আমেরিকার সাথে তালিবানদের চুক্তি : আমেরিকার বিদায় এবং তালিবানের বিজয়
আফগানিস্তানে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরের অধিক সময় ধরে যুদ্ধ করার পর সামরিক শক্তির বিচারে এই গ্রহের সবচেয়ে শক্তির দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নিতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধত মস্তক গত ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে চির অবনত হয়েছে। দোহায় আমেরিকার প্রতিনিধিদলের প্রধান জালমে খলিলজাদের মলিন মুখে আমেরিকার পরাজয়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে।
আমেরিকা তার পরাজয়ের মুখ ঢাকতে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান তথা তালিবানের সাথে যে চুক্তি করেছে, তা আমেরিকার জন্য কতটা পরাজয় বহন করে একটু চোখ বুলালেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে।
“Agreement for Bringing Peace to Afghanistan” অর্থাৎ “আফগানিস্তানে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে চুক্তি” শিরোনামে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানের মাঝে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই যতবার এই চুক্তিতে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান শব্দটি এসেছে ততবারই লেখা হয়েছে, Islamic Emirate of Afghanistan which is not recognized by the United States as a state and is known as the Taliban
অর্থাৎ “ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নয় এবং তালিবান হিসেবে পরিচিত”
কী আছে সেই চুক্তিতে ?
এই চুক্তিতে ৩টি ভাগে ৪টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে:
১। আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা ও পদ্ধতি
২। আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগান ভূমিকে ব্যবহার করতে না দেওয়া সংক্রান্ত বিবরণ
৩। আফগানিস্তানের বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা ও তার দিনক্ষণ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিবরণ
৪। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপরিচালনার ধরণ বিষয়ক আলোচনাকে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা ।
এই চারটি বিষয়ের প্রথম দু’টি বিষয়ের বাস্তবায়নকে শেষ দু’টি বিষয়ের পথ তৈরির শর্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩ ভাগে বিভক্ত এই চুক্তিনামাটি একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক-
১ম ভাগ:
১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা, ন্যাটো জোট এবং বিদেশী সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। আমেরিকার সকল সামরিক,বেসামরিক সৈন্য-কর্মকর্তা, সকল গোয়েন্দা সদস্য আফগানিস্তান ত্যাগ করবে।
আগামী সাড়ে ৩ মাস অর্থাৎ ১০৫ দিনের মধ্যে আমেরিকার বর্তমান ১৪ হাজার সৈন্য কমিয়ে ৮৬০০ তে নিয়ে আসবে। একইভাবে আনুপাতিকহারে ন্যাটোর প্রায় ১৭০০০ হাজার সৈন্যও কমিয়ে ফেলা হবে। এই সাড়ে ৩ মাসের মধ্যে আমেরিকা তার বৃহৎ ৫ টি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দিবে।
চুক্তি বাস্তবায়নে আস্থার অংশ হিসেবে আগামী ১০ মার্চের মধ্যে আমেরিকা ও আফগান দালাল সরকারের হাতে বন্দী ৫০০০ (পাঁচ হাজার) তালিবান সদস্য ও সমর্থক বন্দীকে মুক্তি দিবে। বিপরীতে তালিবানরা তাদের হাতে বন্দী ১০০০ (এক হাজার) দালাল সেনাকে মুক্তি দিবে।
চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আগামী ২৯ মে ২০২০ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা অপসারণের লক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর সাথে সাথেই অফিসিয়াল কার্যক্রম আরম্ভ করবে।
এছাড়া ২৭ আগস্ট ২০২০ তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তালিবান নেতৃবৃন্দের উপর নিষেধাজ্ঞা ও হত্যার পুরষ্কার সংক্রান্ত ঘোষণা অপসারণ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার বর্তমান নিষেধাজ্ঞা ও পুরষ্কার তালিকা পর্যালোচনার প্রশাসনিক কার্যক্রম আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর সাথে সাথেই আরম্ভ করবে।
চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আফগানিস্তানের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো ধরণের হুমকি প্রদান কিংবা শক্তিপ্রয়োগ অথবা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।
২য় ভাগ:
এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে হুমকি প্রদর্শন কিংবা হামলার লক্ষ্যে তার কোনো সদস্য কিংবা আল কায়েদাসহ যেকোনো দলের কোনো সদস্যকে আফগান ভূমিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিবে না।
চুক্তির এই অংশে আরো উল্লেখ আছে, ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিষ্কার বার্তা দিবে যে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে হুমকি এমন ব্যক্তিদের আফগানিস্তানে কোনো স্থান নেই এবং ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান তার সকল সদস্যকে এই মর্মে নির্দেশনা দিবে যে, যারা আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয় এমন কোনো ব্যক্তি বা দলকে যেনো সহায়তা না করে।
অত্র চুক্তির আলোকে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তি ও দলকে আফগানিস্তানে তাদের সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অর্থ সংগ্রহ থেকে বাঁধা প্রদান করবে।
ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আশ্রয়প্রার্থী ও নাগরিকত্বের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, যাতে এই চুক্তির আলোকে আফগানিস্তানে এমন কোনো ব্যক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি হয়ে উঠতে না পারে।
ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি হয় এমন কোনো ব্যক্তিকে আফগানিস্তানের ভিসা, পাসপোর্ট, ভ্রমণের অনুমতি কিংবা বৈধ কাগজপত্র প্রদান করবে না।
৩য় ভাগ:
চুক্তির এই অংশে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটি জাতিসংঘে স্বীকৃতি ও সত্ত্বায়নের জন্য অনুরোধ করবে।
এছাড়া আরো বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবানদের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রত্যাশা করবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রত্যাশাও করে যে, আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মীমাংসা পরবর্তী গঠিত আফগান ইসলামি সরকারের সাথে আমেরিকার ইতিবাচক সম্পর্ক থাকবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মীমাংসা পরবর্তী গঠিত আফগান ইসলামি সরকারের সাথে ইতিবাচক অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
চুক্তির পর্যালোচনা:
তালিবান কী পেলো, কী ছাড়লো ?
তালিবানদের সর্বপ্রথম দাবি হচ্ছে, আমেরিকার সকল সৈন্য আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে হবে। চুক্তি ঠিক থাকলে ১৪ মাসের মধ্যে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে আশা করা যায়। ফলে তালিবানের এই দাবি পূরণ হতে চলেছে।
অতঃপর তালিবানদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, আফগানিস্তান হবে একটি পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র, যেখানে ইসলামের সকল বিধান পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে। চুক্তিনামার ৩য় ভাগে আমেরিকা ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। ফলে তালিবানদের এই আকাঙ্ক্ষাও বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
চুক্তির একটা বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। চুক্তিতে আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার কোথাও আফগান দালাল সরকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তালিবানরা দালাল সরকারকে কোনো পক্ষ মনে করে না। পক্ষ মনে করে আমেরিকাকে, যা তালিবানরা বহুবার তাদের বার্তায় উল্লেখ করেছেন। ফলে আন্তঃআফগান সংলাপ বলতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পক্ষকে বুঝানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে দালাল সরকারও এই সংলাপে থাকবে।
তালিবান যে জায়গাটিতে ছাড় দিয়েছে তা হচ্ছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আল কায়েদা ও অন্যান্য মুজাহিদ দলকে আফগান ভূমি থেকে আমেরিকা ও আমেরিকার মিত্রদের উপর হামলা করার সুযোগ দিবে না। অথচ আল কায়েদা তালিবানের আমিরের হাতে বাই’আতপ্রাপ্ত একটি গ্লোবাল জিহাদি সংগঠন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো ? এবিষয়ে আলোচনা পরে আসছে ইনশাআল্লাহ্*।
তালিবান আমেরিকার সাথে কেনো এই চুক্তি করতে গেলো ?
এই প্রশ্ন অনেকেরই ! আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে করুণ অবস্থায় আছে এবং আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, এমন মুহুর্তে তালিবানরা কেনো চুক্তি করতে গেলো ?
তালিবানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমেরিকাকে আফগানিস্তান থেকে বের করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, আর এই চুক্তির মাধ্যমে যেহেতু তাদের সেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তাই ইসলামি ইসলামি ইমারত ইসলামি শরিয়তের বিধানের আলোকেই এই চুক্তিটি সম্পাদন করেছেন।
চুক্তি না করলে যা হতে পারতো
আমেরিকার বিগত কয়েক বছরের পরিকল্পনার আলোকে বুঝা যায়, আমেরিকা আফগানিস্তানে সরাসরি যুদ্ধ করার খায়েশ পরিত্যাগ করেছে। তারা এখন দালাল বাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধ করাচ্ছে। এই চুক্তি সম্পাদন না হলে আমেরিকা হয়তো এভাবে আফগানিস্তান ত্যাগ করতো না। তার দালাল বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা এবং বিমান হামলার মাধ্যমে এই যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। ইতোমধ্যে সে তার সৈন্যদের জীবন রক্ষার্থে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে অস্ত্র-অর্থ সহযোগিতার মাধ্যমে দালাল বাহিনী তৈরি করে মুসলিমদেরকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রেখেছে, একইভাবে আফগানিস্তানেও সেই পরিকল্পনাকে আরো দীর্ঘায়িত করতো। এমনকি আমেরিকা আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা তীব্রতর করে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে রাখতো, ফলে আফগানরা কখনোই শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারতো না।
যদি এ চুক্তির মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তান ইসলামের বিধানের আলোকে পরিচালিত হয় এবং আমেরিকা সবধরণের হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে, তাহলে এতে আফগানিস্তানের মুসলিমদের জন্য অধিক কল্যাণ রয়েছে বলে আশা করা যায়।
আমেরিকা কী পেলো, কী ছাড়লো ?
আমেরিকার পাওনা যদি বলা হয়, তাহলে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। কেননা আমেরিকা আফগানিস্তানে এসেছিল তালিবানকে নির্মূল করে তার বহু আকাঙ্খিত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে। আমেরিকা তার এই দুই প্রধান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর তালিবানের সাথে তার এই চুক্তি এবং ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আমেরিকার আফগান আক্রমণের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।
আমেরিকা কেনো এতো বড় ছাড় দিতে গেলো ? এর কারণ হচ্ছে, আমেরিকা আফগানিস্তানে দীর্ঘ ১৮ বছরের অধিক সময়ের যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা থেকে বের হওয়ার জন্য আমেরিকার সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। একটি হচ্ছে, রাতের আঁধারে আফগানিস্তান থেকে পলায়ন করা। আরেকটি হচ্ছে, তালিবানদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পাততাড়ি গুটানো।
আমেরিকা চিন্তা করে দেখলো, তালিবানের মৌলিক প্রায় সব দাবি মেনে নিয়ে একটা চুক্তির মাধ্যমে চলে যাওয়াই মুখ রক্ষার জন্য অধিকতর সহায়ক। ফলে তারা এই পথই বেছে নিয়েছে।
আমেরিকা যদি তার প্রাপ্তির তালিকায় একটি বিষয় দেখাতে চায়, তবে তা দেখাতে পারে। আর সেটি হচ্ছে, আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি সংগঠনকে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের উপর হামলা করার সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
আমেরিকা মুখ রক্ষার জন্য এটি বলতে পারে যে, আফগানিস্তানে তাদের আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ছিল আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি দলকে আমেরিকার বিরুদ্ধে হামলা করা বন্ধ করা। এখন চুক্তির মাধ্যমে এটি তারা করতেও পেরেছে !
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিগত ১৮ বছরে তালিবানদের সহায়তায় আল কায়েদা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশে আল কায়েদা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে মালি, মৌরতানিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রে আল কায়েদা প্রকাশ্যে অবস্থান করছে এবং অনেক দেশে বিস্তীর্ণ ভূমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে ইসলামি শরি’আহ অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ফলে আমেরিকা এখন ২০০১ সালের চেয়ে অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এবং ২০০১ সালের তুলনায় আমেরিকার শত্রু আল কায়েদা এখন বহু বিস্তৃত ও বহুগুণ শক্তিশালী হয়েছে। আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখার নির্দেশনায় গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পেনসাকোলাতে আমেরিকান নৌঘাঁটিতে হামলায় অনেক মার্কিন সৈন্যকে হতাহত করার ঘটনা প্রমাণ করে, আফগানিস্তান ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশ থেকে আল কায়েদার মুজাহিদগণ আমেরিকার হৃদপিণ্ডে হামলার মতো সফল অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম।
তালিবান, আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে:
আমরা জানি যে, আল কায়েদা আফগান তালিবানের কাছে বাই’আতবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক জিহাদি জামা’আত। আল কায়েদার জন্ম থেকে শুরু করে টুইনটাওয়ার হামলা এবং এখন পর্যন্ত আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদে আল কায়েদার জন্য তালিবানরা একধরণের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন। এই চুক্তির আলোকে যেহেতু তালিবানরা এখন আর তাদের ভূমিকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিবে না, তাহলে সেসব জিহাদি জামা’আতের অপারেশনের কী হবে ?
এই চুক্তির কোথাও বলা হয়নি যে, তালিবানরা আল কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। একথাও বলা হয়নি যে, তালিবানরা পৃথিবীর আর কোথাও জিহাদ করবে না বা মুজাহিদদের সহায়তা করবে না। বরং এটি শুধু আফগানিস্তানের জন্য বলা হয়েছে। আফগানিস্তানের ভূমি যেমন আমেরিকার বিরুদ্ধে হামলায় ব্যবহৃত হবে না, তেমনি আমেরিকাও আফগানিস্তানে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ করবে না।
আল কায়েদা ছাড়াও আফগানিস্তানে পূর্ব তুর্কিস্তানের (চীনের দখলকৃত জিনজিয়াং) আল হিজবুল ইসলামি আত-তুর্কিস্তানি এবং পাকিস্তানের জিহাদী জামাআত তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) অবস্থান করে তালিবানের অধীনেই জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। তালিবানরা কারো সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেননি।
তালিবানদের ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তারা দুনিয়ার জিহাদি জামা’আতগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বরং চুক্তি রক্ষা করেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাবে ইনশাআল্লাহ্*।
ইতোমধ্যে অন্যান্য জামা’আতের যেসব মুজাহিদিন আফগানিস্তানে আছেন, তাদেরকে তালিবানরা নিশ্চয়ই ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের মুজাহিদদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। যেহেতু তারা ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের অধীনেই জিহাদ করছেন।
এখানে একটি বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেই, বিগত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে আমেরিকার সাথে আলোচনা শুরুর পর থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমারা যখনই আফগানিস্তানে আল কায়েদা ও তুর্কিস্তানের মুজাহিদদের অবস্থান এবং তালিবানদের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহায়তার অভিযোগ করেছে , তখনই তালিবানরা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের সৈন্য ব্যতীত অন্য কেউ নেই। অথচ ২০১৮ সালেও আল হিজবুল ইসলামি আত-তুর্কিস্তানি নিজেদের ব্যানারে অফিসিয়াল মিডিয়ার মাধ্যমে আফগানিস্তানে জিহাদের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল।
তার মানে কী দাঁড়ালো ! আফগানিস্তানে থাকা আল কায়েদা ও তুর্কিস্তানের মুজাহিদদেরকে তালিবানরা ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের অংশ মনে করে।
চুক্তির ফলাফল, তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ:
আমেরিকা তালিবানকে ধ্বংস ও গণতন্ত্র কায়েম করার যে ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ মনোবাসনা নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল, এখন সেই চরমশত্রু তালিবানকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান এবং সকল সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়ে আমেরিকা তার অপূরণীয় মনোবাঞ্ছা ত্যাগ করেছে । দীর্ঘ ১৮ বছরেরও অধিক সময়ের যুদ্ধে আমেরিকার হাজার হাজার সৈন্য হতাহতের মাধ্যমে আমেরিকার সেনাবাহিনির মধ্যে এক চরম যুদ্ধভীতির সঞ্চার হয়েছে। অপরদিকে বিগত ১৮ বছরে শুধুমাত্র আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে *৯৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। * (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনসটিটিউট পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী)
এই বিপুল সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে, যা পরাশক্তি আমেরিকার জন্য এক চরম শিক্ষা। আফগানের এই শিক্ষা ভবিষ্যতে যেকোনো মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালানোর পূর্বে আমেরিকা হাজার বার তার পরিণতি চিন্তা করতে বাধ্য হবে।
চুক্তির পূর্ণ ফলাফল দেখার জন্য আমাদেরকে আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু তালিবানরা ইসলামি শাসনব্যবস্থা ব্যতীত গণতন্ত্র কিংবা অন্যকিছুকে মেনে নিবে না, ফলে কাবুলের দখলে থাকা দালাল সরকারের সাথে তালিবানদের ফায়সালার বিষয়টির উপর হয়তো এই চুক্তিটি অনেকাংশে নির্ভর করছে। যদি দালাল সরকার ইসলামি শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়ে সরে না দাঁড়ায়, তাহলে তালিবানদের সামনে যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোনো পথ থাকবে না এই আগাছাকে সরানোর জন্য। সেক্ষেত্রে আমেরিকা তার গোলামদেরকে রক্ষার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয় তার উপর এই চুক্তিটির কার্যকারিতা নির্ভর করছে। যদি চুক্তির আলোকে সেসময় আমেরিকা দর্শকের ভূমিকা পালন করে তাহলে হয়তো চুক্তি বহাল থাকবে আছে, কিন্তু যদি হস্তক্ষেপ করে বা দালালদেরকে সহায়তা করে তাহলে চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
এই চুক্তিটির দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি করা যায় যে, মূলত: এই চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা আফগানিস্তানের দায়িত্বভার তালিবানদের আয়ত্ত্বে দিয়ে দিয়েছে। কারণ, ভিসা, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বও তালিবানদের হাতে ধরে নিয়ে চুক্তির বিভিন্ন ধারা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এসবের মাধ্যমে আমেরিকা তালিবানদেরকে প্রকারান্তরে আফগানিস্তান পরিচালনার অধিকারী হিসেবে একদম লিখিতভাবেই মেনে নিয়েছে।
চুক্তিটির আরেকটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করি। আর তা হচ্ছে, এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন হওয়ার মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানে ইসলামি শরি’আহ ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এবং তা স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকলে মুসলিম বিশ্বে এর বিরাট প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ নিয়ে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর একটি ঐতিহাসিক উক্তি উল্লেখ করতে চাই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে আফগানদের কিছু প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম উল্লেখ করে সেই জিহাদকে ছোট করার চেষ্টা করলে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. উক্ত ব্যক্তিদেরকে অদূরদর্শী আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, আফগান জিহাদের প্রভাব পুরো দুনিয়াজুড়ে পড়বে এবং এই জিহাদের মাধ্যমে আবার সারা দুনিয়াতে জিহাদ ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ্*। (শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর তাফসিরে সূরাহ তাওবার ১ম খণ্ডে ৭৩ ও ৭৪ পৃষ্ঠায় এই অসাধারণ কথাগুলো আরো বিস্তৃতভাবে রয়েছে।)
শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর সেই কথাগুলো পরবর্তীতে সত্যে পরিণত হয়েছিল। রাশিয়া বিরোধী আফগান জিহাদের প্রভাবে আজকের এই গ্লোবাল জিহাদ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে আলহামদুলিল্লাহ্*।
ঠিক তেমনিভাবে আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এর ইতিবাচক প্রভাব পুরো মুসলিম বিশ্বে পড়বে ইনশাআল্লাহ্*। মুসলিমরা তখন খুব সহজেই সত্যিকারের ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ত্বগুতি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বের হয়ে ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তালিবানদের অনুসরণে ইসলামের বিধান জিহাদের পথ অবলম্বন করার অনুপ্রেরণা পাবে বলে আশা করি।
আল্লাহ তা’আলা এই চুক্তিকে ইসলাম এবং আফগানিস্তান ও সারা দুনিয়ার মুসলিমদের বিজয়ের পথে একটি মাইলফলক বানিয়ে দিন এবং ইসলামের দুশমনদের সকল চক্রান্ত মোকাবেলা করে আমাদেরকেও আল্লাহর শরি’আহ বাস্তবায়নের তাউফিক্ব দান করুন।
লেখক: উস্তায আবু হামজা হাফিজাহুল্লাহ, ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক গবেষক।
ডাউনলোড করুন:
PDF
docx
আফগানিস্তানে দীর্ঘ প্রায় ১৮ বছরের অধিক সময় ধরে যুদ্ধ করার পর সামরিক শক্তির বিচারে এই গ্রহের সবচেয়ে শক্তির দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নিতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ধত মস্তক গত ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের রাজধানী দোহায় শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে চির অবনত হয়েছে। দোহায় আমেরিকার প্রতিনিধিদলের প্রধান জালমে খলিলজাদের মলিন মুখে আমেরিকার পরাজয়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে।
আমেরিকা তার পরাজয়ের মুখ ঢাকতে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান তথা তালিবানের সাথে যে চুক্তি করেছে, তা আমেরিকার জন্য কতটা পরাজয় বহন করে একটু চোখ বুলালেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে।
“Agreement for Bringing Peace to Afghanistan” অর্থাৎ “আফগানিস্তানে শান্তি আনয়নের লক্ষ্যে চুক্তি” শিরোনামে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানের মাঝে। অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয় হচ্ছে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি ইমারত আফগানিস্তানকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, তাই যতবার এই চুক্তিতে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান শব্দটি এসেছে ততবারই লেখা হয়েছে, Islamic Emirate of Afghanistan which is not recognized by the United States as a state and is known as the Taliban
অর্থাৎ “ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নয় এবং তালিবান হিসেবে পরিচিত”
কী আছে সেই চুক্তিতে ?
এই চুক্তিতে ৩টি ভাগে ৪টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে:
১। আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা ও পদ্ধতি
২। আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে আফগান ভূমিকে ব্যবহার করতে না দেওয়া সংক্রান্ত বিবরণ
৩। আফগানিস্তানের বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনা ও তার দিনক্ষণ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিবরণ
৪। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপরিচালনার ধরণ বিষয়ক আলোচনাকে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা ।
এই চারটি বিষয়ের প্রথম দু’টি বিষয়ের বাস্তবায়নকে শেষ দু’টি বিষয়ের পথ তৈরির শর্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
৩ ভাগে বিভক্ত এই চুক্তিনামাটি একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক-
১ম ভাগ:
১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা, ন্যাটো জোট এবং বিদেশী সকল সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। আমেরিকার সকল সামরিক,বেসামরিক সৈন্য-কর্মকর্তা, সকল গোয়েন্দা সদস্য আফগানিস্তান ত্যাগ করবে।
আগামী সাড়ে ৩ মাস অর্থাৎ ১০৫ দিনের মধ্যে আমেরিকার বর্তমান ১৪ হাজার সৈন্য কমিয়ে ৮৬০০ তে নিয়ে আসবে। একইভাবে আনুপাতিকহারে ন্যাটোর প্রায় ১৭০০০ হাজার সৈন্যও কমিয়ে ফেলা হবে। এই সাড়ে ৩ মাসের মধ্যে আমেরিকা তার বৃহৎ ৫ টি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দিবে।
চুক্তি বাস্তবায়নে আস্থার অংশ হিসেবে আগামী ১০ মার্চের মধ্যে আমেরিকা ও আফগান দালাল সরকারের হাতে বন্দী ৫০০০ (পাঁচ হাজার) তালিবান সদস্য ও সমর্থক বন্দীকে মুক্তি দিবে। বিপরীতে তালিবানরা তাদের হাতে বন্দী ১০০০ (এক হাজার) দালাল সেনাকে মুক্তি দিবে।
চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আগামী ২৯ মে ২০২০ এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞা অপসারণের লক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর সাথে সাথেই অফিসিয়াল কার্যক্রম আরম্ভ করবে।
এছাড়া ২৭ আগস্ট ২০২০ তারিখের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তালিবান নেতৃবৃন্দের উপর নিষেধাজ্ঞা ও হত্যার পুরষ্কার সংক্রান্ত ঘোষণা অপসারণ করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার বর্তমান নিষেধাজ্ঞা ও পুরষ্কার তালিকা পর্যালোচনার প্রশাসনিক কার্যক্রম আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর সাথে সাথেই আরম্ভ করবে।
চুক্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আফগানিস্তানের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো ধরণের হুমকি প্রদান কিংবা শক্তিপ্রয়োগ অথবা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।
২য় ভাগ:
এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে হুমকি প্রদর্শন কিংবা হামলার লক্ষ্যে তার কোনো সদস্য কিংবা আল কায়েদাসহ যেকোনো দলের কোনো সদস্যকে আফগান ভূমিকে ব্যবহার করার অনুমতি দিবে না।
চুক্তির এই অংশে আরো উল্লেখ আছে, ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিষ্কার বার্তা দিবে যে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে হুমকি এমন ব্যক্তিদের আফগানিস্তানে কোনো স্থান নেই এবং ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান তার সকল সদস্যকে এই মর্মে নির্দেশনা দিবে যে, যারা আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয় এমন কোনো ব্যক্তি বা দলকে যেনো সহায়তা না করে।
অত্র চুক্তির আলোকে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তি ও দলকে আফগানিস্তানে তাদের সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অর্থ সংগ্রহ থেকে বাঁধা প্রদান করবে।
ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আশ্রয়প্রার্থী ও নাগরিকত্বের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মাইগ্রেশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, যাতে এই চুক্তির আলোকে আফগানিস্তানে এমন কোনো ব্যক্তি আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি হয়ে উঠতে না পারে।
ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান আমেরিকা ও তার মিত্রদের নিরাপত্তার প্রতি কোনো হুমকি হয় এমন কোনো ব্যক্তিকে আফগানিস্তানের ভিসা, পাসপোর্ট, ভ্রমণের অনুমতি কিংবা বৈধ কাগজপত্র প্রদান করবে না।
৩য় ভাগ:
চুক্তির এই অংশে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিটি জাতিসংঘে স্বীকৃতি ও সত্ত্বায়নের জন্য অনুরোধ করবে।
এছাড়া আরো বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবানদের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রত্যাশা করবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রত্যাশাও করে যে, আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মীমাংসা পরবর্তী গঠিত আফগান ইসলামি সরকারের সাথে আমেরিকার ইতিবাচক সম্পর্ক থাকবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে মীমাংসা পরবর্তী গঠিত আফগান ইসলামি সরকারের সাথে ইতিবাচক অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
চুক্তির পর্যালোচনা:
তালিবান কী পেলো, কী ছাড়লো ?
তালিবানদের সর্বপ্রথম দাবি হচ্ছে, আমেরিকার সকল সৈন্য আফগানিস্তান থেকে চলে যেতে হবে। চুক্তি ঠিক থাকলে ১৪ মাসের মধ্যে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে আশা করা যায়। ফলে তালিবানের এই দাবি পূরণ হতে চলেছে।
অতঃপর তালিবানদের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, আফগানিস্তান হবে একটি পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র, যেখানে ইসলামের সকল বিধান পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে। চুক্তিনামার ৩য় ভাগে আমেরিকা ভবিষ্যৎ আফগানিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েছে। ফলে তালিবানদের এই আকাঙ্ক্ষাও বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে।
চুক্তির একটা বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। চুক্তিতে আন্তঃআফগান আলাপ-আলোচনার কোথাও আফগান দালাল সরকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। কেননা তালিবানরা দালাল সরকারকে কোনো পক্ষ মনে করে না। পক্ষ মনে করে আমেরিকাকে, যা তালিবানরা বহুবার তাদের বার্তায় উল্লেখ করেছেন। ফলে আন্তঃআফগান সংলাপ বলতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক পক্ষকে বুঝানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে দালাল সরকারও এই সংলাপে থাকবে।
তালিবান যে জায়গাটিতে ছাড় দিয়েছে তা হচ্ছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আল কায়েদা ও অন্যান্য মুজাহিদ দলকে আফগান ভূমি থেকে আমেরিকা ও আমেরিকার মিত্রদের উপর হামলা করার সুযোগ দিবে না। অথচ আল কায়েদা তালিবানের আমিরের হাতে বাই’আতপ্রাপ্ত একটি গ্লোবাল জিহাদি সংগঠন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ালো ? এবিষয়ে আলোচনা পরে আসছে ইনশাআল্লাহ্*।
তালিবান আমেরিকার সাথে কেনো এই চুক্তি করতে গেলো ?
এই প্রশ্ন অনেকেরই ! আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে করুণ অবস্থায় আছে এবং আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, এমন মুহুর্তে তালিবানরা কেনো চুক্তি করতে গেলো ?
তালিবানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমেরিকাকে আফগানিস্তান থেকে বের করে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, আর এই চুক্তির মাধ্যমে যেহেতু তাদের সেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তাই ইসলামি ইসলামি ইমারত ইসলামি শরিয়তের বিধানের আলোকেই এই চুক্তিটি সম্পাদন করেছেন।
চুক্তি না করলে যা হতে পারতো
আমেরিকার বিগত কয়েক বছরের পরিকল্পনার আলোকে বুঝা যায়, আমেরিকা আফগানিস্তানে সরাসরি যুদ্ধ করার খায়েশ পরিত্যাগ করেছে। তারা এখন দালাল বাহিনীর মাধ্যমে যুদ্ধ করাচ্ছে। এই চুক্তি সম্পাদন না হলে আমেরিকা হয়তো এভাবে আফগানিস্তান ত্যাগ করতো না। তার দালাল বাহিনীকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা এবং বিমান হামলার মাধ্যমে এই যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। ইতোমধ্যে সে তার সৈন্যদের জীবন রক্ষার্থে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে অস্ত্র-অর্থ সহযোগিতার মাধ্যমে দালাল বাহিনী তৈরি করে মুসলিমদেরকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে বিরত রেখেছে, একইভাবে আফগানিস্তানেও সেই পরিকল্পনাকে আরো দীর্ঘায়িত করতো। এমনকি আমেরিকা আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা তীব্রতর করে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে রাখতো, ফলে আফগানরা কখনোই শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে পারতো না।
যদি এ চুক্তির মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তান ইসলামের বিধানের আলোকে পরিচালিত হয় এবং আমেরিকা সবধরণের হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে, তাহলে এতে আফগানিস্তানের মুসলিমদের জন্য অধিক কল্যাণ রয়েছে বলে আশা করা যায়।
আমেরিকা কী পেলো, কী ছাড়লো ?
আমেরিকার পাওনা যদি বলা হয়, তাহলে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। কেননা আমেরিকা আফগানিস্তানে এসেছিল তালিবানকে নির্মূল করে তার বহু আকাঙ্খিত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে। আমেরিকা তার এই দুই প্রধান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর তালিবানের সাথে তার এই চুক্তি এবং ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আমেরিকার আফগান আক্রমণের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।
আমেরিকা কেনো এতো বড় ছাড় দিতে গেলো ? এর কারণ হচ্ছে, আমেরিকা আফগানিস্তানে দীর্ঘ ১৮ বছরের অধিক সময়ের যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা থেকে বের হওয়ার জন্য আমেরিকার সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। একটি হচ্ছে, রাতের আঁধারে আফগানিস্তান থেকে পলায়ন করা। আরেকটি হচ্ছে, তালিবানদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে নামকাওয়াস্তে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পাততাড়ি গুটানো।
আমেরিকা চিন্তা করে দেখলো, তালিবানের মৌলিক প্রায় সব দাবি মেনে নিয়ে একটা চুক্তির মাধ্যমে চলে যাওয়াই মুখ রক্ষার জন্য অধিকতর সহায়ক। ফলে তারা এই পথই বেছে নিয়েছে।
আমেরিকা যদি তার প্রাপ্তির তালিকায় একটি বিষয় দেখাতে চায়, তবে তা দেখাতে পারে। আর সেটি হচ্ছে, আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি সংগঠনকে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের উপর হামলা করার সুযোগ না দেওয়ার বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
আমেরিকা মুখ রক্ষার জন্য এটি বলতে পারে যে, আফগানিস্তানে তাদের আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ছিল আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি দলকে আমেরিকার বিরুদ্ধে হামলা করা বন্ধ করা। এখন চুক্তির মাধ্যমে এটি তারা করতেও পেরেছে !
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিগত ১৮ বছরে তালিবানদের সহায়তায় আল কায়েদা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশে আল কায়েদা সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে মালি, মৌরতানিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রে আল কায়েদা প্রকাশ্যে অবস্থান করছে এবং অনেক দেশে বিস্তীর্ণ ভূমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে ইসলামি শরি’আহ অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ফলে আমেরিকা এখন ২০০১ সালের চেয়ে অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এবং ২০০১ সালের তুলনায় আমেরিকার শত্রু আল কায়েদা এখন বহু বিস্তৃত ও বহুগুণ শক্তিশালী হয়েছে। আল কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখার নির্দেশনায় গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পেনসাকোলাতে আমেরিকান নৌঘাঁটিতে হামলায় অনেক মার্কিন সৈন্যকে হতাহত করার ঘটনা প্রমাণ করে, আফগানিস্তান ছাড়াও পৃথিবীর বহু দেশ থেকে আল কায়েদার মুজাহিদগণ আমেরিকার হৃদপিণ্ডে হামলার মতো সফল অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম।
তালিবান, আল কায়েদা ও অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারে:
আমরা জানি যে, আল কায়েদা আফগান তালিবানের কাছে বাই’আতবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক জিহাদি জামা’আত। আল কায়েদার জন্ম থেকে শুরু করে টুইনটাওয়ার হামলা এবং এখন পর্যন্ত আমেরিকার বিরুদ্ধে জিহাদে আল কায়েদার জন্য তালিবানরা একধরণের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন। এই চুক্তির আলোকে যেহেতু তালিবানরা এখন আর তাদের ভূমিকে আমেরিকা ও তার মিত্রদের কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দিবে না, তাহলে সেসব জিহাদি জামা’আতের অপারেশনের কী হবে ?
এই চুক্তির কোথাও বলা হয়নি যে, তালিবানরা আল কায়েদার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। একথাও বলা হয়নি যে, তালিবানরা পৃথিবীর আর কোথাও জিহাদ করবে না বা মুজাহিদদের সহায়তা করবে না। বরং এটি শুধু আফগানিস্তানের জন্য বলা হয়েছে। আফগানিস্তানের ভূমি যেমন আমেরিকার বিরুদ্ধে হামলায় ব্যবহৃত হবে না, তেমনি আমেরিকাও আফগানিস্তানে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ করবে না।
আল কায়েদা ছাড়াও আফগানিস্তানে পূর্ব তুর্কিস্তানের (চীনের দখলকৃত জিনজিয়াং) আল হিজবুল ইসলামি আত-তুর্কিস্তানি এবং পাকিস্তানের জিহাদী জামাআত তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) অবস্থান করে তালিবানের অধীনেই জিহাদের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। তালিবানরা কারো সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেননি।
তালিবানদের ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তারা দুনিয়ার জিহাদি জামা’আতগুলোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না বরং চুক্তি রক্ষা করেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করে যাবে ইনশাআল্লাহ্*।
ইতোমধ্যে অন্যান্য জামা’আতের যেসব মুজাহিদিন আফগানিস্তানে আছেন, তাদেরকে তালিবানরা নিশ্চয়ই ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের মুজাহিদদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। যেহেতু তারা ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের অধীনেই জিহাদ করছেন।
এখানে একটি বাস্তবতা স্মরণ করিয়ে দেই, বিগত কয়েক বছর ধরে বিশেষ করে আমেরিকার সাথে আলোচনা শুরুর পর থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমারা যখনই আফগানিস্তানে আল কায়েদা ও তুর্কিস্তানের মুজাহিদদের অবস্থান এবং তালিবানদের পক্ষ থেকে তাদেরকে সহায়তার অভিযোগ করেছে , তখনই তালিবানরা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, আফগানিস্তানে ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের সৈন্য ব্যতীত অন্য কেউ নেই। অথচ ২০১৮ সালেও আল হিজবুল ইসলামি আত-তুর্কিস্তানি নিজেদের ব্যানারে অফিসিয়াল মিডিয়ার মাধ্যমে আফগানিস্তানে জিহাদের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল।
তার মানে কী দাঁড়ালো ! আফগানিস্তানে থাকা আল কায়েদা ও তুর্কিস্তানের মুজাহিদদেরকে তালিবানরা ইমারতে ইসলামি আফগানিস্তানের অংশ মনে করে।
চুক্তির ফলাফল, তাৎপর্য ও ভবিষ্যৎ:
আমেরিকা তালিবানকে ধ্বংস ও গণতন্ত্র কায়েম করার যে ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ মনোবাসনা নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল, এখন সেই চরমশত্রু তালিবানকে রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান এবং সকল সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়ে আমেরিকা তার অপূরণীয় মনোবাঞ্ছা ত্যাগ করেছে । দীর্ঘ ১৮ বছরেরও অধিক সময়ের যুদ্ধে আমেরিকার হাজার হাজার সৈন্য হতাহতের মাধ্যমে আমেরিকার সেনাবাহিনির মধ্যে এক চরম যুদ্ধভীতির সঞ্চার হয়েছে। অপরদিকে বিগত ১৮ বছরে শুধুমাত্র আফগানিস্তানে আমেরিকার সামরিক ব্যয় হয়েছে কমপক্ষে *৯৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তাদের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। * (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনসটিটিউট পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী)
এই বিপুল সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে, যা পরাশক্তি আমেরিকার জন্য এক চরম শিক্ষা। আফগানের এই শিক্ষা ভবিষ্যতে যেকোনো মুসলিম দেশে আগ্রাসন চালানোর পূর্বে আমেরিকা হাজার বার তার পরিণতি চিন্তা করতে বাধ্য হবে।
চুক্তির পূর্ণ ফলাফল দেখার জন্য আমাদেরকে আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু তালিবানরা ইসলামি শাসনব্যবস্থা ব্যতীত গণতন্ত্র কিংবা অন্যকিছুকে মেনে নিবে না, ফলে কাবুলের দখলে থাকা দালাল সরকারের সাথে তালিবানদের ফায়সালার বিষয়টির উপর হয়তো এই চুক্তিটি অনেকাংশে নির্ভর করছে। যদি দালাল সরকার ইসলামি শাসনব্যবস্থা মেনে নিয়ে সরে না দাঁড়ায়, তাহলে তালিবানদের সামনে যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোনো পথ থাকবে না এই আগাছাকে সরানোর জন্য। সেক্ষেত্রে আমেরিকা তার গোলামদেরকে রক্ষার ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয় তার উপর এই চুক্তিটির কার্যকারিতা নির্ভর করছে। যদি চুক্তির আলোকে সেসময় আমেরিকা দর্শকের ভূমিকা পালন করে তাহলে হয়তো চুক্তি বহাল থাকবে আছে, কিন্তু যদি হস্তক্ষেপ করে বা দালালদেরকে সহায়তা করে তাহলে চুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
এই চুক্তিটির দিকে গভীর দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি করা যায় যে, মূলত: এই চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা আফগানিস্তানের দায়িত্বভার তালিবানদের আয়ত্ত্বে দিয়ে দিয়েছে। কারণ, ভিসা, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বও তালিবানদের হাতে ধরে নিয়ে চুক্তির বিভিন্ন ধারা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এসবের মাধ্যমে আমেরিকা তালিবানদেরকে প্রকারান্তরে আফগানিস্তান পরিচালনার অধিকারী হিসেবে একদম লিখিতভাবেই মেনে নিয়েছে।
চুক্তিটির আরেকটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করি। আর তা হচ্ছে, এই চুক্তিটি বাস্তবায়ন হওয়ার মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানে ইসলামি শরি’আহ ভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এবং তা স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকলে মুসলিম বিশ্বে এর বিরাট প্রভাব পড়বে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ নিয়ে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর একটি ঐতিহাসিক উক্তি উল্লেখ করতে চাই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে আফগানদের কিছু প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম উল্লেখ করে সেই জিহাদকে ছোট করার চেষ্টা করলে শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. উক্ত ব্যক্তিদেরকে অদূরদর্শী আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, আফগান জিহাদের প্রভাব পুরো দুনিয়াজুড়ে পড়বে এবং এই জিহাদের মাধ্যমে আবার সারা দুনিয়াতে জিহাদ ছড়িয়ে পড়বে ইনশাআল্লাহ্*। (শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর তাফসিরে সূরাহ তাওবার ১ম খণ্ডে ৭৩ ও ৭৪ পৃষ্ঠায় এই অসাধারণ কথাগুলো আরো বিস্তৃতভাবে রয়েছে।)
শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম রাহি. এর সেই কথাগুলো পরবর্তীতে সত্যে পরিণত হয়েছিল। রাশিয়া বিরোধী আফগান জিহাদের প্রভাবে আজকের এই গ্লোবাল জিহাদ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে আলহামদুলিল্লাহ্*।
ঠিক তেমনিভাবে আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এর ইতিবাচক প্রভাব পুরো মুসলিম বিশ্বে পড়বে ইনশাআল্লাহ্*। মুসলিমরা তখন খুব সহজেই সত্যিকারের ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে জানতে পারবে এবং ত্বগুতি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বের হয়ে ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে তালিবানদের অনুসরণে ইসলামের বিধান জিহাদের পথ অবলম্বন করার অনুপ্রেরণা পাবে বলে আশা করি।
আল্লাহ তা’আলা এই চুক্তিকে ইসলাম এবং আফগানিস্তান ও সারা দুনিয়ার মুসলিমদের বিজয়ের পথে একটি মাইলফলক বানিয়ে দিন এবং ইসলামের দুশমনদের সকল চক্রান্ত মোকাবেলা করে আমাদেরকেও আল্লাহর শরি’আহ বাস্তবায়নের তাউফিক্ব দান করুন।
লেখক: উস্তায আবু হামজা হাফিজাহুল্লাহ, ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক গবেষক।
ডাউনলোড করুন:
docx
Comment