বাংলার পুলিশচক্রের আদ্যোপান্ত-
মাহমুদ আল হুসাইনী
বাংলার পুলিশচক্রের ইতিহাসঃ
চাঁদাবাজি, ঘুষ, অপহরণ, মাদক-ব্যবসা, ধর্ষণ, ঘুম, খুন এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে পুলিশ নামটি যুক্ত নেই। বাস্তবতা হল বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম অপরাধীদের তালিকায় পুলিশের অবস্থান সবার শীর্ষে অবস্থিত। এই নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পর্যন্ত পুলিশের এসব বহুবিধ অপরাধ নিয়ে অগণিত রিপোট করতে বাধ্য হয়েছে। আজ সীমাহীন অপরাধ চক্রে পরিণত হয়েছে এই পুলিশ বাহিনী। এই চরিত্রহীন, জন্তু-জানোয়ার বা হায়ানার সদৃশ পুলিশচক্রের জঘন্য অপরাধ আজ ওপেন সিক্রেট। তাদের অপরাধের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ্য, অনেক বিশাল। তবে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান নিয়ে আলোচনার আগে তাদের অতীত নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
উপমহাদেশে ইউরোপীয় বর্বর ইংরেজদের আগমন হয় ব্যবসায়ীর ছদ্মাবরণে। তবে ব্যবসার আড়ালে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল উর্বর এই স্বাধীন উপমহাদেশকে তাদের ঔপনিবেশ বানানো। এ ভূখণ্ড থেকে ধন-সম্পদ লুট করে তাদের নিজেদের দেশ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। এই বেনিয়া ফিরিঙ্গিরাই তাদের বানিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর পুলিশ বাহিনী তৈরি করে। ১৭৯২ সালের ডিসেম্বর প্রণীত “রেজুলেশন ফর দ্যা পুলিশ অব দ্যা কালেক্টরশীপ ইন ব্যাঙ্গল, বিহার এন্ড উরিস্যা” ছিল গভর্নর ইংরেজ জেনারেল কর্নওয়ালিসের নেয়া বড় ধরনের প্রথম পরিকল্পনা। কর্নওয়ালিসের বানানো এই ব্যবস্থাটি ‘থানাধারী পদ্ধতি’ নামেই বহুল পরিচিত ছিল। আর এভাবেই ব্রিটিশ বর্বরদের হুকুমের গোলাম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফিরিঙ্গি লুটেরা যেন লুটপাট ও হত্যা নির্বিঘ্ন চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। আজ দু’শত বছরের পরোও এই পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি, এখনোও তারা একই কাজ করছে এবং গোলাম গোলামই রয়েছে। গোলামের স্বভাব বদলায়নি, কেবল মুনিবের সংখ্যাই বেড়েছে।
তৎকালীন জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা-ধর্ষণ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মুসলিম ও স্বাধীনতাকামিদের দমন-পীড়নের লক্ষ্যে ১৮৫৬ সালে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারত শাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ক্রুসেডার ব্রিটিশ সরকার। একই লক্ষ্যে ১৮৬০ সালের অগাষ্ট মাসে কেনিং ও কোর্টের সুপারিশ এবং প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় “দ্যা পুলিশ এক্ট ১৮৬১” তারপর তা কর্যকর হয় বাংলা তথা উপমহাদেশে। দখলদার ব্রিটিশরা জনসেবার নামে ভারত উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনী তৈরি করে। এই পুলিশ বাহিনী দিয়েই ব্রিটিশরা দুই শত বছরের বেশি তাদের স্বার্থ রক্ষা করেছিল, নির্যাতন চালিয়ে তাদের শাসন টিকিয়ে রেখেছিল।
এই পুলিশ বাহিনী তৈরির পিছনে ফিরিঙ্গীদের উদ্দেশ্য কি ছিল?
তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন এটি অস্ত্রধারী বাহিনী তৈরি করা যারা কালো বা শ্যামলা চামড়ার অধিকারী হয়ে ভারতবাসীর সাথে মিলে মিশে থাকবে কিন্তু সাদা চামড়ার সাহেবদের মনের মত কাজ করবে, গোলামী করবে। সাদা চামড়ার মালিকদের সন্তুষ্টি অর্জন ও স্বার্থরক্ষাই হবে তাদের মূল কাজ। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে এ দেশের অশিক্ষিত হোমড়া-চোমড়া ও সবলদেহী যুবকদের নিয়ে ফিরিঙ্গীরা তৈরি করে খাকি-পোশাকের পুলিশ বাহিনী। ১৮৬১ সালে এজন্য প্রবর্তন করা হয় আলোচিত ও সমালোচিত পুলিশ আইন। ১৮৬১ সালের ভারত সরকার কর্তৃক পাশকৃত ‘পাঁচ (৫) নাম্বার আইন’ ছিল এটি। তৎকালীন ‘পাঁচ (৫) আইন’ এর নামে নারী-পুরুষগণ আঁতকে ওঠতো যেমনি ভাবে আজ ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি’ আইনের নামে অনলাইন এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ আঁতকে ওঠে।
প্রাথমিকভাবে এই গোলাম বাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয় বাঙ্গালী ও বিশেষ করে মুসলিমদের প্রবেশাধীকার ছিলনা বললেই চলে। ভারতীয়দের নিয়োগ কনস্টেবল থেকে হাবিলদার পর্যন্তই ছিল। ইংল্যান্ড থেকে আসা স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট যুবকরা সরাসরি সার্জেন্ট বা ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পেত। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে এসে পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয়দের অনুমতি দেয়া হয়। তবে ফিরিঙ্গী মালিকের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রমান করার পরই কোন ভারতীয় এসব পদে নিয়োগ পেত অর্থাৎ চিন্তা ও চেতনায় সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ গোলামীকে মেনে নেয়া ছাড়া, ঔপনিবেশিক মানসিকতার ধারক-বাহক হওয়া ছাড়া কেউ এসব পদে নিয়োগ পেত না। ফিরিঙ্গিরা তাদের অনুগত কুকুর ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করত না। এ ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুরু থেকেই হুকুমের গোলাম এই পুলিশ বাহিনী ছিল অত্যাচারী ও দখলদার শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বাহন। তাদের মসনদ টিকিয়ে রাখার মাধ্যম। এই বাহিনী কখনই জনগনের বন্ধু ছিলনা বরং তাদের তৈরিই করা হয়েছিল জনগনের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর জন্য। পেশি শক্তি ব্যবহার করে জোড়পূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। পুলিশ কখনই জনগনের রক্ষক ছিলনা বরং পুলিশ হল শাসকের কুকুর যাকে শাসক নিজের প্রয়োজন মত জনগণের উপর লেলিয়ে দেয়। এটাই হলো পুলিশ বাহিনীর আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়, এ বাস্তবতা আজোও অপরিবর্তিত। ১৮৬১ সালের খাকি পোশাক আর আজকের র্যাব, ডিবি, সিআইডি পুলিশের মধ্যে পার্থক্য কেবল নাম আর পোশাকের সঙ্গে এছাড়া ব্রিটিশদের অনুগত সেই গুণ্ডা বাহিনী আর আজকের দিল্লি, ওয়াশিংটন আর বঙ্গভবনের গোলামী করা র্যাব-ডিবির মধ্যে মৌলিকভাবে আর কোন পার্থক্য নেই। আজকের এই পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশদের অনুগত কুকুর বাহিনীর উত্তরাধিকারী যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশের সার্বভৌমত্ব, জনগণের রক্ষা এসব বুলির আড়ালে আজোও তাদের বিদেশি প্রভু আর দেশীয় এজেন্টদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
পুলিশচক্রের ঐতিহাসিক চরিত্রঃ
ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে এই পুলিশচক্রের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে সেগুলো-
১. ব্রিটিশ বর্বরদের হুকুমের গোলাম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর।
২. এই পুলিশ চক্রের উদ্দেশ্য ছিল ফিরিঙ্গি ইংরেজ প্রভুরা যেন নির্বিঘ্নে জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন, হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি মুসলামান ও স্বাধীনতা কামিদের দমন-পীড়ন চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।
৩. এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অশিক্ষিত হোমড়া-চোমড়া ও সবলদেহী যুবকদের নিয়ে তৈরি হয় অস্ত্রধারী খাকি-পোশাকের পুলিশ বাহিনী।
৪. স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট যুবকরা সরাসরি উপরের (সার্জেন্ট বা ইন্সপেক্টর) পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হত।
৫. বাহ্যিকভাবে দেশবাসীর সাথে মিলে মিশে থেকে সাদা চামড়ার সাহেবদের মনের মত কাজ বা গোলামী করতো।
৬. সরকারের প্রতি ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ব্যতিরেকে নিঃশর্ত আনুগত্য ও চিন্তা-চেতনায় সম্পূর্ণভাবে গোলামীকে মেনে নিয়ে এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আসত এই চক্রের সদস্যরা।
বাংলার পুলিশচক্রের বর্তমান চরিত্রঃ
উপরে বর্ণিত চরিত্রে আজও সমভাবে চরিত্রবান হয়ে দম্ভভরে দণ্ডায়মান রয়েছে এই চরিত্রহীন পুলিশচক্রটি। পূর্বে এরা গোলামী করত ভিনদেশী জালিমদের এখন গোলামী করে দেশীয় জালিমদের। এখনও ভিনদেশী আদর্শের ধারক-বাহক দেশীয় গাদ্দারদের জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা-ধর্ষণ, দমন-পীড়নের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে এই পুলিশচক্র। আজও সবলদেহী অর্ধ-শিক্ষিত বা প্রায় অশিক্ষিত, স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট হোমড়া-চোমড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পুলিশ চক্রের সাধারণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে আছে। তাছাড়া বাহ্যিকভাবে দেশবাসীর সাথে মিলে মিশে থাকার স্লোগান দিয়ে (যেমন “পুলিশ জনগণের বন্ধু”) কুখ্যাত মনিবদের গোলামী করার মহাসাফল্যও তাদের চরিত্রে রয়েছে। আরেকটি কুখ্যাত চরিত্র যা পুরোধমে বিদ্যমান তাহল ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ব্যতিরেকে সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও চিন্তা-চেতনায় সম্পূর্ণভাবে গোলামীকে মেনে নেয়া। বরং বর্তমান এই চক্রটি খোদ নিজেই এতটা দুর্বৃত্ত হয়েছে যে দৃশ্যপটে মনে হয়; মানুষতো বটেই গাছপালা, পশুপাখি, আলো-বাতাস, নদী-নালা এককথায় আসমান ও জমীনের সবকিছুই যেন তাদেরকে অন্তহীন অভিশাপ দিয়ে চলছে। এই অনুভুতি বোঝার জন্য কোন নিরীহ মানুষকে অবলোকন করা যেতে পারে, যিনি তাঁর বুক চাপড়িয়ে, চোখফাটা কান্নায় আকাশের দিকে তাঁকিয়ে দু’ হাত তুলে অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর কাছে বিচার কামনা করছে, “হে আল্লাহ! তুমি এই অত্যাচারী দুর্বৃত্তদেরকে ধ্বংস করো; আর আমাদেরকে তাদের বহুবিধ চক্রান্ত ও জুলুম-অত্যাচার থেকে রক্ষা করো। আমীন! ”
সহায়ক তথ্য সূত্রঃ
১. ‘হুকুমের গোলাম’ প্রামাণ্যচিত্র
২. উইকিপিডিয়া
৩. Encyclopaedia Britannica
মাহমুদ আল হুসাইনী
বাংলার পুলিশচক্রের ইতিহাসঃ
চাঁদাবাজি, ঘুষ, অপহরণ, মাদক-ব্যবসা, ধর্ষণ, ঘুম, খুন এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে পুলিশ নামটি যুক্ত নেই। বাস্তবতা হল বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম অপরাধীদের তালিকায় পুলিশের অবস্থান সবার শীর্ষে অবস্থিত। এই নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া পর্যন্ত পুলিশের এসব বহুবিধ অপরাধ নিয়ে অগণিত রিপোট করতে বাধ্য হয়েছে। আজ সীমাহীন অপরাধ চক্রে পরিণত হয়েছে এই পুলিশ বাহিনী। এই চরিত্রহীন, জন্তু-জানোয়ার বা হায়ানার সদৃশ পুলিশচক্রের জঘন্য অপরাধ আজ ওপেন সিক্রেট। তাদের অপরাধের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ্য, অনেক বিশাল। তবে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর বর্তমান নিয়ে আলোচনার আগে তাদের অতীত নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন।
উপমহাদেশে ইউরোপীয় বর্বর ইংরেজদের আগমন হয় ব্যবসায়ীর ছদ্মাবরণে। তবে ব্যবসার আড়ালে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল উর্বর এই স্বাধীন উপমহাদেশকে তাদের ঔপনিবেশ বানানো। এ ভূখণ্ড থেকে ধন-সম্পদ লুট করে তাদের নিজেদের দেশ ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। এই বেনিয়া ফিরিঙ্গিরাই তাদের বানিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসেবে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই ডিসেম্বর পুলিশ বাহিনী তৈরি করে। ১৭৯২ সালের ডিসেম্বর প্রণীত “রেজুলেশন ফর দ্যা পুলিশ অব দ্যা কালেক্টরশীপ ইন ব্যাঙ্গল, বিহার এন্ড উরিস্যা” ছিল গভর্নর ইংরেজ জেনারেল কর্নওয়ালিসের নেয়া বড় ধরনের প্রথম পরিকল্পনা। কর্নওয়ালিসের বানানো এই ব্যবস্থাটি ‘থানাধারী পদ্ধতি’ নামেই বহুল পরিচিত ছিল। আর এভাবেই ব্রিটিশ বর্বরদের হুকুমের গোলাম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ফিরিঙ্গি লুটেরা যেন লুটপাট ও হত্যা নির্বিঘ্ন চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। আজ দু’শত বছরের পরোও এই পুলিশ বাহিনীর মধ্যে কোন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি, এখনোও তারা একই কাজ করছে এবং গোলাম গোলামই রয়েছে। গোলামের স্বভাব বদলায়নি, কেবল মুনিবের সংখ্যাই বেড়েছে।
তৎকালীন জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা-ধর্ষণ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মুসলিম ও স্বাধীনতাকামিদের দমন-পীড়নের লক্ষ্যে ১৮৫৬ সালে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারত শাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ক্রুসেডার ব্রিটিশ সরকার। একই লক্ষ্যে ১৮৬০ সালের অগাষ্ট মাসে কেনিং ও কোর্টের সুপারিশ এবং প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় “দ্যা পুলিশ এক্ট ১৮৬১” তারপর তা কর্যকর হয় বাংলা তথা উপমহাদেশে। দখলদার ব্রিটিশরা জনসেবার নামে ভারত উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনী তৈরি করে। এই পুলিশ বাহিনী দিয়েই ব্রিটিশরা দুই শত বছরের বেশি তাদের স্বার্থ রক্ষা করেছিল, নির্যাতন চালিয়ে তাদের শাসন টিকিয়ে রেখেছিল।
এই পুলিশ বাহিনী তৈরির পিছনে ফিরিঙ্গীদের উদ্দেশ্য কি ছিল?
তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন এটি অস্ত্রধারী বাহিনী তৈরি করা যারা কালো বা শ্যামলা চামড়ার অধিকারী হয়ে ভারতবাসীর সাথে মিলে মিশে থাকবে কিন্তু সাদা চামড়ার সাহেবদের মনের মত কাজ করবে, গোলামী করবে। সাদা চামড়ার মালিকদের সন্তুষ্টি অর্জন ও স্বার্থরক্ষাই হবে তাদের মূল কাজ। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে এ দেশের অশিক্ষিত হোমড়া-চোমড়া ও সবলদেহী যুবকদের নিয়ে ফিরিঙ্গীরা তৈরি করে খাকি-পোশাকের পুলিশ বাহিনী। ১৮৬১ সালে এজন্য প্রবর্তন করা হয় আলোচিত ও সমালোচিত পুলিশ আইন। ১৮৬১ সালের ভারত সরকার কর্তৃক পাশকৃত ‘পাঁচ (৫) নাম্বার আইন’ ছিল এটি। তৎকালীন ‘পাঁচ (৫) আইন’ এর নামে নারী-পুরুষগণ আঁতকে ওঠতো যেমনি ভাবে আজ ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি’ আইনের নামে অনলাইন এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ আঁতকে ওঠে।
প্রাথমিকভাবে এই গোলাম বাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয় বাঙ্গালী ও বিশেষ করে মুসলিমদের প্রবেশাধীকার ছিলনা বললেই চলে। ভারতীয়দের নিয়োগ কনস্টেবল থেকে হাবিলদার পর্যন্তই ছিল। ইংল্যান্ড থেকে আসা স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট যুবকরা সরাসরি সার্জেন্ট বা ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ পেত। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দিকে এসে পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে ভারতীয়দের অনুমতি দেয়া হয়। তবে ফিরিঙ্গী মালিকের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রমান করার পরই কোন ভারতীয় এসব পদে নিয়োগ পেত অর্থাৎ চিন্তা ও চেতনায় সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ গোলামীকে মেনে নেয়া ছাড়া, ঔপনিবেশিক মানসিকতার ধারক-বাহক হওয়া ছাড়া কেউ এসব পদে নিয়োগ পেত না। ফিরিঙ্গিরা তাদের অনুগত কুকুর ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করত না। এ ইতিহাসের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুরু থেকেই হুকুমের গোলাম এই পুলিশ বাহিনী ছিল অত্যাচারী ও দখলদার শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বাহন। তাদের মসনদ টিকিয়ে রাখার মাধ্যম। এই বাহিনী কখনই জনগনের বন্ধু ছিলনা বরং তাদের তৈরিই করা হয়েছিল জনগনের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর জন্য। পেশি শক্তি ব্যবহার করে জোড়পূর্বক ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। পুলিশ কখনই জনগনের রক্ষক ছিলনা বরং পুলিশ হল শাসকের কুকুর যাকে শাসক নিজের প্রয়োজন মত জনগণের উপর লেলিয়ে দেয়। এটাই হলো পুলিশ বাহিনীর আদি ও অকৃত্রিম পরিচয়, এ বাস্তবতা আজোও অপরিবর্তিত। ১৮৬১ সালের খাকি পোশাক আর আজকের র্যাব, ডিবি, সিআইডি পুলিশের মধ্যে পার্থক্য কেবল নাম আর পোশাকের সঙ্গে এছাড়া ব্রিটিশদের অনুগত সেই গুণ্ডা বাহিনী আর আজকের দিল্লি, ওয়াশিংটন আর বঙ্গভবনের গোলামী করা র্যাব-ডিবির মধ্যে মৌলিকভাবে আর কোন পার্থক্য নেই। আজকের এই পুলিশ বাহিনী ব্রিটিশদের অনুগত কুকুর বাহিনীর উত্তরাধিকারী যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশের সার্বভৌমত্ব, জনগণের রক্ষা এসব বুলির আড়ালে আজোও তাদের বিদেশি প্রভু আর দেশীয় এজেন্টদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
পুলিশচক্রের ঐতিহাসিক চরিত্রঃ
ইতিহাস পর্যালোচনা থেকে এই পুলিশচক্রের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠে সেগুলো-
১. ব্রিটিশ বর্বরদের হুকুমের গোলাম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পুলিশ বাহিনীর।
২. এই পুলিশ চক্রের উদ্দেশ্য ছিল ফিরিঙ্গি ইংরেজ প্রভুরা যেন নির্বিঘ্নে জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন, হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি মুসলামান ও স্বাধীনতা কামিদের দমন-পীড়ন চালিয়ে যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা।
৩. এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অশিক্ষিত হোমড়া-চোমড়া ও সবলদেহী যুবকদের নিয়ে তৈরি হয় অস্ত্রধারী খাকি-পোশাকের পুলিশ বাহিনী।
৪. স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট যুবকরা সরাসরি উপরের (সার্জেন্ট বা ইন্সপেক্টর) পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হত।
৫. বাহ্যিকভাবে দেশবাসীর সাথে মিলে মিশে থেকে সাদা চামড়ার সাহেবদের মনের মত কাজ বা গোলামী করতো।
৬. সরকারের প্রতি ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ব্যতিরেকে নিঃশর্ত আনুগত্য ও চিন্তা-চেতনায় সম্পূর্ণভাবে গোলামীকে মেনে নিয়ে এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আসত এই চক্রের সদস্যরা।
বাংলার পুলিশচক্রের বর্তমান চরিত্রঃ
উপরে বর্ণিত চরিত্রে আজও সমভাবে চরিত্রবান হয়ে দম্ভভরে দণ্ডায়মান রয়েছে এই চরিত্রহীন পুলিশচক্রটি। পূর্বে এরা গোলামী করত ভিনদেশী জালিমদের এখন গোলামী করে দেশীয় জালিমদের। এখনও ভিনদেশী আদর্শের ধারক-বাহক দেশীয় গাদ্দারদের জুলুম-নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা-ধর্ষণ, দমন-পীড়নের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে এই পুলিশচক্র। আজও সবলদেহী অর্ধ-শিক্ষিত বা প্রায় অশিক্ষিত, স্বল্প মেধা, দুষ্ট ও উচ্ছৃঙ্খল চরিত্রের লম্পট হোমড়া-চোমড়াই অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পুলিশ চক্রের সাধারণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে আছে। তাছাড়া বাহ্যিকভাবে দেশবাসীর সাথে মিলে মিশে থাকার স্লোগান দিয়ে (যেমন “পুলিশ জনগণের বন্ধু”) কুখ্যাত মনিবদের গোলামী করার মহাসাফল্যও তাদের চরিত্রে রয়েছে। আরেকটি কুখ্যাত চরিত্র যা পুরোধমে বিদ্যমান তাহল ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা ব্যতিরেকে সরকারের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ও চিন্তা-চেতনায় সম্পূর্ণভাবে গোলামীকে মেনে নেয়া। বরং বর্তমান এই চক্রটি খোদ নিজেই এতটা দুর্বৃত্ত হয়েছে যে দৃশ্যপটে মনে হয়; মানুষতো বটেই গাছপালা, পশুপাখি, আলো-বাতাস, নদী-নালা এককথায় আসমান ও জমীনের সবকিছুই যেন তাদেরকে অন্তহীন অভিশাপ দিয়ে চলছে। এই অনুভুতি বোঝার জন্য কোন নিরীহ মানুষকে অবলোকন করা যেতে পারে, যিনি তাঁর বুক চাপড়িয়ে, চোখফাটা কান্নায় আকাশের দিকে তাঁকিয়ে দু’ হাত তুলে অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর কাছে বিচার কামনা করছে, “হে আল্লাহ! তুমি এই অত্যাচারী দুর্বৃত্তদেরকে ধ্বংস করো; আর আমাদেরকে তাদের বহুবিধ চক্রান্ত ও জুলুম-অত্যাচার থেকে রক্ষা করো। আমীন! ”
সহায়ক তথ্য সূত্রঃ
১. ‘হুকুমের গোলাম’ প্রামাণ্যচিত্র
২. উইকিপিডিয়া
৩. Encyclopaedia Britannica
Comment