এদেশের অগনিত মানুষের আশা ছিলো পাকিস্তান থেকে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে, কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। শোষণহীন সমাজ দেখতে পাবে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জনগনের সব আশাই গুড়ে বালি হয়ে যায় মুজিবের নেতৃত্বাধীন ভারতপন্থী আওয়ামী লীগের শাসনমলে। আওয়ামী শাসনামলের শুরু থেকেই হু হু করে বাড়তে থাকে চাল, গম, তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি দ্রব্যের দাম। আওয়ামী শ্রেণীস্বার্থমূলক কৃষিনীতির কারণে কৃষকরা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হন, আর আঙুল ফুলে কলা গাছ হতে থাকে কতিপয় মধ্যস্বত্বভোগী মজুতদার ও কালোবাজারি। এছাড়া একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ দেশের সম্পদ ভারতে পাচার করতে থাকে, দেখা দেয় খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
শেখ মুজিবের সত্তরসনের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম ঘোষণা ছিলো ক্ষমতায় গেলে ১০ টাকা মণ গম ও ২০ টাকা মণ চাল খাওয়াবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি বরং পাকিস্তান আমলের চেয়েও বহুগুন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মুজিব যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন চালের মণ ছিলো ৪০ টাকা, একবছর অতিবাহিত হবার আগেই সে চালের প্রতি মণের দাম হয় ৯০ টাকা। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের সময় ধানের মণ ছিলো ২৫ টাকা বছর শেষে দাম দাঁড়ায় ৫০ টাকা মণ। মুজিব ক্ষমতা গ্রহণের সময় মসুরের ডাল প্রতি সের ১ টাকা ছিলো বছরের শেষে দাম দাঁড়ায় ৩ টাকা সের। গামছা প্রতি পিস ছিলো ১ টাকা তা হয়ে যায় ৫ টাকা পিস। ৬ টাকার শাড়ি কাপড়ের দাম বেড়ে বছরের শেষে হয় ৩৫ টাকা। লুঙ্গি ৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা হয় যায় একবছর অতিবাহিত হবার আগেই।[১]
শেখ মুজিব ক্ষমতাগ্রহণের এক বছর না যেতেই এভাবে প্রতিটি পণ্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। বহু হতদরিদ্র মানুষ ক্রয় করার সামর্থ্য হারিয়ে অনাহারে বা অর্ধাহারে দিনানিপাত করতে বাধ্য হন। তখন থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে মুজিবের ফাঁকাবুলি ও মিথ্যে আশ্বাসের বাস্তবতা বুঝতে শুরু করেন। ক্রমশ প্রতিবাদ ও জনক্ষোভের প্রকাশ ঘটতে থাকে। ৭২ সালে পল্টনে আয়োজিত এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের উদ্দশ্যে মোজাফফর আহমদ বলেন,
‘…. আপনি ভাত দিতে পারবেন না, তবে কিল মারার গোসাই কেন? চোখ থাকতে দেখছেন না, কান থাকতে শুনছেন না কেন? দুর্নীতিবাজ এমসিএ, আড়তদার, মজুতদার, মুনাফাখোর, দুর্নীতিবাজ দালাল কর্মচারীদের শাস্তি দেয়া হয়নি কেন? শুধুমাত্র কয়েকটি ভালো ভালো কথা ও ঘোষণা ছাড়া সত্যিকারভাবে জনগণ কী পেয়েছে?’ [২]
সেদিনের জনসভায় ভাষণে মতিয়া চৌধুরী বলেন,
‘ ২২ পরিবারের বদলে ২২শ’ পরিবার গড়ে তোলা হচ্ছে।’ [৩]
২১ জুলাই পল্টনের এক জনসভায় মুজিববাদীদের উপহাস করে একটি সংগীত পরিবেশন করেন গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর। যার একটি লাইন ছিলো এরকম, “১০০ টাকা চালের দাম, মুজিববাদের অপর নাম” [৪]
মহিউদ্দিন আহমদ তার জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি বইতে লিখেন, ৭০ সালে ১ সের চালের দাম ছিলো এক টাকা। তেহাত্তরের প্রথম দিকেই চালের সের তিন টাকায় ওঠে এবং বছরের শেষে তা ৮ টাকা হয়ে যায়। চোরাচালান বেড়ে যায় বহু গুন।[৫]
ক্রমাগত লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে এদেশের মানুষের নাভিশ্বাস উঠে। অনেক মানুষ এক কাপড়ে বছর পার করতে বাধ্য হন। সবার মুখে মুখে একই কথা এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আগামীর দিনগুলো তারা খাবেন কী? কীভাবে ক্ষুধার সাথে সাথে মোকাবেলা করে বাঁচবেন! অনেকেই তখন দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছিলেন। সে সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত কিছু সংবাদের দিকে তাকালে তৎকালীন জনগণের দুরাবস্থার কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তৎকালীন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু সংবাদ নিম্নে দেয়া হলো:
# খাদ্যের অগ্নিমূল্য কমাও: লজ্জা নিবারণের বস্ত্র দাও। (২০ আগস্ট ১৯৭২, ইত্তেফাক)
# গ্রামে হাহাকার: চাল দাও। আটা কচু সিদ্ধ খেয়ে আর কদ্দিন? ( ২৩ আগস্ট ১৯৭২, গণকন্ঠ )
#কুড়িগ্রাম পৌরসভার নিকটস্থ মঙ্গলের হাট নিবাসীর রোস্তম উল্লাহ’র স্ত্রী রাবেয়া খাতুন তার আদরের দুলালী ফাতেমা খাতুনকে (৭বছর) পৌরসভার জনৈক পিয়ন জমির উদ্দিন এর কাছে মাত্র ছ’টাকায়(৬টাকায়) বিক্রি করে দেয়। (২১ অক্টোবর,১৯৭২, জনকন্ঠ)
# চাউল আকাশচুম্বী: আটা উধাও: কেরোসিন ও ওষুধ নাই, শুধু আছে হাহাকার আর আত্মহত্যা। (২২ শে এপ্রিল১৯৭২, ইত্তেফাক)
# চালের অভাব: পেটের জ্বালায় ছেলে মেয়ে বিক্রি হবিগঞ্জ। হাহাকার: ক্ষুধার জ্বালায় পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু। ( ৩মে ১৯৭৩, গনকন্ঠ)
#কোন কোন এলাকার মানুষ আটা গুলিয়া ও শাক-পাতা সিদ্ধ করিয়া জঠর জ্বালা নিবারণ করিতেছে (৩ মে ১৯৭৩, ইত্তেফাক)
# অনাহারে দশ জন মৃত্যু: বিভিন্ন স্থানে আর্ত মানবতার হাহাকার: শুধু একটি ধ্বনি: ভাত দাও (১০ মে ১৯৭৩ গনকন্ঠ)
# লতাপাতা, গাছের শিকড়, বাঁশ ও বেতের কঁচি ডগা, শামুক, ব্যাঙের ছাতা, কচু-ঘেচু পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যের পরিণত: গ্রামাঞ্চলে লেংটা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি।(১০ মে ১৯৭৩, ইত্তেফাক)
#স্বাধীন বাংলার আরেক রূপ: জামাই বেড়াতে এলে অর্ধউলঙ্গ শাশুড়ি দরজা বন্ধ করে দেয়। (১৫ জুলাই ১৯৭৩, সোনার বাংলা)
সে সময় দেশের অবস্থা কতোটা ভয়াবহ ছিলো তার প্রমাণস্বরূপ এই ভিডিওটি দেখা যেতে পারে- John Pilger: An Unfashionable Tragedy (1975)- https://tinyurl.com/yy7xvk27
দেশের মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় দুর্ভোগ ও অবর্ণনীয় কষ্টের চরমসীমা অতিক্রম করলেও আওয়ামী নেতা ও সরকারি আমলাদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ভোগ দখলের প্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। মুজিব পরিবার ও তার আত্মীয় স্বজনেরা রাষ্ট্রীয় সম্পদকে নিজের সম্পদ মনে করে ভোগ দখল করতে থাকে।
আওয়ামীদের হীন লিপ্সার জন্য ১৯৭৩-এর জুলাই থেকে ১৯৭৪ এর এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ২২ মাসের মধ্যে ১০০ ভাগ নয়, ২০০ ভাগ নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। বিশেষ
ক্ষেত্রে তা হাজারের কোটা ছাড়িয়ে ১৫০০ ভাগ হতেও দেখা গেছে। আর তা সরকারী হিসেবেই। এই সময় সরিষার তেল, নারিকেল তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ১৩২ ভাগ ও ২১৮ ভাগ। হলুদের দাম বেড়েছে ২২০ ভাগ। আদার
দাম বেড়েছে ১৪০ ভাগ। আর সবচেয়ে দাম বেশী বেড়েছে লংকার। একেবারে ১৫০০ ভাগ।
এই সময় সরকার রেশনের চালের দাম বাড়িয়েছে ২৯ টাকা থেকে ৪০ টাকায়। বৃদ্ধির হার ৩৮%। ১৯৭২-এর ১ জুলাই প্রতি মণ সরু আমন চালের খুচরা দাম ছিল বাজারে ৭৫ টাকা। ১৯৭৩-এর জুলাইতে হয়েছে ১১৫ টাকা। ১৯৭৪-এর মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১৬০ টাকা। বৃদ্ধির হার ২১৫%। মসুর ডাল ১৯৭২-এর ১ জুলাই প্রতি মণ ৪১ টাকা, ১৯৭৪-এর মার্চে ১৫০ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৫৪ ভাগ। মুগ ডাল ৫০ টাকা, ১৯৭৪-এর মার্চে ১৮০ টাকা, বৃদ্ধির হার শতকরা ১৬০ ভাগ। মটর ১৯৭২-এর জুলাইতে প্রতি মণের দাম ৩৫ টাকা, বৃদ্ধির হার শতকরা ২৭০ ভাগ হয়ে ১৯৭৪-এর মার্চে ১৩০ টাকা। সরিষার তেল ১৯৭২-এর জুলাই মাসে প্রতি মণ ২৮০-৩২৫ টাকা। ১৯৭৪-এর মার্চে প্রতি মণ ৬২০-৬৫০ টাকা। বৃদ্ধির হার শতকরা ১৩২ ভাগ। সয়াবিন তেল ১৯৭২-এর ১ জুলাই প্রতি মণ ৪২৬ টাকা হতে ৪৫০ টাকা। ১৯৭৪-এর মার্চ মাসে ১০০০-১১০০ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৩০ ভাগ। গরুর গোশত ১৯৭২-এর জুলাই মাসে প্রতি সের দাম ছিল ৩.০০-৩.২৫ টাকা। ১৯৭৪-এর মার্চে ৯.০০-১০.০০ টাকা। বৃদ্ধির হার ২৩৩ ভাগ। খাসির গোশতের দাম বেড়েছে শতকরা ২০০ ভাগ। মোরগের দাম বেড়েছে ১৫৫ ভাগ। জিরার দাম বেড়েছে ৩০০ ভাগ। হলুদের দাম বেড়েছে ২৬০ ভাগ, লম্বা হলুদের দাম ২৫৩ ভাগ। ধনিয়ার দাম ১৫০ ভাগ। ছোট ও বড় এলাচির দাম বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ২৫০ ভাগ ও ১৫০ ভাগ। কালি জিরার দাম বেড়েছে ১১০ ভাগ।
১৯৭২-এর জুলাই মাসে জ্বালানি কাঠের দাম ছিল প্রতি মণ ৬ টাকা। ১৯৭৪-এর মার্চে তা
বেড়ে হয়েছে ১৪-১৬ টাকা। বৃদ্ধির হার ২৪০ ভাগ। এই সময়ে কেরোসিন তেলের দাম বেড়েছে ২৪৩ ভাগ। ১৯৭২-এর জুলাই মাসে প্রতি তোলা তেজাবী সোনার দাম ছিল ৩০০ টাকা। ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯৫০ টাকা। বৃদ্ধির হার ২১২ ভাগ। গিনি সোনার দাম বেড়েছে শতকরা ২০৩ ভাগ ও রূপার দাম বেড়েছে ২০৮ ভাগ। [৬]
চলবে ইনশা আল্লাহ…
তথ্যসূত্র:
১. ‘ভাসানী’ প্রথম খণ্ড, সৈয়দ আবুল মকসুদ; পৃ: ৪৬৩-৪৬৪
২. ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমদ মুসা; পৃ:১৪৩
৩.জগলুল আলমের ‘বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-১৯৮৯”; পৃঃ ৭৭
৪. ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ, আহমদ মুসা; পৃ:৮১
৫. ‘জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’, মহিউদ্দিন আহমদ; পৃ:১০৪
৬. আর্টিকেল: ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বিদায়, জিবলু রহমান
Comment