ইসলামি গণতান্ত্রিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ ও তাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে কিছু প্রশ্ন
ইসলামি গণতান্ত্রিক দলগুলো, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার আশা করে থাকে, তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ও দর্শন নিয়ে কিছু প্রশ্ন চলেই আসে। এই দলগুলো বলে যে, তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা কতটা বাস্তবসম্মত বা ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের পথে তাদের কৌশল কতটা শক্তিশালী? এই প্রশ্নগুলো শুধু তাদের রাজনৈতিক কৌশলের দিকে আলোকপাত করে না, বরং ইসলামের শাসনতাত্ত্বিক দর্শন নিয়েও প্রশ্ন চলে আসে। এছাড়াও জনগণের ভূমিকা এবং ভোটের ফলাফলের উপর আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবের মতো বিষয়গুলোর অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়।
.
জনগণের ভোট ছাড়া কি ইসলাম কায়েম করা সম্ভব?
.
ইসলামি গণতান্ত্রিক দলগুলোর মূল ভিত্তি হলো নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা। তারা ভোটের আশায় বসে থাকেন, কিন্তু জনমত যদি তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে ইসলাম কি বলে যে, ভোটে না জিতলে ইসলামি শাসন কায়েম করা যাবে না?
আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে এই ধারণা অনেক জটিল। গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ এবং সেই ইচ্ছা পরিবর্তনশীল। তাহলে কি ইসলামি দলগুলোর জন্য জনগণের ভোট একটি অপরিহার্য শর্ত? যদি তাই হয়, তবে ইসলামি শাসন কি শুধুই একটি জনপ্রিয়তার খেলা, যেখানে জনমতের ওঠানামার ওপর নির্ভর করে এর স্থায়িত্ব?
.
জনগণ না চাইলে কি কুফরি শাসনে ফিরে যাওয়া হবে?
.
এই প্রশ্নটি আরও গভীর। ইসলামি শাসন কায়েমের পর যদি জনগণ তা আর না চায়, তাহলে কি এই দলগুলো আবার "কুফরি শাসন"-এ ফিরে যাবে? এটি ইসলামি শাসনের একটি মৌলিক প্রশ্ন। ইসলামি দর্শন অনুযায়ী, একটি শাসনব্যবস্থা কেবল তখনই বৈধ যখন তা আল্লাহর আইন মেনে চলে। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যদি জনগণ সেই শাসন প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে কি করা উচিত? জনগণের পরিবর্তনশীল ইচ্ছার সঙ্গে কীভাবে তা সমন্বয় করা যাবে?
তারা যদি জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, তবে ইসলামী শাসনের ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর যদি জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে, তবে তারা গণতান্ত্রিক নীতির বিপক্ষে চলে যায়। এসব আলোচনা তাদের দর্শনের বড় দুর্বলতা প্রকাশ করে।
.
বর্তমান শাসন নিয়ে নীরবতা ঠিক কি কারনে?
.
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই দলগুলো বর্তমান শাসনব্যবস্থা নিয়ে কেন কিছু বলে না? এই শাসন মেনে চলা কি জায়েজ, নাকি জায়েজ নয়? এই শাসন ব্যবস্থা কি কুফরি? আর যদি জায়েজ হয়, তাহলে আলাদা দল বা আন্দোলনের প্রয়োজন কী? এই নীরবতা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার উপরও প্রশ্ন তোলে। গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থায় প্রায় সব কিছুই শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাহলে কেন এই দলগুলো এই বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেয় না? এটি কি তাদের কৌশলগত দুর্বলতা, নাকি তারা এই বিষয়ে চিন্তাই করেনি?
.
ট্রাম্পের জয় ও প্রযুক্তির প্রভাব
.
২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়ে সামাজিক মাধ্যম, বিশেষ করে গুগল, টুইটার ও ফেসবুকের ভূমিকা ছিল অস্বীকার্য। ডেটা বিশ্লেষণ, টার্গেটেড প্রচারণা, এবং জনমত গঠনে প্রযুক্তির ব্যবহার তাকে এগিয়ে দিয়েছিল। এই দলগুলো এই ধরনের প্রযুক্তি বা এআই এর ক্ষমতা সম্পর্কে ভাবে? আমেরিকা এসব ব্যবহার করলে তাদের জনসমর্থন কোথায় যাবে? বর্তমানে এআই এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে এটি জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে অত্যন্ত ভালোভাবে। আগামী ৪-৫ বছরে এআই-এর ক্ষমতা আরও বাড়বে। তখন হয়তো একজন দক্ষ কর্মকর্তা দিয়েই আমেরিকা তার স্পেশালাইজড এ আই দিয়ে যেকোনো দেশে কোটি মানুষের মত পরিবর্তন করতে পারবে। আমেরিকার মতো দেশ যদি এআই ব্যবহার করে জনমত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে, তবে এই দলগুলোর জনসমর্থন কার্যত অনেকে নিচে নেমে আসতে পারে।
.
এই দলগুলো কি এসব নিয়ে চিন্তা করে?
.
এই দলগুলো কি এসব বিষয়ে চিন্তা করে? তাদের কৌশল, দর্শন, এবং প্রচারণা দেখে মনে হয় না যে তারা আধুনিক রাজনীতি বা প্রযুক্তির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত চিন্তাভাবনা করেছে। ট্রাম্পের জয় বা এআই-এর উত্থানের মতো ঘটনা থেকে শিক্ষা না নেওয়া তাদের দূরদৃষ্টির অভাব প্রকাশ করে। তারা হয়তো ঐতিহ্যবাহী ভোটভিত্তিক রাজনীতির ওপর ভরসা করে, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে এটি যথেষ্ট নয়।
জনগণের ইচ্ছা যদি পরিবর্তনশীল হয়, তবে তাদের শাসন নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাহলে কি তারা কিছু দিন ইসলামের শাসন রাখবেন আর কিছু দিন রাখবেন না, এরকম হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা? বর্তমান শাসন নিয়ে তাদের নীরবতা এবং প্রযুক্তির প্রভাব উপেক্ষা করা তাদের দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
Comment