কীভাবে কাটে মুজাহিদ ভাইদের ঈদ?
বছর ঘুরে আবারও আমাদের সামনে ঈদুল আযহা উপস্থিত।
সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ছে ঈদের আমেজ। লাখ লাখ টাকার কুরবানি কেনা হচ্ছে। কার গরু কতোবড় তা নিয়ে ঠান্ডা মনস্তাত্বিক লড়াই চলছে। ঈদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক কেনাকাটাও চলছে সমানতালে। ঈদের কেনাকেটার জন্য আমরা অনেকেই দুই তিন মাস পূর্ব থেকেই অর্থ সঞ্চয় করে রাখি। অনেক বাবারা-ই আছেন যারা ঈদের জন্য বরাদ্দ পুরো অর্থ ব্যয় করে স্ত্রী সন্তানদের জন্য কেনাকাটা করেন। কিন্তু নিজের জন্য কিছুই কেনেন না। কেন জানেন? কারণ পিতার কাছে সন্তানই তার দুনিয়া। স্বামীর কাছে স্ত্রীই তার দুনিয়া। পিতার সকল আয়-রোজগার তার সন্তানের জন্যই। স্বামীর সকল আয়-রোজগার তার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্যই! সন্তানের মুখে হাসি দেখলে বাবাদের চক্ষু শীতল হয়। স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটলে স্বামীর অন্তরও ঠাণ্ডা হয়। বাস্তবতা আসলে এমনই হওয়া উচিত। কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা নিজেই আমাদেরকে দু’আ শিক্ষা দিয়েছেন-
رَبَّنَا ہَبۡ لَنَا مِنۡ اَزۡوَاجِنَا وَذُرِّیّٰتِنَا قُرَّۃَ اَعۡیُنٍ وَّاجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِیۡنَ اِمَامًا
“হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের স্ত্রী-সন্তানদের মাঝে আমাদের চোখের শীতলতা দান করুন। আর আমাদেরকে বানান মুত্তাকীদের সর্দার!” (সূরা আল ফুরকান-৭৪)
আমরা সবাই যখন নিজেদের স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগে ব্যাস্ত, তখন কি একটিবারের জন্যেও আমরা মুজাহিদ ভাইদের কথা ভেবে দেখেছি? ভেবে দেখেছি কি তাদের কথা যারা নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে আছেন বা যারা তাগুতের ভয়ে কোনো এক অন্ধকার কুঠরিতে আত্নগোপন করে আছেন?
তাদের ঈদ কীভাবে কাটছে যারা আল্লাহ তায়ালার দ্বীনের জন্য নিজেদের কলিজার টুকরা ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছেন?বিদায়ের পূর্বমুহূর্তের ছোট্ট মেয়েটির আব্বু আব্বু ডাক যখন তার কানে প্রতিধ্বনিত হয় তখন আল্লাহর পথের মুজাহিদ নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। সন্তানের ভালোবাসায় তার অন্তর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের জন্য তিনি সবকিছু ভুলে যান। বুকে পাথর চাপা দিয়ে আবারো বুক টান টান করে গিয়ে দাঁড়ান শত্রুর সামনে৷
আমরা কি ভেবেছি তাদের কথা, যারা নিজেদের প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখ শীতলকারী হাসিকে উপেক্ষা করে হিজরত করেছেন? স্ত্রীও জানেন না তার প্রিয়তম স্বামী কোথায় আছে, কেমন আছে? স্বামীও জানেন না তার প্রিয়তমা স্ত্রী কোথায় আছে, কেমন আছে? ঈদের দিন স্ত্রী যখন খাবার নিয়ে বসে তখন তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে স্বামীর অবয়ব। তখন হয়ত ঘরের দরজা বন্ধ করে একা একা কাঁদেন তিনি। হাত তুলে দোয়া করেন- হে আল্লাহ! আমার স্বামীকে যেখানেই রেখেছ, সুস্থ্য রেখো! তাগুতের হাত থেকে আমার স্বামীকে রক্ষা করো! এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে আমাদেরকে আবার মিলিত করো!!।
একটিবারের জন্যও কি ভেবেছি তাদের কথা, নিজেদের মমতাময়ী মা-বাবার আদর-সোহাগ ও স্নেহ-ভালোবাসার গলায় ছুরি চালিয়ে যারা বছরের পর বছর অতিবাহিত করছেন কোনো নির্জন গুহায় বা কোনো অন্ধকার কুঠুরিতে??
প্রিয় ভাই! আমরা যখন পড়াশোনা বা চাকরির কারণে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্যকোথাও যাই তখন আমাদের কেমন লাগে? মাস পার হতে না হতেই আমরা অস্থির হয়ে উঠি। প্রিয় মানুষগুলোকে এক পলক দেখার জন্য, নিজের ঘরে ফেরার জন্য আমাদের অন্তরগুলো দুমড়েমুচড়ে যায়!
মাতৃভূমির জন্য এই দরদ-ব্যাথা স্বয়ং রাসূল ﷺ এর মাঝেও ছিলো। হিজরতের সময় যখন তিনি মক্কা ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন:
وَاللَّهِ إِنَّكِ لَخَيْرُ أَرْضِ اللَّهِ وَأَحَبُّ أَرْضِ اللَّهِ إِلَى اللَّهِ وَلَوْلاَ أَنِّي أُخْرِجْتُ مِنْكِ مَا خَرَجْتُ
“আল্লাহর ক্বসম! তুমি নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালার সকল ভূমির মাঝে সর্বোত্তম এবং আল্লাহ্ তায়ালার নিকট তুমিই সবচেয়ে প্রিয়ভূমি। আমাকে যদি তোমার বুক থেকে(জোরপূর্বক) বিতাড়িত না করা হতো তবে আমি কখনই (তোমায় ছেড়ে) চলে যেতাম না”।
(জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৩৯২৫)
সুতরাং তাঁদের দিন কীভাবে কাটছে যারা আল্লাহর দ্বীনকে যিন্দা করতে বছরের পর বছর ধরে নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে আছেন? তাঁদেরও কি মনে পড়ে না,শৈশব ও কৈশরের স্মৃতি? বন্ধুদের আড্ডার আসর, গ্রামের মেঠো পথ, খেলার মাঠের কথা কি তাঁদের মনে পড়ে না? পড়ে ভাই পড়ে! কিন্তু আল্লাহর দ্বীনের জন্য দিকে তাকিয়ে তারা সেটাকে বুকে চাপা দেন!!
প্রিয় ভাই ও বোন! আপনারা কি জানেন তাঁরা এই কুরবানী কেন দিয়ে যাচ্ছেন? কেন তাঁরা নিজেদের পরিবার-পরিজনকে ছেড়ে দুনিয়ার ক্যারিয়ারকে লাথি মেরে কাটায় মোড়ানো এই জিহাদের পথকে বেছে নিয়েছেন? কোন সে দায়িত্ববোধ যা তাঁদেরকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছে?
প্রিয় ভাই! তাঁরা এই পথ বেছে নিয়েছেন কারণ তারা জানেন, মুসলিম উম্মাহ খিলাফাহ হারিয়েছে প্রায় শত বছর হতে চলেছে। এই খিলাফাহ ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে সকল মুসলিমের একজন একক আমীর নির্বাচন করে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা প্রত্যেকটা মুসলিমের উপরেই ফরজ হয়ে আছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সর্ব স্বীকৃত আকীদাহ হলো, نصب الإمام فرض
অর্থাৎ, মুসলমানদের কোনো একক আমীর না থাকলে একজন আমীরুল মুমিনীন নির্বাচন করা ফরজ।
তাঁরা জিহাদের পথ বেছে নিয়েছেন কারণ তাঁরা জানেন, খিলাফাহ ফিরিয়ে আনার জন্য জিহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
তাঁরা এই পথ বেছে নিয়েছেন কারণ তাঁরা জানেন, আমাদের প্রথম কিবলাহ বাইতুল মাকদিস, জায়নিস্ট ইহুদিদের দখলে। আর তা শুধু দু’আর মাধ্যমে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। তাঁরা এই পথ বেছে নিয়েছেন কারণ তাঁরা আরো জানেন, অখণ্ড ভারতজুড়ে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে হিন্দুত্ববাদী ভারত বাংলাদেশী মুসলিমদের উপর ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালানোর নীল নকশা তৈরী করছে। অচিরেই এই ভূমির মুসলিমদের সাথে নিকৃষ্ট মালাউনদের এক ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে৷ ভয়াবহ সেই যুদ্ধের হাত থেকে দেশের উলামায়ে কেরাম, মা-বোন, এবং আপামর জনসাধারণকে রক্ষা করাকে মুজাহিদগণ নিজেদের উপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অর্পিত ফরজ দায়িত্ব মনে করেন।আর এটাই সেই দায়িত্ববোধ যা তাঁদেরকে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান, ঘর-বাড়ী ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়তে বাধ্য করেছে।
কিন্তু কষ্টে আমাদের অন্তরগুলো ফেটে যায় যখন শুনতে পাই, উম্মাহর এ সকল শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে নিয়ে কুৎসা রটানো হচ্ছে। যখন দেখতে পাই তাদের ত্যাগ ও কুরবানিকে উম্মাহর সামনে থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা হচ্ছে। তাদের থেকে মুসলিম সমাজকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে ক্ষমা করুন! আপনার দ্বীনের এই সৈনিকগুলোকে রক্ষা করুন! তাদের এই ত্যাগ ও কুরবানির বদলায় আপনার জান্নাতকে তাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখুন! আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন!!
লেখক: আব্দুল্লাহ মুনতাসির
Comment