা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এই সব অবস্থা ও ঘটনাগুলো জানবেন তারা অপেক্ষা করতে থাকবেন যে, সমস্ত নিশান ও আলামত পূর্ণতা লাভ করেছে। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী এই মুহাররাম মাসেই মাহদি আ. এর আগমন হওয়ার কথা, যিনি উম্মতের এই খারাপ পরিস্থিতিকে ঠিক করবেন।
নয় বা দশে মুহাররাম মাহদি রা. আত্মপ্রকাশ করবেন। আবু দাউদ শরিফের হাদিসে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহদি রা. এর আত্মপ্রকাশের পুরো অবস্থা ও নকশা বর্ণনা করে দিয়েছেন। এই বর্ণনা এতটা বিস্তারিত যে, এরচেয়ে বেশি ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, লোকেরা পেরেশান হয়ে যাবে। মুসতাদরাকে হাকিমের হাদিস যে, আমার উম্মতের সাতজন উচ্চ পর্যায়ের লোক মাহদি রা. কে তালাশ করতে থাকবেন। এদের সম্পর্ক থাকবে উলামা এবং আবদালের জামাতের সাথে। আবদালও বেলায়াতের মর্যাদার একটি স্তর। আবদালকে আল্লাহ তাআলা বেলায়াতের সর্বশেষ অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন। হযরত আলি রা. থেকে বর্ণিত যে, দুনিয়াতে সত্তরজন আবদাল থাকেন; তাদের থেকে চল্লিশজন থাকেন শামের ভূমিতে এবং ত্রিশজন দুনিয়ার বাকি এলাকাতে থাকেন। যখন তাদের থেকে কারও একজনের মৃত্যু হয় তখন আল্লাহ তাআলা তার পরিবর্তে তার স্থানে আরেকজনকে নিয়ে আসেন। যেহেতু এই জায়গাটা সব সময় পূর্ণ থাকে এবং কারও মৃত্যু হয়ে গেলে তার পরিবর্তে আরেকজনকে সাথে সাথেই নিয়ে আসা হয় তাই তাকে আবদাল বলা হয়। আবদাল অর্থাৎ যার বদল বা বিকল্প আল্লাহ তাআলা সব সময় প্রস্তুত করে রাখেন। আল্লাহ তাআলা তাদের দুআ কবুল করেন এবং তাদের বরকতের ফলে বৃষ্টি বর্ষিত হয় এবং তাদের বরকতেই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে দুশমনদের উপর বিজয় দান করেন।
সুতরাং আলেম ও ওলিদের এই সাতজনের জামাত, নেককারদের জামাত হযরত মাহদি রা. এর অনুসন্ধান করবেন। এর ধরণ আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন, খুবই হৃদয়গ্রাহী আলোচনা। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, উম্মতের অবস্থা, আরবদের অবস্থা এবং মুসলিমদের গণহত্যা দেখে লোকজন খুবই পেরেশান হয়ে যাবে। ইতিপূর্বে উম্মত কী কী পর্যায় অতিক্রম করেছে, কেই তাদেরকে শামাল দেওয়ার মতো নেই। উম্মতের ঐক্যপূর্ণ কোন নেতা নেই এবং উম্মতকে ঐক্য ও একতাপূর্ণ লড়াইয়ে এমন কেউ নেই যার ঝা-া তলে সবাই একত্রিত হবে এবং উম্মতে মুসলিমাহ এক জায়গায় এসে যাবে এবং নিজেদের মহত্ত্ব পুনরুদ্ধার করবে।
উম্মত এই করুণ পরিস্থিতির শিকার হবে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই সাতজন লোক এসব আলামতের কারণে এবং হাদিসে বর্ণিত এই বৈশিষ্ট্যাবলীকে সামনে রেখে হযতর মাহদি রা. এর তালাশ করতে থাকবেন। এদিকে হযতর মাহদি বিন আব্দুল্লাহ রা. যিনি মদিনার অধিবাসী তিনি হজ্জ্বের জন্য বাইতুল্লাহ’তে আসবেন। তিনি বাইতুল্লাহ’র তওয়াফ করতে থাকবেন। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই সাতজন লোকের সাথে মাহদি রা. এর প্রথম সাক্ষাত হবে মক্কায়। তারা হযরত মাহদি রা. এর কাছে গিয়ে বলবেন যে, আমাদের ইলম অনুযায়ী আপনিই মাহদি। আপনি ঘোষণা দিন, আমরা সবাই আপনার সহযোগী। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই সাত জনের প্রত্যেকেই নিজস্ব একটি অবস্থান রয়েছে। অর্থাৎ তারা ইলম ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতার অধিকারী এবং নিজেদের এলাকায় প্রভাব ও প্রতিপত্তির অধিকারী। তারা নিজ এলাকায় অনেক বড় ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হযরত মাহদি রা. তাদেরকে বলবেন যে, আমি তো উম্মতের একজন লোক এবং আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বীনের একজন সাহায্যকারী। আমি তো মাহদি নই। ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মাহদিয়াতের কোন ইলহাম করা হবে না। মাহদির অনুসন্ধানকারী এই লোকগুলো মক্কায় অবস্থান করতে থাকবেন। কারণ, হজ্জ্বকারীরা মক্কায় অবস্থান করেন। আর হযরত মাহদি রা. হজ্জ্বের কাজ শেষ করে মদিনায় চলে যাবেন। কারণ, তিনি তো মদিনার বাসিন্দা।
এটি হয়ত আপনারা জানেন যে, হজ্জ্ব আদায়কারীরা হজ্জ্ব শেষ করে কোথায় যায়? মদিনা মুনাওয়ারায়! এরপর এই আলেম ও ওলিদের জামাত মদিনায় চলে যাবেন এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, দ্বিতীয় সাক্ষাত হবে মদিনায় মসজিদে নববীতে। এরপর তারা বলবেন যে, সব আলামত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটিই সেই যুগ এবং বাহ্যিক গুণাবলীও এই। আমাদের ইলম আমাদেরকে বলছে যে, আপনিই মাহদি। আপনি কেন ঘোষণা করছেন না? কিন্তু তিনি এর থেকে মুক্ত ঘোষণা করবেন যে, আমার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সংবাদ আসেনি। আমি রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একজন উম্মত এবং একজন সহযোগী ও সাহায্যকারী। হাজি¦রা কিছু দিন তথা আট দিন, দশদিন, বারো দিন বা পনেরো দিন মদিনায় অবস্থান করে সাধারণত মক্কায় ফিরে আসে। ওলি ও আলেমদের এই জামাতটিও মক্কায় ফিরে আসবে। এটি হল হজ্জ্বের পরবর্তী সময়। দশই জিলহজ্জ্ব থেকে শুরু করে মুহাররামের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আনুমানিক পঁচিশ থেকে এক মাসের পার্থক্য হবে। এই দিনগুলো এভাবেই চলে যাবে। কারণ, রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, মুহাররামের দশম দিন বা দশম রাত হবে। সুতরাং এই একটি মাস মাহদি রা. এর সাথে সাক্ষাত ও তার কাছে আসা-যাওয়ার মাধ্যমে পূর্ণ হয়ে যাবে।
ওলি ও আলেমদের এই সাত জনের জামাত মদিনায় থেকে কোথায় ফিরে যাবে? মক্কা মুকাররামায়! রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, যেদিন তারা মক্কা মুকাররাময় পৌঁছবে সে রাতটি হবে ফয়সালার রাত। ইবনে মাজাহ’র বর্ণনা যে, এই সিদ্ধান্তের রাতে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-মাহদিকে মাহদিয়াতের মর্যাদা দান করবেন এবং যোগ্যতা ও গুণাবলী তার মাঝে ঢেলে দেবেন। এখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার জন্য হুকুম হবে যে, তিনি যেন মক্কায় যান এবং মাহদিয়াতের ঘোষণা দেন। আলেম ওলিদের জামাত আগে থেকেই মক্কায় পৌঁছে গেছেন।
এখন তৃতীয় সাক্ষাতটি মক্কা মুকাররামায় হচ্ছে। হাদিসের ভাষ্যমতে আলেম ওলিদের এই জামাত অত্যন্ত কঠোরতার সাথে তার কাছে গিয়ে তাকে ঝাঁকাবেন। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, হযরত মাহদি রা. বাইতুল্লাহকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে কেঁদে দুআ করতে থাকবেন যে, হে আল্লাহ! আপনিই আমাকে মাহদিয়াতের মাকাম দান করেছেন। আমার মাধ্যমে উম্মতকে এক ও ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলাম বিজয়ের কাজ নিয়ে নিন। আপনিই উম্মতের অবস্থাগুলো পর্যবেক্ষণকারী। আলেম ওলিদের জামাতকে তিনি বলবেন যে, দেখো! তোমাদের সাথে এটি আমার তৃতীয় সাক্ষাত এবং যদি আজ তোমরা আমার কথা না মানো তাহলে উম্মতের মাঝে যত ফাসাদ ও রক্তপাত হচ্ছে তার জিম্মাদার তোমরাই হবে। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাদেরকে ধরে তাদের কাঁধে হাত রেখে তাদেরকে ঝাঁকি দেবেন। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে,হযরত মাহদি তাদেরকে বলবেন যে,আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হয়ে গেছে এবং আমাকে সংভাদ দেওয়া হয়েছে যে, আমাকে মাহদিয়াতের অবস্থানে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। তোমরা আমার সহযোগী ও সাহায্যকারী হয়ে যাও। আর তোমরা তো ইতিপূর্বে আমার সাথে সাক্ষাত করেছ। তাই আমার হাতে বাইআত করো যে, তোমরা আমার সঙ্গ ত্যাগ করবে না। তোমাদের বাইআতের পরই আমি মাহদিয়াতের ঘোষণা দেব। রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই বাইআতটি সাধারণ বাইআতের আগে বিশেষ বাইআত হবে। যা শুধু খেলাফতের বাইআত বা জিহাদের বাইআত। বরং এটি হল মৃত্যুর উপর বাইআত যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেহে প্রাণ আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই দেহে শ^াস আছে আমরা আপনার সঙ্গ ত্যাগ করবো না এবং জিহাদে আমরা আপনার সঙ্গ দেব। এটি সেই বাইআত যা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইআতে রেদওয়ানের সময় গ্রহণ করেছিলেন। এটি মৃত্যুর বাইআত, জিহাদের বাইআত এবং খেলাফতের বাইআত।
রাসুলে আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, এই বাইআত এশার নিকটবর্তী সময় অনুষ্ঠিত হবে। আবু দাউদ শরিফের হাদিস যে, হযরত মাহদি চলতে চলতে আগমন করবেন এবং অল্প কিছু লোক থাকবে। হজ্জ্বের মৌসুম সমাপ্তির দিকে। এছাড়া এমনিতেও এই হজ্জ্বে বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে খুব কম লোকই আগমন করেছেন। আরবে যুদ্ধ চলছিল। হযরত মাহদি রা. তখন আর-রুকন এবং আল-মাকামের মাঝখানে থাকবেন। “আর-রুকন” যখন বলা হয়েছে তখন এর দ্বারা উদ্দেশ্য রুকনে ইয়েমেনি নয়। বরং “আর-রুকন” দ্বারা উদ্দেশ্য হল হজরে আসওয়াদ। কিন্তু যখন শুধু “রুকন” বা “রুকনে ইয়ামানি” বলা হবে তখন রুকনে ইয়েমেনি উদ্দেশ্য হবে। কিন্তু “আর-রুকন” দ্বারা হজরে আসওয়াদ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। হজরে আসওয়াদ এবং মাকামে ইবরাহিমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে হযরত মাহদি রা. নিজের মাহদি হওয়ার ঘোষণা দেবেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রহমতের উপর কুরবান হয়ে যাও! তিনি সময়, অবস্থা এবং আলামত এবং কোন জায়গা এবং নির্দিষ্ট করে সে জায়গার নাম বলে দিয়েছেন যে, ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দেবেন। বরং না শুধু আলামত, ঘটনাবলী, ইতিহাস এবং তার সাক্ষাত ও তার অবস্থা, তার মর্যাদা এবং শুধু বাইআতের কথাই বলেছেন। বরং হযরত মাহদি রা. এর প্রথম খুতবাটি কেমন হবে তা পুরোপুরি হাদিসের কিতাবগুলো বিদ্যমান আছে।
হযরত মাহদি রা. যে খুতবা দিবেন তা আধা পৃষ্ঠার খুতবা; হাদিসের কিতাবে তা উল্লেখ আছে। যার সারকথা ও অর্থ এই যে, মাহদি রা. নিজের নাম বলবেন যে, আমি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-মাহদি। আল্লাহ তাআলা আমাকে মাহদিয়াতের মর্যাদা দান করেছেন এবং আমি তোমাদের সাথে একথার প্রতিশ্রুতি দিতে এসেছি যে, আমরা কুরআন এবং সুন্নাহ’র উপর আমল করব। কুরআন ও সুন্নাহ যে জিনিসগুলো বাকি রেখেছে আমরা ও সেগুলোকে বাকি রাখব এবং যে জিনিসগুলো মিটিয়ে দিয়েছে আমরাও সেগুলো মিটিয়ে দেব। প্রত্যেক বিদআতের সমাপ্তি ঘটাবো এবং কুফুরি ব্যবস্থাকে শেষ করবো। আর এই সুরত বাস্তবায়িত হবে জিহাদের মাধ্যমে। কে আছে যে আমার হাতে জিহাদের বাইআত করবে?
নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, সর্বপ্রথম যারা যারা তার হাতে বাইআত গ্রহণ করবেন তাদের সংখ্যা বদরের সাহাবিদের সংখ্যার সমান হবে। তিনশত তেরোজন সদস্য হবে। প্রশ্ন হচ্ছে হজ্জ্বের মৌসুমে আল্লাহর ঘর হারামে সব সময় বিশাল সংখ্যক মুসলমান উপস্থিত থাকে। তাহলে তিনশত তেরোজনের সংখ্যাটা খুবই কম হয় না? উত্তর হচ্ছে যেহেতু তখন সেখানে ফেতনা ও যুদ্ধ চলছে। নিরাপত্তা থাকছে না। অংশগ্রহণ কারীদের সংখ্যা যেহেতু শুরু থেকেই কম এবং অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত লোকের সংখ্যা আরও কম। তাই অন্যরা ভাববে যে, মাহদি দাবীদার তো এর আগেও অনেকে এসেছে। যাদের অবস্থা ও ঘটনাবলীর জ্ঞান নেই তারা দ্বিধা-দ্বন্ধে পড়ে যাবে। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, হযরত মাহদি রা. মাহদিয়াতের ঘোষণা দেওয়ার পর বলবেন যে, আমার হাতে জিহাদের বাইআত করো!
দেখুন! আল্লাহ তাআলা তাকে সমস্ত যোগ্যতা দান করে দেবেন। তিনি এসে নিজের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় বসবেন না। তিনি এসে নিজের পদ্ধতির ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা তৈরি করবেন না। বরং এসেই তিনি যে পরিবর্তন এবং ইসলাম বিজয়ের পথ গ্রহন করবেন তা হচ্ছে তিনি বলছেন যে, তোমরা আমার হাতে জিহাদের বাইআত দাও। জিহাদের মাধ্যমেই ইসলাম টিকে থাকবে এবং জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বদা ইসলাম জিহাদের মাধ্যমেই বিজয়ী হয়েছে। সর্বদা জিহাদের মাধ্যমেই ইসলাম বিজয়ী থেকেছে। ইসলাম বাকি থাকবে জিহাদের মাধ্যমেই। অন্য কোন সুরত নেই। এটিই হচ্ছে নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পথ এবং এটিই হচ্ছে অন্যান্য নবিদের পথ। আর এটিই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আগত আল-মাহদির জন্য নির্দেশ এবং এই পথই হবে হযরত ইসা আ. এর পথ যিনি দাজ্জালকে হত্যা করার জন্য আগমন করবেন। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আবু দাউদ শরীফের দীর্ঘ হাদিসটি এই পর্যন্তই শেষ।
মাহদি রা. আসলে তার যুদ্ধের বিন্যাস কী হবে? তার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা নেই। বিন্যাসের নামে সময় নষ্টের কোন সুযোগ নেই। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, মাহদি রা. এসেই এই বাইআতের পর জিহাদের ঘোষণা দিয়ে দেবেন এবং পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দেবেন যে, পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র এবং সমস্ত শাসকরা শেষ হয়ে যাবে। আমি তাদের সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যে, এই জমিন আল্লাহর এবং আল্লাহর হুকুমই এখানে বাস্তবায়িত হবে। নিজেদের ক্ষমতা শেষ, নিজেদের সরকার ও গভরমেন্ট শেষ। এখানে আল্লাহর বিধানই বাস্তবায়িত হবে। যারা আল্লাহর দেওয়া জমিনকে আল্লাহর দ্বীনের সংরক্ষণকারীদের হাতে সোপর্দ করবে তারা তো ঠিক থাকবে। আর যারা সোপর্দ করবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চলবে।
সহিহ মুসলিম শরিফে রাসুলে আকরাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যুদ্ধগুলোর কথা বলেছেন তা চারটি বড় যুদ্ধ। হযরত মাহদি রা. এর প্রথম যুদ্ধটি আরব উপদ্বীপের নামধারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে হবে। বাদশাহী পাওয়ার জন্য যে তিন ভাই পরস্পরে লড়াই করছিল তারা চতুর্থ একজনকে কিভাবে বাদশাহ হিসেবে কবুল করবে? বিচক্ষণ লোকেরা জানেন যে, বর্তমান আরবের রয়েল ফ্যামিলিতে কতটা ঝগড়া ও মতানৈক্য কাজ করছে। আর আরবের কত পরিবার ও ব্যক্তিকে নির্বাসন করা হচ্ছে যে, তারা নিজেদের বাদশাহির জন্য রাস্তা তৈরি করছে; এটি তো সম্ভাব্য একটি সুরত।
চলবে ইনশাআল্লাহ....
সূত্র:নওয়ায়ে গাযওয়ায়ে হিন্দ-এপ্রিল সংখ্যা-২০২০ইং১ম পর্বের লিংক:
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B0
২য় পর্বের লিংক:
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A...A6%BE%E0%A6%B0
৩য় পর্বের লিংক:
Comment