ভারতীয় মুসলিমদের শঙ্কা
ইন্দোনেশিয়ার পর ভারতেই মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ দেশটিতে এখন প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের বাস৷ পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা এক গবেষণা দেখা গেছে ২০৬০ সালের মধ্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩০ কোটিরও বেশি৷ অর্থাৎ মাত্র দুই জেনারেশন ( প্রজন্ম) পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বীর দেশ হবে ভারত৷
কিন্তু অন্যসব ধর্মের তুলনায় মুসলিমদের জনসংখ্যা বেশি হলেও ভারতের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এখন তারাই সবচেয়ে বেশি শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন৷ ২০১৪ সালে সন্ত্রাসী দল বিজেপির নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ভারতের মুসলিমরা আগের চেয়েও বেশি আতংকের মাঝে দিন কাটাচ্ছেন৷ মোদি এবং তার দলের ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়াই এর মূল কারণ৷ উপমহাদেশে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এখানে হিংসাত্মক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে মোদি সরকার।
মোদির শাসনক্ষমতায় বসার শুরুতেই মুসলিমবিরোধী উগ্র সহিংসতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। গরুর মাংস খাওয়ার অজুহাতে অন্তত ৪০টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ এই ঘটনাগুলোর তেমন কোনো বিচারও হয়নি৷ বরং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়ই মুসলিমদের উপর বহু হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, যার একটি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হলো দিল্লি গণহত্যা।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক কিছু বিষয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী প্রকাশ্য প্রচারণার মাধ্যমে মুসলিমবিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়েছে। করোনাকালে নিকৃষ্ট হিন্দুত্ববাদীদের এই মুসলিমবিদ্বেষের চরম নমুনা লক্ষ্য করা গেছে। মুসলিমদেরকে ‘করোনা জিহাদী‘ আখ্যায়িত করে বিভিন্ন জায়গায় হয়রানি থেকে শুরু করে নির্যাতন করা হয়েছে, এমনকি কেবল মুসলিম পরিচয়ের কারণে হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে এই হিন্দুরা।
হিন্দুদের এমন আগ্রাসী নিকৃষ্ট চেতনার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে করার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে উত্তর ভারতে মুসলিমরা নিজেদের ভিটেমাটিতেই আর নিরাপদ বোধ করেন না৷
এক ভারতীয় মুসলিম কলামিস্ট নিজের পরিচয় গোপন রেখে লিখেছেন, ‘মোদি সরকার এসে শক্ত অবস্থান নেয়ার পর থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অত্যাচার নির্যাতন শুরু হয়ে গেলো। এটা আমাকে অস্থির করে তুলেছে। আমার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম পরিচয়ের কারণে যে কোনো সময় আমার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। তাই প্রকাশ্যে বিতর্ক করা আমি কমিয়ে দিলাম। প্রকাশ্যে ফোন কল রিসিভ করে আস সালামু আলাইকুম বলা বন্ধ করে দিলাম। সন্তানদের বললাম যাতে ট্রেন বা বাসে সফরের সময়ে আমাকে আব্বা বলে না ডাকে। এমনকি আমার নামটাও একটু ঘুরিয়ে নিলাম আমি। আমার খাবারের তালিকা থেকে মাংস চলে গেলো। যখন সফরে থাকি, তখন তো এটা আরও বেশি কঠোরভাবে অনুসরণ করি। কখনও আমি কল্পনাও করিনি যে, নিজের পরিচয় গ্রহণ করার সুবিধাটুকু কেড়ে নিয়ে আমাকে এভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। এই নতুন ভারতে একই সাথে মুসলিম আর উদারপন্থী হওয়ার পরিণতি সত্যিই ভয়াবহ।
আমি আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে শুরু করলাম। আমার পরিচয় নিয়ে আরও বেশি ভাবতে শুরু করলাম আমি, যতোটা আর বাকি জীবনে কখনও করিনি।’
মালাউনরা মনে করে ভারত হলো শুধু হিন্দুদের দেশ। “মুসলিমদের কারণে সেখানে হিন্দুরা নানা রকম সমস্যায় পড়ছে” বছর দুয়েক আগে এমনই অভিযোগ করেছিল উত্তর প্রদেশ বিজেপির আইন সভার সদস্য সন্ত্রাসী বিক্রম সাইনি । সে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, যারা হিন্দু ধর্ম অনুসরণ করছে ভারত শুধু তাদের।
আর এ নিকৃষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনার বাস্তবায়নেই তারা এখন প্রকাশ্যে মুসলিমনিধন শুরু করেছে। কেবল মুসলিম পরিচয়ের কারণে গুলি করে হত্যা করছে। হিন্দু সন্ত্রাসীদের এরূপ অপকর্মের কারণে ভারতীয় মুসলিমরা এখন চরম আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কি কেউ নেই? জাতিসংঘ, ওআইসির মতো বৈশ্বিক সংগঠনগুলো কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে বা নিবে? নাকি তারাও মনে করে ভারতে মুসলিমদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই?
প্রশ্ন তো আছে অনেক, কিন্তু জবাব দেওয়ার লোক নেই। সমস্যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সমাধান করার লোক নেই। তবে হ্যাঁ, কেউ কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী সমাধান করতে চাইলে তাকে সন্ত্রাসী বলার লোকের আবার অভাব নেই। ভারতের মুসলিমরা আজ নির্যাতিত, তাদের জন্য আমাদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ আছে? নেই। দুদিন পর যদি কেউ ভারতীয় নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে হিন্দু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, তাহলে তাকে কী বলবেন? সন্ত্রাসী। হ্যাঁ, এটাই হয়ে গেছে আমাদের নীতি।
লেখক: উসামা মাহমুদ, প্রতিবেদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।
Comment