কসাই মোদির অপরাধনামা! (প্রথম পর্ব)
শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ২৬-২৭ মার্চ ঢাকা সফরে আসছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কসাই নরেন্দ্র মোদী।
বাংলাদেশের হিন্দুঘেষা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে মোদী ঢাকা সফর করবে। বাংলাদেশের কথিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ নামের শিরকী পূজা উপলক্ষে মোদির এই সফর।
কিন্তু মোদি শুধু একটা নাম নয়। বরং মোদির নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে, বাবরি মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ শহীদ করার দৃশ্য, রক্তাক্ত গুজরাট, নির্যাতিত কাশ্মীর, অগ্নিদগ্ধ দিল্লি। ভেসে উঠে গোরক্ষার নামে মুসলিমদের পিটিয়ে মারার বর্বর দৃশ্য ।
যার নাম শুনলেই বিবেকের আয়নায় ভেসে উঠে অসহায় কান্নারত শিশুদের আগুনের লেলিহান শিখায় ছুঁড়ে ফেলার দৃশ্য। এই সে মোদি যার নির্দেশে পুলিশের বন্দুক, দাঙ্গাবাজ হিন্দু পান্ডাদের পরিবর্তে তাক করা হয়েছিল পলায়নরত মুসলিম নারী-পুরুষদের দিকে। তার নির্দেশে শেষ পর্যন্ত মামলার ফাইলও গায়েব করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি বললে আধুনিক যুগের নর হত্যাকারী এক সফল কসাইয়ের চেহারাই ফুটে ওঠে। হ্যাঁ, মোদিই গুজরাটের কসাই।
মোদির উত্থানের পর থেকে মুসলিমদের উপর চলমান নির্যাতনের দীর্ঘ অপরাধনামার সংক্ষিপ্ত কিছু অংশ তুলে ধরা হবে এই সিরিজে –
১/ বাবরি মসজিদ:
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং শিব সেনা পার্টির সন্ত্রাসীরা ৫০০ বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদটি ধ্বংস করে দেয়। মসজিদ শহীদ করতে বাধা দেওয়ায় ২হাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়।
ভারতের বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বর্তমান ক্ষমতাসীন সন্ত্রাসী দল বিজেপিকে দোষী সাবস্ত করা হয়।
তবুও মোদি প্রশাসন অন্যায়ভাবে, বাবরি মন্দিরের জায়গায় রাম মন্দির বানানোর পক্ষে রায় ঘোষণা করে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর ।
দেশটির সর্বোচ্চ আদালত রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেয় । শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলায় সব আসামিকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছে দেশটির বিশেষ আদালত।
২০২০ সালের ৫ আগষ্ট অযোধ্যায় প্রায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।রাম মন্দিরের ভূমিপূজা সেরেই অনুষ্ঠানটিকে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেছে এই কুখ্যাত কসাই নরেন্দ্র মোদি।
২/গুজরাট হত্যাকাণ্ড:
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটের ‘গোধরা রেলস্টেশনের’ নিকটে ‘সাবারমাতি এক্সপ্রেস’ ট্রেনে আগুন লেগে যায়। সে ঘটনায় পুড়ে মারা যায় অযোধ্যার বাবরি মসজিদ এলাকা থেকে পূজা সেরে আসা ৫৮ জন তীর্থযাত্রী। অন্যায়ভাবে দোষ চাপানো হয় মুসলিমদের উপর। একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে স্থানীয় মুসলিমরাই নাকি সেই ট্রেনে আগুন লাগাবার জন্য দায়ী। আর স্রেফ সেই গুজবের উপর ভিত্তি করে গুজরাটে রচিত হয় ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায় ‘গুজরাট দাঙ্গা।
ট্রেনে হামলার পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) রাজ্যব্যাপী বন্ধ বা ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধরনের ধর্মঘটে সহিংসতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, ধর্মঘট রোধে মোদি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।মোদি সরকার রাজ্যজুড়ে সহিংসতার প্রকোপ বন্ধ করার চেষ্টা করেনি। স্বতন্ত্র প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে রাজ্য বিজেপি সভাপতি রানা রাজেন্দ্রসিংহ এই ধর্মঘটের সমর্থন করেছে। নরেন্দ্র মোদী ও রানা রাজেন্দ্রসিংহ উত্তেজক ভাষা ব্যবহার করেছে, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছিল।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করে যে ট্রেনে মুসলিমরা হামলা করেছে। ফলে স্থানীয় সংবাদপত্র এবং রাজ্য সরকারের সদস্যরা বিনা প্রমাণে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলা করার জন্য এই বিবৃতিটি ব্যবহার করে। এছাড়াও, হিন্দুত্ববাদী স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে মিথ্যা গল্প ছাপা হয়, যেগুলিতে দাবি করা হয় যে মুসলিমরা হিন্দু মহিলাদের অপহরণ এবং ধর্ষণ করেছিল।
২৮ ফেব্রুয়ারি (ট্রেনের আগুনের পরদিন) থেকে শুরু হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হামলা।প্রথমে গেরুয়া হামলাকারীরা ঐ অঞ্চলজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে চিহ্নিত করে। পরে জাফরান পোশাক এবং খাকি শর্টস (হিন্দু জাতীয়তাবাদের আনুষ্ঠানিক ইউনিফর্ম) এবং বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।অনেক ক্ষেত্রেই হামলাকারীরা সংলগ্ন হিন্দু ভবনগুলি অক্ষত রেখে মুসলিমদের মালিকানাধীন বা দখলকৃত ভবনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করে বা পুড়িয়ে দেয়। যদিও ক্ষতিগ্রস্থদের থেকে পুলিশের কাছে বহু বার ফোন করা হয়, তবুও পুলিশ তাদের জানিয়েছিল যে “আপনাদের বাঁচানোর কোনও আদেশ আমাদের নেই।” কিছু ক্ষেত্রে, পুলিশই মুসলিমদের উপর গুলি চালিয়েছিল।
নির্বাচনে মোদির অন্যতম প্রতিপক্ষ এহসান জাফরির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল কিছু মুসলিম। কিন্তু প্রায় বিশ হাজার উন্মত্ত হিন্দু তার বাড়ি ঘেরাও করে। আর শেষমেশ এহসান জাফরি নেমে এলে তার হাত ও পা দু’টো কেটে মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়; শেষে মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, তার ঘরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় মুসলিম পুরুষদের নির্মমভাবে কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়; নারীদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে এসেছিল আরও বেশ কয়েকটি গণহত্যার কথা। এদের মধ্যে অন্যতম ‘গুলবার্গ ম্যাসাকারে’ একসাথে ৯০ জন মুসলিমকে হত্যা।
২৮ ফেব্রুয়ারি আহমেদাবাদের মোড়জারি চৌক এবং চরোদিয়া চক জেলাগুলিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া 40 জনের সকলেই মুসলিম ছিলেন।কমপক্ষে আড়াই শতাধিক মুসলিম বালিকা ও মহিলাদের গণধর্ষণ করা হয়েছিল এবং পরে তাদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বাচ্চাদের জোর করে পেট্রল খাওয়ানো হয় এবং তারপরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, গর্ভবতী মহিলাদের আগুনে পুড়ানো হয়েছিল। তাদের পেটে অনাগত সন্তানের পোড়া দেহ দেখা যাচ্ছিল। নানদা পটিয়া গণকবরে ৯৬ টি মৃতদেহ ছিল, যার মধ্যে ৪৬ টি জন মহিলা ছিলেন। উগ্র মৌলবাদী হিন্দুদের দ্বারা ধর্ষণগুলি একটি সুসংহত, ইচ্ছাকৃত এবং পূর্বপরিকল্পিত কৌশলের একটি অংশ ছিল। এই ঘটনাগুলি গণহত্যার অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া, মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অন্যান্য বিষয় ছিল অ্যাসিড আক্রমণ, মারধর এবং গর্ভবতী মহিলাদের হত্যা। বাচ্চাদের তাদের পিতামাতার সামনে হত্যা করা হয়।
প্রায় ২০০০ এর মতো মুসলিমকে মাত্র কয়েকদিনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, আহত হয় আরও অনেক। গুজরাট থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় ৯৮,০০০ মুসলিম। রাতের ব্যবধানেই এতগুলো মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। কোনো কোনো হিসেব মতে সেই সংখ্যা আসলে দেড় লক্ষেরও অধিক।
গুজরাটের সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তা সঞ্জিব ভাট পরবর্তীতে আদালতের জবানবন্দিতে জানায় এক গোপন সত্য। সেই সময় কাজের কারণেই নানারকম স্পর্শকাতর তথ্য তার জানা ছিল। আদালতে সে জানায়, “দাঙ্গা শুরু হবার আগের রাতে মোদি অফিসিয়ালদের নিয়ে এক মিটিংয়ে বসেছিল। সেই মিটিংয়ে মোদি সবার উদ্দেশ্যে বলেছিল যে তীর্থযাত্রীদের হত্যার প্রতিশোধস্বরূপ মুসলিমদের এক উচিত শিক্ষা দিতে হবে।” আর দাঙ্গা শেষ হবার পর মোদিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছিল গুজরাটের ব্যাপারে তার কোনোই অপরাধবোধ নেই। এসমস্ত কারণে নরেন্দ্র মোদিকে এখনও ডাকা হয় ‘গুজরাটের কসাই’ নামে।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তার কি কোন বিচার হয়নি। তার উত্তর হচ্ছে না, ভারতে তার কোনো বিচার হয়নি। এমনকি ভারতের ভোটাররাও তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিয়েই সে তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিল। ভারতের সাধারণ হিন্দুরা এই রক্তচোষা মোদিকেই এখন দ্বিতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে। আর এরই মাধ্যমে চরম হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনে রায় দেয় ভারতীয় সাধারণ হিন্দুরা। ভারতবর্ষের প্রধান কান্ডারি এখন হাজারো নিরাপরাধ মানব হত্যাকারী কসাই। এক নরখাদক মোদি। তা-ও জনতার ভোটে! হায়রে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত! হায়রে ভারতীয় গণতন্ত্র!
চলবে ইনশা আল্লাহ…
লেখক: উসামা মাহমুদ, প্রতিবেদক আল-ফিরদাউস নিউজ
রেফারেন্স:
১/ বাবরি মসজিদ রায়: কার প্রতিক্রিয়া কী?-https://tinyurl.com/ya8c3zx7
২/ বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার সব আসামি খালাস-https://tinyurl.com/wx5zpu8j
৩/ রামমন্দির নিয়ে মোদির মন্তব্যে তীব্র আপত্তি মমতার-https://tinyurl.com/r7vajz8y
৪/২০০২ গুজরাট দাঙ্গা- https://tinyurl.com/y4753uu8
৫/ Gujarat riot death toll revealed- https://tinyurl.com/p28jj57t
৬/ The 2002 Gujarat riots- https://tinyurl.com/2pnvfm3m
৭/ Narendra Modi’s Shame: Muslim Survivors of the Gujarat Riots Are Still Suffering- https://tinyurl.com/2ewr3322
৮/ How India’s 2002 Gujarat riots unfolded- https://tinyurl.com/s8b6ajke
৯/ CNN IBN Narendra Modi 2110 2007- https://tinyurl.com/24v3ezy3
10/ No guilty feeling about Gujarat riots, says Modi – https://tinyurl.com/4sr59ddz
১১/ Narendra Modi ‘allowed’ Gujarat 2002 anti-Muslim riots- https://tinyurl.com/32hh24td
১২/ India: A Decade on, Gujarat Justice Incomplete- https://tinyurl.com/43f7wjup
১৩/ Timeline of the Riots in Modi’s Gujarat- https://tinyurl.com/tu3h52se
Comment