গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন
(দ্বিতীয় পর্ব)
গণতন্ত্রের বিষয়ে অনেকেরই পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা নেই। ভাসাভাসা কিছু জানা থাকলেও অনেকে বিপরীত পক্ষের যুক্তিগুলো শুনলে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং যথাযথ উত্তর দিতে না পেরে নির্বাক হয়ে পড়েন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যদি কারও গণতন্ত্রের ব্যাপারে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা থাকে তাহলে তার জন্য যে কারও সাথে কথা বলার হিম্মত এসে যাবে এবং স্বচ্ছ ধারণা রাখার কারণে তার আকিদা-বিশ্বাসও বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ ওজর বা রাজনৈতিক মাসলাহাতের কারণে কেউ করলে সেটা ভিন্ন বিষয়, কিন্তু এটার মূল বিধান কী হবে, সে ব্যাপারে তাকে কখনো হীনম্মন্যতায় ভুগতে হবে। এজন্য প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্যকর্তব্য হলো, গণতন্ত্রের ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক বিধান কী, তা জেনে নেওয়া। এ চিন্তা থেকেই আজকের এ ছোট্ট প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। আশা করি, এটা পড়লে গণতন্ত্রের বিষয়ে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট ও স্বচ্ছ হবে ইনশাআল্লাহ। আজ এখানে স্রেফ মৌলিক কয়েকটি পয়েন্টে আলোচনা করার চেষ্টা করব। পূর্বের আর্টিকেলটি পড়ে থাকলে এটা পূর্ণতার কাজ দেবে ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত, আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, গণতন্ত্র হলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি জীবনব্যবস্থা। কেননা, এটা আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণ বা তাদের প্রতিনিধি তথা সাংসদের হাতে অর্পন করে। এ ব্যবস্থায় শাসনক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণরূপে গাইরুল্লাহ তথা জনগণ ও তাদের প্রতিনিধিদের জন্য সাব্যস্ত করা হয়। এতে যেকোনো সিদ্ধান্ত সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে নয়; বরং সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই গ্রহণযোগ্যতা পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্ত পুরো জাতির জন্য অবশ্যপালনীয় আইনে পরিণত হয়ে যায়; যদিও তা দ্বীন, ফিতরাত ও বিবেকের সাথে সাংঘর্ষিকক হয়। মানবরচিত এ ব্যবস্থাতে ভ্রুণমোচন, সমকামী বিবাহ, সুদভিত্তিক লেনদেন, শারয়ি দণ্ডবিধি রহিতকরণ, পতিতালয় ও মদপানের লাইসেন্স, অবাধ যৌনাচার-সহ যেকোনো আইন পাশ করানোর সুযোগ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ রায় দিলেই এসব নিকৃষ্ট ও শারিয়া-বিরুদ্ধ আইন জারি হয়ে যায়। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সবাইকে সে আইনকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। এ হিসেবে বলা যায়, এ গণতান্ত্রিক এ সিস্টেম পুরা ইসলামের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুসলিমদের সামগ্রিক জীবনে পূর্ণাঙ্গ দ্বীন পালনে সর্বশক্তি দিয়ে বাধা প্রদান করে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কিতাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, বিচার ও শাসনক্ষমতা একমাত্র তাঁরই জন্য নির্ধারিত এবং তিনিই হলেন শ্রেষ্ঠতম বিচারক। তিনি তাঁর শাসনক্ষমতায় কাউকে অংশীদার বানাতে নিষেধ করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে, তার চেয়ে উত্তম বিচারক আর কেউ নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَعْلَمُونَ
‘বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত কোরো না। এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত কোরো না। এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ
‘অতএব যাবতীয় কর্তৃত্ব আল্লাহরই, যিনি সমুচ্চ, মহান।’ [সুরা আল-মুমিন : ১২]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘অতএব যাবতীয় কর্তৃত্ব আল্লাহরই, যিনি সমুচ্চ, মহান।’ [সুরা আল-মুমিন : ১২]
أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ
‘আল্লাহ তাআলা কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন?’ [সুরা আত-তিন : ৮]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘আল্লাহ তাআলা কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন?’ [সুরা আত-তিন : ৮]
وَلا يُشْرِكُ فِي حُكْمِهِ أَحَداً
‘আর তিনি কাউকে নিজ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে অংশীদার বানান না।’ [সুরা আল-কাহফ : ২৬]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘আর তিনি কাউকে নিজ ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে অংশীদার বানান না।’ [সুরা আল-কাহফ : ২৬]
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْماً لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
‘তবে কি তারা জাহিলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?’ [সুরা আল-মায়িদা : ৫০]
আল্লাহ তাআলা সকল মাখলুকের স্রষ্টা। তাই তাদের জন্য কল্যাণকর ও উপযোগী বিধিবিধান তিনিই সবচেয়ে ভালো জানেন। মানবসত্তা সাধারণত জ্ঞান-গরিমা, স্বভাব-চরিত্র ও অভ্যাসের দিক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তারা অন্যদের কল্যাণকর বিষয়াদি সম্পর্কে জানা তো দূরে থাক; স্বয়ং নিজেদের কল্যাণকর বিষয় সম্বন্ধেই সম্যক জ্ঞান রাখে না। আর এজন্যই যে সমাজ ও দেশে জনগণই নিজেদের জীবনযাত্রার জন্য সংবিধান ও আইন-কানুন প্রণয়ন করে সে দেশে দুর্নীতি, চারিত্রিক অবক্ষয় ও সামাজিক বিপর্যয় পরিদৃষ্ট হতে থাকে।‘তবে কি তারা জাহিলিয়াতের বিধি-বিধান কামনা করে? আর দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে আর কে শ্রেষ্ঠতর?’ [সুরা আল-মায়িদা : ৫০]
সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, অনেক দেশে এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাস্তবতাহীন এক বাহ্যিক অবয়ব ও শুধুই শ্লোগানে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে মূলত মানুষকে ধোকা দেওয়া হয়। বাস্তবিক অর্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করে কেবল ক্ষমতাসীনরা। জনগণ এদের আদেশের সামনে নত ও পরাজিত থাকে। এ ব্যাপারে এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে যে, গণতন্ত্রের কোনো আইন যখন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অভিলাষের বিপরীত হয় তখন তাকে তারা পদদলিত করে পিষ্ট করে। নির্বাচনী জালিয়াতি, মানুষের স্বাধীনতাহরণ, সত্য ও ন্যায় প্রকাশকারীদের মুখবন্ধকরণের ঘটনাগুলো এমন কিছু বাস্তবতা, যা কমবেশি সবারই জানা। দিবালোকের মতো পরিষ্কার এ বিষয়ের জন্য আলাদা কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই। মূলত আলোকোজ্জ্বল দিনে সূর্যের অস্তিত্বের জন্য যখন দলিলের দরকার পড়ে তখন বিবেক কোনোকিছুর জন্যই আর উপযোগী থাকে না।
‘মাওসুআতুল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিবিল মুআসিরা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে :
ديمقراطية نيابية : أحد مظاهر النظم الديمقراطية التي يمارس فيها الشعب مظاهر السيادة بواسطة مجلس منتخب من نواب من الشعب ، وفيها يحتفظ الشعب بحق التدخل المباشر لممارسة بعض مظاهر السيادة عن طريق وسائل مختلفة ، أهمها :
1. حق الاقتراع الشعبي : بأن يقوم عدد من أفراد الشعب بوضع مشروع للقانون مجملاً أو مفصَّلاً ، ثم يناقشه المجلس النيابي ويصوِّت عليه .
2. حق الاستفتاء الشعبي : بأن يُعرض القانون بعد إقرار البرلمان له على الشعب ليقول كلمته فيه
3. حق الاعتراض الشعبي : وهو حق لعدد من الناخبين يحدده الدستور للاعتراض في خلال مدة معينة من صدوره ، ويترتب على ذلك عرضه على الشعب في استفتاء عام ، فإن وافق عليه نُفِّذ....... وإلا بطل ، وبه تأخذ معظم الدساتير المعاصرة.
‘সংসদীয় গণতন্ত্র : এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি রূপ, যাতে জনগণ তাদের প্রতিনিধির নির্বাচিত কাউন্সিলের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব প্রকাশের অনুশীলন করে থাকে। এতে মানুষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে সার্বভৌমত্বের কিছু দিক অনুশীলন করার জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। তন্মধ্য হতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পদ্ধতি হলো :
১. ভোটাধিকার : তা এভাবে যে, কতিপয় জনপ্রতিনিধি সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিতভাবে একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করবে। অতঃপর পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ এ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে সে ব্যাপারে (হ্যাঁ-বাচক কিংবা না-বাঁচক) ভোট দেবে।
২. গণভোটাধিকার : তা এভাবে যে, পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর তা জনগণের সামনে প্রকাশ করা হবে, যাতে এ ব্যাপারে তারা তাদের মন্তব্য পেশ করতে পারে।
৩. বিরোধিতাধিকার : এটা শুধুমাত্র নির্বাচিত কতিপয় সদস্যের অধিকার। আইনটি প্রকাশিত হওয়ার নির্দিষ্ট কিছুদিনের মধ্যেই বিরোধিতা করার জন্য সংবিধান সময় নির্ধারিত করে দেয় এবং গণভোটের জন্য জনগণের নিকট তা প্রকাশ করা এই ভোটের ফলের ওপর নির্ভর করে। যদি এটার পক্ষে (অধিকাংশের) ভোট পড়ে তাহলে তা বাস্তবায়িত হয়, নচেৎ তা প্রত্যাখ্যাত বলে বিবেচিত হয়। বর্তমানের বেশিরভাগ সংবিধান এ নিয়মই অনুসরণ করে থাকে।’ [মাওসুআতুল আদইয়ান ওয়াল মাযাহিবিল মুআসিরা : ২/১০৬৬]
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইবাদত ও আনুগত্য কিংবা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শিরকের নতুন একটি প্রকার। যেহেতু এতে মহান সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্ব ও নিঃশর্ত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অধিকারকে বাতিল করে তা মানুষের অধিকার বলে সাব্যস্ত করা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত করছ, যাদের নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা করেছ, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত কোরো না। এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে নিছক কতগুলো নামের ইবাদত করছ, যাদের নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা করেছ, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ নাযিল করেননি। বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তাআলারই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত কোরো না। এটাই শাশ্বত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ [সুরা ইউসুফ : ৪০]
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
‘বিধান দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই।’ [সুরা আল-আনআম : ৫৭]
দ্বিতীয়ত, অনেক মানুষ ধারণা করে, গণতন্ত্র মানেই স্বাধীনতা। কিন্তু এটা সঠিক ধারণা নয়। বাস্তবে এ স্বাধীনতা মানুষের জন্য বিষতুল্য। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর স্বাধীনতা নয়। বস্তুত গণতন্ত্রে যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়, সেটা দ্বারা উদ্দেশ্য বিশ্বাসগত স্বাধীনতা, চারিত্রিক অবক্ষয়ের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ইসলামি সমাজব্যবস্থায় এর অপকারিতা অনেক বেশি। এমনকি মত স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বিষয়টি এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, আল্লাহ, কুরআন, নবি-রাসুল ও সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারেও অপবাদ আরোপ ও বিভিন্ন সমালোচনা করা হচ্ছে। আর এ স্বাধীনতার দোহাই দিয়েই পর্দাহীনতা, অশ্লীলতা ও নৈতিকতা বিবর্জিত ছবি-সিনেমা সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এরকম আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যার সবগুলোই নৈতিকতা ও ধর্মীয়ভাবে জাতির ধ্বংসের ব্যাপারে অবদান রাখছে।‘বিধান দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই।’ [সুরা আল-আনআম : ৫৭]
তাছাড়াও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে স্বাধীনতার দাবি করে থাকে তাও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত নয়। কেননা, আমরা এ স্বাধীনতাকে নিজ স্বার্থ ও সুবিধা অনুযায়ী সীমাবদ্ধ দেখি। যে সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে সমালোচনা ও কটুক্তিকে গণতন্ত্র অনুমোদন করে থাকে ঠিক সে সময়েই ইহুদিদের সাথে নাৎসিদের নৃশংসতা নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে এ স্বাধীনতা খর্ব হতে দেখি। এটাকে অস্বীকার করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয় না। শুধু এতটুকুই নয়; বরং এ নৃশংসতার কথা কেউ অস্বীকার করলে তার বিরূদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে কারাবরণও করতে হয়। অথচ এটা এমন একটি ইতিহাস, দলিল-প্রমাণের আলোকে যা ভালোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ আছে।
এরা যদি স্বাধীনতারই দাবিদার হয়ে থাকে তাহলে কেন মুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের পথ ও ধর্ম বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় না? কেন তারা তাদের দেশে উপনিবেশ করে এবং তাদের ধর্ম-বিশ্বাস পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় লেগে আছে? ইতালি কর্তৃক লিবিয়ার গণহত্যা, ফ্রান্স কর্তৃক আলজেরিয়ার গণহত্যা, ব্রিটিশ কর্তৃক মিশরের গণহত্যা ও আমেরিকা কর্তৃক আফগান ও ইরাকের গণহত্যার ব্যাপারে তাদের এ স্বাধীনতা কোথায় গেল?
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দাবিদাররা যখন দেখল যে, স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যায় না; বরং অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার সাথে তাদের কত্থিত স্বাধীনতার সাংঘর্ষিকতা অনিবার্য তখন তারা স্বাধীনতার অর্থকে কিছু নিয়ম-কানুনের দ্বারা শৃঙ্খলিত করে দিল। যেমন :
১. আইন : গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন কোনো ব্যক্তির জন্য এ অধিকার নেই যে, সে রাস্তায় চলার বিপরীত দিক দিয়ে চলবে। অনুরূপ কারও এ অধিকারও নেই যে, লাইসেন্স ছাড়া কোনো দোকান বা ব্যবসা-বানিজ্য চালাবে। যদি সে বলে, আমি তো স্বাধীন তথাপিও তার কথার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করা হবে না।
২. সমাজ : উদাহরণস্বরূপ তাদের দৃষ্টিতে একজন নারী গোসলের সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিধান করে কোনো শোকাক্রান্ত বাড়ি যেতে পারে না। যদি সে বলে, আমি তো স্বাধীন একজন নারী তথাপিও লোকজন তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে এবং তাকে তাড়িয়ে দেবে। কারণ, এটা সামাজিকতা পরিপন্থী।
৩. স্বাভাবিক রুচি : উদাহরণস্বরূপ তাদের কেউ মানুষের সামনে বায়ুত্যাগ করতে পারে না; এমনকি ঢেকুরও তুলতে পারে না। এতে মানুষ তাকে তুচ্ছ ও ইতর মনে করবে; যদিও সে বলে আমি তো স্বাধীন।
এ পর্যায়ে আমরা বলতে চাই :
তাহলে আমাদের দ্বীন ইসলামের জন্যও কেন কিছু শৃঙ্খলতা ও সীমাবদ্ধতা তৈরি করা যাবে না? যেমনিভাবে তাদের অবাধ স্বাধীনতাকেও কিছু বিষয়ের সাথে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা তারা অস্বীকার করতে পারে না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, দ্বীনের আনিত বিধি-বিধানের মাঝেই রয়েছে মানুষের সমূহ কল্যাণ। অতএব নারীর পর্দাহীনভাবে বের হওয়া, মানুষের মদপান ও শূকরের গোশত ভক্ষণ ইত্যাদির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এগুলোর মাঝে মানুষের শরীর, বিবেক ও জীবনের জন্য সুনিশ্চিত কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিন্তু ধর্মীয়ভাবে এ আদেশ হলে তারা স্বাধীনতার এ সীমাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলকে ভেঙ্গে ফেলতে চায়। আর যদি আদেশটি তাদের মতোই কোনো মানুষের পক্ষ থেকে কিংবা তাদের রচিত কোনো আইনগতভাবে আসে তাহলে তারা বলে, আমরা শুনলাম ও মানলাম!
তৃতীয়ত, অনেকেরই ধারণা, ‘গণতন্ত্র’ ইসলামের ‘শুরা’ এর সমার্থক। কিন্তু অনেকগুলো কারণে এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। কতিপয় কারণ নিম্নরূপ :
১. শুরা বা পরামর্শ হয় কেবল নিত্যনতুন সমসাময়িক বিষয়াদি এবং কুরআন-সুন্নাহয় যে বিষয়গুলোর বিশদ বিবরণ নেই সেগুলো নিয়ে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় দ্বীনের অকাট্য প্রমাণিত বিধি-বিধানেরও বিরোধিতা করার সুযোগ দেওয়া হয়। অতএব এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের মত নিয়ে শারিয়াহ-নিষিদ্ধ বিষয়ের নিষেধাজ্ঞাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় এবং আল্লাহ তাআলা যেটা অনুমোদন বা আবশ্যক করেছেন তা নিষিদ্ধ করে দেয়। মদ বিক্রির লাইসেন্স এ সংবিধানের দ্বারাই দেওয়া হয়। পতিতাবৃত্তি ও সুদি লেনদেনেরও একই অবস্থা। এ সংবিধানের দ্বারাই ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও আল্লাহর পথে আহবানকারীদের কর্মস্থল সংকীর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে। এতে শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিকতা সুস্পষ্ট। তাহলে এটা কী করে শুরা হতে পারে?
২. শুরা মজলিস গঠিত হয় দ্বীনের পাণ্ডিত্য, ইলম, বিবেক, মেধা, চরিত্র ইত্যাদি বিবেচনায় উত্তীর্ণ একদল যোগ্য লোকের সমন্বয়ে। অতএব এখানে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও নির্বোধ শ্রেণীর সাথে পরামর্শ করার কোনোই সুযোগ নেই; ইসলামের শত্রু কাফির বা নাস্তিকদের ব্যাপার তো দূরে থাক! কিন্তু গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট বোর্ডে এগুলোর কোনোই গুরুত্ব নেই। এজন্য এখানে একজন কাট্টা কাফির, কট্টর নাস্তিক ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী নির্বোধও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সুতরাং ইসলামের শুরা ব্যবস্থার সাথে গণতান্ত্রিক সিস্টেমের পার্থক্য আকাশ-পাতাল।
৩. শুরা মজলিস আমির বা খলিফাকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে পারে না। প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে এবং অন্য সদস্যদের তুলনায় কারও মতকে অধিক সঠিক মনে করায় তিনি কখনো শুরা সদস্যদের একজনের মতকেও প্রাধান্য দিতে পারেন। এর বিপরীত সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের সিদ্ধান্ত জাতির জন্য অবশ্যপালনীয় আইনে পরিণত হয়ে যায়। বিষয়টি যদি সার্বিক বিবেচনায় অকল্যাণকর ও জাতির জন্য ক্ষতিকরও হয় তবুও এখানে রাষ্ট্রপ্রধানের বিরোধিতা করার কোনো সুযোগ থাকে না।
যখন এটা জানা হলো তখন মুসলিমদের জন্য কর্তব্য হলো, স্বীয় দ্বীনের ওপর গর্ব করা, স্বীয় রবের শাশ্বত বিধি-বিধানের ব্যাপারে এ আস্থা রাখা যে, তা তাদের দ্বীন ও দুনিয়াকে কল্যাণময় করবে। পাশাপাশি তাদের জন্য এটাও অপরিহার্য যে, আল্লাহর শরিয়তবিরোধী সকল তন্ত্র-মন্ত্র থেকে দূরে থাকা। আর শাসক হোক বা শাসিত, সকল মুসলিমের জন্য অবশ্যকরণীয় হলো, ব্যক্তি হোক বা পরিবার, সমাজ হোক বা রাষ্ট্র—জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে আল্লাহর শরিয়তকে আঁকড়ে ধরা। কারও জন্য এটা বৈধ নয় যে, সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মত বা পথকে নিজের জন্য গ্রহণ করবে। আর আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নবি হিসেবে মেনে সন্তুষ্ট থাকার দাবি হলো, মুসলিমরা ইসলামকে প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং আল্লাহর শরিয়তকে বড় মেনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহর অনুসরণ করে চলবে।
আল্লাহ তাআলার কাছে আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে ইসলামের দ্বারা সম্মানিত করেন এবং ইসলামের শত্রু ও মুনাফিকদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেন। আল্লাহ তাআলাই সর্বজ্ঞ।
চলবে...
✍️
Collected
Comment