‘উগ্রবাদ’ প্রচারের ঝুঁকি বাড়া নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদন—
একটি পর্যালোচনা
একটি পর্যালোচনা
গত ১৮ই জুন ‘প্রথম আলো’ নামক পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় ‘করোনাকাল : উগ্রবাদ প্রচারের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামের একটি আর্টিকেল। আর্টিকেলটিতে ইসলাম নিয়ে আলোচনা আছে। কেননা, প্রথম আলো গংদের কাছে যেখানেই ‘উগ্রবাদ’, সেখানেই আছে ‘ইসলাম’। আর যেখানে ইসলাম আছে, সেখানে ইসলামপন্থীদের পদচারণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই ইসলামের একজন একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার উল্লিখিত আর্টিকেলটি সংক্ষেপে পর্যালোচনা করতেই আজ লিখছি।
পর্যালোচনার শুরুতে ‘প্রথম আলো’ নামক পত্রিকার ব্যাপারে পাঠকদের জানা থাকা উচিত। ‘দৈনিক প্রথম আলো’; নামটা বেশ চমৎকার হলেও চিন্তাচেতনায় তারা কুৎসিত। নামের সাথে ‘আলো’ থাকলেও কাজকর্মে সদা ‘অন্ধকার’ ছড়িয়ে যাচ্ছে পত্রিকাটি। দেশ ও সমাজকে কুলুষিত করতে নিজেদের হিংস্র চিন্তার সব লেখক-লেখিকাকে লেলিয়ে দিয়েছে তারা। এসকল তথ্যসন্ত্রাসী লেখকগোষ্ঠী ইসলামের উপর নগ্ন আঘাত হানছে বার বার, তাদের ইসলামবিদ্বেষী নীতি চক্ষুষ্মান সকলের নিকট পরিষ্কার। পূর্বে আমাদের বিভিন্ন আর্টিকেলে এই ইসলামবিদ্বেষী পত্রিকাটির ব্যাপারে অনেক আলোচনা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে তাদের ইসলামবিদ্বেষের নানা বিষয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এখন এই ইসলামবিদ্বেষীরাই আবার মুসলিমদেরকে ইসলাম শেখাতে আসে, ইসলামের কোন ব্যাখ্যা সঠিক আর কোনটি সঠিক নয়—তার মাপকাঠি নির্ধারণ করতে চায় এই ইসলামবিদ্বেষী তথ্যসন্ত্রাসীরা। আর এসকল সন্ত্রাসীদের মিলনমেলা হিসেবে ‘প্রথম আলো’ নিকৃষ্ট ভূমিকা রেখে আসছে।
আমাদের আলোচ্য আর্টিকেলটিতেও মুসলিমদেরকে ইসলাম শেখাতে চেয়েছে আর্টিকেলটির লেখিকা। তাই মূল পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে লেখিকা সম্পর্কেও জানা থাকা দরকার, যেনো তার থেকে আমরা কী শিখবো আর কী শিখবো না—তা স্পষ্ট হতে পারি।
‘করোনাকাল : উগ্রবাদ প্রচারের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামের আর্টিকেলটি লিখেছেন ‘জান্নাতুল মাওয়া’ নামক মহিলা। ‘প্রথম আলো’তে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাসের রিলিজিয়াস স্টাডিজের গবেষক হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। লেখিকার আরেকটি বিশেষ পরিচয়ও প্রথম আলোতে দেওয়া হয়েছে, সেটা হলো— লেখিকা আন্তধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতিবিষয়ক কর্মী। আন্তধর্মীয় সংলাপে মূলত সকল ধর্মকেই সঠিক বা সব ধর্মের গন্তব্যই এক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হয়; যা সুস্পষ্ট কুফুরি। আর ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত আমাদের আলোচ্য আর্টিকেলের লেখিকা সেই কুফুরি বিষয়ের দিকে আহ্বানকারী এবং এর একনিষ্ঠ কর্মী। এই বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা এবার মূল পর্যালোচনায় যেতে পারি ইনশাআল্লাহ।
‘করোনাকাল : উগ্রবাদ প্রচারের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামের আর্টিকেলটিতে বাংলাদেশে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে চিন্তিত এক মহিলার ব্যথিত হৃদয়ের আকুতি ফুটে উঠেছে। মহিলার আলোচনা ছিল মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে।
এক. ‘উগ্রবাদ’ ছড়িয়ে পড়ার কারণ।
দুই. ‘উগ্রবাদী’রা কীভাবে তাদের মতাদর্শ প্রচার করে।
তিন. ‘উগ্রবাদ’ মোকাবেলায় জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুতি।
প্রথমত, ‘উগ্রবাদ’ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে লেখিকা কয়েকটি বিষয়কে ইঙ্গিতে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘করোনাকালীন পরিস্থিতিতে মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বহুমুখী হতাশা ও অস্থিরতা আগের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি মানুষের উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে।’ তার মতে, ‘বাংলাদেশ কোনোভাবেই এই ঝুঁকির বাইরে নয়। সর্বস্তরে ব্যাপক হারে দুর্নীতি, মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার পরিসর ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করে ফেলা, সুশাসনের অভাব ও আইনের শাসন উপেক্ষিত থাকা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা এবং দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীলতার অভাব—সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের উগ্রপন্থা ছড়িয়ে পড়ার সঠিক ক্ষেত্র হিসেবে অনেক আগে থেকেই বিবেচিত হয়ে আসছে। আর এর সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনৈতিক অবস্থা তো রয়েছেই।’
অর্থাৎ লেখিকা বলতে চাচ্ছেন, দেশজুড়ে নানাপ্রকার জুলুম এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ‘উগ্রবাদে’র দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সংগ্রাম করতে চাচ্ছে। আর মানুষের মুক্তির এই সংগ্রামকে লেখিকা বলতে চাচ্ছেন ‘উগ্রবাদ’! কথিত ঐ গবেষক লেখিকার বিশ্লেষণ অনুযায়ী তাহলে, ১৯৭১ সালে যারা পাকি জালিমদের থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করেছিল তারা ছিল উগ্রবাদী; আর শেখ মুজিবুর ছিল উগ্রবাদীদের নেতা! কথিত ঐ গবেষক লেখিকা কি কল্পনাতেও শেখ মুজিব সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে সাহস করবেন? মনে হয় না। তবে কেন তিনি বর্তমানে যারা জুলুম থেকে মুক্তির জন্য ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী লড়াই করছে তাঁদেরকে ‘উগ্রবাদী’ বলেন?! এর কারণ একমাত্র ইসলাম। কেননা, সর্বপ্রকারের জুলুম থেকে মুক্তি পেতে তাঁরা ইসলামকে বেছে নিয়েছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। আর এ কারণেই লেখিকার যতো আপত্তি, যতো দুশ্চিন্তা। আপনি যদি প্রথম আলোর ঐ লেখিকাকে বলতেন যে, আমরা জুলুম থেকে বাঁচতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি। তাহলে কিন্তু লেখিকা আপনাকে ‘উগ্রবাদী’ বলতেন না। কিন্তু জুলুম থেকে মুক্তির জন্য মুসলিমরা যেহেতু ইসলামকে বেছে নিয়েছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন, তাই ঐ কথিত গবেষক মহিলা তার পুরো আর্টিকেলটাতে মুসলিমদেরকে ‘উগ্রবাদী’ বলে গালি দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ‘প্রথম আলো’র ঐ কথিত গবেষক মহিলা ‘উগ্রবাদী’রা কীভাবে তাদের মতাদর্শ প্রচার করে তা বুঝাতে চেয়েছেন। এ ধাপে গবেষক লেখিকার আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। তিনি আসলে কোন ইসলাম প্রচার করতে চান, তাও এ ধাপে পরিষ্কার হয়েছে। ‘উগ্রবাদী’দের প্রচারিত ইসলামের বিরোধিতা করার নামে তিনি মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিলকৃত ইসলামকেই প্রকারান্তরে কটাক্ষ করেছেন। এক্ষেত্রে ‘উগ্রপন্থী’দের মতাদর্শ প্রচারের একটি ‘কৌশল’ হিসেবে লেখিকা উল্লেখ করেছেন, ‘উগ্রপন্থী’রা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে ইসলামের প্রথম যুগের গৌরবগাথার বর্ণনা করে এবং মানুষকে ধারণা দেয় যে সেই যুগের সবকিছুই ছিল যথাযথ, কোথাও কোনো সমস্যা ছিল না। আর ‘উগ্রপন্থী’দের এ কথার সাথে লেখিকা যে একমত নন—এটাও সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তার উপস্থাপনায়।
লেখিকার এই মন্তব্য নিয়ে সম্মানিত পাঠকবৃন্দ একটু চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে, লেখিকা ইসলামের প্রথম যুগ তথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশিদিনের স্বর্ণযুগকে যথাযথ মানতে রাজি নন। তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, ইসলামের প্রথম যুগেও সমস্যা ছিল! তিনি যেন বলতে চাচ্ছেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সমস্যা ছিল, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে সমস্যা ছিল, উমর, উসমান ও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের শাসনামলে সমস্যা ছিল! নাউযুবিল্লাহ। তার মতে সমস্যা নেই কোথায় জানেন? সমস্যা নেই হলো পশ্চিমাদের প্রচারিত মডারেট ইসলামে। আর এ বিষয়টি বুঝা যায় তার লেখার পরবর্তী প্যারায়। সেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন, পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মডারেট ইসলাম চলে আসছে। বহু প্রখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ নাকি পশ্চিমাদের মতো ইসলামের মডারেট ভার্সনের কথা বলেছেন! যদিও ঐ লেখিকা তার দাবির স্বপক্ষে কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ উল্লেখ করেননি। যাইহোক, ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা কোনটি আর কোনটা ভুল—সে বিষয়ে মুসলিম উলামাদের মাঝে পর্যালোচনা হতে পারে, তবে কোনো নাস্তিক্যবাদী কিংবা সেক্যুলারিস্ট এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন না।
কথিত গবেষক লেখিকা ‘উগ্রপন্থী’দের আরেকটি কৌশল বিবৃত করেছেন এভাবে, ‘উগ্রপন্থীদের আরেকটি সর্বাধিক ব্যবহৃত কৌশল হলো মুসলিমরা যে সবকিছুর ভিকটিম, তা প্রমাণের চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, তাদের উদাহরণ টেনে এনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয় যে মুসলিমরা পৃথিবীর সব দেশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। এখানেও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব ও নিজেদের মধ্যে হানাহানির বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকে।’
এখানে লেখিকার ‘প্রশংসা’ না করে পারা যায় না! চতুর উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি কতোটা নিকৃষ্টভাবে মুসলিমদের মগজধোলাই করতে চেয়েছেন তা ভাবতেই ভয়ংকর লাগে। লেখিকা খুব সংক্ষেপে অনেক ঈমানবিধ্বংসী বিষ প্রচারের চেষ্টা করেছেন। তার সেই সংক্ষিপ্ত কথাগুলো থেকে যা বুঝা যায়, তার উপর ভিত্তি করে আমার কিছু প্রশ্ন:
• পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুসলিমরা নির্যাতিত, লেখিকা কি এটা অস্বীকার করতে চান? যদি অস্বীকার না করেন তাহলে মুসলিম নির্যাতনের ঘটনাগুলো মুসলিমদের জানালে লেখিকার সমস্যা কোথায়? মুসলিমরা এক দেহের মতো; পৃথিবীর কোথাও কোনো একজন মুসলিম নির্যাতিত হলেও অন্য মুসলিমগণ এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে বাধ্য। ইসলামের আল-ওয়ালা ওয়াল বারাআর শিক্ষা এটিই। আর এ আক্বিদা থেকে মুসলিমদের দূরে সরাতেই যে লেখিকা এমন হীন আলোচনা করেছেন, তা কি সুস্পষ্ট নয়?
• পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানে মুসলিমদের উপর নির্যাতন করা হয়, এটা লেখিকা স্বীকার করছেন। একইসাথে আবার মুসলিমদেরকে তিনি ভিকটিম হিসেবে মানতেও নারাজ! অর্থাৎ তিনি যেন বলতে চাচ্ছেন, মুসলিমদের হত্যা করা হচ্ছে ঠিক আছে, তবে তারা নির্যাতিত নয়! এভাবেই বিষয়টিকে তিনি উপস্থাপন করেছেন। যেন সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর নির্যাতন কোনো সমস্যাই না, মুসলিমদের এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আসলেই কি লেখিকা এটা বুঝাতে চান যে, সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর নির্যাতন হতে পারে, এটা কোনো সমস্যা না? আর এ বিষয়ে মুসলিমদের জানানোটাই কি লেখিকার কাছে ‘উগ্রপন্থা’ মনে হয়?
• লেখিকা বলতে চেয়েছেন, কেবল যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানেই তারা নির্যাতিত হয়। কিন্তু আসলেই কি কেবল সংখ্যালঘু দেশেই মুসলিমরা নির্যাতিত? ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, আফগানিস্তান, ইয়ামান ইত্যাদি দেশগুলোতে কি মুসলিমরা সংখ্যালঘু? সেখানে কি মুসলিমদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে না? অবশ্য লেখিকা এক্ষেত্রে বলছেন, সেগুলোতে গৃহযুদ্ধ চলছে। মুসলিমরা নিজেদের মাঝে মারামারি করছে! কেননা, লেখিকার মতে অর্থাৎ তিনি যে আন্তধর্মীয় সংলাপের কর্মী সেখানে প্রকৃতপক্ষে কাফের-মুশরিক আর মুসলিমদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আর তাই, মুসলিমদের দেশগুলোতে দালাল শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমে কাফেররা যে মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তা লেখিকার মতে গৃহযুদ্ধ, নিজেদের মাঝে মারামারি।
• লেখিকার কথা থেকে বুঝা যায়, বাংলাদেশে মুসলিমরা ভিকটিম না। অথচ এর আগেই তিনি বাংলাদেশে ‘উগ্রপন্থা’র বিস্তারের কারণ হিসেবে বলে এসেছেন যে, সর্বস্তরে ব্যাপক হারে দুর্নীতি, মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতার পরিসর ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা, সুশাসনের অভাব ও আইনের শাসন উপেক্ষিত থাকা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়ন, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি সমস্যাগুলো বাংলাদেশে বিদ্যমান। এ সমস্যাগুলো কি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণকে ভিকটিম প্রমাণিত করে না? যদি ভিকটিম প্রমাণিত না-ই করে তাহলে লেখিকা কেন এই বিষয়গুলোকে বাংলাদেশে ‘উগ্রপন্থা’ বিস্তারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন? লেখিকা কেন মনে করেন, এগুলো বাংলাদেশে ‘উগ্রপন্থা’ বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করবে?
যাইহোক লেখিকার উল্লেখিত বিষয়গুলো বাদেও বাংলাদেশে মুসলিমদের উপর নির্যাতনের সুস্পষ্ট বহু উদাহরণ আছে। ৫ই মে শাপলা চত্বরে হাজারো মুসলিমদের রক্তের কথা মুসলিমরা ভুলে যায়নি, ভুলে যায়নি ভোলার নবীপ্রেমিক মুসলিমদের বুকে পুলিশের গুলি চালানোর কথা। বাংলাদেশে মুসলিমদের বুকে এভাবে গুলি চালানোর বহু ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া, হিন্দুত্ববাদের দালাল শাসকগোষ্ঠী যে আজ প্রতিটি পদে পদে মুসলিমদেরকে লাঞ্ছিত করছে, বঞ্চিত করছে ন্যায্য অধিকার থেকে—তা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। লেখা এমনিতেই দীর্ঘ হয়ে যাওয়াই সেসকল লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিষয়গুলো এখানে আর উল্লেখ করতে চাচ্ছি না।
লেখিকা সর্বশেষে ‘উগ্রপন্থী’দের আরেকটি কৌশল উল্লেখ করেছেন যে, ‘উগ্রপন্থী’রা কিয়ামতের আলামত তথা কিয়ামত–পূর্ব সময়ের আগমনের ইঙ্গিত দিয়ে সাধারণ মুসলিমদের ‘ভয়াবহ আতঙ্কের’ মধ্যে ফেলে দেয়। লেখিকা কিয়ামতের আলামতগুলো নিয়ে আলোচনায় চিন্তিত হওয়ার কারণ হিসেবে আমি যা বুঝলাম তা হলো, লেখিকা আসলে চাচ্ছেন মুসলিমরা যেন কিয়ামতের পূর্বের ফিতনাগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, মালহামাতুল কুবরা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে যেন এ অঞ্চলের মানুষ বেখবর থাকে, তিনি চাচ্ছেন দাজ্জালকে যেন রব হিসেবে মুসলিমরা সহজেই মেনে নেয়। আর এ চাওয়াগুলোকে সফল করতে চাইলে মুসলিম আলেমদের মুখ চেপে ধরতে হবে, বন্ধ করতে হবে কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত ঘটনাসমূহ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণীর আলোচনা।
সর্বশেষে লেখিকা মূলত সরকারের কাছে আবেদন করেছেন ‘উগ্রপন্থী’রা যেন প্রচারণা চালাতে না পারে, ‘উগ্রপন্থী’দের দমনে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের মতে, ‘উগ্রপন্থী’দের বাকস্বাধীনতা থাকতে পারবে না, কিয়ামতের আলামতগুলো নিয়ে মুসলিমরা আলোচনা করতে পারবে না। তবে মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে হবে, ছেলে-মেয়ে একসাথে বসিয়ে বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে, ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। যে কাজগুলো মূলত ‘প্রথম আলোগোষ্ঠী’ বীরত্বের সাথে করে যাচ্ছে।
শেষ কথা হলো, ‘করোনাকাল: উগ্রবাদ প্রচারের ঝুঁকি বাড়ছে’ শিরোনামের লেখাটাতে ‘উগ্রবাদী’ হিসেবে মূলত প্রকৃত মুসলিমদেরকেই নিকৃষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখিকা। তিনি ইসলাম ও মুসলিমদের কিছু মৌলিক, ঐতিহাসিক এবং বর্তমানের বাস্তবিক সত্য বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন তার পাঠক সেগুলোকে মিথ্যা হিসেবে মেনে নেয়। তিনি ‘উগ্রপন্থী’দের কতগুলো প্রচার কৌশল হিসেবে যা উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি স্বর্ণকে কয়লা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, তাই বলে আমরা তার কথা মেনে নিয়ে স্বর্ণকে কয়লা বলতে পারি না। আমাদের জন্য এটা বলার সুযোগ নেই যে, ‘উগ্রপন্থী’রা ঐগুলো প্রচার করে না। বরং ঐগুলো প্রচার করাই ঈমানের দাবি।
যেমন লেখিকার মতে, ‘উগ্রপন্থী’রা প্রচার করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ছিল নির্ভুল, খোলাফায়ে রাশিদিনের যুগ ছিল যথাযথ। তো এগুলো যেকোনো প্রকৃত মুসলিমই স্বীকার করতে বাধ্য। আর বর্তমানে মুসলিমরা যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত এটা ‘উগ্রপন্থী’দের প্রমাণ করার কিছু নেই। বরং এটা স্বাধীনভাবেই প্রমাণিত।
‘প্রথম আলো গং’রা মুসলিম নির্যাতনের খবর প্রকাশ না করলে এবং ‘জান্নাতুল মাওয়া’ এর মতো কথিত লেখক-গবেষকরা মুসলিম নির্যাতনকে মিথ্যা দাবি করলেই এটা মিথ্যা হয়ে যাবে না। আর হ্যাঁ, কিয়ামতের আলামত নিয়ে আলোচনা করার ফলে যদি ‘জান্নাতুল মাওয়া’দের কষ্ট হয়, তাহলে তারা কান বন্ধ রাখলেই তো পারেন! যেহেতু তারা শান্তিকামী(!), নিরীহ(!) থাকতে পছন্দ করেন! আরেকটি বিষয় জেনে রাখা উচিত, ‘প্রথম আলো’দের সরকারের কাছ থেকে মুসলিমরা ‘বাকস্বাধীনতা’র অনুমতি প্রার্থনা করে না, করবে না। মুসলিমদের যতোটুকু ‘বাকস্বাধীনতা’ দরকার, তা বিশ্বজাহানের রব আল্লাহ তা’য়ালাই দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং, সরকার কী পদক্ষেপ নিবে-না নিবে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করা হবে না। আল্লাহ যা মানুষের কাছে পৌঁছানোর আদেশ দিয়েছেন, মুসলিমরা সর্বদা তা পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক:আহমাদ উসামা আল-হিন্দী, নির্বাহী সম্পাদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।
সূত্র: https://alfirdaws.org/2020/06/27/39197/
Comment