জিহাদ ও জ্ঞানার্জনের মাঝে ভারসাম্য সাধন
শাইখ আবু ইয়াহইয়া আল লিবি (রহ)
আস-সাহাব মিডিয়া প্রকাশিত ভিডিও “একটি শরয়ী কোর্সের সমাপনী বাক্য” এর অনুবাদ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
নিশ্চয়ই আমি রাসূলদের স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ পাঠিয়েছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও (ন্যায়ের) মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি আরো নাযিল করেছি লোহা, তাতে প্রচন্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে। আর যাতে আল্লাহ জেনে নিতে পারেন, কে না দেখেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। অবশ্যই আল্লাহ মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী। [সূরা হাদীদ – আয়াত ২৫]
একটি শরয়ী কোর্সের সমাপনী বাক্য যা শাইখ আবু ইয়াহইয়া আল লিবি (আল্লাহ তার উপর রহম করুন) কর্তৃক মুজাহিদীনদের একটি সেন্টারে বিবৃত হয়েছিল।
এই কোর্সে নিম্নোক্ত শিক্ষা পাওয়া যায়ঃ
প্রথমঃ তাজওয়ীদের নিয়মাবলী
দ্বিতীয়ঃ তাহারাত, সলাত ও সিয়ামের ফিকহ শিক্ষা
তৃতীয়ঃ বুলুগুল মারাম থেকে “কিতাবুল জামি” শিক্ষা, তার সাথে এর চল্লিশটি হাদীস মুখস্থকরণ
চতুর্থঃ নবীজীর জীবনী হতে বিভিন্ন শিক্ষা এবং শিক্ষামূলক উপদেশ
পঞ্চমঃ আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর কিতাব থেকে মুখস্থকৃত অংশ পুনরায় পাঠ
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যার অনুগ্রহে ভাল কাজসমূহ সম্পাদন করা সম্ভব হয়।
এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের এ পথের হিদায়াত দিয়েছেন এবং তিনি হিদায়াত না করলে আমরা সঠিক পথ পেতাম না।
আজ, মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হিজরতের ১৪২৮ বছর পর জমাদিউস সানী মাসের ১২ তারিখ।
আজ এই শরয়ী কোর্সের শেষ দিন এবং আমরা আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তা’আলা এর কাছে দুআ করি যাতে তিনি আমাদের দিনগুলোকে সংরক্ষণ করেন যাতে এগুলো সেই দিনে আমাদের কাজে আসতে পারে যেদিন সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, তবে সে ব্যতীত যে পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে উপনীত হয়।
এবং যেমনটি আমি আপনাদের কোর্সের শুরুতে বলেছিলাম যে এরকম কোর্স মানুষের জীবনকালের অনুরূপ যেখানে একটি শুরু এবং একটি শেষ আছে। এবং তার সমাপ্তি নির্ভর করে তার জীবনকালের প্রচেষ্টার উপর। সুতরাং আমরা দেখতে পেয়েছি এই কোর্সে আমাদের প্রয়োজন হয়েছিল প্রচেষ্টা, অধ্যয়ন ও পুনঃ-অধ্যয়ন, যতক্ষন না ব্যক্তি জ্ঞানের সমুদ্র থেকে কিছু অর্জন করতে পারে যার অন্বেষণে সে অংশ নিয়েছিল।
আর এটা আমাদের উপর আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের জন্য দুটি ইবাদতের সন্নিবেশন করেছেন – জিহাদ ও জ্ঞান অর্জন। আর এটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর অনুগ্রহ যে তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সবচেয়ে মহান ও সম্মানিত ইবাদতের সন্নিবেশন ঘটিয়েছেন এবং তিনি সবচেয়ে মহান, সবচেয়ে করুণাময়, সর্বাপেক্ষা উদার।
জিহাদের ব্যাপারে, আমরা জানি যে এটি হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তদুপরি আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর কিতাবে এসেছে,
لَّا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ
বসে থাকা মুমিনগণ, যারা ওযরগ্রস্ত নয় এবং নিজেদের জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীগণ এক সমান নয়…… [সূরা নিসা – আয়াত ২৫]
সুতরাং যে জিহাদের সাথে জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টার সমন্বয় করে, এমনকি কিছু দিনের জন্য হলেও, তবে সে জেনে রাখুক, এটি তার উপর আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর অনুগ্রহ।
কেন?
কারন আমাদের কেবল এজন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে আমরা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর ইবাদত করতে পারি।
আল্লাহ আযযা ওয়া জাল বলেছেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে। [সূরা যারিয়াত – আয়াত ৫৬]
এবং ইবাদত হলো আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর পক্ষ থেকে দায়িত্ব, অন্য কথায়, আদেশ ও নিষেধ। আর এমন কোন ইবাদত নেই যার নিয়মাবলী একজন মুসলিমকে জানতে হয় না, তা এটি সালাত হোক অথবা সিয়াম অথবা হাজ্জ্ব অথবা জিহাদ।
সুতরাং যদি আল্লাহ আপনার জন্য জ্ঞান আহরণের রাস্তা সহজ করে দেন, তাহলে জেনে রাখুন তিনি আপনার জন্য তাঁর ইবাদত করার রাস্তাও সহজ করে দিয়েছেন। কারন মানুষের দায়িত্ব হলো আল্লাহর ইবাদত করা। সুতরাং যদি সে সঠিক বুঝ, জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও দলিলের আলোকে আল্লাহর ইবাদত না করে, তাহলে নিশ্চিতভাবে সে অজ্ঞতা ও মুর্খতার আলোকে আল্লাহর ইবাদত করবে, এবং আমরা আল্লাহর কাছেই আশ্রয় চাই।
সুতরাং এটি আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ, যে ব্যাপারে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সর্বদা এটি ঘোষণা দেওয়া এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো যাতে তা আমাদের থেকে উঠিয়ে না নেওয়া হয়। এবং আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস জানি, “অধিকাংশ মানুষ দুটি নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার করতে পারে নাঃ স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।”
আপনারা আপনাদের পরিবার ও ভাইদের থেকে অনেক দূরে এই বাড়ীতে অথবা এই সেন্টারে অবস্থান করেছিলেন, একটি বিষয়ের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন, আর তা হলো জ্ঞান অর্জন। সুতরাং এটি আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে আপনাদের জন্য বিশাল অনুগ্রহ। যে অনুগ্রহে আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আপনাদের ভূষিত করেছেন।
সুতরাং জ্ঞান অর্জনের ইবাদত এবং জিহাদের ইবাদত, বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামতসমূহের অন্তর্ভুক্ত।
এটি প্রথম ব্যাপার।
এই কোর্স থেকে আমরা যা শিখতে পারি, তা হলো অস্বীকৃতি, এ ব্যাপারে যে কিছু লোক জিহাদের ইবাদত ও জ্ঞান অর্জনের ইবাদতকে পৃথক করতে চেষ্টা করে, যেটি সত্য নয়। অর্থাৎ এই ধারণা যে জিহাদের সাথে কোন ইলম নেই যেটি ভুল। এবং এই ধারণা যে আলেম ও তালেবে ইলমরা জিহাদ করতে পারে না, এটিও ভুল।
কেন?
কারন আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলা তাঁর কিতাবে আমাদের সত্য জানিয়েছেনঃ
وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا
আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। [সূরা নিসা – ৮২]
এগুলো কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর বাণী।
সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাবের আয়াতসমূহের মধ্যে কোন পরষ্পর বিরোধ নেই এবং এর নিয়মাবলীর মধ্যেও কোন অসঙ্গতি নেই। সুতরাং আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আমাদেরকে যে ইবাদতের বিধান দিয়েছেন, সেখানেও কোন পরষ্পর বিরোধ নেই।
সুতরাং এই ব্যাপারে কিছু লোক মিথ্যা উদ্ভাবন ও অতিরঞ্জন করতে চেষ্টা করে যে জিহাদ ও ইলম একত্রে খাপ খায় না যেটি ভুল। এবং আমাদের এখনকার কাজ এর উদাহরণ অথবা প্রমাণ। এটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর অনুগ্রহে একটি প্রমাণ যে জিহাদের ময়দানেও জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
আর কতগুলো ফিকহ এর বিধান যার জিহাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই, জিহাদের ময়দানে নাযিল হয়েছে। তার মধ্যে আছে তায়াম্মুমের আয়াত।
কোথায় তায়াম্মুমের আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিল?
সেগুলো নাযিল হয়েছিল যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি যুদ্ধ থেকে ফিরছিলেন, তাই নয় কি? অতঃপর আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আমাদের এ ব্যাপারে অবগত করে বললেন,
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
আর মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে। [সূরা তাওবাহ – আয়াত ১২২]
সুতরাং আল্লাহ জিহাদ ও জ্ঞান অর্জনকে একত্র করার মাধ্যমে আমাদের জন্য ইবাদতকে সহজ করে দিয়েছেন, আর এটা হলো আল্লাহ সুবহানাহ ওয়া তাআলার অনুগ্রহের মধ্য থেকে অন্যতম। এটি হলো প্রথম বিষয় যেটি আপনাদের মাথায় রাখতে হবে।
অপর বিষয়টি যেটি আমরা উল্লেখ করেছি যে জ্ঞান অর্জন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের মাঝে কোন বিরোধ নেই। এবং অন্যান্য মুসলিমদের মত আমাদের, মুজাহিদ হিসেবে, দায়িত্ব হলো দ্বীনের বিধি-বিধান শিক্ষা করা। আর আমি দ্বীনের বিধি-বিধান বলতে কেবল জিহাদ সম্পর্কীয় বিধি-বিধান বোঝাচ্ছি না। না! আমাদের দায়িত্ব হলো সালাতের বিধান শেখা, তাহারাতের বিধান, সিয়ামের বিধান। প্রত্যেকটা ইবাদত যা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল মুমিনদের দিয়েছেন এবং বাধ্যতামূলক করেছেন, মুজাহিদদের দায়িত্ব এর বিধান শেখা। কারন মুজাহিদরা এমন লোক না যারা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর আইনের বাইরে থাকতে পারে। আর সে এমন লোক না যার উপর থেকে শরয়ী বাধ্যবাধকতা দূর হয়েছে। বরং সে অন্যান্য মুসলিমদের মতই একজন।
সুতরাং আমরা যেমন জিহাদের ময়দানে জিহাদের বিধান, এর পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন শিক্ষা করি, তেমনি আমাদের কর্তব্য হলো অন্যান্য ইবাদতেরও বিধি-বিধান শিক্ষা করা।
সুতরাং কী লাভ যদি একজন মুজাহিদ জিহাদ করে এবং আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করে, কিন্তু সে জানে না কিভাবে সুন্দর করে ওযু করতে হয়, এবং সে জানে না কিভাবে সালাতকে সুন্দর করতে হয়, এবং সে জানে না কিভাবে সঠিক পদ্ধতিতে সিয়াম পালন করতে হয়?
কী লাভ এতে?
অর্থাৎ সে সঠিকভাবে জিহাদ করে এবং ভ্রান্ত ও ভুল পদ্ধতিতে সালাত ও অন্যান্য ইবাদত পালন করে।
এটা সম্ভব নয়।
সুতরাং এটা আল্লাহ আযযা ওয়া জাল এর অনুগ্রহ যে তিনি আমাদের দ্বারা তাত্ত্বিকভাবে ও বাস্তব ক্ষেত্রেও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে তাদের মাঝে কোন বিরোধ নেই। যেরকম আল্লাহর কিতাবে এর আয়াতসমূহের মাঝে কোন বৈপরীত্য নেই এবং এর বিধানসমূহের মাঝেও কোন বিরোধ নেই, তেমনি আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আমাদের যে ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন, তার মাঝেও কোন অসঙ্গতি নেই।
বুঝতে পেরেছেন? ভালো।
বাকি লিখাটি কমেন্টে
Comment