আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৫ম পর্ব
“ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
একবিংশ শতাব্দীর গণতন্ত্র’’
(সূরা আসরের আলোকে)
।।মাওলানা আসেম উমর হাফিজাহুল্লাহ ||
এর থেকে– ৫ম পর্ব
মুফাসসিরগণের ভাষায় উপাসনার অর্থ
মুফাসসিরগণ উপাসনার নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
ইমাম আবূ বকর জাসসাস রহ.
ফিকহে হানাফীর সিংহপুরুষ ইমাম আবূ বকর জাসসাস রহ. (৩০৫-৩৭০ হি./ ৯১৭-৯৮০ খৃ.) বলেন-
ثم قلدوا أحبارهم هَؤُلَاءِ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ فِي التَّحْلِيلِ وَالتَّحْرِيمِ وَقَبِلُوهُ مِنْهُمْ وَتَرَكُوا أَمْرَ اللَّهِ تَعَالَى فِيمَا حَرَّمَ وَحَلَّلَ صَارُوا مُتَّخِذِينَ لَهُمْ أَرْبَابًا إذْ نَزَّلُوهُمْ فِي قَبُولِ ذَلِكَ مِنْهُمْ مَنْزِلَةَ الْأَرْبَابِ
“অতঃপর তারা (খৃষ্টানরা) হালাল-হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজেদের পাদ্রী-যাজকদের অনুসরণ করতে লাগল। তাদের কাছ থেকে তারা তা গ্রহণ করল। ভুলে গেল আল্লাহর হুকুম, আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল কিংবা হারাম করেছিলেন। তেমনিভাবে খৃষ্টানরা সেসব পাদ্রীকে রব বানিয়ে নিল। কারণ, তারা পাদ্রীদেরকে হুকুম (আইন) গ্রহণ করার ক্ষেত্রে রবের আসনে সমাসীন করেছে।”
ইমাম আবূ সাউদ রহ.
ইমাম আবূ সাউদ রহ. (৮৯৮-৯৮২ হি.) বলেন-
بأن أطاعوهم في تحريم ما أحل الله تعالى وتحليل ما حرمه¬ أربابا من دون الله
“তারা নিজেদের উলামা ও পাদ্রীদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিল। এভাবে যে, আল্লাহ যা হালাল ও বৈধ ঘোষণা করেছেন, তা হারাম ও অবৈধ বানানো এবং আল্লাহ যা হারাম ও অবৈধ বলেছেন, তা হালাল ও বৈধ বানানোর ক্ষেত্রে তারা (ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা) বড়দের কথা মান্য করত।”
একটু সামনে গিয়ে তিনি আরও বলেন-
إلا ليعبدوا إلها واحدا عظيم الشأن هو الله سبحانه وتعالى ويطيعوا أمره ولا يطيعوا أمر غيره بخلافه فإن ذلك مخل بعبادته تعالى
“তাদেরকে হুকুম দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর হুকুম ও আইনের অনুসরণ করে। এর বিপরীতে অন্য কারো হুকুম ও আইনের অনুসরণ না করে। কারণ, এমনটি করা আল্লাহর ইবাদতের পরিপন্থী।”
আল্লামা আলূসী রহ.
আল্লামা আলূসী রহ. (১২১৭-১২৭০ হি./১৮০২-১৮৫৪ খৃ.) এটিকে ইবাদতেরই বিপরীত বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
ويطيعوا أمر غيره بخلافه فإن ذلك مناف لعبادته جل شأنه
“আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা আল্লাহর হুকুমই মানবে। তিনি ছাড়া অন্য কারো হুকুম মানবে না। কারণ, এমনটি করা আল্লাহর উপাসনার বিপরীত।”
ইমাম রাযী রহ.
ইমাম রাযী রহ. (৫৪৪-৬০৬ হি./১০৫০-১২১০ খৃ.) রব বানানোর অর্থটি আরও পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। যার উদ্দেশ্য মানুষ ভালোভাবে বুঝতে পারবে। তিনি বলেন-
المسألة الثانية: الأكثرون من المفسرين قالوا: ليس المراد من الأرباب أنهم اعتقدوا فيهم أنهم آلهة العالم، بل المراد أنهم أطاعوهم في أوامرهم ونواهيهم
“অধিকাংশ মুফাসসিরের মতামত হলো, রব বানানো থেকে এ কথা উদ্দেশ্য নয় যে, তারা নিজেদের পাদ্রীদের ব্যাপারে এ বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছে যে, তারাই জগতের উপাস্য। বরং এর উদ্দেশ্য হলো, তারা হুকুম ও আইন-কানুনে সেসব পাদ্রীর অনুসরণ করত।”
সুতরাং আল্লাহর বিপরীতে আইন-কানুন ও হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে কারো অনুসরণ করা মানে তার উপাসনা করা এবং তাকে উপাস্যের স্তরে নিয়ে যাওয়া।
ইমাম আবূল লাইস সমরকন্দী রহ.
ইমাম আবূল লাইস সমরকন্দী রহ. (মৃত্যু: ৩৭৫ হি./ ৯৮৫ খৃ.) বলেন-
أربابا من دون الله، يعني: اتخذوهم كالأرباب يطيعونهم في معاصي الله
অর্থাৎ সেসব ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা তাদের বড়দেরকে রবের মতো বানিয়ে ফেলেছে। তারা আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তাদের কথাই মান্য করত।
সুতরাং আল্লাহর অবাধ্যতায় যারা নিজেদের শাসনকর্তা ও নেতাদের হুকুম মান্য করে, তারা মূলত তাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছে।
ইমাম বাগাভী রহ.
একই কথা ইমাম বাগাভী রহ. (মৃত্যু: ৫১৬ হি./১২২২ খৃ.) বলেন-
قلنا: معناه أنهم أطاعوهم في معصية الله واستحلوا ما أحلوا وحرموا ما حرموا، فاتخذوهم كالأرباب
“আমরা বলি, এর অর্থ হলো, তারা (খৃষ্টানরা) আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে নিজেদের পাদ্রীদের কথা মান্য করেছে। পাদ্রীরা যা হালাল বলেছে, তা হালাল হিসেবে মেনে নিয়েছে আর যা হারাম বলেছে, তা হারাম হিসেবে মেনে নিয়েছে। সুতরাং তারা পাদ্রীদের সাথে রবের ন্যায় আচরণ করেছে।”
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.
হযরত থানভী রহ. (মৃত্যু: ৪ জুলাই ১৯৪৩ খৃ.) তাফসীরে বয়ানুল কুরআনে বলেন-
يعنى ان كى اطاعت تحليل اور تحريم ميں مثل طاعت خدا كے كرتے ہيں كہ نص پر ان كے قول كو ترجيح ديتے ہيں اور ايسى اطاعت بالكل عبادت ہے پس اس حساب سے وه ان كى عبادت كرتے ہیں
অর্থাৎ হালাল-হারাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্যের মতো তাদের অনুসরণ করতে থাকে। নছ (আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ) এর উপর তাদের কথাকে প্রাধান্য দেয়। আর এমন অনুসরণ নিরেট উপাসনা। সুতরাং সেই অর্থে তারা তাদের উপাসনা করে।
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. (মৃত্যু: ১০ শাওয়াল ১৩৯৬ হি./৬ অক্টোবর ১৯৭৬ খৃ.) তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআনে বলেন-
)آگے افعال كفريہ كا بيان ہے كہ) انهوں نے (يعنى يہود و نصارى نے) خدا (كى توحيد فى الطاعۃ) كو چہوڑ كر اپنے علماء اور مشائخ كو (باعتبار اطاعت كے) رب بنا ركها ہے (كہ ان كى اطاعت تحليل اور تحريم ميں مثل اطاعت خدا كے كرتے ہيں كہ نص پر ان كے قول كو ترجيح ديتےہيں اور ايسى اطاعت بالكل عبادت ہيں(
(প্রথমে কুফরী কাজের বর্ণনা) তারা (ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা) অনুসরণের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর অনুসরণ ছেড়ে নিজেদের উলামা-মাশায়েখকে (আনুগত্যের ক্ষেত্রে) রব বানিয়ে নিয়েছে। (তারা যা হালাল-হারাম ঘোষণা করে তা তারা আল্লাহর আনুগত্যের ন্যায় মেনে নেয়। আর তাদের কথাকে আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশের উপর প্রাধান্য দেয়। এমন আনুগত্য নিরেট উপাসনা।)
মুফতী শফী রহ. এ বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে ‘উপাসনা’ বলেছেন।
মাওলানা আশেকে এলাহী বুলন্দশহরী রহ.
মাওলানা আশেকে এলাহী বুলন্দশহরী রহ. (১৩৪৩ হি./১৯৯৯ খৃ.) তাফসীরে আনওয়ারুল বয়ানে লিখেন-
"جب تحليل و تحريم كا اختيار صرف اللہ ہی کو ہے جو خالق اور مالک ہے تو اس کے سوا جو کوئ شخص تحليل و تحريم کے قانون بناۓاور اپنے پاس سے حلال و حرام قرار دے، اس کی بات ماننا اور فرمانبرداری کرنا اللہ تعالی کے اختيارت ميں شريک بنانا ہوا ۔ جيسے اللہ تعالی کي فرمانبرداری کرنا اس کی عبادت ہے، اسی طرح ان امور میں غیر اللہ کی فرمانبرداری کرنا جو اللہ کی شريعت کے خلاف ہيں يہ ان کی عبادت ہے.... چاہے انہیں سجدہ نہ کريں، چونکہ ان جاری کیے ہوۓ احکام کے ساتھ اکیسویں صدی میں 'جمہوری نظام' تباہی کے دہا نے پر ! ............. إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا فرمانبرداری کا وہی معاملہ ہے اللہ کے احکام کے ساتھ ہونا چاہيے اس ليے ان کی اتباع اور اطاعت کو عبادت قرار دیا "۔
“যেহেতু হালাল-হারাম প্রণয়নের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতেই। যিনি সৃষ্টিকর্তা ও অধিকর্তা। সুতরাং তিনি ব্যতীত যে ব্যক্তিই হালাল-হারাম প্রণয়ন করবে, নিজের পক্ষ থেকে হালাল-হারাম ঘোষণা করবে, তার কথা মান্য করা ও তার আনুগত্য করা মানে আল্লাহর ইচ্ছায় অংশীদার সাব্যস্ত করা। যেমনি আল্লাহর আনুগত্য করা তাঁর উপাসনা। তেমনি সেসব শরীয়াহবিরোধী কাজে গাইরুল্লাহ’র আনুগত্য করাও তাদের উপাসনা; এমনকি তাদেরকে সিজদা না করলেও। যেহেতু তাদের প্রণীত আইন-কানুনের আনুগত্য করার ব্যাপারটি আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করার ন্যায়, তাই তাদের আনুগত্যকে উপাসনা বলা হয়েছে।”
ফায়েদা:বর্তমান যুগের মুক্তচিন্তার মানুষেরা যেহেতু ইসলামী অনুশাসন মেনে চলতে কষ্ট অনুভব করে এবং ইসলামের শত্রুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বলে, উলামায়ে কেরাম সম্মেলন করুক, ইসলামী আইন-কানুনের ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করুক, অমুক অমুক হুকুমটি পাল্টে দিক বা সহজ করে দিক, অমুক অমুক হারাম বিষয়গুলোকে হালাল করে দিক। এসব তাদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার ফল। উলামায়ে কেরাম যদি এমন সম্মেলন করে তারা সরাসরি কাফের হয়ে যাবে।
মুফাসসিরগণের তাফসীরের আলোকে এ আয়াত থেকে জানতে পারলাম:
০১. আল্লাহর সাথে কোনো প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান বা সরকারকে হালাল-হারাম তথা বৈধতা-অবৈধতাপ্রদান করার ক্ষমতা দেওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহকে ছেড়ে সেই প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান বা সরকারকে উপাস্য বানিয়ে নেওয়া।
০২. যে ব্যক্তি আল্লাহর হারামকৃত কোনো কাজকে বৈধ (হালাল) ঘোষণা করে, যেমন সুদ ও সুদের কেন্দ্র ব্যাংকগুলোকে বৈধতা দেয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফিরদেরকে সাহায্য করে, কুরআনী আইনবিরোধী সিদ্ধান্তদাতা আদালতগুলোকে আইনী রূপ দেয়, এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন নিজেকেই উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে।
০৩. তারপর যে কেউ সেই অবস্থানকে মেনে নেয়, বা তার আনুগত্য করতে থাকে, তো সে ব্যক্তি যেন তার উপাসক।
০৪. হারাম ও আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো আনুগত্য করা, যেমন নিজেদের অফিসারদের নির্দেশে সুদি প্রতিষ্ঠানসমূহ ও গান-বাজনার অনুষ্ঠানে ডিউটি করা, শরীয়াহ বাস্তবায়ন (কথিত সন্ত্রাসবাদ) এর এ যুদ্ধে মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে লড়াই করা অথবা অন্য যে কোনোভাবে পুলিশ-সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা ইত্যাদি।
০৫. নিজেদের অফিসারবৃন্দ, প্রতিষ্ঠানসমূহ ও পার্লামেন্ট সম্পর্কে এ মনোভাব রাখা যে, তারা যা-ই হুকুম দেবে, আমাদের জন্য তার আনুগত্য ওয়াজিব। এমন সম্পর্ককে তার ‘উপাসনা’ই বলা হবে।
আরও পড়ুন