করোনা এবং আমাদের করণীয়
পুরো পৃথিবী আজ থমকে গিয়েছে করোনা আতঙ্কে। যেসব দেশগুলো নিজেদেরকে অজেয় ভাবতো, তারাও আজ অসহায়। এ যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়া’লার সুস্পষ্ট আযাব। মানবসমাজ যখন অবাধ্যতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, আল্লাহ দুনিয়াতেই তখন তাঁর আযাবের কিঞ্চিত প্রদর্শন করান। অবাধ্যদের জন্যে করোনা আযাব হলেও ধৈর্যশীল-নেককার মুমিনদের জন্যে তা রহমত। কেননা প্রতিটি বিপদ মুমিনের কোনো না কোনো গুনাহ মাফের উসিলা হয়, এমনকি সে বিপদ যদি পায়ে কাঁটা ফোটার মত সামান্যও হয়। তাছাড়া মহামারিতে মুমিন মৃত্যুবরণ করলে, সে শহীদের সাওয়াব লাভ করবে।
সুতরাং করোনা আতঙ্কের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একজন মুমিনের জন্যে করণীয় কী? এ সম্পর্কে আজ আমরা কিঞ্চিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
১. শিরককে বর্জন করা:
গুনাহসমুহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ গুনাহ হচ্ছে, রব্বুল আলামীনের সাথে অংশীদার স্থাপন করা। ঠিক এই সময়ে ব্যক্তিগত-সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক – যেকোনো ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত ছোট-বড় সব ধরনের শিরক সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর জন্যে ইবাদাতকে খালেস করা একান্ত প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, এক ফোঁটা শিরকের আবর্জনা গায়ে নিয়ে কবরে গেলে আমাদেরকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হতে হবে। আল্লাহ তায়া’লা সকল গুনাহ নিজ দয়ায় ক্ষমা করে দিলেও শিরকের গুনাহ কখনোই ক্ষমা করবেন না। [১]
২. তাগুতকে বর্জন করা:
ঈমান গৃহীত হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ‘কুফর বিত তাগুত’ বা তাগুতকে অস্বীকার করা। জীবনের এ ক্রান্তিলগ্নে সব ধরনের তাগুতের সাথে প্রকাশ্যে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিতে হবে। প্রথমত তাগুতকে বর্জন, অতঃপর ঈমান আনায়নের মাধ্যমে আমরা এমন এক রশিকে আঁকড়ে ধরতে পারবো, যা কখনো ছিন্ন হবার নয়৷ [২]
৩. তাওবা করা :
এ জীবনে পাপ তো আর কম করিনি। রাসূলুল্লাহ (সা এর মত নিষ্পাপ মহামানব যদি প্রতিদিন ৭০ বা ১০০ বার তাওবা করতে পারেন, তাহলে আমাদের প্রতিদিন কতবার তাওবা করা উচিত [৩]? জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কৃত সব ধরনের সগীরা-কবিরা গুনাহ থেকে অতিদ্রুত চলুন তাওবা করি।
৪. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা :
অতীত গুনাহেরই কোনো অন্ত নেই। চলমান এ সংকটাপন্ন অবস্থাতেও যদি গুনাহে লিপ্ত থাকি, তাহলে মুমিন হওয়ার পরেও এ করোনা আমাদের জন্যেও হবে আল্লাহর গজব। তাই সব ধরনের সগীরা-কবিরা গুনাহ থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। বিশেষ করে গীবত থেকে বেঁচে থাকতেই হবে। যেহেতু আমরা বেশিরভাগ সময়ই অবসরে কাটাচ্ছি, তাই অবসর কাটাতে হয়তো অন্যের সাথে নানান গল্পগুজবে মেতে উঠতে পারি। আর এ সুযোগে শয়তান আমাদের দ্বারা গীবতের মত ভয়ংকর গুনাহও ঘটিয়ে নিতে পারে। তাই এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে।
৫. নেক আমলে আত্মনিয়োগ করা:
ফরজ-ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি সুন্নত-নফল ইবাদতেও মশগুল হওয়া উচিত। প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে হবে। সুন্নাহ সমর্থিত আযকার এবং কুরআন তিলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন। সুন্নাহ সমর্থিত আযকার আমরা বিভিন্ন কিতাবে সাজানো অবস্থায় পাবো ইনশাআল্লাহ [৪]।
৬. ধৈর্যের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা :
এ কঠিন অবস্থায় ধৈর্য অনেক দামি একটি সম্পদ। মুমিন কখনোই বিপদাপদে দিশেহারা হয় না, বরং সে দেখায় ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বিপদকালে তাঁর সাহায্য প্রার্থনার দু’টি পন্থা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন – ১. সালাত, ২. সবর [৫]। মনে রাখতে হবে, এ বিপদ আমাদের জন্যে হয়তো রহমত, এ পরীক্ষা হয়তো আমাদের উঁচু স্তরে ওঠবার সিঁড়ি। আল্লাহ তো ধৈর্যশালীদের সাথেই রয়েছেন।
৭. নিয়তকে পরিশুদ্ধ করা :
এ সময়ে যতটা সম্ভব নিয়ত পরিশুদ্ধ রেখে নেক আমল করে যান। আর যেসব আমল করা সম্ভব হচ্ছে না, সেসবের জন্যে পরিশুদ্ধ নিয়ত রাখুন এবং সেসব আমল করার উপায়-উপকরণ খুঁজুন। নেক নিয়তের বদৌলতেও আপনি অশেষ পূন্যের অধিকারী হবেন। বিশেষত গাযওয়ায়ে হিন্দের জন্যে প্রস্তুতি নিন। জিহাদের উপায়-উপকরণ খুঁজুন আন্তরিকভাবে। শহীদি মৃত্যুর প্রবল তামান্না রাখুন অন্তরে। আপনার নিয়ত আন্তরিক এবং পরিশুদ্ধ হলে বিছানায় মৃত্যুবরণ করলেও শহীদের মর্যাদা লাভ করবেন ইনশাআল্লাহ।
৮. জিহাদের প্রস্তুতি নেয়া :
জিহাদ তো ফরজে আইন হয়েই আছে আমাদের ওপর। তাই আর গড়িমসি নয়। একটুও নয়। জিহাদের প্রস্তুতি নেয়ার এখনই চূড়ান্ত সময়। জিহাদ যখন ফরজে আইন, ই’দাদ বা জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করাও তখন ফরজে আইন [৬]। মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক প্রস্তুতি নিন। মানসিক বল বৃদ্ধি করুন। শারীরিক শক্তি সঞ্চয় করুন। প্রতিদিন অন্তত কিছু টাকা হলেও জমিয়ে রাখুন।
৯. ঋণ পরিশোধ করা :
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর রাখা একান্ত আবশ্যক – আর্থিকভাবে কোনো দেনা থেকে থাকলে তা অতি দ্রুত পরিশোধ করা উচিত। ঋণ হাক্কুল ইবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট। সুতরাং বান্দা যতক্ষণ না তা মাফ করবে, আল্লাহও ততক্ষণ ঋণ গ্রহীতাকে মাফ করবেন না। শহীদের সকল গুনাহ মাফ হয়ে গেলেও অপরিশোধিত ঋণের দায় থেকে সে মুক্ত হবে না। তাই আমাদের কোনো ঋণ থেকে থাকলে তা পরিশোধ করা উচিত। একইভাবে অন্য সব হাক্কুল ইবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা।
১০. পারিবারিক দাওয়াহ বৃদ্ধি করা :
কেবল নিজেকে প্রস্তুত করলেই হবে না, বরং পরিবারকেও প্রস্তুত করতে হবে [৭]। পরিবারকেও আসন্ন ফেতনা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এ জন্যে ফিতনা সংশ্লিষ্ট হাদিস পড়ে শোনানো যেতে পারে। অথবা কোনো বিজ্ঞ আলেমের এ সংক্রান্ত আলোচনার রেকর্ড শোনানো যেতে পারে। তাদেরকে ধৈর্যের তা’লীম দিতে হবে – এটা অত্যন্ত জরুরী।
১১. আল্লাহর সাহায্য কামনা করা :
সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন – সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। আমরা যদি খালেসভাবে আল্লাহকে ডাকতে পারি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহ আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন [৮]। দোয়া একটি ইবাদাত [৯] এবং মুমিনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। আল্লাহর কাছে দোয়া না করলে আল্লাহ আমাদের ওপর রাগান্বিত হন [১০]। আমরা আল্লাহর দিকে কিছুটা অগ্রসর হলেই, আল্লাহ আমাদেরকে আরো অনেক শক্তি দেবেন তাঁর পথে চলার [১১]।
পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ, নভেল করোনা ভাইরাসকে কাফিরদের জন্যে গজব এবং মুমিনদের জন্যে রহমত বানিয়ে দিন। আমাদেরকে আপনার পথে চলার তাওফিক দিন। আমাদেরকে কবুল করে নিন খলিফা মাহদীর সৈনিক হিসেবে।
___________________________________
পাদটীকা:
১. সূরা নিসা : ৪৮
২. সূরা বাকারা : ২৫৬
৩. সহীহ মুসলিম : ৬৭৫২
৪. আযকারের জন্যে আমরা বাংলা ভাষায় রচিত বা অনূদিত কিছু বইয়ের সাহায্য নিতে পারি। যেমন :
ক. বান্দার ডাকে আল্লাহর সাড়া : শাইখ সাঈদ ইবনে আলী আল কাহতানী
খ. হিসনে হাসীন : ইমাম মুহাম্মাদ আল জাজরী (রহ
গ. আযকার : শাইখ সাঈদ ইবনে আলী আল কাহতানী
ঘ. সহীহ মাসনূন ওযীফা : ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ
৫. সূরা বাকারা : ১৫৩
৬. সূরা আনফাল : ৬০
৭. সূরা আত তাহরীম : ০৬
৮. সূরা মু’মিন : ৬০
৯. জামে আত তিরমিজি : ৩৩৭২
১০. জামে আত তিরমিজি : ৩৩৭৩
১১. সহীহ বুখারী : ৭৪০৫
লেখক: আব্দুল্লাহ আবু উসামা, ইসলামী চিন্তাবিদ।
Comment