শত্রুর চোখে আল-কায়েদা:
বিলুপ্ত নাকি হুমকি?
বিলুপ্ত নাকি হুমকি?
ওয়ার অন দ্যা রকস’ নামক একটি আমেরিকার বিদেশনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্লাটফর্মে ২০২০ সালের ১২ই মার্চ প্রকাশিত হয় ‘Al-Qaeda: Threat or Anachronism?’ শিরোনামের একটি লেখা। এটি লিখেছেন ‘ব্রুস হফম্যান ও জেকব ওয়্যার নামক দুজন গবেষক। বাংলাভাষী পাঠকদের সুবিধার্থে সেই লেখাটির উল্লেখযোগ্য অংশের বাংলা অনুবাদ আমরা প্রকাশ করছি।
—————————————–
মাইক পম্পেও।
আমেরিকার স্টেইট সেক্রেটারি। আফগানিস্থান থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে যুক্তি দিলো সে। খুব দম্ভের সাথে ঘোষণা দিলো, ‘আমেরিকার পুরোনো শত্রু আল-কায়েদা পরাজিত হয়েছে। ‘ওরা আর আগের মতো নেই। আল-কায়েদা নিজেদের ছায়া হয়ে রয়েছে’।
অতীতে বহু মার্কিন কর্মকর্তা বহুবার বলেছে তারা আল-কায়েদাকে পরাজিত করেছে, আল-কায়েদার কোমর ভেঙে দিয়েছে। পম্পেও সর্বশেষ কর্মকর্তা যে এ লিস্টে নাম তুললো। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলা মাইক পম্পেও এর কথা গুলো অনিবার্যভাবে একটি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় বিশ্বকে-
আল-কায়েদা কি আসলেই পরাজিত হয়েছে?
আর কখনো কি আমেরিকাকে নাকানি চুবানি খাওয়াবে আল-কায়েদা?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হোক একটু পর থেকে। আপাতত একটা জিনিস চিন্তা করা যাক। ধরুন, উসামা বিন লাদেন বেঁচে আছেন। এখন বলুনতো, তিনি আল-কায়েদার বর্তমান অবস্থা দেখে খুশি হতেন না হতাশ হতেন?
অনেক কষ্ট হলেও এটা স্বীকার করতেই হবে উসামা বিন লাদেন বেঁচে থাকলে তিনি হতেন এই পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। তিন দশক আগে যে দলের বীজ তিনি বুনেছিলেন, সেই দলটি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি আর মিলিটারি সুপারপাওয়ারের সাথে লড়াই করে এখনো টিকে আছে। মাঝে অনেক ঝড় ঝাপটা এসেছে, উসামা বিন লাদেনসহ অন্যান্য অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু আল-কায়েদা ঠিকই সফলতার সাথে সব কিছু সামাল দিয়েছে। আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এমন এক দৃষ্টান্ত, এমন এক ন্যারেটিভ উসামা বিন লাদেন দাঁড় করিয়েছেন যা এখনো নতুন প্রজন্মকে রোমাঞ্চিত করে বিপ্লবের নেশায়। ২৪ বছর আগে উসামা যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, আজও সে যুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে বিশ্বব্যাপী অজস্র তরুণদের। এমন সব তরুণদের, উসামা যখন যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন তখন তাদের অনেকেরই জন্ম হয়নি! ৯/১১ এর ঠিক পর পর পাকিস্তানি এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন উসামা। বলেছিলেন, ‘আমার শাহাদাত আরো অনেক উসামার জন্ম দিবে’।
আজ আল-কায়েদা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ৯/১১ এর সময়কার চাইতে অনেক বেশী দেশে তাদের সমীহ জাগানিয়া উপস্থিতি। যোদ্ধার সংখ্যা ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজারের মতো।
এসবকিছু প্রমাণ করে, উসামা বিন লাদেন সত্যই বলেছিলেন।
গত ছয় বছর ধরে স্বঘোষিত ইসলামিক স্টেইট সালাফি জিহাদী এবং কাউন্টার টেরোরিজিম ইউনিটের স্পটলাইটে ছিলো। আল-কায়েদা নীরবে, নিভৃতে নিজেদের শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয় এই সময়টাতে। দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দুই ডজনেরো বেশী স্থানীয় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে দলটি । জাতিসঙ্ঘের Analytical Support and Sanctions Monitoring Team এক রিপোর্টে বলছে, আল কায়েদা নিশ্চুপ হয়ে আছে কিন্তু প্রচণ্ড হুমকি হয়ে গড়ে উঠছে… সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে এর(আল-কায়েদার) শাখাগুলো আইএসের চাইতেও বেশী শক্তিশালী। বিশেষ করে সাহেল (পশ্চিম আফ্রিকার একটি অঞ্চল), সোমালিয়া, ইয়ামান এবং সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। হাজার হাজার যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে আল-কায়েদা। সম্ভবত সিরিয়াতে আল-কায়েদার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে ২০ হাজার, সাহেলে কমপক্ষে ২ হাজার, ইয়ামানে ৬ হাজার, সোমালিয়াতে ৭ হাজার, আর আফগানিস্থানে ৬০০ এর মতো।
কীভাবে তারা বছরের পর বছর ধরে বাহ্যিক দৃষ্টিতে শক্তিশালী শত্রুদের চোখে চোখ রেখে টিকে থাকলো? কীভাবেই বা এতোকিছুর পরেও তারা রয়ে গেলো আগের মতোই দুর্ধর্ষ?
আল-কায়েদার নবউত্থানঃ
আরব বসন্তের পূর্ব থেকেই আল-কায়েদা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছিলো। কিন্তু এটা কোনোমতেই অস্বীকার করা যাবেনা আরব বসন্তের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট অস্থিরতা, নৈরাজ্য আল কায়েদার পুনরুত্থানের পালে হাওয়া লাগিয়েছে। আরব বসন্তের সময়ে লাগামহীন আশাবাদের সুবাতাস বয়ে গিয়েছিলো উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। এই স্বপ্ন ছিলো পরিবর্তিত এক সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের। আর এ কারণে আশা করা হয়েছিল আল-কায়েদার মতো দলগুলো একঘরে হয়ে যাবে, যে দলগুলোকে একঘরে করতে কাউন্টার টেরোরিজম ক্যাম্পেইন এক দশক ধরেও করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই দেশগুলোতে রাজনৈতিক জুলুম নিপীড়নের ইতি টানার হাতিয়ার হিসেবে ভাবা হতো অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের সংস্কার। কিন্তু এই দেশগুলোতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার্যক্রম আর নাগরিক আন্দোলন হিতে বিপরীত করে ফেললো। ‘জিহাদী মতবাদ’কে স্থায়ীভাবে ডেকে নিয়ে আসলো এরা।
ইন্সপায়ার ম্যাগাজিনের ২০১১ সালের মার্চ মাসের সংখ্যায় আল-কায়েদার অঘোষিত প্রচারণা প্রধান আনোয়ার আল আওলাকি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, ‘বিশ্বের আনাচে কানাচে মুজাহিদরা অত্যন্ত সুসময় পার করছেন। আমি ঠিক জানিনা মিশর, তিউনেশিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সৌদি, আলজেরিয়া এবং মরোক্কোতে মুজাহিদদের উত্থান সম্পর্কে পাশ্চাত্য অবগত কিনা’। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, আল-কায়েদার মতাদর্শীরা এরপরে ক্রমান্বয়ে প্রচারণা চালাতে সক্ষম হবেন। বিশৃঙ্খল পরিবেশ জিহাদিদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে। ‘পৃথিবীতে কী ঘটছে পশ্চিমারা কি সে ব্যাপারে সচেতন? নাকি তারা গভীর ঘুমে অচেতন’—প্রশ্ন রেখেছিলেন আল-আওলাকি।
২০১১ এবং ২০১২ সালে উসামা বিন লাদেন, আনোয়ার আল আওলাকি এবং আল কায়েদার সেকেন্ড ইন কমান্ড আবু ইয়াহিয়া আল লিবিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডগুলো আল কায়েদার আসন্ন ও স্থায়ী পরাজয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিলো। কিন্তু আরব বসন্তের বিপর্যয়কর পরিবেশ বিশেষভাবে মিশরের নৈরাজ্য এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নতুন করে আল-কায়েদাকে নবজীবন দান করে।
দেশে দেশে আল-কায়েদার শাখাঃ
সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে অনেকগুলো সালাফি জিহাদি গ্রুপ আছে। তাদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী গ্রুপ হিসেবে উত্থান ঘটেছে আল-কায়েদার। যুদ্ধের ফ্রন্ট হবার কারণে এই প্রদেশের জনসংখ্যা নেমে এসেছে ত্রিশ লাখে। ৯/১১ এর পূর্বের আফগানিস্থান যেমন, ঠিক তেমন এই প্রদেশও এখন আল-কায়েদা বা তার সহযোগী গ্রুপগুলোর সবচাইতে বড় নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে।
ইদলিব প্রদেশের দলগুলোর মধ্যে হাইয়াত তাহরির আশ-শাম সবচেয়ে শক্তিশালী। এদের যোদ্ধা সংখ্যা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মতো। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তাহরির আশ-শামের সাথে আল কায়েদার সম্পর্কে টানপোড়েন সৃষ্টি হলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় আছে। আল-কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন একটি দল হলো হুররাস আদ-দ্বীন। এদের আকার কিছুটা ছোট। যোদ্ধা সংখ্যা ৩৫০০ থেকে ৫০০০।
হাইয়াত তাহরীর আশ-শাম মূলত সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রতিই বেশী মনোযোগী, তারা সিরিয়ান সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আর যুদ্ধ করে সরকারি বাহিনীর রক্ষক রাশিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে। কিন্তু হুররাস আদ-দ্বীন আল-কায়েদার মতো গ্লোবাল জিহাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী। এমনকি তাঁদের নেতা আব্দুল করিম আল-মাসরি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সরাসরি বৈশ্বিকভাবে হামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলামিক স্টেটের পতন বা আমেরিকান সেনাবাহিনী সরিয়ে নেবার পর সিরিয়াতে শূন্যতা তৈরি হবে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করার সব সম্ভাবনাই ইদলিবে আল-কায়েদার সুরক্ষিত এবং শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মধ্যে বিদ্যমান।
আল-কায়েদার আরব উপদ্বীপ শাখাই বোধহয় আল-কায়েদার সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গ্রুপ। কেবল ২০১৯ সালেই এরা কী কী করেছে দেখুন।
ইয়ামানের নিয়ন্ত্রণ নেবার জন্য হুথিদের বিরুদ্ধে এক ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন। এরই মাঝে সৌদি আরব আক্রমণ করেছেন দুইবার। আমেরিকাকেও ছাড় দেননি তারা। আক্রমণ করেছেন তাদেরকেও। সেপ্টেম্বরে AQIP (আলকায়েদা ইন এরাবিয়ান পেনিনসুলা) দাবী করেন যে, সৌদি রয়াল গার্ডের কমান্ডারকে তারা জেদ্দাহতে হত্যা করেছেন। ডিসেম্বরে আবার আঘাত হানেন রিয়াদে। সেখানে কনসার্ট চলছিলো। কনসার্টের তিনজন পারফর্মারকে ছুরি মেরে বসেন AQIP এর একজন যোদ্ধা। একই মাসে আমেরিকার মাটিতেও AQIP হামলা চালালো। সৌদি রয়্যাল এয়ার ফোর্সের শিক্ষানবিশ পাইলট (যিনি AQIP এর মুজাহিদও), তিনজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন ফ্লোরিডার এক নৌ-ঘাঁটিতে।
AQIP এর প্রতিষ্ঠাতা নাসির আল ওহায়শি, AQIP এর প্রধান মুখপাত্র, দাঈ, আনোয়ার আল আওলাকি বা বোমা বানানোয় কিংবদন্তিতুল্য ইবরাহিম আল আসিরিরকে হত্যা করার পরও দেখা যাচ্ছে AQIP দুর্বল হয়নি। বরং, বিভিন্ন প্রমাণাদি চিৎকার করে বলছে আল আসিরির অস্ত্র বানানোর দক্ষতা আল-কায়েদার অন্যান্য শাখার মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। এমন গ্রুপের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে যারা এর আগে বানিজ্যিক বিমানগুলোকে টার্গেট করেননি। যেমন আল শাবাব। আল শাবাব টেকনোলজি ব্যবহারে আনাড়ি। কিন্তু, এই আল শাবাব পর্যন্ত ল্যাপটপ কম্পিউটারের মধ্যে এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস লুকানো শিখে গেলো। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে ল্যাপটপের মাঝে লুকানো ইম্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ দিয়ে মোগাদিসু থেকে ছেড়ে যাওয়া এক বাণিজ্যিক বিমান প্রায় ধ্বংস করে ছেড়েছিলেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে AQIP এর আমীর কাসিম আর রিমিকে যে হত্যা করা হয়েছে, তাও কোনো আচড় কাটতে পারবেনা AQIP এর গায়ে। বরং ইয়ামানের গৃহযুদ্ধে AQIP যতো দাপট দেখাচ্ছে তা থেকেই ধারণা করা যায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হামলা চালানোর জন্য এরা কতোটা সক্ষম।
এদিকে, এই বছরের শুরুতেই কেনিয়া সোমালিয়া বর্ডারের কাছে আমেরিকান আর্মির ক্যাম্প ‘সিম্বাতে’ আক্রমণ চালায় আল শাবাব। তিন জন আমেরিকান নিহত হয়। আল শাবাব অস্তিত্ব জানান দিয়ে রাখছে সোমালিয়া বা কেনিয়াতে আমরাও আছি। আমাদের কথা ভুলে যেওনা!
আফ্রিকা থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে খুব সম্ভবত আল কায়েদা ইন ইসলামিক মাগরিব, জামাত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিনের সাথে সাথে আল শাবাবও ফায়দা লুটবে।
আমেরিকা এবং তালিবানের মধ্যকার শান্তিচুক্তিতে আলকায়েদা অবশ্যই চরম আনন্দিত। সেই সাথে আফগানিস্থান থেকে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহার তো আছেই। আল-কায়েদার সাথে তালিবানের সম্পর্কচ্ছেদ করাতে পারেনি আমেরিকা।তার মানে হলো— সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে উঠা আল-কায়েদার নতুন দুই খেলোয়াড়, আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (AQIS) এবং কাশ্মীরভিত্তিক আনসার গাজওয়াতুল হিন্দ একেবারে স্বাধীনভাবে তাঁদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।
আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানোর ক্ষেত্রে আল-কায়েদাকে আফগানিস্থানের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া হবেনা- আমেরিকা তালিবানকে শুধু এটুকু রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। আল-কায়েদার সাথে তালিবানের সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেওয়াতে পারলে তা আমেরিকা এবং তালিবানের মধ্যকার শান্তিচুক্তির ওজন বৃদ্ধি করতো। এর মাধ্যমে বোঝা যেতো তালিবান বিদেশী যোদ্ধাদেরকে তাঁদের মাটি ব্যবহার করতে দেওয়া থেকে সরে এসেছে। বুঝা যেতো, তালিবান শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করা থেকে সরে এসেছে এবং আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকারের সাথে কাজ করতে আসলেই প্রস্তুত (এসকল কাজের বিরোধিতা আল-কায়েদা চিরকাল করে এসেছে)। কিন্তু আমেরিকা, তালিবানকে দিয়ে এর কিছুই করাতে পারেনি।
আল-কায়েদা বারবার প্রমাণ করেছে তালিবানের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হলো তাঁরা। তাঁরা তালিবানের আক্রমণ ক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে কোনোমতেই আফগানিস্থানে আল-কায়েদার অপারেশন বন্ধ হবেনা। বেছে বেছে কেবল আমেরিকান লক্ষ্যবস্তু বা যেসব লক্ষ্যবস্তুর সাথে পরোক্ষভাবে আমেরিকা সংযুক্ত সেসব এড়িয়ে যাবে আল-কায়েদা। কিন্তু আল-কায়েদা আফগানিস্থানের মাটি ব্যবহার করে অপারেশন চালিয়ে যাবেই। তার ওপর আল-কায়েদা বারবার ঘোষণা দিচ্ছে, দুই পরাশক্তি—সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকার পরাজয় ঘটেছে আফগানিস্থানে। এই দুই পরাশক্তির পরাজয়, শান্তিচুক্তির অস্পষ্ট বিষয়গুলোর ফায়দা চতুর আল-কায়েদা অবশ্যই তুলবে। এগুলো ব্যবহার করে তারা নতুন নতুন সদস্য রিক্রুট করবে। ফান্ড সংগ্রহ করবে।
উপসংহারঃ
১৬ বছর আগে উসামা বিন লাদেন জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সর্বশেষ ভিডিওটেপ রিলিজ করেছিলেন। সেখানে বিন লাদেন বলেছিলেন, ‘জালিম সুপারপাওয়ারদের বিরুদ্ধে ‘ক্রমশ শক্তি ক্ষয়’ নীতি অবলম্বন করে আল-কায়েদা যুদ্ধ করছে। বিন লাদেন গর্বভরে বলেছিলেন, “আল-কায়েদা, আফগান মুজাহিদদের সঙ্গে নিয়ে ১০ বছর ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের রক্ত ঝরিয়েছে। যুদ্ধ চালাতে চালাতে অবশেষে রাশিয়া দেউলিয়া হয় এবং পরাজয় মেনে নিয়ে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্থান থেকে পালিয়ে যায়। আল-কায়েদার হাতে আমেরিকাও একদিন এমন পরিণতি বরণ করবে।” আমেরিকা-তালিবান ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি এবং সিরিয়া ও আফ্রিকা উভয় ফ্রন্টেই আমেরিকার খাবি খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে বিন লাদেনের ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
ইসলামিক স্টেটের পরাজয়, কথিত খেলাফত ধ্বংস, আল-কায়েদার দীর্ঘ নিরবতা এই ধারণা তৈরি করেছে যে সালাফি-জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই শেষ। তবে, আমাদের মুদ্রার উলটো পিঠটার দিকেও খেয়াল রাখতে বলেছিলেন জেনারেল জেমস এন ম্যাটস। ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন তিনি। জেনারেল জেমস বলেছিলেন, “যতোক্ষণ পর্যন্ত না শত্রু ঘোষণা দেয় যে ‘যুদ্ধ শেষ’, ততোক্ষণ পর্যন্ত আসলে কোনো যুদ্ধই শেষ হয়না। আমরা হয়তো ভাবতে পারি যুদ্ধ শেষ। আমরা ঘোষণা দিয়ে বলতে পারি যুদ্ধ শেষ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, শত্রুরা সুযোগ পেয়ে যায়। আমরা এদিকে হয়তো যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি, এককভাবে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানছি; অন্যদিকে আমাদের শত্রুরা নতুন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার প্রতীজ্ঞা করছে। সেই যুদ্ধের প্রতীজ্ঞা করছে, যা উসামা বিন লাদেন ঘোষণা করেছিলেন প্রায় ২৫ বছর আগে!
Comment