বিজয়ের পদধ্বনি-২
বিশ বছর মেয়াদী আফগান যুদ্ধ
ও আমাদের শিক্ষা
বিশ বছর মেয়াদী আফগান যুদ্ধ
ও আমাদের শিক্ষা
২০০১ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হয়েছিল আফগানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নতুন এক ক্রুসেড। এই যুদ্ধের ঘোষণাকালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিল- এই যুদ্ধে হয় আপনি আমাদের (ক্রুসেডের) পক্ষে থাকবেন, নয়তো সন্ত্রাসীদের (মুজাহিদদের) পক্ষে। মূলত এই বার্তার মাধ্যমে বুশ ঈমান ও কুফরের দু’টি তাঁবুকে আলাদা করে দিয়েছিল। সে তখন মুজাহিদদের পরাজিত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল। অপরদিকে মুজাহিদগণও মহান আল্লাহর উপরে অটল বিশ্বাস রেখে আগ্রাসী কাফেরদের মুকাবেলা করে গেছেন পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে।
অ্যামেরিকা ও তার মিত্র জোটের হামলায় প্রথম দিকে মুজাহিদ বাহিনী কৌশলগত কারণে পিছু হটে বিস্তীর্ণ আফগান অঞ্চলে মিলিয়ে যান। একেই অ্যামেরিকা চোখ ধাঁধানো সফলতা মনে করে! নিজেদের বিজয় উল্লাসের ঘোর কাটতে বেশী সময় লাগেনি তাদের। মুজাহিদ বাহিনী আবার নতুন উদ্যমে আক্রমন শুরু করে। সেই থেকে নিয়ে ২০ বছর। কথিত পরাশক্তি অ্যামেরিকার সবচেতে দীর্ঘমেয়াদি এবং সবচেয়ে ব্যায়বহুল যুদ্ধ!
অবশ্যই সময় সাক্ষ্য দেয় এবং আল্লাহর ওয়াদাই সর্বদা সত্য হয়। ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লিপিবদ্ধ কাফেরদের পরাজয়ের মত অ্যামেরিকা এবং তার মিত্র বাহিনীও পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করল। শুধু তাই নয় প্রবল অহংকারে উড়ে আসা অ্যামেরিকা আজ পরাজিত নেড়ি কুকুরের মত ময়দান ত্যাগ করছে। নিজেদের লজ্জা ও ভীতি গোপন করার জন্য তারা পালিয়ে গেছে রাতের আঁধারে!
নিশ্চয়ই এই বিজয় আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। আমরা শুধু গল্প বলার জন্য বিজয় স্মরণ করিনা বরং তা আমাদের জন্য এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এপ্রেক্ষিতে আমাদের স্মরণ হয় মক্কা বিজয়ের কথা –
মক্কা বিজয়ের সময় রাসুলুল্লাহ ﷺ ঘোষণা দেন, “আজ যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং দরজা বন্ধ রাখবে, তারা নিরাপদ। যারা মক্কার নেতা আবু সুফিয়ানের ঘরে অবস্থান করবে, তারাও নিরাপদ। পবিত্র কাবা ঘরে যারা আশ্রয় গ্রহণ করবে, তারাও নিরাপদ। এভাবে বিশ্বনবী মক্কাবাসীদের প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ গ্রহণ না করে মুসলমানদের নিরাপত্তার স্বার্থে ও শৃঙ্খলার জন্য শর্তসাপেক্ষে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।” [১]
এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে, নববী সুন্নাহ অনুসরণে, তালিবান মুজাহিদদের একের পর এক সামরিক বিজয় শুরু হওয়ার পর থেকে ইমারতে ইসলামিয়ার পক্ষ হতে সাধারন ক্ষমা ঘোষণা করা হতে থাকে। বলা হয়,
“যারা ক্রুসেডার অ্যামেরিকা ও তাদের গোলামদের হয়ে কাজ ছেড়ে দিবে, যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইবে এবং যারা তাওবা করে মুজাহিদদের কাতারে শামিল হবে তারা সবাই মুক্ত। আমরা তাদেরকে নিজেদের ভাই হিসাবে গ্রহন করে নিবো। তাদের ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা দিবো”
আল্লাহু আকবার! ইমারতে ইসলামিয়া ও আমীরুল মু’মিনিনের এইধরণের সাধারন ক্ষমা ঘোষণার পর থেকে প্রতিমাসে হাজার হাজার কাবুল সেনা তাওবা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে, অনেকেই আবার তালিবানদের কাতারে যোগ দিচ্ছেন। যার ফলে মুজাহিদগণ বিনা যুদ্ধ আর রক্তপাত ছাড়াই অনেক জেলা, কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটি বিজয় করছেন।
১০ হাজার সাহাবির বিশাল মুসলিম বাহিনী বিশ্বনবী ﷺ এর সফল নেতৃত্বে একরকম বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর নিজ মাতৃভূমি ও পবিত্র মক্কার মুক্ত বাতাসে প্রশান্তির সুঘ্রাণ লাভ করেন রাসুলুল্লাহ ﷺ। কৃতজ্ঞতায় সেজদায় লুটিয়ে পড়েন প্রিয় কাবা চত্ত্বরে। আল্লাহু আকবার!
এরপর তাঁরা দাওয়াহ্ ও জিহাদের মহান লক্ষ্য নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলেন এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে।
আজ মুজাহিদগণও বিনা রক্তপাত আর যুদ্ধ ছাড়াই প্রতিসপ্তাহে কয়েক ডজন করে জেলা বিজয় করছেন। ২০ বছর পর পুনরায় এসব ভূমিতে মুজাহিদগণ বিজয় আর প্রশান্তির সুঘ্রাণ লাভ করছেন। মহান রবের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে মুজাহিদগণ সেজদায় লুটিয়ে পড়ছেন।
আজ প্রমানিত, কৌশল হিসেবে প্রথম দিকে মুজাহিদদের পিছু হটা কোন পরাজয় ছিল না, বরং এটা ছিল এক যুদ্ধ-কৌশল, যার লক্ষ্য ছিল নিজেদেরকে পূর্বের চেয়ে আরও শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ করে পুনরায় আঘাত হানা । আর আমরা আজ তার উজ্বল প্রমাণও দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের সেই সময়ের কথাগুলোও অনেক মনে পড়ে, যখন মানুষ পাহাড়ী তালিবান আর আল-কায়েদা মৌলভীদের নাম উচ্চারণ করতেও অনেক ভয় পেত। আলহামদুলিল্লাহ্, এখন সময় সেই পাহাড়ী মোল্লাদের! মুসলিমরা আজ গর্বভরে সেই পাহাড়ী মোল্লাদের নাম নিচ্ছেন। তারা মুজাহিদদের সংবাদ আর বার্তাগুলো এক কান থেকে অন্য কানে পৌঁছে দিচ্ছেন। জিল্লতির সময়ে একটুকরো সম্মানের হারানো স্বাদ অনুভব করছেন! আলহামদুলিল্লাহ।
যেখানে বছরের পর বছর ধরে অ্যামেরিকা ও হলুদ মিডিয়াগুলো তালিবানকে সন্ত্রাসী বলে বেড়াত, এখন সেই তালিবানদের সাথেই তারা চুক্তি, আলোচনা করতে বসেছে।
এই বৈঠক শুরুর মাত্র কয়েকমাস আগেও যেখানে তালিবানদের দখলে আফগানিস্তানের অর্ধশতাধিক জেলা ছিল। সেখানে এখন তা ছাড়িয়ে গেছে আড়াই শতাধিক জেলা কেন্দ্রকেও। তালিবানদের সাম্প্রতিক এই বিজয় মু’মিনদের হৃদয়কে যেমনিভাবে করছে প্রশান্ত তেমনিভাবে কুফ্ফার ও ত্বাগুতদের অন্তরে ভীতি এবং ত্রাস সৃষ্টি করেছে।
বর্তমানে তালিবানদের সফলতা ও বিজয় নিয়ে কথা বলার সময় অনেক মুসলিম আলিমদের এই কথাটা অধিকহারে প্রচার করতে দেখা যাচ্ছে যে, ” ১৯৯৬ এর তালেবান আর বর্তমান তালিবান এক নয়। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করার মতো। বর্তমান নেতৃত্ব অনেকটা পরিপক্ব, তারা প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক। তারা রাজনৈতিক সমাধানেই বেশি আগ্রহী।”
এটা ঠিক যে ৯৬ এর পর তালিবানের রাজনৈতিক এবং সামরিক বিভাগে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কেননা তালিবানরা এখন সামরিক শক্তির দিক থেকে পূর্বের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ও একটি দক্ষ সামরিক বাহিনী হিসাবে গড়ে উঠেছেন। পাশাপাশি তারা রাজনীতির ময়দানেও নিজেদের সক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিচ্ছেন। আলিমরা যদি বিষয়টিকে এভাবে প্রকাশ করতেন তাহলে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তারা এই পরিবর্তনের দ্বারা কেমন যেন এটাই বুঝাতে চাচ্ছেন যে, তালিবানদের পূর্বেকার নেতৃত্ব অপরিপক্ব ছিলেন, তারা প্রতিবেশী ও বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
তাদের এমন চিন্তাধারা এটাই প্রমাণ করে যে, তারা ৯৬ এর তালিবানের ইতিহাসই ভালোভাবে জানেনই না। অথচ তালিবানরা ৯৬ থেকেই সব দেশের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করার চেষ্টা করেছেন, সব দেশেই নিজেদের দূতাবাস নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন। অ্যামেরিকায় ৯/১১ হামলা ও আফগানে মার্কিন আগ্রাসনের বিষয়টি নিয়েও তালিবানরা কূটনৈতিকভাবে সমাধান করার জন্য অ্যামেরিকাকে আহ্বান করেছিলেন। কিন্তু দাম্ভিক অ্যামেরিকা তখন কূটনৈতিক সমাধানে যেতে রাজি হয়নি।
অপরদিকে ৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩ টি দেশ ছাড়া কোনো দেশই তালিবানদের নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ইমারতকে স্বীকৃতি দিতে ও সেসব দেশে তালিবানদের দূতাবাস নিয়োগ দিতে রাজি হয়নি। বরং সব দেশই তখন চেয়েছিল নতুন এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে। কেননা তালিবানদের এই ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ফলে কুফরি গণতন্ত্রের নোংরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার নষ্টামি জনগণের সামনে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। তাই ২০০১ সালে যখন অ্যামেরিকা ইসলামিক ইমারত অফ আফগানিস্তানকে ধ্বংস করতে যুদ্ধ শুরু করে তখন এই দেশগুলো অ্যামেরিকার সাথে একজোট হয়ে তালিবানদের উপর হামলা চালায়। যে তিনটি রাষ্ট্র ২০০১ সালের আগে তালিবানদের স্বীকৃতি দিয়েছিল, তারাও তখন অ্যামেরিকার পতাকাতলে এসে একত্রিত হয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তান তার আকাশ ও স্থলপথ অ্যামেরিকার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, সৌদিআরব অ্যামেরিকাকে তেল আর অস্ত্রের যোগান দেয়। কাতারসহ অন্যান্য আরব দেশগুলোও তাদের বিমান ঘাঁটিগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেয় অ্যামেরিকাকে।
এখন হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, তখন তালিবানের সাথে সম্পর্ক রাখতে অনাগ্রহী দেশগুলো এখন কেন তালিবানদের সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী?
কারণ আজ বাস্তবতার বিচারে প্রেক্ষাপট পালটে গেছে। কথিত গন্তন্ত্রের মন্ত্র বাতাসে মিলিয়ে গেছে আর সেখানে কালিমার পতাকা উড়ছে। বাতিলের প্রবল শক্তি ২০ বছর যুদ্ধ করার পরেও যখন পরাজিত হয়েছে তখন আলোচনায় বসা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ আছে!
সুতরাং এসব কিছু পূর্বের তালিবান আর বর্তমান তালিবানের বিষয় নয়, বরং এগুলো ৯/১১ হামলা এবং তালিবান এবং আল-কায়েদার মধ্যকার দৃঢ় সম্পর্ক আর সামরিক শক্তির প্রভাব মাত্র। তাইতো দোহা চুক্তির সময় প্রতিবেশী দেশগুলো অ্যামেরিকার মাধ্যমে এই চুক্তি করিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল যে, আফগানের ভূমি ব্যবহার করে কেউ যেন পুনরায় সাপের মাথা অ্যামেরিকা ও তাদের দালাল রাষ্ট্রগুলোতে আক্রামন না করে। দোহা চুক্তির এই অংশটিতে বিবেকবানদের জন্য রয়েছে চিন্তা করার মত অনেক বিষয়, যা তাদের সামনে আল-কায়েদা ও তালিবানদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং তাদের সামরিক সক্ষমতার বিষয়ে অনেক তথ্য প্রদান করবে।
সর্বশেষ, এখন আফগানিস্তান থেকে দখলদার বিদেশী সেনাদের বিদায় পুরো বিশ্বের মুসলিমদেরকে এই বার্তাই দিচ্ছে যে, আগ্রাসী শক্তি যতই প্রযুক্তিনির্ভর কিংবা পরমাণু শক্তির মালিক হোক না কেন, যদি মুসলিমরা আল্লাহ্ তায়ালার উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থার সাথে সঠিক পদ্ধতিতে দ্বীন কায়েমের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাহলে ঈমানদার ও সাহসী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কোনটিই ইসলামের শত্রুদের থাকে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিজয় লিখে রেখেছেন এবং পরাজয় ও লিখে রেখেছেন। মুজাহিদ বাহিনী যদি সাময়িক পরাজয় বরণ করেও সেটি আল্লাহর ইচ্ছার প্রকাশ মাত্র, কিন্তু শেষ বিজয় তো শুধু মুমিনদের জন্য। সেখানে কাফেরদের কোন অংশ নেই!
টীকা:
[১] কিছু বিশেষ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
চলবে ইনশাআল্লাহ্…
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ।
Comment