রামমন্দির নির্মাণ:
রামরাজত্ব কায়েমের ভিত্তি স্থাপন
রামরাজত্ব কায়েমের ভিত্তি স্থাপন
ভারতবর্ষে উগ্র হিন্দুত্ববাদী চেতনার পুনঃউন্মেষ ঘটে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকারের ছত্রছায়ায়। যার ফলশ্রুতিতে বিংশ শতকের প্রথম লগ্নে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নামের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য অখণ্ড ভারতবর্ষে কল্পিত রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা। আর এই আরএসএসের অঘোষিত রাজনৈতিক শাখা হচ্ছে ভারতে ক্ষমতাসীন দল নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বিজেপির প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা ঘোষণা করা হয় অযোধ্যার বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ। এই এজেন্ডা সামনে রেখেই ভারতের রাজনীতিতে শক্তিশালী উত্থান ঘটে বিজেপির। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে বাবরি মাসজিদ শহিদ করার মাধ্যমে রামমন্দির নির্মাণের প্রথম পদক্ষেপ সম্পন্ন করা হয়।
গেলো ৫ ই আগস্ট ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অনেকটা তড়িঘড়ি করে করোনা পরিস্থিতিতে তোয়াক্কা না করেই রামমন্দিরের কাজ শুরু করা হয়। প্রশ্ন হলো, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে কেন এত গুরুত্ব দিয়ে মন্দির বানানো হচ্ছে? বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ওই স্থানে রাম মন্দির বানানোর রাজনৈতিক গুরুত্বটা কী?
মূলত ভারতীয় মালাউনদের লক্ষ বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতকে নিয়ে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা। সন্ত্রাসী আরএসএসের নেতারা প্রকাশ্যেই দাবি করছে ‘অখন্ড ভারত’ এখন আর কোনও অবাস্তব কল্পনা নয়। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা টেলিভিশনে অখণ্ড ভারত নিয়ে মুখ খুলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। মাধব দলের খুব ক্ষমতাশালী একজন নীতি-নির্ধারক হিসেবেই পরিচিত। বহুবছর আরএসএসের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করার পর সঙ্ঘই(আরএসএস) তাকে দায়িত্ব দিয়ে বিজেপিতে পাঠিয়েছে দল আর আরএসএসের মধ্যে সমন্বয় রাখার জন্য । এমনকি কাশ্মীরে পিডিপির সঙ্গে সমঝোতা কিংবা বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে দলের যোগাযোগও সামলান এই রাম মাধব।
এই রাম মাধবকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো অখণ্ড ভারত নিয়ে এখন আরএসএসের মনোভাব কী? উত্তরে মাধব স্পষ্ট করে বলেন, ‘মাত্র ৬০ বছর আগে ঐতিহাসিক কারণে যে ভূখণ্ডগুলো আলাদা হয়েছিল, আরএসএস বিশ্বাস করে, সেগুলো পুনরায় একদিন অখণ্ড ভারতের অংশ হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন আরএসএস সদস্য হিসেবে আমিও তা মনে করি।’
সঙ্ঘের প্রবীণ নেতা এমজি বৈদ্য একধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একদিন আবার জুড়তেই পারে।’
এছাড়া ভারত জুড়ে আরএসএসের অজস্র শাখায় প্রভাতী অনুশীলনের সময় আজও অখণ্ড ভারতের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসী আরএসএসের নেতারা অখণ্ড ভারতের মানসে ভারতীয় হিন্দুদের প্রস্তুত করতে নানামুখী কর্মসূচি পালন করে চলেছে।
আরএসএসের মূল উদ্দেশ্য শুধু অখণ্ড ভারত নয় বরং গোটা অঞ্চলে তাদের কাল্পনিক দেবতা রামের রাজত্ব গড়ে তোলা। রামরাজত্ব কায়েম করতে হলে আগে রামকে বাস্তব প্রমাণ করতে হবে। তার জন্মভূমি বের করতে হবে। অন্যথায় কিভাবে গোটা উপমহাদেশে রাম রাজত্ব কায়েম করবে! কিছু হিন্দুদের দাবি ভারতের অযোধ্যায় রামের জন্মভূমি। আবার অনেকের ধারণা ভিন্ন কোথাও। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি রামের জন্ম নেপালে হয়েছিল বলে সম্প্রতি যে দাবি করেছে তা প্রতিষ্ঠিত করতে সেখানেও রামমন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার সোপান হিসেবে রামের স্মরণের তীর্থ স্থান তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আরএসএস। ভারতভূমে রামকে প্রাসঙ্গিক হিসেবে উপস্থাপন করতেই রামমন্দির নির্মাণের প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে।
রাম একটি কাল্পনিক চরিত্র। এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে রাম চরিত্রের প্রকৃত কোন ভিত্তি নেই। নিরপেক্ষ ও সূক্ষ্ম সমালোচক, ঐতিহাসিকগণ এবং খ্যাতিমান হিন্দু পণ্ডিতরাও রামকে একটি কাল্পনিক চরিত্র হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। তারা রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণকে ইতিহাস হিসেবে স্বীকার করেননি। তাদের মতে রামায়ণ, পুরাণ ও মহাভারত কাব্যের বই, ইতিবৃত্ত নয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুরেন্দ্র নাথ এমপিএইচডি,আরএস, ডিলিট-এর মতে রাম ও যুধিষ্ঠির নামে কোনো রাজা ছিলনা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘স্মৃতি পুরাণাদি সামান্য বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের রচনা; ভ্রম, প্রমাদ, ভেদবুদ্ধি ও দ্বেষবুদ্ধিতে পরিপূর্ণ।’
আর বাবরি মসজিদ সংক্রান্ত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ও ছিল সেই কাল্পনিক চরিত্র রামের স্বীকৃত মিথ্যা ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার জুডিশিয়াল অপপ্রয়াস বৈ অন্যথা নয়।
এজন্য ভারতীয় মালাউনরা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রাম মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে রামের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চাচ্ছে। রামরাজত্ব কায়েমের পথকে মসৃণ করতে প্রয়াস চালাচ্ছে। যাতে তাদের অখণ্ড ভারত নির্মাণের কাজটা সহজ হয়ে যায়। যেন ভারতজুড়ে রামরাজত্ব কায়েমের দাবিতে মূর্খ হিন্দুদের সোচ্চার করা যায়; রামকে একজন মহান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। আর অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থান বেছে নেয়ার মাধ্যমে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের বিদ্বেষ চাঙ্গা করাও তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। এরইমধ্যে হিন্দুদের মাঝে একটি মিথ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে মুসলিমরা ক্ষমতায় থাকা কালে রামমন্দির ভেঙে বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিল এবং তারা তাই রামের জন্মস্থানে রামমন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে! যাতে মূর্খ অন্ধভক্ত হিন্দু সন্ত্রাসীদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া যায়।
আর এই অপপ্রয়াস কেবল ভারতের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ নয়। এটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেও দেখার সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে বাংলাদেশহ অন্যান্য দেশের হিন্দুরাও রাম মন্দির নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেছে। বাংলাদেশে হিন্দু মহাজোটের প্রধান গোবিন্দ প্রামাণিক তার কর্মীদের অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্বুদ্ধ করে বক্তৃতা দিয়েছে। এছাড়াও এদেশের অন্যান্য হিন্দু সংগঠনগুলোও রামরাজত্ব কায়েমের নিমিত্তে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আনলে হলফ করেই বলা যায় রাম মন্দির নির্মাণ হচ্ছে রামরাজত্ব কায়েমের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি স্থাপন। ঘটা করে এই রাম মন্দির নির্মাণকে কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকস্মিক ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি সন্ত্রাসী আরএসএসের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ বিশেষ। যার চূড়ান্ত লক্ষ ভারতবর্ষ থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ ও দমন করে কল্পিত রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা।
এহেন পরিস্থিতিতে উপমহাদেশব্যাপী উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্লাবন ঠেকাতে ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মুসলিমদের পরিকল্পিত প্রস্তুতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের সামগ্রিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ মনে করছেন উপমহাদেশের মুসলিমদের দোরগোড়ায় হাদিসে উল্লেখিত গাজওয়াতুল হিন্দ কড়া নাড়ছে। আর এখন প্রস্তুতি নিতে কালবিলম্ব করা হবে চরম অর্বাচীন সীদ্ধান্ত।
লেখক: উসামা মাহমুদ, প্রতিবেদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।
Comment