স্বাধীনতার মোড়কে নব্য উপনিবেশবাদ
স্বাধীনতা শব্দটি মায়াময়। আবেগ জড়ানো। স্বাধীনতার বিপরীত শব্দ হচ্ছে পরাধীনতা বা পরের অধীন থাকা। আমাদের উপমহাদেশ তথা ভারতবর্ষ একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিলো। দীর্ঘ ১৯০ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭সাল) ব্রিটিশদের কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে শাসিত ও শোষিত হয়েছে এই ভূখণ্ডের মানুষেরা।[1] ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ইংরেজরা স্বশরীরে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ ছিলো। সে সূত্র ধরে আগস্ট মাসকে উপমহাদেশের মানুষরা স্বাধীনতা বা আজাদীর মাস হিসেবেই বিবেচনা করে। ভারত ও পাকিস্তানে ঘটা করে উদযাপনও করা হয় আগস্টকে স্বাধীনতার মাস ও নির্দিষ্ট একটি দিনকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে।[2]
স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের পূর্বে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন, ভারত বর্ষ কি আসলেই স্বাধীন? বা ইংরেজরা কী আদৌও স্বাধীনতা দিয়েছে? যুদ্ধ করে উপনিবেশ গড়ে তোলার পর সকল উপনিবেশ থেকে ব্রিটিশদের অকস্মাৎ চলে যাবার কারণই বা কী? ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে হওয়া নবগঠিত রাষ্ট্রসমূহ এখন পর্যন্ত কেন ব্রিটিশ রানীর প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ও নতজানু? সাবেক ব্রিটিশ কলোনি গুলোর মধ্যে আমেরিকার শক্তিশালী প্রভাব বলয় গড়ে উঠলোই বা কীভাবে?
এ সকল প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের রেখে আসা অতীত ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের জানতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ শুরু হয়ে ১৯৪৫ সালে এসে সমাপ্ত হয়।[3] এই যুদ্ধে পৃথিবীর সকল শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্রিটেন অথবা জার্মানি যে কোন এক পক্ষে অংশ নিলেও, আমেরিকা প্রথম দিকে এ যুদ্ধে অংশ নেয়নি।[4] তারা কোন পক্ষে না যেয়ে নজর রাখা শুরু করে কীভাবে এ যুদ্ধ থেকে নিজেদের সর্বোচ্চ স্বার্থ হাসিল করা যায়।
১৯৪০ সালে হিটলারের জার্মানি ব্রিটেনের মিত্র ফ্রান্স দখল করে নেয়।[5] এতে ব্রিটেন নিজের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে জার্মানির মিত্র জাপান ব্রিটিশদের থেকে মায়ানমার দখলে নেয়,[6] তখন সবদিক থেকে কোনঠাসা ব্রিটেন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমেরিকার সহায়তা কামনা করে। ধূর্ত আমেরিকা হয়তো এ সময়েরই অপেক্ষায় ছিলো। আমেরিকা ব্রিটিশদের সাথে ‘গিভ এন্ড টেক’ নীতি গ্রহণ করে। যুদ্ধে সহায়তার শর্তে আমেরিকার সাথে একটি চুক্তিতে আস্তে বাধ্য হয় ব্রিটেন।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৯ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার নিউফাউন্ডল্যান্ড দ্বীপের কাছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকেপ্রিন্স অফ ওয়েলস’ নামে একটি যুদ্ধজাহাজে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের নামে কলোনি বিরোধী ধারাসহ আটদফা সুত্র সম্বলিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি ”আটলান্টিক সনদ” (‘Atlantic charter’ 1941 ) নামে পরিচিত।[7] এই সনদে যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করে এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি আনয়নে পারস্পরিক আলাপ আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সকল আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত হয়। এই চুক্তির একটি দফা ছিলো, “স্বনির্ভর জাতি তার জনগণের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীন সরকার গঠন করবে ” অর্থাৎ আমেরিকার সাহায্যে ব্রিটিশরা যুদ্ধে বিজয়ী হলে যুদ্ধের পর কলোনিসমূহকে স্বাধীনতা দিতে হবে, কলোনি সমূহ রিপাবলিক তথা প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে।[8]
এরপর ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের মিত্র সোভিয়েত নেতা স্টালিন এবং চীনের নেতা চিয়াং কাইশেক ওই একই চুক্তির ড্রাফটে আমেরিকা ইংল্যান্ডের সাথে মিলে চার রাষ্ট্র স্বাক্ষর করে। এই চার রাষ্ট্রের চুক্তিটাকেই আবার জাতিসংঘ জন্মের ঘোষণা বলা হয়।[9]
এই আটলান্টিক চার্টারে স্বাক্ষরের অর্থ দ্বারায় ব্রিটিশ , ফ্রান্স , জাপানসহ সকল দেশের কলোনি সমূহ রিপাবলিক তথা প্রজাতন্ত্রে রূপ দেয়া হবে। আর সদ্য স্বাধীন হওয়া রিপাবলিক রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমেরিকা ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠা করে জাতিসংঘ।[10] কোলনি থেকে সদ্য প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহকে দেয়া হবে জাতিসংঘের সদস্যপদ। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার বছরেই প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে বছরের অক্টোবরেই ঘোষণা করা হয় জাতিসংঘ চার্টার। আর আমেরিকাসহ ২য় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী পক্ষের অপর চার রাষ্ট্রের ( ব্রিটেন,ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন) কাছে রাখা হয় ভেটো প্রদানের ক্ষমতা।[11] ভেটো হচ্ছে একটি বিশেষ ক্ষমতা, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সকল রাষ্ট্র মিলেও যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয় আর ভেটো প্রদানের ক্ষমতা সম্পন্ন পাঁচটি রাষ্ট্রের যে কোন একটি রাষ্ট্র যদি সে প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়, তবে সে প্রস্তাব আর গৃহীত হবে না।
এভাবেই কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে কুক্ষিগত করে নেয় সারা পৃথিবীকে। সাবেক কলোনিগুলো নামেমাত্র স্বাধীনতা পায় এবং জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে আবার কিছু রাষ্ট্রের অধিনস্ত করে রাখা হয় এ সকল সাবেক কলোনি ও দূর্বল রাষ্ট্রগুলোকে। আর সদ্য গঠিত হওয়া রাষ্ট্রসমূহের
সীমান তারাই এঁকে দেয়। প্রতিটি রাষ্ট্র পায় একটি করে নতুন পতাকা। আর ছড়িয়ে দেয়া হয় ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প।
এগুলোই হচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশদের চলে যাবার অন্যতম কারণ। ব্রিটিশরা এই দীর্ঘশাসন আমলে তৈরি করেছিলো নিজেস্ব ভাবাদর্শের রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মী।[12] উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পশ্চিমা দাসত্বমনা এলিটশ্রেণী। এরা গাত্রবর্ণ ভারতীয় হলেও চিন্তা-চেতনায় ইংরেজদের দাস। তাদেরকে প্রভুর সভ্যতার এনলাইটমেন্ট আলো (পড়ুন অন্ধকার) এতটাই চোখ ঝলসে দিয়েছিলো যে পশ্চিমা প্রভুদের সব কিছুই সুন্দর ও তা রক্ষা করা একান্ত দায়িত্ব মনে করেছে এই এলিট শ্রেণী নামক মানসিক দাসরা। তাদের একান্ত অনুগত সামরিক কর্মচারীদের দেয়া হয় অফিসার য্যাংক।[13] তাদের হাতেই মানসিক ও শারীরিক সেবাদাসদের সমন্বয়ে গড়ে উঠে সদ্য প্রজাতন্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনী, আর তাদের হাতেই পড়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ভার। বিচারব্যবস্থা, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অর্গান পরিচালনার দায়িত্বপাবে সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত দাসরা। আমেরিকায় অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অর্থনীতি বানানো হয় পশ্চিমা নির্ভরশীল ও নিয়ন্ত্রিত। এককথায় বলতে গেলে ব্রিটিশরা সাম্রাজ্য ছেড়ে স্বশরীরে চলে গেলেও প্রতিষ্ঠা করে যায় নব্য সাম্রাজ্যবাদী স্বায়ত্তশাসন। আর এ নব্য উপনিবেশবাদে ভালো-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ তারাই করছে। জাতিসংঘ প্রবর্তিত সনদের বাইরে গেলেই সে রাষ্ট্র হয়ে যাবে উগ্র,বর্বর, অসভ্য, মধ্যযুগীয় ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রে অবরোধ, হামলা, লাখো লাখো জনগণ হত্যা কোন কিছুই অন্যায় নয় এই নব্য সাম্রাজ্যবাদের অভিধানে।
যারা সম্রাজ্যবাদের এই ছকের বাইরে চলতে চাইবে তারা হয়ে যাবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী। এটাই বর্তমান পৃথিবীর আজাদী বা স্বাধীনতার বাস্তবতা। তারা প্রকৃত স্বাধীনতা দিয়ে যায়নি, দিয়ে গেছে পরাধীনতার নতুন ভার্সন। তৈরি করেছে দূরে বসে শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার নতুন ফর্মুলা। গায়রতহীন পশ্চিমাব্যবস্থার কোনো মানসিক দাস ব্রিটিশদের ফিজিক্যালি এই চলে যাওয়াকে স্বাধীনতা মনে করতে পারে কিন্তু সুস্থবোধ সম্পন্ন কারো পক্ষে নতুন মোড়কে পরাধীনতাকে স্বাধীনতা মনে করার কোন কারণ নেই। উপমহাদেশ স্বাধীন তখনই বলা যাবে যখন উপমহাদেশে বিজাতীয় প্রভাবমুক্ত সত্যধর্ম ইসলাম হবে পুনঃরায় নিয়ন্ত্রক শক্তি। সেটাই হবে ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপে ফিরে যাওয়া। আর বর্তমানে পরাধীন থেকে মিছে স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন আত্মপ্রবঞ্চনা বৈ অন্য কিছু নয়।
তথ্যসূত্র:
1.www.globalsecurity.org/report:British Bengal – 1757-1947
2.https://www.telegraph.co.uk/8702510/...dence-Day.html
3.https://www.britannica.com/event/World-War-II
4.https://tekleaders.com/us-entry-into-ww2-essay
5.http://www.bbc.co.uk/history/worldwa...rance_01.shtml
6.http://www.historyofwar.org/articles..._japanese.html
7.https://www.un.org/en/sections/histo...ter/index.html
8.https://www.jstor.org/stable/2145412
9.https://www.history.com/.amp/topics/...united-nations
10.https://www.un.org/en/about-un
11.https://research.un.org/en/docs/sc/quick
12.https://www.nytimes.com/1984/09/16/m...-a-colony.html
13.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Mili...ry_of_Pakistan
লেখক: রাফিদ ইয়াজভান
Comment