বিজয়ের পদধ্বনি- ৩
যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদের ত্রাস আফগানিস্তান
যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদের ত্রাস আফগানিস্তান
ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তানকে প্রতি শতাব্দীতেই কোন না কোন পরাশক্তি নিজেদের দখলে নেয়ার পায়তারা করেছে। সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা কঠিন চক্রান্ত করেছে, নিজেদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র আর সর্বশক্তি নিয়ে আফগান পাহাড়ি মোল্লাদের বিরুদ্ধে এক অসময় লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, আফাগানিস্তানের এই ভূমি তাদেরকে তিক্ত পরাজয়ের স্বাদ ব্যাতিত আর অন্য কিছুই ফেরত দেয়নি।
যুগে যুগে ইতিহাস পরিবর্তনকারী বীর মুজাহিদ-গাজীদের জন্মভূমি আফগানিস্তানের এই জমিন কব্জা করতে আধুনিক রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে সাবেক সুপারপাওয়ার ব্রিটিশরা লড়েছে, পরাশক্তি রাশিয়া চেস্টা করেছে, আর দীর্ঘ বিশ বছর ধরে লড়াই করে মার্কিন-ন্যাটো জোটের শোচনীয় পরাজয় তো আমাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট!
এসব সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুসলিমদের দ্বীন ও ঈমানকে হেফাজত করতে, ঘুমন্ত উম্মাহকে জাগিয়ে তুলতে, উম্মাহর নেতৃত্ব ও ইসলামের গৌরবকে ফিরিয়ে আনতে এবং আল্লাহ্’র জমিনে আল্লাহ্ দ্বীনকে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা জারি রাখতে আল্লাহ্ তা’আলা যুগে যুগে একজন রাহবার পাঠিয়ে থাকেন। এমনই একজন রাহবার ছিলেন বীর মুজাহিদ আহমাদ শাহ্ আবদালী। তিনিই ছিলেন আফগানিস্তানের প্রথম স্বাধীন সম্রাট। ১৭৬১ সালে যখন ভারতের মুশরিক মারাঠা বাহিনী মুসলিমদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে উপমহাদেশে অখন্ড হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চলছিল, তখন এই বীর মুজাহিদ শাহ ওয়ালি উল্লাহ্ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পানীপথের তৃতীয় যুদ্ধে ভারতীয় মুশরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এই যুদ্ধে তিনি মুসলিমদের শত্রু মারাঠা মুশরিক বাহিনীকে লাঞ্চনাকর ও শোচনীয় পরাজয় উপহার দেন এবং মুসলিম ভূমি উদ্ধার করে এর বিস্তৃতি ঘটান।
এরপর ১৮৩৮ সালে ইংরেজ বা ব্রিটিশরা আফগানিস্তানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যুদ্ধ শুরু করে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় ব্রিটিশরা দেশটির রাজধানী কাবুল দখলে নেয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের জন্য আফগান যুদ্ধ ও তার রাজধানী দখলে নেয়া তাদের ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সূচনা শুরু করে। কেননা এসময় আফগান বীর মুজাহিদদের হাতে একে একে তাদের তিনজন সেনাপ্রধান নিহত হয়। ১৮৪২ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অপরাজেয় শক্তির ইতিহাসে কালো সীলমোহর মারেন আফগান মুজাহিদরা। মুজাহিদদের একের পর এক হামলায় সে বছর কাবুল ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে ব্রিটিশ সৈন্যরা। জানা যায় ব্রিটিশ বাহিনীর একজন ব্যাতিত বাকি সকল সৈন্যকে তাদের আগ্রাসী মনোভাব এবং জুলুমের যথার্থ পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হয়।
এরপর ১৮৭৮ সালে আফগানিস্তানে ফের আগ্রাসন চালায় ব্রিটিশ বাহিনী। তারা রাজধানীসহ দেশের সিংহভাগ এলাকা দখল করে নেয়। এসময় ১৮৮০ সাল পর্যন্ত আফগানের বিভিন্ন অঞ্চলে আফগান মুজাহিদদের সাথে তীব্র লড়াই হয় ব্রিটিশ বাহিনীর। ঐবছরের ২৭ শে জুলাই আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের মাইওয়ান্দ গ্রামে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা আফগান পাহাড়ি মোল্লাদের বিরুদ্ধে শতাব্দীর পট পরিবর্তনকারী এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সে যুদ্ধে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে স্বাধীনচেতা আফগান মুসলিমরা আধুনিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জর্জ বুড়োসের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ-ভারতের দুই ব্রিগেড সৈন্যদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
যুদ্ধের আগের দিন অর্থাৎ ২৬ শে জুলাই দুপুর বেলা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জর্জ বুড়োস সংবাদ পান স্বাধীনচেতা আফগান মুসলিমরা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আগ্রাসন প্রতিহত করতে অসীম শৌর্যবীর্যে মাইওয়ান্দের দিকে এগিয়ে আসছে।
জর্জ সিদ্ধান্ত নেয় পরদিন ২৭ জুলাই ভোরে মাইওয়ান্দে আগেভাগেই পৌছে আফগান মুসলিমদের দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ শক্তিকে গুড়িয়ে দিবে। কিন্তু পরদিন ঘটে তার ঠিক উলটো ঘটনা।
সকাল ১০ টা নাগাদ তুমুল যুদ্ধ শুরু হলে আফগান মুসলিমদের চতুর্মুখী আক্রমণে ব্রিটিশ-ভারতীয় সৈন্যরা ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। আইয়ুব খান বাহিনীর অতর্কিত হামলায় তাদের রণকৌশন ভেস্তে যায়। সে যুদ্ধে ব্রিটিশ-ভারতের ২১ জন উর্ধতন অফিসার সহ ৯৬৯ জন সৈন্য নিহত হয়; ৮ অফিসার সহ ১৭৮ জন সৈন্য আহত হয়। তাছাড়াও মাইওয়ান্দের সে যুদ্ধে বহু ব্রিটিশ-ভারতীয় সৈন্য বীর আফগানদের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
মাইওয়ান্দ যুদ্ধে বাজেভাবে হেরে ব্রিটিশরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাদের সাম্রাজ্যবাদী অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়। এরপর ব্রিটিশ বাহিনী মুজাহিদদের হামলার ফলে গান্ধামাক চুক্তির মাধ্যমে পুনরায় আফগান ছাড়তে বাধ্য হয়।
এরপর ১৯৭৯ সালে আফগানের মুরতাদ সরকারের সহায়তায় তৎকালীন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ১ লক্ষ ৫ হাজার সৈন্য নিয়ে আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালায়। সোভিয়েত তাদের এই আগ্রাসনের অনেক আগ থেকেই আফগানিস্তানের সামরিক ও সরকারের উচ্চপদস্থ প্রতিটি স্থানেই বসিয়ে রেখেছিল তাদের গোলামদের। যেমনটি আমরা বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। এমন অবস্থায় নিজেদের দ্বীন ঈমান ও ভূমি রক্ষায় তৎকালীন পরাশক্তির বিরুদ্ধে পুনরায় হাতে অস্ত্র তুলে নেন আফগানের তাওহিদী মুসলিমরা। এভাবেই ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আগ্রাসী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে নিজেদের সমর্থের সবটুকু দিয়ে রুখে দাড়ান বীরের জাতি আফগান মুসলিমরা। এসময় তাদের সাহায্যে জিহাদের এই ভূমিতে আগমন ঘটে শাইখ শহীদ শাইখ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম, শহীদ শাইখ ওসামা বিন লাদেন রহঃ ও শাইখ আইমান হাফিজাহুল্লাহ্’র মত মহান ব্যক্তিদের। তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসতে থাকেন তরুণরা। তাঁরা আফগানীদের কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধ শুরু করেন। আরব-আজমের জানবাজ মুজাহিদদের দীর্ঘ ১০ বছরের অসম লড়াইয়ের ফলে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান ছাড়তে বাধ্য হয়। মুজাহিদদের কাছে এই পরাজয়ের পর পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে, পতন ঘটে সমাজতন্ত্র নামক কুফরি জীবন-ব্যবস্থার।
সর্বশেষ ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে আগ্রসন চালায় পরাশক্তির দাবীদার ক্রুসেডার অ্যামেরিকা, ন্যাটো জোট ও তাদের গোলাম সৈন্যরা। যা আজ ২০ বছর যাবত চলমান রয়েছে। ইতিহাস ঘুরতে থাকে এবং সত্য লিপিবদ্ধ করতে থাকে, আবারো পূর্বের আগ্রাসী শক্তিগুলোর মতই পরাজয়ের স্বাদ নিয়ে ফিরে যাচ্ছে কথিত পরাশক্তি অ্যামেরিকা!
চলবে ইনশাআল্লাহ্…
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
বিজয়ের পদধ্বনি-১
বিজয়ের পদধ্বনি- ২
Comment