আল কায়েদার শক্তিশালী রণকৌশল: যেভাবে নাস্তানাবুদ আমেরিকা!
১৮ মে মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস অবশেষে স্বীকার করে নিল যে আল-ক্বায়েদা’ই প্রত্যক্ষভাবে ফ্লোরিডার বিমান ঘাঁটিতে ডিসেম্বরের ওই হামলা পরিচালনা করেছে। মূলত এ স্বীকারোক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল-ক্বায়েদার ক্রমবর্ধমান সামর্থ্য আর শক্তিমত্তাকেই আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিতে বাধ্য হলো। এ যাবতকাল শত্রুপক্ষ বিশেষ করে আল-ক্বায়েদা ও অন্যান্য মুজাহিদদের সামর্থ্যকে বিশ্বের সামনে হীন করে দেখানোর প্রচলিত আমেরিকান নীতিবিরোধী এ স্বীকারোক্তি রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক দিয়েই বেশ গুরুত্ববহ।
মুখের কথা যেরকমই হোক না কেন, রাশিয়ার ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সামর্থ্যকে বাস্তবে সমীহ করেই চলে আমেরিকা। চীনকেও বাণিজ্যের পাশাপাশি সামরিক হুমকি হিসেবেও বিশেষ গুরুত্ব দেয় তারা। এর কারণ কোন কাল্পনিক জুজু নয়, বরং এই দেশগুলো আমেরিকার মূলভূখন্ডে আক্রমণ চালানোর ক্ষমতা রাখে – সেটা শক্তিমত্তার বিচারে যত সবল আর যত দুর্বলই হোক না কেন।
অথচ গণহত্যা, বর্বরতা, ধ্বংস আর নতুন অস্ত্রের পরীক্ষার জন্যে মুসলিম দেশগুলোকে তারা নির্দ্বিধায় উর্বর ভূমি হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে বিগত কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে। বিশ্ব মানবতার স্লোগান, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তুমুল বিরোধিতা কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোয় স্মরণকালের সবচেয়ে বড় যুদ্ধবিরোধী গণসমাবেশ কোন কিছুর প্রতিই তারা ভ্রূক্ষেপের প্রয়োজন মনে করেনি। তার কারণও সাদামাটা ও স্পষ্ট – আর তা হচ্ছে মুসলিমদের ভূমিতে হত্যাযজ্ঞ আর নজিরবিহীন বর্বরতা চালালেও তাতে আমেরিকার মূলভূখণ্ডের ওপরে কোন হুমকি নেই।
কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া কিংবা শিয়া ইরানের সাথে আমেরিকার দ্বন্দ্ব কখনোই রাজনীতি, পত্রিকার পাতা আর বেশির বেশি প্রক্সি-যুদ্ধের বাইরে গড়ায়নি – কারণটা এরই মধ্যে আশা করি স্পষ্ট হয়ে গেছে। অথচ আমেরিকার তুলনায় এই দেশ গুলো সামরিক দিক দিয়ে বহুগুণে পিছিয়ে থাকলেও তাদের কিছুটা ক্ষেপণাস্ত্র সামর্থ্য আছে আর কিঞ্চিৎ হলেও পরমাণু অস্ত্রের জ্ঞান আছে। আর সেটাই মার্কিন সমরাস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করতে সুস্পষ্ট সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে দশকের পর দশক ধরে।
আমেরিকার আগ্রাসনের পেছনে মূল চালিকাই হচ্ছে তাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর কোন হুমকি না থাকলে তারা দুনিয়ার যেকোন জায়গায় যেকোন ধরনের অভিযান চালাতে পারে সেটা হোক ভিয়েতনাম কিংবা আফগানিস্তান, হোক পারমাণবিক বোমা কিংবা ড্রোন হামলা। আর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর যদি তারা কোনরকম হুমকি আঁচ করতে পারে সেটা যত দূরবর্তী আর যত সামান্যই হোক না কেন, তাহলে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে কেবল হোয়াইট হাউজের সাংবাদিকদের কানের পর্দাই গরম করবে। এই সরল বিশ্লেষণের খাপে গত শতকের বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ও রাজনীতির ইতিহাসকে ফেলেই দেখুন না – দ্বিমত করার সুযোগ ইতিহাসই আপনাকে দেবে না!
মোহাম্মদ সাঈদ আল-শামারানি, সৌদি রাজকীয় বিমান বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট – উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণের জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। দু’বছর যাবত সেখানকার বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফ্লোরিডার ‘নেভাল এয়ার স্টেশন পান্সাকোলা’য় পেন্টাগনের অর্থায়নে শিক্ষানবীশ পাইলট হিসেবে অবস্থানের সময় ৬ ডিসেম্বর ২০১৯, অতর্কিত হামলায়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বিকারোক্তি অনুযায়ী, তিনজন মেরিনকে হত্যা ও আরো আটজনকে আহত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জিহাদি আক্রমণ হিসেবে আল-শামারানির হামলা নতুন কিছু নয়। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবারই এই ধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। ৯/১১ এর পর লোন উলফদের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীতেও এরকম হামলার ঘটনা আছে। মার্কিন বাহিনীর তৎকালীন মেজর নিদাল হাসান ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর টেক্সাসের ফোর্ট হুড ঘাঁটিতে গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা ও ৩০ জনেরও বেশি সৈন্যকে আহত করেন। নিদাল হাসান মার্কিন বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮৮ সালে। মার্কিন বাহিনীতে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে, হতাশায় আক্রান্ত ইরাক ও আফগান ফেরত সৈন্যদের কাছ থেকে সেসব দেশে তাদের করে আসা বর্বরতার বর্ণনা শুনতে হতো তাঁকে। এই পৈচাশিক বর্ণনাগুলো নিদালকে এতটাই আঘাত করেছিল যে তিনি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দায়বদ্ধতাকে নিজ বাহিনীর আনুগত্যের চেয়ে বেশি প্রাধাণ্য দিয়ে মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিলেন। লোন উলফদের প্রায় সকলের ইতিহাসও একই ধাঁচের।
কিন্তু এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আল-শামারানির হামলা অনন্য এবং গুরুত্বের দিক দিয়েও নতুন ধরনের! পেন্সাকোলা হামলার প্রায় ছয় মাস পর গত ১৮ মে, ২০২০ এফবিআই এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে – আল-শামারানি আল-ক্বায়েদার আরব শাখা একিউএপি এর সাথে সদস্য ছিলেন।
সম্প্রতি কয়েক মাসের চেষ্টায় আল-শামারানির দুটি আইফোন ডিক্রিপ্ট করতে সমর্থ হয়েছে এফবিআই। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলেছে – আল-শামারানি হামলার মুহূর্ত পর্যন্ত একিউএপি এর সাথে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ওয়ারেন্ট প্রুফ এনক্রিপশনের সাথে এন্ড টু এন্ড এনক্রিপ্টেড এপ্লিকেশন ব্যবহার করে তিনি সব ধরনের নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে গেছেন। তবে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে আল-শামারানি ২০১৫ সালের আগে থেকেই আল-ক্বায়েদার সাথে সংযুক্ত ছিলেন। এফবিআই তাদের তদন্তে নিশ্চিত করেছে, আল-শামারানি আগে থেকেই আল-ক্বায়েদার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং আল-ক্বায়েদার স্লিপার এজেন্ট হিসেবে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই সৌদি বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।
সামরিক সহযোগিতা চুক্তির আওতায় সৌদি বাহিনীর সবচেয়ে চৌকশ পাইলটদেরকে পেন্টাগণ নিজস্ব অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আল-শামারানি ২০১৫ সালে সৌদি বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর কমিশন পেয়ে পেন্টাগনের বৃত্তিসহ এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ঘাঁটিতেই ছিলেন – আদতে তিনি এই পুরোটা সময় একজন অত্যন্ত সুদক্ষ এবং অপরিসীম ধৈর্যশীল স্লিপার এজেণ্ট হিসেবে তার টার্গেট নির্ধারণের কাজ করেছেন, একা একা নন বরং প্রতিনিয়ত একিউএপি কে তথ্য সরবরাহ করেছেন, তাদের সাথে পরামর্শ করেছেন।
এ বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একিউএপি’র তৎকালীন আমির ক্বাসিম আল-রিমি পেন্সাকোলা হামলার দায় স্বীকার করে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন – এফবিআই এর নতুন তদন্ত রিপোর্ট এবং ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের স্বীকারোক্তি সেই বক্তব্যকেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ করে।
‘কয়েক বছর ধরেই আমাদের বীর(আল-শামারানি)আমেরিকার বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিতে রেকি করেছেন, যাতে সবচেয়ে ভাল এবং বেশি ক্ষতি করা যায় এমন টার্গেট ঠিক করা যায়, … আল্লাহ তাকে অপরিসীম ধৈর্য দিয়েছিলেন, আর একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহেই তিনি সবগুলো সামরিক পরীক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা উতরাতে পেরেছিলেন। … আমাদের বীর (আল-শামারানি) বছরের পর বছর ধরে তার নিয়াতকে অন্তরে লুকিয়ে রেখেছিলেন যতক্ষণনা আল্লাহ তাকে সফলতা দান করলেন। তিনি আল্লাহর শত্রু আমেরিকাকে সেই রক্তের পেয়ালা থেকেই কিছুটা স্বাদ আস্বাদন করালেন যা তারা প্রতিদিন মুসলিমদেরকে পান করায়।’ – বলেছিলেম ক্বাসিম আল-রিমি।
আল-শামারানির ইচ্ছা ও আরো বিভিন্ন নোটের যে ছবিগুলো আল-রিমির বক্তব্যের ভিডিওতে যুক্ত করা হয়েছিলো – এখন ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস সেগুলোর সত্যায়ন করল। ১৮ মে’র প্রেস ব্রিফিংএ এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে বলেন, আল-শামারানি একজন দৃঢ়সংকল্প আল-ক্বায়েদা সদস্য – সে এখানে আসার পরে রেডিকালাইজ হয়েছে এমনটি মোটেও নয় বরং সে তার পরিকল্পনা নিয়েই আমেরিকাতে এসেছিলো।
এভাবে স্লিপার এজেন্ট হিসেবে মার্কিন মিত্র বাহিনীগুলোতে আল-ক্বায়েদার ঢুকে পড়াটা মার্কিন স্বার্থের জন্যে দুমুখী তলোয়ার হিসেবে মারাত্মক উদ্বেগের কারণ। এতে একদিকে সরাসরি মার্কিনীরা বা তাদের মিত্ররা যেমন আক্রান্ত হতে পারে তেমনি মার্কিন মিত্রদের বিশ্বস্ততা বা সামর্থ্যের ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে পাকিস্তানের জন্যে বরাদ্দকৃত সামরিক সাহায্যের লাগাম টেনে দিয়েছে আমেরিকা – কারণ এই সন্দেহ।
ফলস্বরূপ স্বঘোষিত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধে’ তারা নিজেরাই দুর্বল হয়ে পড়ছে। তদুপরি এ ধরনের ঘটনায় মার্কিন মিত্রদের মনোবলেও ভাটা পড়বে – আর এই ভাটা কেবল মিত্রদের মাঝেই আটকে থাকবে না কারণ মার্কিনিরা এই মিত্রদের ঘাড়ে বন্দুক রেখেই মাতুব্বরি করে আসছে। অন্যদিকে সামরিক ও রাজনৈতিক স্বার্থেই আমেরিকা তার মিত্রদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা পুরোপুরি বন্ধ করতেও পারবে না। মিত্রবাহিনীর সদস্যদের ওপর বাড়তি নজরদারি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপও হিতে বিপরীত ফলই বয়ে আনবে। ফলে আল-শামারানি মার্কিন নিরাপত্তা বেষ্টনীর যে ফাঁক কাজে লাগিয়েছিলেন সেটা আদতে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে – আল-শামারানি কি প্রথম এবং শেষ? আদতে এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর কোন বোদ্ধারই জানা নেই। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পুলিশ কিংবা সামরিক বাহিনীর ভেতর এরকম কোন স্লিপার এজেন্ট নেই – এ দাবি কেউই করতে পারবেন না। তবে – আল-ক্বায়েদা দাবি করতেই পারে যে তাদের স্লিপার এজেন্টরা সবখানে আছে, আল-শামারানির হামলার পর এই দাবি এখন অত্যন্ত বাস্তব এবং প্রকাশ্যে না হলেও অপ্রকাশ্যে ঠিকই নীতিনির্ধারকদের উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। দুনিয়ার সব থেকে শক্তিশালী নিরাপত্তা বেষ্টনীও যখন তাশের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ছে আল-ক্বায়েদার কৌশল ও দৃঢ়তার কাছে তখন বাংলাদেশের মত অদক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিশ্ছিদ্র দাবি করা কিংবা জিরো টলারেন্সের কার্যকারিতা গাধার বুলি নয় কী!
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতির বিচারে আমেরিকা যদি বিশ্ব শক্তি হয়, তাহলে এক্ষেত্রে আমেরিকার পর একমাত্র আল-ক্বায়েদাকেই এই বৈশিষ্টের নিরিখে আরেকটি বিশ্ব শক্তি বলতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকা, ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য, আরব উপদ্বীপ সবখানেই আল-ক্বায়েদার সামরিক কার্যক্রম অগ্রসরমান। আর এই ধারাকে এখানে সেখানে দু’একজন আমিরকে হত্যা করেই বন্ধ করে ফেলা যাবে – সেরকম হিসাব-নিকাশ আমেরিকাও অনেক আগেই বাদ দিয়েছে।
আল-শামারানির দীর্ঘ পরিকল্পিত এই হামলার ফলে আরো একটি বিষয় সামনে চলে এসেছে – আমেরিকানরা আসলেই নিজেদের দেশে কতটা নিরাপদ? ৯/১১ এর পরেও তারা নিজেদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দাবি বেশ জোর গলায় করে আসছিলো। আদতে সে দাবির ভেতর যে বড় ছিদ্র আছে – ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস তাদের বক্তব্যে সেটাই স্বীকার করে নিলো। আল-শামারানি যেমন করে এই ছিদ্রকে কাজে লাগিয়েছেন, হতে পারে আরো অনেকেই এপথে এগিয়ে গেছেন অনেক দূর – আর এই আলোচনায় আমেরিকা ও তার মিত্রদের মধ্যকার দ্বন্দ্বই কেবল বাড়বে, আর এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে বহির্বিশ্ব মানে মুসলিম ভূমিগুলো থেকে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেয়া।
এটা আমেরিকাও ভালভাবেই বুঝতে পারছে – ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান কোথা থেকে এল সেই ধাধার সমাধান আমাদের এই বিশ্লেষণের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে! আর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিও আদতে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ (যেমন সৌদি আরব) কিংবা দূরবর্তী (যেমন বাংলাদেশ) মিত্রদেরকে আল-ক্বায়েদার সামনে কেবল আরো নাজুক আর দুর্বলই করে তুলবে। কার্যত আমেরিকা এখন এমন এক ফাঁদে আটকে গেছে যেখান থেকে নিজের শত্রুর উন্নতি দেখে কেবল আফসোসই করা যায়, কিন্তু শত্রুকে আটকানোর কোন পথই জানা নেই বরং যে দিক দিয়েই শত্রুকে আক্রমণ করা হোক না কেন – তা শত্রুরই শক্তি বৃদ্ধি করবে আর নিজের সমস্ত পদক্ষেপই কেবল আত্মঘাতি হবে, যেখান থেকে নিজের ধ্বংসকে শত্রুর করুণার কাছে সমর্পণ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
সামরিক কার্যক্রমের পাশাপাশি, আল-ক্বায়েদার মিডিয়া কার্যক্রমও দেশে দেশে মূলধারার মিডিয়ার প্রতি জনগণের অবিশ্বাস ও বিতশ্রদ্ধাকে কাজে লাগিয়ে অলটারনেটিভ মিডিয়া হিসেবে এরই মধ্যে কার্যকর অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। এই বাস্তবতা কেউ আর অস্বীকার করছে না বরং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে বিধি নিষেধ আরোপ ও ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা লঙ্ঘন এখন সরকার ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া থেকে মানুষকে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছে। দাওয়াতি কার্যক্রমকেন্দ্রিক মিডিয়া ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আল-ক্বায়েদাও জনস্বার্থের দিকে নজর দিয়ে স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা ও সম্পূর্ণ মিডিয়া কার্যক্রমের দিকেই ঝুঁকছে।
আল-ক্বায়েদার বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের যুদ্ধের পর প্রাপ্তির খাতায় আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে খরিদ করা নিরাপত্তাহীনতার গ্লানি আর সারবত্তাহীন মিথ্যা সাফল্য ছাড়া আর কিছুই যে জোটেনি – আল-শামারানি সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। একদিকে পতনমুখ অর্থনীতি, বাড়তে থাকা নিরাপত্তা হুমকি, আর অন্যদিকে উচ্চ ফলনশীল জনরোষ সাথে নিয়ে আমেরিকা ও তার মিত্ররা আর কতদিন তাদের প্রভাব ধরে রাখতে পারছে – তাই এখন দেখার বিষয়।
সেই সাথে নতুন কোন মুসলিম ভূখন্ডে সেনা পাঠানোর আগে আমেরিকাকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি নিয়েও ব্যাপক চিন্তাভাবনা করতে হবে, বিশ বছর আগে যেটা তারা কল্পনাতেও চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করত না। হতে পারে আমেরিকা এই চিন্তা থেকেই ভবিষ্যতে আর কখনোই মুসলিমদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না – যার নজির এরই মধ্যে খানিকটা বাস্তব হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন থেকে যায়, বহির্বিশ্ব থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েও কি আমেরিকা তার পতন ঠেকাতে পারবে? আল-শামারানিরা সংখ্যায় শক্তিতে কিন্তু উত্তরোত্তর উন্নতিই করে চলেছেন – এই সত্য আজ আর ধোঁয়াশাচ্ছন্ন নেই।
আল-শামারানি সন্ত্রাসী নাকি বীর – এই প্রশ্নে এখন পৃথিবী যতটা দ্বিধাবিভক্ত, ৯/১১ এর পরেও কিন্তু এমনটা দেখা যায় নি! আমরা, আমাদের পাঠকরাও এই দ্বন্দ্বের বাইরে নই! সভ্যতার দ্বন্দ্বে বর্তমানকালে একপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু নেতৃত্ব যেমন আমেরিকার ও তার মিত্রদের হাতে তেমনি অন্য পক্ষের নেতৃত্বে কি আল-ক্বায়েদা ও তার মিত্ররাই ধীরস্থির সুদৃঢ়তার সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে? প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখবেন!
আবু আফিয়া
সূত্র: https://alfirdaws.org/2020/06/17/38760/
Comment