কেবল রক্ষীবাহিনী নয় শেখ মুজিব ‘মুজিববাদ’ প্রতিষ্ঠা ও নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বিশেষ বাহিনী গঠন করে। তার দলীয় কর্মীদের ভিন্নমত দমনের জন্য খুনের লাইসেন্স দিয়ে দেয়। রক্ষীবাহিনীর আদলেই বাহিনী গুলো গড়ে তোলা হয়েছিলো। তার মধ্যে অন্যতম হলো আওয়ামী লীগ সদস্যদের নিয়ে গঠিত ডিফেন্স কমিটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিফেন্স কমিটির সদস্যরা জবাই করে হত্যা করতে পছন্দ করতো। জবাই করা লাশের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সাক্ষাৎকার মারফত জানা গেছে,
“ওরা খুনের কাজে যথেষ্ট নিপুন ছিলো। হাত পা প্রথমে পিছমোড়া করে বেঁধে অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে শিকারকে আগে কাহিল করে নিতো, করে চিৎ করে শুইয়ে কণ্ঠনালীর উর্ধাংশে নরম জায়গায় ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে জবাই করা হতো। সাধারণত ঈশ্বরগঞ্জে এসব জবাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট কিছু লোক ছিলো। এ ধরনের একজন খুনির সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে যে, সে প্রতিটি খুনের জন্য ঊর্ধ্বে ২০টাকা পর্যন্ত পেতো।” [১]
১৯৭২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এক বক্তৃতায় বলেন,
“আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিশ্বের নবতম মতবাদ মুজিববাদ বাংলার ঘরে ঘরে প্রচারের জন্য একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
এরপর তারা সারা দেশ জুড়ে লাঠিসহ ট্রেনিং শুরু করে। শ্রমিকলীগ ১ লাখ সদস্য সংগ্রহের টার্গেটে গঠন করে ঘৃণ্যতম লালবাহিনী। ১৯৭২ সালের ১মে লাল বাহিনীর নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন যে ৭ জুন থেকে তারা সমাজ বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে। এরপর থেকে তারাও অরাজকতা ও নৈরাজ্যের রাজ কায়েমে তৎপর হয়ে উঠে। এ বাহিনীর সাথে পুলিশ বাহিনীর সাথেও সংঘর্ষ হয়। এভাবে এখনো রক্ষীবাহিনী, কখনো লালবাহিনী বা কখনো অন্য কোন মুজিববাদী সংগঠন দিয়ে প্রতিবাদী জনতার কন্ঠরোধের চেষ্টা করে যায় শেখ মুজিব সরকার।
১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জনপ্রিয়তায়
তলানিতে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয় লাভ করে। এই জয়ের পেছনেও রক্ষীবাহিনীর বড় ভূমিকা ছিলো। তারা সারা দেশে ভোট কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে বড় জয় এনে দেয়। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে দেখা যায় শেখ মুজিবের দুই নির্বাচনী আসনসহ ১০ জন ডাকসাইটে আওয়ামী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে দাঁড়াতেও দেওয়া হয়নি। আর বাকি আসনগুলোতেও যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো তাদেরকেও বহু অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করা হয়।
৭ই মার্চ পাতানো নির্বাচন সম্পর্কে আবু জাফর মোস্তফা সাদেক লিখেছেন, “ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাস, নির্বাচন প্রহসনে পরিণত – ইত্যাদির মধ্য দিয়ে মুজিব সরকার ক্ষমতাশীন হয়। ভোটের পর অনেকটা প্রকাশ্যেই শুরু হয়- আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী/ জয়বাংলা বাহিনী/ লালবাহিনী/ যুবলীগসহ বিভিন্ন বেসামরিক সামরিক ও আধা-সামরিক, রক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বিরোধী দলীয় কর্মী গুম, ব্যাংক ডাকাতি, লুট, খুন, হাইজ্যাক ও ধর্ষণের এক বিভীষিকাময় রাজত্ব।” [২]
মুজিবের শাসনকালে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে যায় যে, অভ্যন্তরীণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের এক গ্রুপের হাতে অপর গ্রুপের সদস্যরা খুন হতে থাকে। মুজিবের শাসনকালীন সময়ে ৫জন আওয়ামী লীগের সাংসদ খুন হয়, তাদের মধ্যে জনের ৪ জনের হত্যার সঙ্গে আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই জড়িত ছিলো।১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে নির্মমভাবে খুনের শিকার হন ছাত্রলীগ করা ৭জন শিক্ষার্থী। যা মুহসিন হল সেভেন মার্ডার নামে খ্যাত।[৩] এ ঘটনার তিন দিন পর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকে হত্যার জন্য দায়ী হিসেবে গ্রফতার করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের জিএস রোকনকে হত্যা করা হয়। এভাবে ছাত্ররাজনীতি কলুষিত করা হয়।
আর এই খুন গুমের রাজনীতি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন পর থেকেই শুরু করে। ৭২ এর জানুয়ারিতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩নং আসামি ও অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা স্টুয়ার্ড মুজিবকে গুম করা হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের হতে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আওয়ামী নেতাদের অনেক দুষ্কর্মের ফিরিস্তি জেনে ফেলেছিল স্টুয়ার্ড মুজিব, এজন্যই তাকে গুম করা হয়েছে। একই কারণে গুম করা হয় চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক জহির রায়হানকে। নরসিংদী জেলার অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা নেতা নেভাল সিরাজকেও হত্যা করা হয় স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে। তাঁদের সকলের হত্যাতেই মুজিববাহিনীর নাম উঠে আসে।
শেখ মুজিবের অপরাজনীতি ও জুলুমের এক পর্যায়ে তৎকালীন বামদের একটি অংশ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। জাসদের নেতৃত্বে গণবাহিনী গঠিত হয়। যাদের সাথে সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা মুজিববাদী আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে সর্বাহারা পার্টিও মুজিবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। দেশ জুড়ে প্রতি বিপ্লবের ঢেউ উঠে, এতে প্রচুর মানুষ হতাহত হয়। শেখ মুজিবের শাসনামলে বাংলাদেশ কখনোই স্থিতিশীল ছিল না। পুরোটা সময় জুড়ে খুন-গুম, চোরাচালান, লুটপাট, বিচারবহির্ভূত হত্যা ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কর্মহীন মানুষের নাভিশ্বাস, অপরদিকে নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির করাল গ্রাসে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয় সমগ্র বাংলাদেশ। তৎকালীন অসহায় মানুষদের শেখ মুজিবের পতন ও মৃত্যু কামনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না!
এছাড়া গণমানুষের সেন্টিমেন্টের বিপরীতে সংবিধান প্রণয়ন, অর্থনৈতিক সংকট ও দেশ জুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, জননিরাপত্তা হীনতা এগুলোই ছিলো বাংলাদেশকে দেয়া শেখ মুজিবের উপহার। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করে। তৎকালীন মুজিব সরকারের ইসলাম বিরোধী রাষ্ট্রনীতি, ভঙ্গুর অর্থনীতি, নতজানু বৈদেশিক সম্পর্ক, ধর্মহীন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
চলবে ইনশা আল্লাহ…
তথ্যসূত্র:
১.ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমদ মুসা; পৃ:১১৬
২.বাংলাদেশ কমিউনিস্ট আন্দোলন- পৃ:৭৫
৩.রক্তাক্ত ছাত্ররাজনীতি (দ্বিতীয় পর্ব): ঢাবি মুহসীন হলের সেভেন মার্ডার- হাসান ইজ জামান।
Comment