আল-কায়েদার উত্থানে আফ্রিকায় কর্তৃত্ব হারাচ্ছে ক্রুসেডার ফ্রান্স!
আফ্রিকায় বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকায় আল-কায়েদা মুজাহিদদের উত্থানের ফলে দিন দিন সেখানে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে দখলদার ফ্রান্স। আফ্রিকায় মুজাহিদদের এই উত্থান ও ক্রুসেডার ফ্রান্সের কর্তৃত্ব হারানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদদের আফ্রিকা দখলের লড়াই নিয়ে সামান্য আলোচনা করা দরকার।
ক্রুসেডার ফ্রান্স কর্তৃক আফ্রিকা দখল:
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের শতবছর পর ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা নতুন বাজার খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠে। তখন তাদের চোখ পড়ে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। ১৮৮৪-১৮৮৫ সালে বার্লিন সম্মেলন করে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকা দখলের লড়াই শুরু করে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা। ১৯১২ সালের মধ্যে ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া ছাড়া পুরো আফ্রিকা দখল করে নেয় ইউরোপের সাতটি দেশ। তাদের নেতৃত্বে ছিল ক্রুসেডার ফ্রান্স। এছাড়াও ছিল— ব্রিটেন, পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেন ও বেলজিয়াম। সময়ের পরিক্রমায় আফ্রিকার সচেতন মুসলিম জনসাধারণের তীব্র আন্দোলন ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের ফলে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষভাগে বেশিরভাগ দেশ ক্রুসেডারদের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এর জন্য আফ্রিকান মুসলিমদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মূল্য দিতে হয়েছিল।
কিন্তু ক্রুসেডার ফ্রান্সের দখল করা ২৪ দেশের মধ্যে ১৪ দেশে এখনো চলছে ফ্রান্সের শোষণ। টোগো, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো (ব্রাজাভিলা), নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনসহ ১৪ দেশকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সফ্রিকা বা ফ্রাংক জোন। ক্রুসেডার ফ্রান্স এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোনিয়াম, স্বর্ণ, জ্বালানি, কফির উপর যেমনিভাবে একচেটিয়া দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে বিনিয়োগের উপরও রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। ফ্রাংক মুদ্রা ব্যবহারকারী ১৪টি দেশের জল বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পরিবহন, ব্যাংক, কৃষি, নির্মাণ শিল্প—সবই ক্রুসেডার ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে।
এসব দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই এখনো জমা রাখতে হয় ক্রুসেডার ফ্রান্সের কাছে। আর তাদের আয়ের প্রায় ২০ শতাংশই ব্যয় করতে হয় ফ্রান্সের নানা দেনা মেটাতে। দেশ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হলে তাদের অর্থই ফ্রান্সের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। এই ১৪টি দেশকে ব্যবহার করতে হয় ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ফ্রাংক। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ফ্রান্সের মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে জোরপূর্বক ট্রেজারিতে সম্পদ রাখা ও ফ্রাংক ব্যবহার করার চুক্তি করিয়ে নেয় ক্রুসেডার ফ্রান্স। আর এসব পরিকল্পনার মূলহোতা ছিল তৎকালীন (১৯৫৯-১৯৬৯) ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ‘দ্য গল’। তারপর সে তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বন্ধু ‘জ্যাক ফোকার্ট’-কে দিয়ে আফ্রিকায় ‘ফ্রান্সফ্রিকা’ নামে একটি নেটওয়ার্ক দাঁড় করায়। এই নেটওয়ার্কের কাজ ছিল আফ্রিকা জুড়ে ক্যু, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও কারচুপির নির্বাচন জারি রাখা এবং মুসলিমদের উত্থানকে দমিয়ে রাখা।
ফ্রান্সের স্বার্থ বিরোধীদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ:
এ বিষয়ে আমরা বেশি দূরে না গিয়ে সাম্প্রতিক কালেরই কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৯ ও ২০২০ সালে মালি সরকার বাধ্য হয়ে আল-কায়েদার সাথে কয়েকবার বৈঠকে বসতে এবং একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। এসবের উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদা যেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু দখলদার শক্তির উৎখাত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার পবিত্র দায়িত্ব বাস্তবায়নে যে যুদ্ধ আল-কায়েদার মুজাহিদিন শুরু করেছেন, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পূর্বেই সেই যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ করে দেবেন? তাই আল-কায়েদা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হননি। বরং তারা মালি সরকারের সাথে এই শর্তে বৈঠক করতে রাজি হন যে, মালি থেকে দখলদার ফ্রান্সের সৈন্যদের হটাতে হবে এবং এখানে একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই বিষয়টি নিয়ে যখন মালি সরকার ফ্রান্সের সাথে আলোচনা করে তখনই ফ্রান্স মালি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চক্রান্ত শুরু করে। মনে করা হয়, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটি ২০২০ সালের শেষ দিকে বাস্তবায়নও করেছে ক্রুসেডার ফ্রান্স। অবশ্য মালি সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও জুলুমের কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন দেশটির জনগণও। যার ফলে তারাও বিভিন্ন সময় সরকার হটানোর আন্দোলন করেছিলেন।
এমনিভাবে চীন ঘেঁষা আইভেরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট ‘লঁরা বেগবো’ একটি সেতু গড়তে চেয়েছিল। এই সেতু নির্মাণে ফরাসি একটি সংস্থা মার্কিন ডলারে একটি দাম হাঁকে। কিন্তু তার অর্ধেক দাম হাঁকে চীনা প্রতিষ্ঠান। তারা অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছিল আইভরি কোস্টের প্রাকৃতিক সম্পদ কোকো বিন দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঁরা বেগবোকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়।
এর আগে সিলভানাস অলিম্পিতে ১৯৬৩ সালে টোগোতে নিজস্ব মুদ্রা চালুর লক্ষ্যে জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরের দিনই ফ্রান্সের প্রশিক্ষিত স্বদেশীয় দালালরা তাকে হত্যা করে। ১৯৬৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সফ্রিকার ১৪ দেশে ২২ জন সরকার প্রধানকে হত্যা করে ক্রুসেডার ফ্রান্স। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ক্রুসেডার ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএসই।
পশ্চিম আফ্রিকায় আল-কায়েদার উত্থান:
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ৯০ দশকে শুরু হয় ক্রুসেডার ফ্রান্স ও তাদের গোলাম সরকার বিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল। যা ধীরে ধীরে পবিত্র জিহাদে রূপ নেয়। এর ধারাবাহিতায় ২০১৩ সালের মধ্যে আল-কায়েদা (AQIM) সহ কয়েকটি জিহাদী দল মালির রাজধানী বামাকো পর্যন্ত পৌঁছে যান। তাঁরা রাজধানীর রেডিও-স্টেশন ও বিমান বন্দরসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে উত্তর মালি পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি মালির ৭৫% এলাকার উপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মুজাহিদগণ। সেসময় দেশটির জাতীয় রেডিও-স্টেশন থেকে নিয়মিত সম্প্রচারিত হতে থাকে কুরআন ও হাদিসের দরস এবং মুজাহিদদের বিজয় সংবাদ। এর মাধ্যমে মুজাহিদগণ ক্রুসেডার ফ্রান্সের দখলদারিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতেও মুজাহিদদের এই বিজয় মুসলিমদের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তুলে। মসজিদগুলোতে দো’আ হতে থাকে মুজাহিদদের জন্য।
বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত মালির একটি ম্যাপ:
বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত মালির একটি ম্যাপে দেখানো হয়, এপ্রিল ২০১২ থেকে জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত ম্যাপের লাল অংশটুকু মুজাহিদগণ এবং একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।
হলুদ অংশটুকুতে দেখানো হয় যে, জাতিগত উত্তেজনা এবং মুজাহিদদের হামলা ও অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
রাজধানী বামাকোসহ ম্যাপের এই অংশটুকু দেখানো হয়েছে মুজাহিদদের হামলা ও হুমকির স্থান হিসেবে। যদিও ঐবছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে মুজাহিদগণ মুপ্তি রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে রাজধানী বামাকো অবরুদ্ধ করেন এবং রাজধানীর অনেকাংশ দখল করে নেন। বাকি ম্যাপের সবুজ অংশ বা শুধুমাত্র মালির দুটি রাজ্যকে দেখানো হয়েছে ক্রুসেডার ফ্রান্সের পুতুল সরকারের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চল হিসেবে।
এমন পরিস্থিতিতে ক্রুসেডার ফ্রান্স বুঝতে পারে যে, মুজাহিদদের অগ্রগতির এই ধারা আরো কিছুদিন চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই পুরো আফ্রিকায় কর্তৃক হারাবে ফ্রান্স। তাই খুব দ্রুততার সাথেই ফ্রান্স ইউরোপিয় দেশ ও আফ্রিকাতে বসিয়ে রাখা তাদের গোলাম সরকারদের নিয়ে জোট গঠন করে এবং মালিতে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। কিন্তু এতে তেমন একটা ফলাফল পাচ্ছিল না ফ্রান্স। তাই এবার কুফ্ফার জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স। এরপর জাতিসংঘ তাদের ভাড়াটিয়া কথিত ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ নিয়ে মালিতে অভিযান শুরু করে। কুফ্ফার জোটের এই মিশনে তখন ৯ শতাধিক সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে; সময়ে সময়ে সেই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ মুরতাদ সরকার। ২০২০ সালের অক্টোবরেও এই মিশনে অংশগ্রহণ করতে দেশ ত্যাগ করে প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ ও সেনা সদস্য।
মালিতে বাংলাদেশি সেনারা
কুফ্ফার বাহিনীর সম্মিলিত এই অভিযানের ফলে ২০১৪ সালের মধ্যে মুজাহিদগণ শহরীয় এলাকাগুলো ছেড়ে সাময়িক সময়ের জন্য তখন পিছনে সরে আসতে বাধ্য হন। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অবস্থান নেন লিরা, কাইদাল, গাও, মেনেকা ও টিসালিটের সীমান্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। এসময় তারা সীমান্ত রাজ্যগুলোর কিছু কিছু স্থানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখেন এবং সেখান থেকেই আশপাশের অঞ্চলগুলোতে গেরিলা অভিযান চালাতে থাকেন। এসময়ের মধ্যে মুজাহিদগণ পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চার ও কুফ্ফার বাহিনীর শক্তিক্ষয় করতে গেরিলা অভিযান চালাতে থাকেন।
সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে মুজাহিদদের অবস্থানকালের ম্যাপ:
কমলা অংশ মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল এবং হালকা কমলা অংশে মুজাহিদগণ তখনও অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
অতঃপর ২০১৬ সালের মধ্যে মুজাহিদগণ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ক্রুসেডার ও মুরতাদ বাহিনীর উপর ধীরে ধীরে বড় বড় হামলা চালাতে থাকেন। এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালে আল-কায়েদা পশ্চিম আফ্রিকা ভিত্তিক মালির AQIM এর মুজাহিদিন স্থানীয় বৃহৎ ৩টি জিহাদী দল (আনসার আদ-দ্বীন, আনসার আল-মুরাবিতুন ও আনসার আল-ইসলাম) ঐকবদ্ধ হয়ে একই আমীর ও একই পতাকাতলে দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদের অঙ্গীকার করেন। আল-কায়েদার অধীনে বায়াতবদ্ধ হয়ে তারা গঠন করেন জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (সংক্ষেপে JNIM) নামে নতুন দল, বিলুপ্ত করেন আগের আঞ্চলিক দলগুলো।
পরের অংশ নিচে.....
Comment