গণতন্ত্র ও নির্বাচন : কিছু নিবেদন
(পঞ্চম পর্ব)
কেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়?(পঞ্চম পর্ব)
কিছু মানুষের ধারণা ইসলামি রাষ্ট্র গঠনই যেহেতু মূল লক্ষ্য, বিধায় যে পদ্ধতিই অবলম্বন করা হোক না কেন, তা শরিয়া অনুমোদিত ও বৈধ হয়ে যাবে। তাদের কেউ কেউ এ ব্যাপারে সিরাত থেকে দলিলও দিয়ে থাকে যে, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের যুদ্ধে মদিনায় প্রবেশপথে যে পরিখা খনন করিয়েছিলেন, সেটা ছিল পারস্যের অগ্নিপূজারিদের কৌশল, যা তিনি সালমান ফারসি রাযিয়াল্লাহু আনহুর মাধ্যমে জানতে পারেন। অতঃপর কৌশলটি পছন্দ হওয়ায় তিনি তার প্রায়োগিক ব্যবহার করে উপকৃতও হলেন। এ ঘটনা উল্লেখ করে তাদের একদল বলতে চায়, কাফিরদের আবিষ্কৃত যেকোনো কলা-কৌশল ও পদ্ধতি গ্রহণ করতে কোনো সমস্যা নেই। এটার ভিত্তিতেই তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে গণতন্ত্র নামক কুফরি তন্ত্রের মতো ইমানবিধ্বংসী এক পথ, যে পথে ব্যর্থতা ছাড়া সফলতার কোনো নজির নেই।
কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সিরাতের উপরিউক্ত ঘটনা থেকে কী বুঝার ছিল, আর তারা বুঝলটা কী! এখান থেকে কি এটা প্রমাণিত হয় যে, কাফিরদের প্রণীত যেকোনো কৌশল, তাদের আবিষ্কৃত যেকোনো প্রযুক্তি মুসলিমরা গ্রহণ করতে পারবে? নাকি কাফিরদের কৌশল ও প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে? এ ব্যাপারে আলিমদের কোনো মতানৈক্য নেই যে, কাফিরদের কৌশল ও প্রযুক্তি মুসলিমদের জন্য ততক্ষণই ব্যবহারের অনুমতি আছে, যতক্ষণ তাতে কুফর, শিরক, হারাম বা মাকরুহ জাতীয় কোনো বিষয় না থাকবে। খন্দকের যুদ্ধে ঠিক এটাই ঘটেছে। কেননা, যুদ্ধের জন্য পরিখা খনন না কুফর, না শিরক, না হারাম আর না মাকরুহ। সুতরাং যুদ্ধের ক্ষেত্রে কাফিরদের আবিষ্কৃত একটি বৈধ যুদ্ধকৌশল অবলম্বনের ঘটনা থেকে এটা কীভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাদের আবিষ্কৃত কুফরি পদ্ধতিও মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত?
মূলত শত্রুদের দেখানো পথে যে কখনো গন্তব্যে পৌঁছা যায় না, এ সহজ নীতিটিও আজ অনেকে বুঝতে চায় না। এমন সরল ও স্বীকৃত একটি বিষয়ও যাদের বুঝে আসে না, তারা কীভাবে ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করার সাহস দেখায়? একসময় এ ব্যাপারে কিছু মানুষ সাপোর্ট করলেও বর্তমানে এর বাস্তবতা ও কদর্যতা বুঝতে অনেকেই এ পথ পরিত্যাগ করছেন। শত্রুদের দেখানো এ পন্থায় শারয়ি সমর্থন না থাকার পাশাপাশি এতে যে শেষ পর্যন্ত সফলতা আর মুক্তি নেই, তা আজ বিবেকবানদের কাছে দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। আজকের আলোচনায় আমরা এ দিকটি স্পষ্ট করব যে, কেন গণতন্ত্র দিয়ে কখনোই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আশা করি, মনোযোগ সহকারে পুরো লেখাটি পড়লে সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমরা এখানে পনেরোটি কারণ উল্লেখ করছি, যা প্রমাণ করবে যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
প্রথম কারণ : কুফর-শিরক মিটিয়ে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার পর ইসলামি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, রাষ্ট্রীয়ভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজ না করলে সহিহ হাদিসে শাসকের বিরুদ্ধে (শর্তসাপেক্ষে, যার বিশদ বিবরণ রয়েছে ফিকহের কিতাবাদিতে) অস্ত্রধারণ করার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। ন্যায়পরায়ণ ও নেককার শাসকদের বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তার বিবরণ উল্লেখ করে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ.
‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমি জমিনের বুকে (ক্ষমতায়) প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সব কাজের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহরই ইখতিয়ারে।’ [সুরা আল-হজ : ৪১]
সহিহ মুসলিমে আউফ বিন মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমি জমিনের বুকে (ক্ষমতায়) প্রতিষ্ঠিত করলে সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎকাজের নির্দেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে। আর সব কাজের চুড়ান্ত পরিণতি আল্লাহরই ইখতিয়ারে।’ [সুরা আল-হজ : ৪১]
خِيَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُحِبُّونَهُمْ وَيُحِبُّونَكُمْ، وَيُصَلُّونَ عَلَيْكُمْ وَتُصَلُّونَ عَلَيْهِمْ، وَشِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ، وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ، قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَفَلَا نُنَابِذُهُمْ بِالسَّيْفِ؟ فَقَالَ: لَا، مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلَاةَ.
‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম নেতা হচ্ছে তারাই, যাদেরকে তোমরা ভালোবাসো এবং তারাও তোমাদেরকে ভালোবাসে; তারা তোমাদের জন্য দুআ করে, তোমরাও তাদের জন্য দুআ করো। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট নেতা হচ্ছে তারাই, যাদেরকে তোমরা ঘৃণা করো এবং তারাও তোমাদেরকে ঘৃণা করে; তোমরা তাদেরকে অভিশাপ দাও এবং তারাও তোমাদেরকে অভিশাপ দেয়। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা কি তাদেরকে তরবারি দ্বারা প্রতিহত করব না? তখন তিনি বললেন, না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তোমাদের মধ্যে নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নয়।’ [সহিহ মুসলিম : ৩/১৪৮১, হাদিস নং ১৮৫৫, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত]
নামাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তব্য কী, এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ এর মত হলো, বে-নামাজিকে জেলে বন্দি করে রাখা হবে; যতক্ষণ না সে তাওবা করে নামাজ শুরু করার প্রতিজ্ঞা করে। আর অন্য ফকিহদের মত হলো তাকে প্রথমে তাওবার আহবান জানানো হবে। তাতে সাড়া না দিলে তাকে হত্যা করা হবে। এ ব্যাপারে ‘আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা’-তে এ ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের মতামত উল্লেখ করে বলা হয়েছে :
لاَ خِلاَفَ فِي أَنَّ مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ جَاحِدًا لَهَا يَكُونُ مُرْتَدًّا، وَكَذَا الزَّكَاةُ وَالصَّوْمُ وَالْحَجُّ؛ لأِنَّهَا مِنَ الْمُجْمَعِ عَلَيْهِ الْمَعْلُومِ مِنَ الدِّينِ بِالضَّرُورَةِ. وَأَمَّا تَارِكُ الصَّلاَةِ كَسَلاً فَفِي حُكْمِهِ ثَلاَثَةُ أَقْوَالٍ: أَحَدُهَا: يُقْتَل رِدَّةً، وَهِيَ رِوَايَةٌ عَنْ أَحْمَدَ وَقَوْل سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، وَعَامِرٍ الشَّعْبِيِّ، وَإِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، وَأَبِي عَمْرٍو، وَالأْوْزَاعِيِّ، وَأَيُّوبَ السَّخْتِيَانِيِّ، وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْمُبَارَكِ، وَإِسْحَاقَ بْنِ رَاهَوَيْهِ، وَعَبْدِ الْمَلِكِ بْنِ حَبِيبٍ مِنَ الْمَالِكِيَّةِ، وَهُوَ أَحَدُ الْوَجْهَيْنِ مِنْ مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ، وَحَكَاهُ الطَّحَاوِيُّ عَنِ الشَّافِعِيِّ نَفْسِهِ، وَحَكَاهُ أَبُو مُحَمَّدِ بْنُ حَزْمٍ عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، وَمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، وَعَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ، وَأَبِي هُرَيْرَةَ، وَغَيْرِهِمْ مِنَ الصَّحَابَةِ. وَالْقَوْل الثَّانِي: يُقْتَل حَدًّا لاَ كُفْرًا، وَهُوَ قَوْل مَالِكٍ وَالشَّافِعِيِّ، وَهِيَ رِوَايَةٌ عَنْ أَحْمَدَ. وَالْقَوْل الثَّالِثُ: أَنَّ مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ كَسَلاً يَكُونُ فَاسِقًا وَيُحْبَسُ حَتَّى يُصَلِّيَ، وَهُوَ الْمَذْهَبُ عِنْدَ الْحَنَفِيَّةِ.
‘এতে কারও মতানৈক্য নেই যে, যে-ব্যক্তি নামাজ অস্বীকার করে পরিত্যাগ করবে সে মুরতাদ (ইসলামত্যাগী) হয়ে যাবে। অনুরূপ জাকাত, রোজা ও হজেরও একই বিধান। কেননা, এগুলো সর্বসম্মতভাবে ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ ও জ্ঞাত আবশ্যকীয় বিধান। তবে অলসতাবশত নামাজ পরিত্যাগকারীর ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়। প্রথম মত হলো, তাকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে। এটা ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ এর একটি উক্তি। এছাড়াও সাইদ বিন জুবাইর রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম শাবি রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম ইবরাহিম নাখয়ি রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আবু আমর রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আওজায়ি রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আইয়ুব সাখতিয়ানি রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মুবারক রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম ইসহাক বিন রাহুয়াহ রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম আব্দুল মালিক বিন হাবিব মালিকি রাহিমাহুল্লাহ; এদের মতও এরূপই। শাফিয়ি মাজহাবের দুটি মত হতে একটি মত এমনই। ইমাম তাহাবি রাহিমাহুল্লাহ ইমাম শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহ থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনু হাজাম রাহিমাহুল্লাহ এ মতটি উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু, মুআজ বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুর রহমান বিন আঊফ রাযিয়াল্লাহু আনহু, আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু-সহ প্রমূখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় মত হলো, তাকে হত্যা করা হবে হদ (শারয়ি দণ্ড) হিসেবে, মুরতাদ হিসেবে নয়। এটা ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহ এর মাজহাব। ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ এর একটি উক্তিও এমনই। তৃতীয় মত হলো, যে ব্যক্তি অলসতাবশত নামাজ পরিত্যাগ করবে সে ফাসিক বলে বিবেচিত হবে। নামাজ পড়ার আগ পর্যন্ত তাকে বন্দি করে রাখা হবে। আর এটাই হানাফিদের মাজহাব।’ [আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২২/১৮৭, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত]
এখন ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ গণতন্ত্র কতটুকু সফল হবে? ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের মাত্র ২% মানুষ নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। তাহলে আপনি কি করে আশা করেন যে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠার এ ধরনের বিধানের পক্ষে ভোট দেবে, আর তাদের ভোটে ইসলামি বিধান বাস্তবায়িত হবে! বে-নামাজি মানুষদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তাদের জন্য নামাজকে বাধ্যতামূলক করা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র। বস্তুত গণতন্ত্রবাদী কোনো ইসলামি দল যদি ভাগ্যক্রমে ক্ষমতায় চলেও আসে তবুও তারা কখনোই ইসলামি বিধানানুসারে নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। কেননা, গণতান্ত্রিক সংবিধান অনুসারে তারা এটার জন্য কাউকে বাধ্যও করতে পারবে না। বাধ্য করতে গেলে সেখানে জাতিসংঘ-সহ পশ্চিমাবিশ্ব সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। এমনকি প্রয়োজন হলে তারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাদের মসনদও উল্টে দিতে পারে; যেমনটি মিশরে হয়েছিল। এক্ষেত্রে তারা বলতে পারে, আমরা আইন না করলেও দাওয়াতের মাধ্যমে সকল মানুষকে নামাজমুখী বানাব। সেক্ষেত্রে আমাদের কথা হলো, আইন করা ছাড়া দাওয়াতের মাধ্যমে সবাইকে নামাজি বানানো হলেও সেটা ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হবে না।
বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কারভাবে খুলে বলি। গণতন্ত্রবাদী কোনো ইসলামি দল ক্ষমতায় এসে যদি ব্যাপক দাওয়াতি কার্যক্রম ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে যদি রাষ্ট্রের শতভাগ মুসলিমকেও নামাজি বানিয়ে ফেলে তবুও আমরা কখনো ওই রাষ্ট্রকে ইসলামি রাষ্ট্র বলতে পারব না; যতক্ষণ না সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বে-নামাজির জন্য সুনির্ধারিত শাস্তির বিধান থাকে; চাই সেটা ফিকহে হানাফির মতানুসারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে হোক কিংবা অন্যান্য মাজহাব অনুসারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে হোক। কিন্তু যে রাষ্ট্রে বে-নামাজির জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান আছে, সে রাষ্ট্রের সকল মানুষ যদি নামাজ নাও পড়ে তবুও সেটাকে ইসলামি রাষ্ট্র বলা হবে। বস্তুত ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেই এই বিভ্রান্তিগুলো ছড়ানো হচ্ছে। কেউ কেউ তো এমনটিও মনে করে যে, তাদের দল পার্লামেন্টের ১৫১টি আসন পেলেই বুঝি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে!! এটা যে কতবড় মারাত্মক বিভ্রান্তি, তা আমরা ইতোপূর্বে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
দ্বিতীয় কারণ :
ইসলাম নামক মুক্তির বিহঙ্গ আজ জাতীয়তাবাদ নামক লোহার খাঁচায় বন্দী। মুসলিমদের সীসাঢালা ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আজ আমেরিকা, ব্রিটেনের এঁকে দেওয়া সীমারেখায় কেঁদে কেঁদে মরছে। গণতন্ত্র কি পারবে এ লোহার খাঁচা ভেঙে উম্মাহকে পুনরায় ঐক্য আর মুক্তির স্বাদ দিতে? শত্রুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে, তাদেরই শেখানো বুলি আওড়িয়ে শত্রু বধের কৌশলের কথা শুনলে তো পাগলেও হাসবে। যে গণতন্ত্রের মাধ্যমে খিলাফত ধ্বংস করা হয়েছে, সে গণতন্ত্র দিয়েই খিলাফত ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা কতটা যে বোকামি, তা একসময় মানুষ না বুঝলেও বর্তমানের সচেতন যেকোনো মুসলিমই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে। আর তাই তো শত্রুর পাতা এ ফাঁদ থেকে আজ অনেকেই মুক্ত হয়ে প্রত্যাবর্তন করছে সেই পথ অভিমুখে, যে পথে চলেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি যুগের হকপন্থী জামাত।
তৃতীয় কারণ :
কোনো ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম থেকে ইহুদি বা খ্রিস্টান হয়ে গেলে কিংবা নাস্তিক হয়ে গেলে ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, তাকে তাওবা করে ইসলামে ফিরে আসার আহবান জানানো। এতে সে অসম্মতি প্রকাশ করলে রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো, তাকে হত্যা করা। যেমন সহিহ বুখারিতে ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ
‘যে-ব্যক্তি নিজের দ্বীন (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) পরিবর্তন করে ফেলবে, তোমরা তাকে হত্যা করো।’ [সহিহুল বুখারি : ৪/৬১, হাদিস নং ৩০১৭, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত]
ইমাম তিরমিজি রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় সুনানে উক্ত হাদিসটি বর্ণনা শেষে লিখেছেন :
وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ فِي الْمُرْتَدِّ، وَاخْتَلَفُوا فِي الْمَرْأَةِ إِذَا ارْتَدَّتْ عَنِ الإِسْلاَمِ، فَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ العِلْمِ: تُقْتَلُ، وَهُوَ قَوْلُ الأَوْزَاعِيِّ، وَأَحْمَدَ، وَإِسْحَاقَ. وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ: تُحْبَسُ وَلاَ تُقْتَلُ، وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، وَغَيْرِهِ مِنْ أَهْلِ الكُوفَةِ.
‘মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে আহলে ইলমের নিকট এটাই অনুসৃত বিধান। তবে কোনো নারী ইসলাম ত্যাগ করলে তার বিধানের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরাম মতানৈক্য করেছেন। একদল উলামায়ে কিরামের মতে (পুরুষ মুরতাদের মতো) তাকেও হত্যা করা হবে। এটা ইমাম আওজায়ি রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম ইসহাক রাহিমাহুল্লাহ এর মত। আর অন্য আরেক দল উলামায়ে কিরাম বলেন, তাকে বন্দি করে রাখা হবে, হত্যা করা যাবে না। এটা ইমাম সুফইয়ান সাওরি রাহিমাহুল্লাহ ও অন্যান্য কুফাবাসী ফুকাহায়ে কিরামের মত।’ [সুনানুত তিরমিজি : ৩/১১১, হাদিস নং ১৪৫৮ সংশ্লিষ্ট আলোচনা, প্রকাশনী : দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত]
আপনার কি মনে হয়, যারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ ইসলাম ও মুসলিমদের ধ্বংস করার জন্য ওয়ার অন টেরর নামে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিচালনা করছে, পাশাপাশি মানুষকে ইসলামবিমুখ, নাস্তিক ও মুরতাদ বানানোর জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে, তারা এত সহজেই আপনাকে এই আইন বাস্তবায়ন করতে দেবে? বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যথাযথ সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অর্জন করা ছাড়া স্রেফ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসব আইন করার কল্পনাও করা যায় না। আর পুরো দুনিয়ার গণতন্ত্রীদের এসব বিষয়ে সক্ষমতার স্তর যে কত নিম্নমুখী, সেটা আমাদের বলার প্রয়োজন নই, সেটা তারা নিজেরাই স্বীকার করে।
চতুর্থ কারণ :
ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদি-খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে জিজিয়া-কর আদায় করা। ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন :
قَالَ الْمُخَصِّصُونَ بِالْجِزْيَةِ لِأَهْلِ الْكِتَابِ: الْمُرَادُ مِنْ إِرْسَالِ الرُّسُلِ وَإِنْزَالِ الْكُتُبِ إِعْدَامُ الْكُفْرِ وَالشِّرْكِ مِنَ الْأَرْضِ وَأَنْ يَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ كَمَا قَالَ تَعَالَى: {وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ} [البقرة: 193] ، وَفِي الْآيَةِ الْأُخْرَى: {وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ} [الأنفال: 39] ، وَمُقْتَضَى هَذَا أَلَّا يُقَرَّ كَافِرٌ عَلَى كُفْرِهِ، وَلَكِنْ جَاءَ النَّصُّ بِإِقْرَارِ أَهْلِ الْكِتَابِ إِذَا أَعْطَوُا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ، فَاقْتَصَرْنَا بِهَا عَلَيْهِمْ وَأَخَذْنَا فِي عُمُومِ الْكُفَّارِ بِالنُّصُوصِ الدَّالَّةِ عَلَى قِتَالِهِمْ إِلَى أَنْ يَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.
‘জিজিয়া শুধু ইহুদি-খ্রিষ্টানদের জন্যই প্রযোজ্যকারী ফুকাহায়ে কিরাম বলেন, নবি-রাসুলদের প্রেরণ ও কিতাবসমূহ অবতরণের উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবী থেকে কুফর-শিরক একেবারে নিশ্চিহ্ন করা এবং একমাত্র আল্লাহর দ্বীনই পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকো, যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয় এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৯৩) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যতক্ষণ না দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (সুরা আল-আনফাল : ৩৯) এ আয়াতের দাবি হলো, কোনো কাফিরকেই তার কুফরের উপর থাকতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু অন্য আয়াতে আহলে কিতাব তথা ইহুদি-খ্রিষ্টানরা অবনত মস্তকে বশ্যতা স্বীকার করে জিজিয়া দিলে সেক্ষেত্রে তাদেরকে অব্যহতি দেওয়ার কথা এসেছে। অতএব, আমরা শুধু তাদের ব্যাপারেই ক্ষান্ত থাকব। আর অন্য কাফিরদের ব্যাপারে ওই আয়াত গ্রহণ করব, যেখানে সামগ্রিকভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে।’ [আহকামু আহলিজ জিম্মাহ : ১/৯৫, প্রকাশনী : রামাদি, দাম্মাম]
অতএব, যারা ঠুনকো কারণে-অকারণে মার্কিন, চীন বা ভারতীয় দূতাবাসে ধরনা দেয়, যারা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের প্রণীত পদ্ধতিতে এবং তাদেরই সাপোর্টে ক্ষমতায় আসতে চায়, তারা ইহুদি-খ্রিষ্টান নাগরিকদের ওপর ইসলামি জিজিয়া-কর ব্যবস্থা চালু করার সাহস দেখাবে বলে আপনার মনে হয়? কুফফারদের ফর্মুলা অনুসরণ করে, তাদের সাহায্য গ্রহণ করে উল্টো তাদের স্বার্থবিরোধী আইনের স্বপ্ন দেখা কি নিছক বিভ্রান্তি নয়? এটা তো একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন আপনি তাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাদের মুখে মুখ রেখে কথা বলার মতো প্রয়োজনীয় সাহস ও যথাযথ উপকরণ তৈরি করবেন। এর আগে এসব চিন্তা করা বাতুলতা বৈ কিছু নয়।
পঞ্চম কারণ :
ইসলামি রাষ্ট্র বানাতে হলে অবশ্যই তাকে ইসলামবিরোধী সকল প্রকার বাতিল মতবাদ, মানবরচিত কুফরি তন্ত্রমন্ত্র ও এসংশ্লিষ্ট দলসমূহকে নিষিদ্ধ করতে হবে। চাই তারা বামপন্থী হোক, সেক্যুলার হোক, কিংবা জাতীয়তাবাদী হোক। তাদেরকে তাওবা করার আহবান জানানো হবে। তাওবা করলে তারা মুক্ত ও ক্ষমাযোগ্য; অন্যথায় তাদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করে হত্যা করা হবে। শুধু এতটুকুই নয়; বরং ইসলামি আইন অনুসারে ‘সরকারি দল’ এবং ‘বিরোধী দল’ এসব পরিভাষা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য ঘোষণা করতে হবে। কেননা, ইসলামে সকল প্রকার দলাদলি নিষিদ্ধ। এক আমিরের নেতৃত্বে গোটা উম্মাহ পরিচালিত হবে। এটাই হলো ইসলামি শাসনব্যবস্থার রূপরেখা। বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বীকার করে নিয়ে এ কাজ করার সুযোগ কোথায়?
জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসে তাদেরই প্রিয় নাস্তিক বুদ্ধিজীবী ও ইসলামবিরোধী কবি-সাহিত্যিককে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হত্যা করার নৈতিক শক্তি গণতান্ত্রিক ইসলামি দল কোথায় পাবে? প্রচলিত সিস্টেমে ক্ষমতায় এসে এসব বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব? রাজনৈতিক দলসমূহকে নিষিদ্ধ করতে গেলে কার্যত গণতন্ত্রকেই কবর চাপা দিতে হবে। যে জনগণের কাছ থেকে ভোটভিক্ষার মাধ্যমে দলটি ক্ষমতায় এসেছে, তারা এটা মানবে কেন? ওই সমস্ত দল বা তাদের সাপোর্টাররাই বা বসে থাকবে কেন? আর পশ্চিমারাই বা বসে বসে আঙুল চুষবে কেন? তাই হয় ইসলাম প্রতিষ্ঠার চিন্তা বাদ দিতে হবে, নয়তো নিজেদের ক্ষমতার মসনদ ছাড়তে হবে। ঘুরেফিরে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই আদি ও আসল পদ্ধতিতেই ফিরে যেতে হবে, যেটায় রয়েছে আল্লাহর নুসরাত ও যেখানে রয়েছে বিজয় ও সাফল্যের শত-সহস্র ইতিহাস।
ষষ্ঠ কারণ :
একটি ইসলামি রাষ্ট্র সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, যত্রতত্র বেপর্দা চলাফেরা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, সহশিক্ষা, অশ্লীল নাটক, সিনেমা, যাত্রাপালা নিষিদ্ধ করবে। সিনেমা হল, নাইটক্লাব, মদের বার, ডিজে পার্টি, নিষিদ্ধ গানের আসর বন্ধ করবে। সকল প্রকার বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে ফেলবে। ইসলামি মূল্যবোধ বিরোধী পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, ব্লগ, সাময়িকী, বইপত্র, কবিতা, উপন্যাস, সাহিত্য নিষিদ্ধ করবে। বিবাহিত ব্যভিচারীকে রজম (প্রস্তরাঘাত করে হত্যা) করবে। সমকামীদের দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তি বা প্রয়োজনবোধে হত্যা করবে। চারুকলা-কারুকলার নামে নিষিদ্ধ মূর্তি-ভাস্কর্য তৈরির চর্চা বন্ধ করবে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকারের এসব করার সুযোগ কোথায়?
আপনি যদি ক্ষমতায় যেতে চান তাহলে আপনাকে জনপ্রিয়তা খুঁজতে হবে। বিদেশি প্রভুদের সাহায্য ও তাদের আশির্বাদ নিতে হবে। আর আপনি যদি জনপ্রিয়তা খুঁজতে চান এবং পশ্চিমাদের সাহায্য তালাশ করেন তাহলে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, উল্টো আপনার নিজের মাঝেই পূর্ণাঙ্গ ইসলাম থাকবে না। আসলে জনপ্রিয়তার রাজনীতিই আজকের ইসলামি দলসমূহের আদর্শিক অধঃপতনের অন্যতম প্রধান কারণ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন :
وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ.
‘আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা অনুসারে চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। তারা তো কেবল ধারণারই অনুসরণ করে থাকে, আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথাই বলে।’ [সুরা আল-আনআম : ১১৬]
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন :‘আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা অনুসারে চলেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলবে। তারা তো কেবল ধারণারই অনুসরণ করে থাকে, আর তারা শুধু অনুমানভিত্তিক কথাই বলে।’ [সুরা আল-আনআম : ১১৬]
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ- وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا.
‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও (ইসলামের চূড়ান্ত) বিজয়, আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।’ [সুরা আন-নাসর : ১-২]
কাজেই ইসলামের বিজয় আসলে মানুষ এমনিতেই দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে। অধিকাংশ মানুষের সাপোর্ট আর তাদের সন্তুষ্টি অনুসরণের কোনোই প্রয়োজন নেই। কিন্তু গণতন্ত্রীরা উল্টো বুঝে মনে করে, আগে মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করবে, তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা ইসলামের বিজয় ঘটাবেন। বস্তুত এটা কুরআনি নির্দেশনা ও বাস্তবতার পুরো বিপরীত। তাই আপনাকে আগে অন্যভাবে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। এরপর মানুষ অটোমেটিকভাবে দলে দলে ইসলামের বিবিধিবিধান মেনে নেবে।‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও (ইসলামের চূড়ান্ত) বিজয়, আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।’ [সুরা আন-নাসর : ১-২]
সপ্তম কারণ :
সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা উৎখাত করতে গেলে এবং জাকাত ব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক করতে গেলে দেশের ভোগবাদী ধনিশ্রেণি আপনাকে অপসারণ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। আর এটা আজ ওপেন সিক্রেট যে, তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া আপনি কখনো গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন না। কেননা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে এই শিল্পপতী ও বুর্জোয়া শ্রেণির সমর্থনেই সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাদেরকে এড়িয়ে কোনো কিছু করা অসম্ভবপ্রায়। আর এই শ্রেণির লোকেরা সুদের জোরেই জিইয়ে রেখেছে তাদের আদিগন্ত ভোগলিপ্সা, শাসন, শোষণ, অবৈধ কর্তৃত্ব আর সম্পদের বিশাল পাহাড়। আর এজন্য এরাই সবসময় পুঁজিবাদনির্ভর গণতন্ত্রের পেছনের কলকাঠি নাড়ে। প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক রাযিয়াল্লাহু আনহুর যুগেও একটা গ্রুপ জাকাত দিতে অস্বীকার করে মুসলিম সেনদলের বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। তাহলে তো বর্তমান যুগের পুঁজিবাদীদের কথা বলাই বাহুল্য।
অষ্টম কারণ : মিশর কিংবা আলজেরিয়ার মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য দরকার পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। গণতন্ত্রীদের এসব পরিস্থিত সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি কতটুকু? তাদের প্রস্তুতি তো কেবল পোস্টারিং আর দেয়াল লিখন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। বরং তারা এ ধরনের প্রস্তুতিকে অসাংবিধানিক ও অনিয়মতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ আলিমদের পরিষ্কার মত হলো, সার্বক্ষণিক জিহাদের প্রস্তুতি মুসলিমদের জন্য ফরজ; চাই যুদ্ধের পরিস্থিতি থাকুক আর নাই থাকুক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন :
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ.
‘আর তোমরা তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখো।’ [সুরা আল-আনফাল : ৬০]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :‘আর তোমরা তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখো।’ [সুরা আল-আনফাল : ৬০]
وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُم مَّيْلَةً وَاحِدَةً.
‘কাফিররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও, যাতে তারা তোমাদের ওপর একযোগে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।’ [সুরা আন-নিসা : ১০২]
সহীহ মুসলিমে উকবা বিন আমির রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি :‘কাফিররা কামনা করে যেন তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র সম্বন্ধে অসতর্ক হও, যাতে তারা তোমাদের ওপর একযোগে ঝাপিয়ে পড়তে পারে।’ [সুরা আন-নিসা : ১০২]
سَتُفْتَحُ عَلَيْكُمْ أَرَضُونَ، وَيَكْفِيكُمُ اللهُ، فَلَا يَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَلْهُوَ بِأَسْهُمِهِ.
‘অচিরেই তোমাদের হাতে অনেক ভূখণ্ড বিজিত হবে এবং (শত্রুদের মোকাবেলায়) আল্লাহই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবেন। এতদসত্ত্বেও তোমাদের কেউ যেন তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ ছেড়ে না দেয়।’ [সহিহু মুসলিম : ৩/১৫২২, হাদিস নং ১৯১৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, বৈরুত]
মূলত গণতন্ত্র হলো কাফিরদের তৈরি একটি ফাঁদ। যখন তারা দেখবে, একটি ইসলামি দল ক্ষমতায় চলে এসেছে তখন তারা মিথ্যা অভিযোগে তাদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালাবে এবং তখনও তারা গণতন্ত্র রক্ষারই অজুহাত দেবে। দূর ও নিকট ইতিহাসে এর অনেক প্রমাণ আছে।
গনতন্ত্র নিয়ে আক্ষেপ করতে গিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ যথার্থই বলেছিলেন :
‘গনতন্ত্র এমন একটা ধর্ম, যা তার অনুসারীদের বেঁধে দেয়। এমনকি বুলেটের আঘাতে তোমাদের বুক ঝাঁঝরা করে দিলেও তোমরা সর্বোচ্চ রাস্তায় গিয়ে একটু প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। আর এতটুকু করতে পারলেই তারা এই ভেবে পরিতৃপ্ত হয়ে যায় যে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় হয়ে গিয়েছে!’
নবম কারণ :
আমেরিকার র্যান্ড ইনস্টিটিউশন মডারেট মুসলিমদের যে চারটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে এবং যেগুলো তারা আমাদের ওপর আরোপ করতে চায় তার দুটি হলো :
ক. গণতন্ত্রকে (ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি মতে নয়; বরং) সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে যেভাবে পশ্চিমা ঐতিহ্যে বিশ্বাস করা হয়।
খ. ধর্মনিরপেক্ষ আইনের উৎস গ্রহণ করা। যারা বিশেষ কোনো ধর্মগ্রন্থের আইন চায় তারা মূলত চরমপন্থী।
বিস্তারিত জানার জন্য শাইখ আনওয়ার আল-আওলাকি রাহিমাহুল্লাহ এর Accepting Democracy as understood in the liberal western traditions লেকচারটি শুনতে পারেন।
আপনি হয়তো ভাবছেন, গণতন্ত্র গ্রহণ করলেই পশ্চিমারা আপনার ওপর খুশি হয়ে যাবে, আপনাদেরকে গুড মুসলিম বলে ঘোষণা করবে। কিন্তু ব্যাপারটি আদতে এমন নয়। তারা স্পষ্ট করেই বলেছে, সেই গণতন্ত্র নয়, যে গণতন্ত্র আপনি বুঝেন বা যে গণতন্ত্র আপনি পালন করতে চান; বরং তাদের বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট যে, Accepting Democracy as understood in the liberal western traditions অর্থাৎ উদারপন্থী পশ্চিমা ঐতিহ্যে গণতন্ত্রকে গ্রহণ করতে হবে।
তারা গনতন্ত্রবাদী ইসলামি দল ‘ব্রাদারহুড’ ইস্যুতে বলেছে :
as in the case of present Egyptian Muslim Brotherhood is not Enough.
অর্থাৎ বর্তমান মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষেত্রে (গণতন্ত্রের এতটুকু চর্চা) যথেষ্ট নয়।
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, পশ্চিমারা যে গণতন্ত্র চায়, আপনাকে সে গণতন্ত্রই চর্চা করতে হবে। এতে কোনো পরিমার্জন ও পরিবর্তন করলে তা তারা মেনে নেবে না। প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, র্যান্ড ইন্স্টিটিউশনের সংজ্ঞায় যেটা মডারেট ইসলাম, আমাদের কাছে তা পরিষ্কার কুফর। এ বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাদের অনেক আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন :
وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ.
‘ইহুদি-খ্রিষ্টানরা কখনও আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না; যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাত (অর্থাৎ ধর্মের আদর্শ) অনুসরণ করবেন।’ [সুরা আল-বাকারা : ১২০]
দশম কারণ :‘ইহুদি-খ্রিষ্টানরা কখনও আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না; যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাত (অর্থাৎ ধর্মের আদর্শ) অনুসরণ করবেন।’ [সুরা আল-বাকারা : ১২০]
প্রতিপক্ষের ওপর বিজয়ী হবার সবচেয়ে সহজ কৌশল হলো, Divide & Rule অর্থাৎ বিভেদ সৃষ্টি করো এবং শাসনকার্য পরিচালনা করো। মোটাদাগে দেখলে এ দেশের অল্প কিছু মানুষই ইসলামপন্থী। অতঃপর বহুদলীয় গণতন্ত্রের ফর্মুলায় এই অল্প সংখ্যক ভোট ভাগ হবে এত এত বিচ্ছিন্ন ইসলামি দলগুলোর মাঝে। একদলের শাইখুল হাদিস দাঁড়াবে আর অপরদলের দাড়িবিহীন শিক্ষিত তরুণ হবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। অতঃপর সমর্থকদের মাঝে শুরু হবে নোংরা কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি, গিবত, অপবাদ আর পরনিন্দার বৃষ্টিধারা। দূর থেকে সেক্যুলার-বামপন্থীরা মজা লুটবে। আসলে গণতন্ত্র আর নির্বাচন এই উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্যের বিষফোঁড়া রোপণ করে দিয়েছে, যার ফল আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।
প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী হবার সবচেয়ে সহজ কৌশল হলো, Divide & Rule (জাতিকে বিভক্ত করে দাও, অতঃপর নির্বিঘ্নে শাসনকার্য পরিচালনা করো) মূলনীতির প্রয়োগ। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলেই পরিষ্কার বুঝা যায় যে, এ দেশের অল্পকিছু মানুষই ইসলামি দলগুলোর সমর্থক। অতঃপর বহুদলীয় গণতন্ত্রের ফর্মুলায় এই অল্প সংখ্যক মানুষের ভোট আবার ভাগ হবে বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত ইসলামি দলগুলোর মাঝে। আসলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন এই উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্যের বিষফোঁড়া রোপণ করে দিয়েছে, যার ফল আমরা আজ নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে বর্তমানে ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ঠিক কতটি, তা এই মূহুর্তে বলা মুশকিল। তবে এর ভঙ্গুরতা এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, এদেশে কেবল ইসলামি ঐক্যজোটের সংখ্যাই চার থেকে পাঁচটি! তাহলে চিন্তা করে দেখুন, দল ও উপদলের সংখ্যা কতগুলো হতে পারে! এরা প্রত্যেকেই গণতন্ত্র ধ্বংস করে খিলাফাহ প্রতিষ্ঠা করার দাবি করে, আবার খিলাফাহ ধ্বংসকারী সেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই পথ চলতে পছন্দ করে। এটা যে কতবড় স্ববিরোধিতা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একাদশ কারণ :
বর্তমানে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিদেশী প্রভাব একটি ওপেন সিক্রেট। প্রতিটি ইলেকশনের পূর্বে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীদের গণতন্ত্রের প্রভুদের দেশে দৌড়াদৌড়ির দৃশ্য তাই খুবই কমন। বলা যায়, পশ্চিমা প্রভুদের পক্ষ থেকেই নির্ধারন করা হয়ে থাকে আগামী পাঁচ বছর কারা এদেশে তাদের প্রক্সি গোলাম হিসেবে কাজ করবে। তার ওপরে ভোটে কারচুপি, জাল ভোটপ্রদান, ব্যালট বক্স ছিনতাই, দুর্নীতি, নির্বাচন কমিশনের অবৈধ হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার—এগুলো তো আছেই। এই সিরিয়ালে সর্বশেষ সংযোজন হলো, এক তরফা প্রহসনের নির্বাচন। ইসলামি দলগুলো তো দূরের কথা, সেক্যুলার দলগুলোরও এক্ষেত্রে আসলে কিছুই করার থাকে না।
আর গণতন্ত্রের তথাকথিত ‘সর্বশক্তির উৎস’ বলে পরিচত ‘জনগন’ তো এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আর কিছুই করে না; এমনকি দুয়েকটি ফাঁকা বুলিও নয়। আসলে সাধারণ জনতার এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। ‘চাচা তোর আপন প্রাণ বাঁচা’ নিয়েই সবাই ব্যস্ত। দেশের মানুষ প্রহসনের নির্বাচনের আগেও যেমন সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ঘুমোতে যেত, এখনও তেমনই যায়। দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল বারবার ওয়াশিংটনের দিকে হাত তুলে মুনাজাত করেছিল, কিন্তু ওয়াশিংটন আকার ইঙ্গিতে ভালো করেই বুঝিয়ে দিয়েছে, আমরা মুখে যাই বলি না কেন, কাজে আমরা তার পক্ষই গ্রহণ করব, যারা আমাদের বেশি সুবিধা দেবে আর নিষ্ঠাপূর্ণভাবে গোলামি করবে। সেক্যুলারদের প্রভুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতিটি আপনি আরও ভালো করে বুঝবেন গণতন্ত্রের পুরোপুরি বিপরীত রাজতন্ত্রবাদী সৌদিদের সাথে তাদের গভীর সম্পর্ক থেকে। অর্ধ শতাব্দির বেশি সময় ধরে সৌদিআরবে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব তো যুক্তরাষ্ট্রই পালন করছে। সেখানে তো তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি করে না। সেখানে তো তারা জুলুম ও স্বৈরাচারির বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করে না। এর একমাত্র কারণ হলো, রাজতন্ত্র থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, উল্টো পেট্টোডলার চুক্তি করে সে অবিশ্বাস্যভাবে লাভবান হচ্ছে। আসলে তাদের দরকার কর্তৃত্ব আর আধিপত্যি। তারা গণতন্ত্রের মন্ত্র তো জপে কেবল মুসলিম উম্মাহ ও তৃতীয় বিশ্বের লোকদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য।
পশ্চিমা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো সাম্রাজ্যবাদ নীতি। বিভিন্ন মুসলিম দেশে আক্রমন করা, যুবকদের হত্যা করা, নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠন করা, শিশুদের রক্ত ঝরানো, মূল্যবান খনিজ সম্পদ লুটে নেওয়া—এগুলো পশ্চিমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য। এজন্য তারা কখনোই কোনো দেশে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না, যারা তাদের দখলদারিত্বের বিরোধিতা করবে আর নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য জিহাদ পরিচালনা করবে। অথচ এ ব্যাপারে আলিমদের ইজমা (ঐকমত্য) রয়েছে যে, যখন কাফিররা কোনো মুসলিম দেশে আক্রমন করে তখন ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে সারা বিশ্বের মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরজ হয়ে যায়।
আমাদের এসব ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না :
ক. ইসলামের চিরশত্রু ইহুদি-খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক ক্রুসেড যুদ্ধ চালিয়েছে, মুসলিমদের প্রথম কিবলা বাইতুল মাকদিস দখল করে রেখেছে, ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালিয়ে স্পেন থেকে ইসলাম ও মুসলিমদের নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে দিয়েছে।
খ. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া মিলে মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তির কেন্দ্র তুরস্কের খিলাফাহব্যবস্থা ধ্বংস করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড করেছে। কামাল আতার্তুর্ক নামক গাদ্দারের মাধ্যমে পশ্চিমারা সে সময় কার্যত তুরস্কে ইসলামকেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।
১৯২৪ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তি (Lausanne Treaty) স্বাক্ষর হওয়ার পর হাউস অফ কমন্সে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড কার্জন ঘোষণা দিয়েছিল যে, মূল বিষয় হচ্ছে তুরস্ক ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এটি আর কোনোদিনও মাথা তুলে দাঁড়াবে না। কারণ, আমরা তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি ধ্বংস করে দিয়েছি। আর তা হলো খিলাফত এবং ইসলাম।’ অনুরূপ বাইতুল মাকদিসে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ জেনারেল অ্যালেনবি ঘোষণা করেছিল, ‘আজ ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটল।’
আর দামেস্ক দখল করে নেওয়ার পর ফরাসি জেনারেল গরো ((Gourou) তড়িৎগতিতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রাহিমাহুল্লাহ এর সমাধিস্থলে প্রবেশ করে তার কবরে লাথি মেরে বলেছিল, ‘ওঠো সালাহউদ্দিন, আমরা আবার ফিরে এসেছি।’ বস্তুত খিলাফত ধ্বংসের পর পশ্চিমাদের উল্লাসের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।
গ. ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার চেষ্টার জন্য এবং আংশিকভাবে মুজাহিদদের সাহায্য করার জন্য এরাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছিল।
ঘ. এরাই সৌদি বাদশাহ ফয়সালকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করেছে। বাদশাহ ফয়সালের অপরাধ ছিলো, তিনি আমেরিকার মিত্র ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন, মুসলিমদের প্রথম কিবলা বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন এবং পশ্চিমাদের কাছে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
ঙ. মুসলিমদের পবিত্র ভূমিতে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হলে শহিদ হাসান আল বান্না যখন দেখলেন, তাঁর চোখের সামনে ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করা হচ্ছে, তখন তিনি দশ হাজার মুজাহিদ নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে চাইলেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার তিন রাষ্ট্রদূত বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্তপত্র মিশরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। এর দুই মাস পর মিশরের রাজা ফারুকের সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান মাহমুদ আব্দুল মাজিদ শহরের সবচেয়ে বড় রাস্তায় শহিদ হাসান আল বান্নাকে হত্যার চেষ্টা করে। এতে তিনি আহত হন। এরপর তাকে সেখানে থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তখন রাজা ফারুকের আরেক ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা মুহাম্মাদ ওয়াসফি পুনরায় হাসান আল বান্নাকে গুলি করে সেখানেই শহিদ করে দেয়।
দ্বাদশ কারণ :
একথা কারও অজানা নয় যে, আধুনিক কালে নির্বাচন মানেই লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি টাকার ছড়াছড়ি। মিছিল, মিটিং, মাইকিং, পোস্টারিং ইত্যাদিতে কে কাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সবসময় তারই প্রতিযোগিতা চলে। একগাদা ভাড়া করা ক্যানভাসার যোগাড় করা হয়। কোথাও কোথাও তো অসভ্য নর্তকী আর গায়িকাদেরও ভাড়া করা হয়। এসব ক্যানভাসারদের কাজই হলো, জোর গলায় নিজের নেতার চরিত্রকে ‘ফুলের মতো পবিত্র‘ বলে দাবি করা আর যে কোনোভাবে প্রতিপক্ষের নামে দুর্নাম ও কুৎসা রটনা করা। একগাদা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সুযোগ পেলে আকাশের চাঁদ হাতে এনে দেওয়ার গল্পও বাদ দেওয়া হয় না।
ভোটারদের মনোরঞ্জনের জন্য ক্ষণেক্ষণে পান, তামাক, চা, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা, মদ, গাঁজা ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়। এমনকি প্রয়োজনে নগদ টাকা-পয়সা দিয়েও ভোট কেনা হয়। যে এই কাজ যত বেশি করতে পারবে সে তত বেশি সফল। একজন ইসলামপন্থী না নিজের মিথ্যা গুণগান গাওয়ার জন্য লোক ভাড়া করতে পারে, না অন্যের নামে মিথ্যা বদনাম রটনা করতে পারে, না মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে পারে, না তরুণদের হাতে মদের বোতল আর বৃদ্ধদের হাতে হুক্কার ডিব্বা ধরিয়ে দিতে পারে, না সে দুর্নীতিবাজদের মতো ক্যানভাসে লাখ লাখ টাকা অপচয় করতে পারে, না সে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ভোট কেনার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে। এসব যদি সে না-ই পারে তাহলে এই গুনাহের প্রতিযোগিতায় তার কোনো স্থান নেই। কেননা, তথাকথিত নীতি-নৈতিকতার বুলি তো কত আগেই নগদ টাকা-পয়সা আর বিড়ি সিগারেটের গন্ধে কর্পুরের মতো উবে গেছে। আর যদি কোনো ইসলামি দল অন্যদের মতো নিজেরাও এসব করা শুরু করে তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে ইসলামি আদর্শ-চরিত্রের ছিঁটেফোঁটাও আর বাকি নেই। জনপ্রিয়তা অর্জনের স্রোতে গা ভাসিয়ে সব ধুয়েমুছে একেবারে সাফ হয়ে গেছে।
সহিহ বুখারিতে আবু মুসা আল-আশআরি রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন :
دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا وَرَجُلاَنِ مِنْ قَوْمِي، فَقَالَ أَحَدُ الرَّجُلَيْنِ: أَمِّرْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَقَالَ الآخَرُ مِثْلَهُ، فَقَالَ: إِنَّا لاَ نُوَلِّي هَذَا مَنْ سَأَلَهُ، وَلاَ مَنْ حَرَصَ عَلَيْهِ.
‘আমি ও আমার গোত্রের দু’ব্যক্তি নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আসলাম। সে দু’জনের একজন বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে (কোনো বিষয়ে) আমীর নিযুক্ত করুন। দ্বিতীয়জনও অনুরূপ কথা বলল। তখন তিনি বললেন, আমরা এরূপ ব্যক্তিকে কোনো পদে মনোনীত করি না, যে তার প্রার্থী হয় এবং পদের প্রতি লালায়িত হয়।’ [সহিহুল বুখারি : ৯/৬৪, হাদিস নং ৭১৪৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত]
ত্রিয়োদশ কারণ :
গণতন্ত্রের মাধ্যমে একটা ইসলামি দল যদি কোনোভাবে ভাগ্যক্রমে ক্ষমতায় চলেও আসে তবুও তারা দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। দূর ও নিকট ইতিহাসের বাস্তবতা এটাই বলে। একবার যদি কোনোমতে পাঁচ বছরের মেয়াদ পার করতে পারেও, কিন্তু এর পরের ইলেকশনে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সবচেয়ে ভালো শাসনেও জনগণের মাঝে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’—টাইপের অনুভূতি কাজ করতে পারে। ফলে আবারও দেশ পরিচালিত হবে কুফরি আদর্শ ও আগের মূলনীতিতে। এভাবে পাঁচ বছর ইসলাম আর পাঁচ বছর কুফর—এই অবস্থা তো আমাদের আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে তৎকালীন কাফিরদের সেই প্রস্তাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘আপনি এক বছর আমাদের (বাতিল) ইলাহগুলোর ইবাদত করুর, আমরাও পরের বছর আপনার (সত্য) ইলাহের ইবাদত করব।’ এরপর আল্লাহ তাআলা সুরা কাফিরুন অবতীর্ণ করে মুসলিম জাতিকে কী কঠিন বার্তা দিয়েছিলেন, তা কুরআনের পাঠক হিসেবে আমাদের সবারই জানা।
চতুর্দশ কারণ :
অষ্টম কারণ বর্ণনায় সহিহ মুসলিমের একটি হাদিসের উদ্ধৃতিতে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিশ্রুতি জেনেছি যে, ‘অচিরেই তোমাদের হাতে অনেক ভূখণ্ড বিজিত হবে এবং (শত্রুদের মোকাবেলায়) আল্লাহই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবেন।’ এরপর তিনি মুসলিমদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, ‘এতদসত্ত্বেও তোমাদের কেউ যেন তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ ছেড়ে না দেয়।’ এত্থেকে আমরা কী ইঙ্গিত পাই, তা বিবেকবানদের ব্যাখ্যা করে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। যেখানে মুসলিমদের বিজয়ী হওয়ার সময়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের তীর-তলোয়ার রেখে দিয়ে উদাসীন হতে নিষেধ করেছেন, সেখানে মুসলিমদের পতনের কালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশনা ভুলে আমরা যদি কাফিরদের দেখানো আদর্শে পথ চলি, তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিজয়ী হওয়ার পর আমরা যখন ইসলামি আইন-কানুন বাস্তবায়িত করতে যাব তখন কি সামরিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছাড়া তা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয়? বস্তুত দিনশেষে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চিন্তা করলে কাফিরদের সাথে সংঘাত অনিবার্য। সেটা আগে বুঝে সে অনুসারে মুসলিমদের প্রস্তুতি নিতে না বলে যদি আমরা নিজেরাই তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে চলি তাহলে এটা কি মারাত্মক একটি ভুল নয়? বস্তুত কাফিরদের প্রণীত কথিত ভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে পৃথিবীতে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার মতো আমূল পরিবর্তন আসবে বলে বিশ্বাস করাটা সুস্পষ্ট বোকামি ও দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
পঞ্চদশ কারণ :
দ্বীনকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী করার জন্য প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী জিহাদ পরিচালনা করবে। কারণ, ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জন্য নয়; বরং সমগ্র পৃথিবীর জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। যদি মুসলিমরা অক্ষম না হয় এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধবিরতির কোনো চুক্তি না থাকে, তাহলে ইসলামি রাষ্ট্রকে পার্শ্ববর্তী কুফরি রাষ্ট্রে আক্রমন চালাতে হবে এবং তাদেরকে হয় ইসলাম, নয় জিজিয়া, নয় যুদ্ধের নীতিতে আহবান জানাতে হবে। এই জিহাদকে ‘জিহাদুত তলব’ বলা হয়। প্রত্যেক বছরে কমপক্ষে একবার এই ধরনের আক্রমন পরিচালনা করতে হবে। কখনো প্রয়োজন হলে একবারের বেশিও করা আবশ্যক হয়ে যায়।
ইমাম ইবনু কুদামা রাহিমাহুল্লাহ বলেন :
وَأَقَلُّ مَا يُفْعَلُ مَرَّةً فِي كُلِّ عَامٍ؛ لِأَنَّ الْجِزْيَةَ تَجِبُ عَلَى أَهْلِ الذِّمَّةِ فِي كُلِّ عَامٍ، وَهِيَ بَدَلٌ عَنْ النُّصْرَةِ، فَكَذَلِكَ مُبْدَلُهَا وَهُوَ الْجِهَادُ، فَيَجِبُ فِي كُلِّ عَامٍ مَرَّةً، إلَّا مِنْ عُذْرٍ... وَإِنْ دَعَتْ الْحَاجَةُ إلَى الْقِتَالِ فِي عَامٍ أَكْثَرَ مِنْ مَرَّةٍ وَجَبَ ذَلِكَ؛ لِأَنَّهُ فَرْضُ كِفَايَةٍ، فَوَجَبَ مِنْهُ مَا دَعَتْ الْحَاجَةُ إلَيْهِ.
‘বছরে সর্বনিম্ন একবার জিহাদ করা আবশ্যক। কেননা, প্রত্যেক বছর জিম্মিদের ওপর একবার জিজিয়া আবশ্যক হয়। আর এটা হলো তাদেরকে নুসরাত বা সাহায্য-সহযোগিতার বিনিময়। অতএব, বিনিময়কৃত বস্তু তথা জিহাদও অনুরূপ হওয়া চাই। তাই প্রত্যেক বছর একবার জিহাদ ফরজ। তবে বিশেষ কোনো অপারগতা থাকলে ভিন্ন কথা। ...আর যদি এক বছরে একবারের বেশি জিহাদ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে তাও আবশ্যক হয়ে পড়বে। কেননা, এটা ফরজে কিফায়া। সুতরাং প্রয়োজন হলেই তা আবশ্যক হয়ে যাবে।’ [আল-মুগনি : ৯/১৯৮, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল কাহিরা, মিশর]
ইমাম ইবনু কাসির রাহিমাহুল্লাহ সুরা তাওবার ১২৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
وَقَالَ قَتَادَةُ (يُخْتَبَرُونَ) بِالْغَزْوِ فِي السَّنَةِ مَرَّةً أَوْ مَرَّتَيْنِ.
‘কাতাদা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, তাদেরকে (কাফিরদেরকে) বছরে একবার বা দুবার যুদ্ধের মাধ্যমে বিপদের সম্মুখীন করা হবে।’ [তাফসিরু ইবনি কাসির : ৪/২১০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত]
কাজেই ইসলামের দুশমন তাগুত ও তাদের দোসররা কখনোই নিছক কিছু টিপসই দিয়ে এরূপ রাষ্ট্র হতে দেবে না, যা তাদের অস্তিত্বকেই হুমকির সম্মুখীন করবে। এটা ততদিন পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতদিন না সুঁইয়ের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। তাই এসব বিজাতীয় পদ্ধতির অনুসরণ বাদ দিয়ে আমাদেরকে ফিরতে হবে সেই নববি পদ্ধতিতে, যে পদ্ধতি অবলম্বন করে সাহাবায়ে কিরামের ক্ষুদ্রতম এক জামাত তৎকালীন পরাশক্তি রোম ও পারস্যের গর্ব ধুলোয় মিশিয়ে সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সারকথা :
আশা করি, উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কখনোই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এদ্বারা না উম্মাহর ক্ষতের উপশম হবে, আর না হারিয়ে যাওয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। বস্তুত গণতন্ত্র হলো একটি ফাঁদ, একটি ধোঁকা ও একটি প্রতারণার জাল। এতসব বাস্তবতা জানার পরও, এতসব অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরও কেন যে মানুষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি খুঁজতে চায়! একসময় কিছুটা অস্পষ্টতা থাকলেও আজ দিবালোকের ন্যায় সব স্পষ্ট হওয়ার পরও এই গণতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরে রাখার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। যারা এখনও বিষয়টি বুঝছেন না বা বুঝার চেষ্টা করছেন না, তাদের জন্য আমরা কেবল একটি দুআই করি- ‘হে আল্লাহ, আপনি সত্য উপলব্ধির জন্যে আমাদের অন্তরসমূহ উন্মুক্ত করে দিন, সঠিক বাস্তবতা বুঝার জন্য আমাদের বক্ষকে প্রসারিত করে দিন। সর্বশেষ একটি মনে রাখবেন, মুমিন একবার দংশিত হওয়ার পর সাপের গর্তে দ্বিতীয়বার হাত দেয় না। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
لاَ يُلْدَغُ المُؤْمِنُ مِنْ جُحْرٍ وَاحِدٍ مَرَّتَيْنِ.
‘মুমিন একই গর্ত থেকে দুবার দংশিত হয় না।’ [সহিহ বুখারি : ৮/৩১, হাদিস নং ৬১৩৩, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত]
চলবে ইনশাআল্লাহ...
✍️
Collected
Comment