বিশেষ প্রতিবেদন || আফগান অর্থনীতির সংকট : পূর্বতন সরকার কর্তৃক ডলার-ভাণ্ডার ধ্বংস ও পশ্চিমাদের আফগান রিজার্ভ আটক।
আফগানিস্তান, দুনিয়া জুড়ে যার পরিচিতি যুদ্ধে অপরাজেয় হিসেবে, বিশ্ব যাকে চেনে সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্তান হিসেবে। তাতার, ব্রিটিশ ও সোভিয়েতের পর যে দেশে কবর রচিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকার।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে পাতায় পাতায় রয়ছে যুদ্ধজয় আর বীরত্বের ইতিহাস। তবে এই বিজগাঁথার নীচেও চাপা পরে আছে কতিপয় দালাল চাটুকারের গাদ্দারি এবং ফলশ্রুতিতে আফগান জনগণের সাময়িক আর্থ-সামাজিক দুর্দশার অজানা কিছু গল্প।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আফগান জনগণের এমনই কিছু আর্থসামাজিক দুরবস্থার এবং এর পেছনের কুশিলবদের কারসাজি নিয়েই আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন।
তালিবানের আফগান বিজয় ও ইসলামি ইমারা গঠনের প্রেক্ষিতে আলোচনায় আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে আফগান অর্থনীতির বেহাল দশা। সেই সাথে রয়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ঘাটতি, বর্বর অ্যামেরিকা কর্তৃক আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আটকে দেওয়া, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাদের সহযোগিতার অর্থ হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সাবেক সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমাদানের ঘটনাগুলো।
আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক দাতাদের জন্য প্রস্তুত করা এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বেশিরভাগ মার্কিন ডলারের মজুদ কমিয়ে দিয়েছে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের লেখা গোপনীয়, দুই পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ঐ বিবরণীতে বলা হয়েছে, তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পূ্র্বে থেকেই দেশটিতে তীব্র নগদ ঘাটতি শুরু হয়।
এই বিবরনীটি মূলত বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(IMF) সহ অন্যান্য দাতা ও ঋণদাতাদের ব্যবহারের জন্য লেখা হয়েছিল। এতে তালেবানের বিজয়ের আগের মাসগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন নেতৃত্ব কিভাবে এই সংকটকে যে উপায় মোকাবিলা করেছে তার সমালোচনা করা হয়েছে।
পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্বাভাবিক ভাবে বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলার নিলাম করা এবং কাবুল থেকে প্রাদেশিক শাখায় অর্থ সরানোর মত অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তগুলোরও সমালোচনা করা হয়েছে।
ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, – “কাবুলে সিবি(কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ভল্টে এফএক্স(বৈদেশিক মুদ্রা) মজুদ হ্রাস পেয়েছে, সিবি গ্রাহকদের নগদ অনুরোধ(চেকের বদলে টাকা) পূরণ করতে পারছে না..” এবং এতে ‘সমস্যার সবচেয়ে বড় উৎস’ হিসেবে দায়ী করা হয় তালেবানদের দখলের আগে থেকেই চলতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অব্যবস্থাপনাকে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান শাহ মেহরাবি, যিনি তালেবানদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ব্যাংকের তদারকিতে সহায়তা করেছিলেন এবং এখনও তার পদে রয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগেকার কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, তারা এসব নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্থানীয় আফগানি মুদ্রার স্ফীতি রোধ করার চেষ্টা করছেন, অর্থাৎ ডলার দিয়ে জনগণের হাত থেকে তারা আফগান মুদ্রা নিয়ে নিয়েছেন, যাতে বাজারে অতিরিক্ত আফগান মুদ্রার উপস্থিতি কমিয়ে আনা যায়।।
তাদের এই ভুল পদক্ষেপগুলোর ফলে চলমান রিজার্ভ ঘাটতি যে কি ব্যাপক আকার ধারন করেছে, সেটা আফগান শহরগুলোর রাস্তায় বেরোলেই বুঝা যায়। সেখানে লোকেরা ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের সঞ্চয়ের ডলার তুলতে লাইনে দাড়িয়ে থাকছে। এর উপর আবার কত টাকা বের করতে পারবে তার একটা কঠোর সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
মূলত পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের পতনের আগে থেকেই তাদের নানান ভুল ও পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের কারণে জাতীয় অর্থনীতি ভুগছিল। কিন্তু, তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে কোটি কোটি ডলার লুটপাট এবং কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তার আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়া আফগান অর্থনীতিকে আরো গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।
সেই সাথে যুক্ত হয়েছে আমেরিকা কর্তৃক অন্যায় ভাবে আফগান জনগণের অর্থ আটকে দেওয়া। অথচ এই আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বকেই আবার আফগান নারী-শিশু ও জনগণের জন্য মেকি কান্না কাঁদতে দেখা যায়।
এইসব সমস্যা আফগানিদের প্রধান প্রধান খাদ্যগুলো যেমন-ময়দার দাম একদিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আবার আর্থিক সংকটের কারণে কাজের যোগানও কমে গেছে। একইসাথে আবার শীতও প্রায় আগত। যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
#হঠাৎ বন্ধ নগদ সহায়তা
পূর্ববর্তী সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি সহায়তার ২৪৯ মিলিয়ন ডলারের নগদ চালানের উপর নির্ভর করতো। ঐ সহায়তা প্রতি তিন মাস পর পর ১০০ ডলারের নোটের বাউন্ড বাক্সে সরবরাহ করা হত এবং সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের ভল্টে সংরক্ষণ করা হত। বিষয়টি সম্পর্কে সরাসরি জানেন – এমন তিনজন ব্যক্তির কাছে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
বর্তমান ক্ষমতাশীল তালিবানর ঐ বিদেশী সৈন্য এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যে লড়াইয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে; যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক এবং এদের বেশীরভাগই দখলদারদের ড্রোন হামলায় মারা গেছে।
দখলদার বিদেশী শক্তিগুলো তাই তালেবানদের সাথে সরাসরি লেনদেন করতে অস্বস্তি বোধ করছে। ফলে সাহায্য হিসেবে আসা ঐ অনুদানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আফগানিস্তানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই যুক্তরাষ্ট্রের ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা সহায়তাগুলো বিতরণ করত।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা এখন বলছে যে, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণের জন্য তারা একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তবে এটি এ ব্যাপারে কোনও বিশদ বিবরণ দেয়নি।
মুদ্রা সংকটের এই কঠিন পরিস্থিতি তালেবান সরকারের জন্য দেশেবাসীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন করে তুলছে। সরকারী কর্মচারীদের মাসিক বেতন বন্টন করা- যাদের অনেককে কয়েক মাসের বেতন দেওয়া হয় নি, তালিবান কর্মকর্তা ও উমারাদের বেতন প্রদান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত ও চরম দুর্দশাপিরিতদের মানবিক সহায়তা প্রদান – এসব মৌলিক কাজগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে তাদেরকে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে।
#আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আটক
তালেবানরা কাবুল দখল করার সাথে সাথে আফগানিস্তানের প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের অফশোর রিজার্ভ আটকে দেওয়া হয়। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে কেবল নগদ টাকা থেকে যায়, ডলারের রিজার্ভ প্রায় খালি হওয়ার উপক্রম হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ জুন থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার নিলাম করেছে। যা “বিস্ময়করভাবে বেশি” বলে প্রতিবেদনটি জানিয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসেই হয়তো এমন নজির নেই।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হল, ১৫ আগস্টের দিনের হিসাব মতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৫০ বিলিয়ন আফগানি (৫৬৯ মিলিয়ন ডলার) এর বকেয়া দায়বদ্ধতা ছিল। নিলামে বিক্রি করে বা অন্য উপায়ে ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার খালি করার একটি ছিল প্রধান একটি কারণ।
আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা মেহরাবি অবশ্য বলেছে, যদিও প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার নিলামের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তবে বিক্রি হওয়া প্রকৃত পরিমাণ ছিল ৭১৪ মিলিয়ন ডলার। সে বলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতি কমাতে তখন বৈদেশিক মুদ্রা নিলামের এই আয়োজন করেছিল।
#ডলার লোপাট?
পূর্বতন শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু মজুদ প্রাদেশিক শাখায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেক। যেহেতু ২০২০ সালের শেষের দিকে তালেবান যোদ্ধারা বিজয় তরাণ্বিত করার উদ্দেশ্যে সারা দেশে দ্রুত অগ্রগতি করছিল, তাদের ভাষায় আঞ্চলিক শাখাগুলোতে ডলারের মজুদ তখন ঝুঁকিতে পরে যায়।
তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, তালিবান আক্রমনের অজুহাততে নিজেদের চুরি আর দুর্নীতিকে আড়াল করতেই তৎকালীন ক্ষমতাশীলরা এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া যুদ্ধপিরিত এলাকায় রিজার্ভ’এর অর্থ প্রেরণ করার আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শেষে এই শাখাগুলোতে প্রায় ২০২ মিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছিল, যা ২০১৯ সালে ১২.৯ মিলিয়ন ডলার ছিল, এবং তালেবান যোদ্ধাদের হাতে
প্রদেশগুলির পতনের শুরু হওয়ার পর ও এসব নগদ অর্থ সরিয়ে নেয়া হয় নি।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, “প্রাদেশিক শাখাগুলোর কয়েকটা থেকে কিছু অর্থ হারিয়ে(চুরি) গেছে বলে জানা গেছে।” তবে তা পরিমাণে কত সেটা নির্দিষ্ট করা হয় নি।
মেহরাবি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার তিনটি শাখা থেকে “চুরি” করা অর্থের ব্যাপারে তদন্ত করছে, যদিও তালেবানরা তা করে নি। তিনি এ ব্যাপারে আর কোনও বিশদ বিবরণ দেন নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আজমল আহমাদি, যে কাবুলের পতনের পরের দিন দেশ ত্যাগ করেছিল। তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার কয়েক মাস আগে তার এবং ব্যাংকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্যের অনুরোধ করে ইমেইল এবং মেসেজে যোগাযোগ করা হলেও সে কোন জবাব দেয় নি।
আহমাদি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টুইটারে বলেছে যে, পরিস্থিতি সঠিকভাবে পরিচালনা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সে এবং নগদ অর্থের যে কোনো ঘাটতির জন্য বিদেশে(আমেরিকায়) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ আটকে রাখাকে দায়ী করেছে।
তার বিবৃতিতে সে আরও বলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাবুলের পতনের আগে অর্থনীতি ভালোভাবেই পরিচালনা করছিল। কর্মীদের পিছনে রেখে আসার ব্যাপারে তার খারাপও লাগছিল, কিন্তু তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সে ভয় পেয়েছিল।
যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরেও সে বলেছে যে, রিজার্ভ অ্যাকাউন্টগুলোর একটি থেকেও কোনও টাকা চুরি হয়নি!
এসকল দুর্নীতিবাজ নেতাদের পেছনেই আমেরিকা ও পশ্চিমারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরছ করেছে তাদের দখলদারিত্বকে দীর্ঘায়িত করার জন্য; অথচ এখন যখন আফগান অর্থনীতি সংকটে এবং আফগান জনগণ কষ্টে আছে, তারা তখন হাত গুটিয়ে বসে আছে, আর আফগান জনগণের বৈধ অর্থ তারা আটকে রেখেছে!
আফগানিস্তান, দুনিয়া জুড়ে যার পরিচিতি যুদ্ধে অপরাজেয় হিসেবে, বিশ্ব যাকে চেনে সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্তান হিসেবে। তাতার, ব্রিটিশ ও সোভিয়েতের পর যে দেশে কবর রচিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী অ্যামেরিকার।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে পাতায় পাতায় রয়ছে যুদ্ধজয় আর বীরত্বের ইতিহাস। তবে এই বিজগাঁথার নীচেও চাপা পরে আছে কতিপয় দালাল চাটুকারের গাদ্দারি এবং ফলশ্রুতিতে আফগান জনগণের সাময়িক আর্থ-সামাজিক দুর্দশার অজানা কিছু গল্প।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আফগান জনগণের এমনই কিছু আর্থসামাজিক দুরবস্থার এবং এর পেছনের কুশিলবদের কারসাজি নিয়েই আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদন।
তালিবানের আফগান বিজয় ও ইসলামি ইমারা গঠনের প্রেক্ষিতে আলোচনায় আসা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে আফগান অর্থনীতির বেহাল দশা। সেই সাথে রয়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ঘাটতি, বর্বর অ্যামেরিকা কর্তৃক আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আটকে দেওয়া, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতাদের সহযোগিতার অর্থ হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সাবেক সরকারী কর্মকর্তাদের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জব্দ করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমাদানের ঘটনাগুলো।
আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক দাতাদের জন্য প্রস্তুত করা এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বেশিরভাগ মার্কিন ডলারের মজুদ কমিয়ে দিয়েছে, যা বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের লেখা গোপনীয়, দুই পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ঐ বিবরণীতে বলা হয়েছে, তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পূ্র্বে থেকেই দেশটিতে তীব্র নগদ ঘাটতি শুরু হয়।
এই বিবরনীটি মূলত বিশ্ব ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(IMF) সহ অন্যান্য দাতা ও ঋণদাতাদের ব্যবহারের জন্য লেখা হয়েছিল। এতে তালেবানের বিজয়ের আগের মাসগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন নেতৃত্ব কিভাবে এই সংকটকে যে উপায় মোকাবিলা করেছে তার সমালোচনা করা হয়েছে।
পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্বাভাবিক ভাবে বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলার নিলাম করা এবং কাবুল থেকে প্রাদেশিক শাখায় অর্থ সরানোর মত অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তগুলোরও সমালোচনা করা হয়েছে।
ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, – “কাবুলে সিবি(কেন্দ্রীয় ব্যাংক) ভল্টে এফএক্স(বৈদেশিক মুদ্রা) মজুদ হ্রাস পেয়েছে, সিবি গ্রাহকদের নগদ অনুরোধ(চেকের বদলে টাকা) পূরণ করতে পারছে না..” এবং এতে ‘সমস্যার সবচেয়ে বড় উৎস’ হিসেবে দায়ী করা হয় তালেবানদের দখলের আগে থেকেই চলতে থাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অব্যবস্থাপনাকে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান শাহ মেহরাবি, যিনি তালেবানদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ব্যাংকের তদারকিতে সহায়তা করেছিলেন এবং এখনও তার পদে রয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগেকার কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, তারা এসব নিয়ম বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্থানীয় আফগানি মুদ্রার স্ফীতি রোধ করার চেষ্টা করছেন, অর্থাৎ ডলার দিয়ে জনগণের হাত থেকে তারা আফগান মুদ্রা নিয়ে নিয়েছেন, যাতে বাজারে অতিরিক্ত আফগান মুদ্রার উপস্থিতি কমিয়ে আনা যায়।।
তাদের এই ভুল পদক্ষেপগুলোর ফলে চলমান রিজার্ভ ঘাটতি যে কি ব্যাপক আকার ধারন করেছে, সেটা আফগান শহরগুলোর রাস্তায় বেরোলেই বুঝা যায়। সেখানে লোকেরা ঘন্টার পর ঘন্টা তাদের সঞ্চয়ের ডলার তুলতে লাইনে দাড়িয়ে থাকছে। এর উপর আবার কত টাকা বের করতে পারবে তার একটা কঠোর সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
মূলত পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের পতনের আগে থেকেই তাদের নানান ভুল ও পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্তের কারণে জাতীয় অর্থনীতি ভুগছিল। কিন্তু, তালেবানদের প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে কোটি কোটি ডলার লুটপাট এবং কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তার আকস্মিক বন্ধ হয়ে যাওয়া আফগান অর্থনীতিকে আরো গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।
সেই সাথে যুক্ত হয়েছে আমেরিকা কর্তৃক অন্যায় ভাবে আফগান জনগণের অর্থ আটকে দেওয়া। অথচ এই আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বকেই আবার আফগান নারী-শিশু ও জনগণের জন্য মেকি কান্না কাঁদতে দেখা যায়।
এইসব সমস্যা আফগানিদের প্রধান প্রধান খাদ্যগুলো যেমন-ময়দার দাম একদিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে আবার আর্থিক সংকটের কারণে কাজের যোগানও কমে গেছে। একইসাথে আবার শীতও প্রায় আগত। যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
#হঠাৎ বন্ধ নগদ সহায়তা
পূর্ববর্তী সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশি সহায়তার ২৪৯ মিলিয়ন ডলারের নগদ চালানের উপর নির্ভর করতো। ঐ সহায়তা প্রতি তিন মাস পর পর ১০০ ডলারের নোটের বাউন্ড বাক্সে সরবরাহ করা হত এবং সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের ভল্টে সংরক্ষণ করা হত। বিষয়টি সম্পর্কে সরাসরি জানেন – এমন তিনজন ব্যক্তির কাছে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
বর্তমান ক্ষমতাশীল তালিবানর ঐ বিদেশী সৈন্য এবং ক্ষমতাচ্যুত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যে লড়াইয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে; যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক এবং এদের বেশীরভাগই দখলদারদের ড্রোন হামলায় মারা গেছে।
দখলদার বিদেশী শক্তিগুলো তাই তালেবানদের সাথে সরাসরি লেনদেন করতে অস্বস্তি বোধ করছে। ফলে সাহায্য হিসেবে আসা ঐ অনুদানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আফগানিস্তানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকই যুক্তরাষ্ট্রের ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা সহায়তাগুলো বিতরণ করত।
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা এখন বলছে যে, দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণের জন্য তারা একটি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তবে এটি এ ব্যাপারে কোনও বিশদ বিবরণ দেয়নি।
মুদ্রা সংকটের এই কঠিন পরিস্থিতি তালেবান সরকারের জন্য দেশেবাসীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন করে তুলছে। সরকারী কর্মচারীদের মাসিক বেতন বন্টন করা- যাদের অনেককে কয়েক মাসের বেতন দেওয়া হয় নি, তালিবান কর্মকর্তা ও উমারাদের বেতন প্রদান, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামো পুনঃনির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত ও চরম দুর্দশাপিরিতদের মানবিক সহায়তা প্রদান – এসব মৌলিক কাজগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে তাদেরকে অনেকটা বেগ পেতে হচ্ছে।
#আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ আটক
তালেবানরা কাবুল দখল করার সাথে সাথে আফগানিস্তানের প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের অফশোর রিজার্ভ আটকে দেওয়া হয়। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে কেবল নগদ টাকা থেকে যায়, ডলারের রিজার্ভ প্রায় খালি হওয়ার উপক্রম হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১ জুন থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে স্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ীদের কাছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার নিলাম করেছে। যা “বিস্ময়করভাবে বেশি” বলে প্রতিবেদনটি জানিয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসেই হয়তো এমন নজির নেই।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হল, ১৫ আগস্টের দিনের হিসাব মতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৭০০ মিলিয়ন ডলার এবং ৫০ বিলিয়ন আফগানি (৫৬৯ মিলিয়ন ডলার) এর বকেয়া দায়বদ্ধতা ছিল। নিলামে বিক্রি করে বা অন্য উপায়ে ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার খালি করার একটি ছিল প্রধান একটি কারণ।
আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা মেহরাবি অবশ্য বলেছে, যদিও প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার নিলামের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তবে বিক্রি হওয়া প্রকৃত পরিমাণ ছিল ৭১৪ মিলিয়ন ডলার। সে বলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবমূল্যায়ন এবং মুদ্রাস্ফীতি কমাতে তখন বৈদেশিক মুদ্রা নিলামের এই আয়োজন করেছিল।
#ডলার লোপাট?
পূর্বতন শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু মজুদ প্রাদেশিক শাখায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অনেক। যেহেতু ২০২০ সালের শেষের দিকে তালেবান যোদ্ধারা বিজয় তরাণ্বিত করার উদ্দেশ্যে সারা দেশে দ্রুত অগ্রগতি করছিল, তাদের ভাষায় আঞ্চলিক শাখাগুলোতে ডলারের মজুদ তখন ঝুঁকিতে পরে যায়।
তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, তালিবান আক্রমনের অজুহাততে নিজেদের চুরি আর দুর্নীতিকে আড়াল করতেই তৎকালীন ক্ষমতাশীলরা এমন পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়া যুদ্ধপিরিত এলাকায় রিজার্ভ’এর অর্থ প্রেরণ করার আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শেষে এই শাখাগুলোতে প্রায় ২০২ মিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছিল, যা ২০১৯ সালে ১২.৯ মিলিয়ন ডলার ছিল, এবং তালেবান যোদ্ধাদের হাতে
প্রদেশগুলির পতনের শুরু হওয়ার পর ও এসব নগদ অর্থ সরিয়ে নেয়া হয় নি।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, “প্রাদেশিক শাখাগুলোর কয়েকটা থেকে কিছু অর্থ হারিয়ে(চুরি) গেছে বলে জানা গেছে।” তবে তা পরিমাণে কত সেটা নির্দিষ্ট করা হয় নি।
মেহরাবি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার তিনটি শাখা থেকে “চুরি” করা অর্থের ব্যাপারে তদন্ত করছে, যদিও তালেবানরা তা করে নি। তিনি এ ব্যাপারে আর কোনও বিশদ বিবরণ দেন নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আজমল আহমাদি, যে কাবুলের পতনের পরের দিন দেশ ত্যাগ করেছিল। তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার কয়েক মাস আগে তার এবং ব্যাংকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্যের অনুরোধ করে ইমেইল এবং মেসেজে যোগাযোগ করা হলেও সে কোন জবাব দেয় নি।
আহমাদি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে টুইটারে বলেছে যে, পরিস্থিতি সঠিকভাবে পরিচালনা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সে এবং নগদ অর্থের যে কোনো ঘাটতির জন্য বিদেশে(আমেরিকায়) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ আটকে রাখাকে দায়ী করেছে।
তার বিবৃতিতে সে আরও বলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাবুলের পতনের আগে অর্থনীতি ভালোভাবেই পরিচালনা করছিল। কর্মীদের পিছনে রেখে আসার ব্যাপারে তার খারাপও লাগছিল, কিন্তু তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সে ভয় পেয়েছিল।
যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরেও সে বলেছে যে, রিজার্ভ অ্যাকাউন্টগুলোর একটি থেকেও কোনও টাকা চুরি হয়নি!
এসকল দুর্নীতিবাজ নেতাদের পেছনেই আমেরিকা ও পশ্চিমারা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরছ করেছে তাদের দখলদারিত্বকে দীর্ঘায়িত করার জন্য; অথচ এখন যখন আফগান অর্থনীতি সংকটে এবং আফগান জনগণ কষ্টে আছে, তারা তখন হাত গুটিয়ে বসে আছে, আর আফগান জনগণের বৈধ অর্থ তারা আটকে রেখেছে!
Comment