আন নাসর মিডিয়া পরিবেশিত
“কুদসের মুক্তির পথ!”
।। উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে - দ্বিতীয় পর্ব
“কুদসের মুক্তির পথ!”
।। উস্তাদ উসামা মাহমুদ হাফিযাহুল্লাহ ||
এর থেকে - দ্বিতীয় পর্ব
গাজাযুদ্ধেআমেরিকারভূমিকা
এই যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে যে, ইসরাঈলের অস্তিত্ব, আমাদের পবিত্র স্থানগুলিতে তাদের দখল এবং মুসলমানদের উপর তাদের বর্বর অত্যাচার—এসবই আমেরিকার সাহায্য ও সমর্থনের ফল। আমেরিকা ইসরাঈলকে কীভাবে এবং কতটা সাহায্য করেছে? এখানে আমরা সংক্ষেপে তার কিছু ঝলক তুলে ধরছি।
সাত অক্টোবর ইসরাঈলে হামলা হয়েছিল, কিন্তু সেই রাতেই আমেরিকায় মাতম শুরু হয়ে গেল। রাতেই হোয়াইট হাউসে ইসরাঈলের পতাকার আলো জ্বালিয়ে দেখানো হলো যে, আমেরিকা ইসরাঈল থেকে দূরে নয়। এরপর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সামরিক নেতৃত্বও ইসরাঈলে পৌঁছে গেলেন। আমেরিকা সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং মিডিয়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসরাঈলের পাশে দাঁড়াল এবং এমন এক দেহ-দুই প্রাণের নজির স্থাপন করল, যেন ইসরাঈল কোনো আলাদা রাষ্ট্র নয়, বরং আমেরিকারই একটি অংশ।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিলেন: “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা ইসরাঈলের সাথে আছি, আমরা ইসরাঈলের সাথে আছি, আমরা ইসরাঈলের সাথে আছি।”
এবং বললেন: “আমরা ইসরাঈলকে কখনো একা ছাড়ব না, যতদিন আমেরিকা থাকবে—আর আমেরিকা চিরকাল থাকবে—ততদিন এটি ইসরাঈলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে।”
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বারবার মিথ্যার পুনরাবৃত্তি করে ইসরাঈলের নৃশংসতার এমনভাবে পক্ষ নিলেন যে, মনে হলো তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নন, বরং ইসরাঈলের মুখপাত্র।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনও যখন শোকগ্রস্ত মুখে তেলআবিবে গেলেন, তখন অনেক কথার পাশাপাশি এও বললেন: “ইসরাঈল এই যুদ্ধ একা লড়তে পারে, কিন্তু যতদিন আমেরিকা আছে, ততদিন ইসরাঈলকে একা যুদ্ধ করতে হবে না।”
তিনি ইসরাঈলকে এই সুসংবাদ দিলেন যে, তাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ শুরু হয়ে গেছে এবং তা কখনো বন্ধ হবে না। আর বাস্তবেও তাই হলো—১৫ মাসে এক দিনের জন্যও এই সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়নি [ ]।
আমেরিকা তাদের দুটি বিমানবাহী রণতরী মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করল। এর পাশাপাশি তারা হাজার হাজার সৈন্য ইসরাঈলের অভ্যন্তরে স্থাপন করল, যাদের কাজ ছিল ইসরাঈলি সেনাবাহিনীকে লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করা [ ]।
ওয়াশিংটন পোস্ট যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে লিখেছিল যে, যুদ্ধের প্রথম ৫৪ দিনে ইসরাঈল গাজায় ২২ হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছিল, যেগুলো সবই আমেরিকান ছিল।
ইসরাঈলি টিভি চ্যানেল 12-এর তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকার সাহায্যের মধ্যে বড় আকারের বোমা এবং দুই হাজার পাউন্ড ওজনের বাঙ্কার বাস্টার গোলা ছাড়াও রয়েছে ডজনখানেক এফ-35 যুদ্ধবিমান ও অ্যাপাচি হেলিকপ্টার [ ]।
একটি আমেরিকান সংস্থার তথ্যমতে, গাজার যুদ্ধের এক বছরে আমেরিকা ইসরাঈলকে কমপক্ষে ২২.৭৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে, যা ইসরাঈলের মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ[ ]। অন্যদিকে, ৪.৮৬ বিলিয়ন ডলার আমেরিকা নিজেই সেই সময়ে ইসরাঈলের প্রতিরক্ষায় নিজেদের অপারেশনে ব্যয় করেছে[ ]।
একটি পশ্চিমা গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, এই যুদ্ধে ইসরাঈল যে পরিমাণ অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে ৬৯ শতাংশ আমেরিকান, ৩০ শতাংশ জার্মান এবং মাত্র ১ শতাংশ তাদের নিজস্ব অস্ত্র। উল্লেখ্য, জার্মানির পক্ষ থেকে এই অস্ত্র সরবরাহও আমেরিকার জার্মানির উপর চাপ সৃষ্টির কারণে হয়েছে। আমেরিকা এও ঘোষণা করেছে যে, ইসরাঈলের অস্ত্রভাণ্ডারে যে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, আমেরিকা তা অব্যাহতভাবে পূরণ করে যাবে[ ]।
আমেরিকা ইসরাঈলে ১৯৮০-এর দশকে অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তোলে এবং ‘War Reserve Stock Allies-Israel (WRSA)’ নামে পরিচিত এই ডিপো ক্রমাগত সমৃদ্ধ করতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে জরুরি অবস্থায় অস্ত্র সরবরাহ নিশ্চিত করা। জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশের (বুশ সিনিয়র) আমলে আমেরিকা ইসরাঈলকে এই গুদাম থেকে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়, তাই বর্তমান যুদ্ধে ইসরাঈল এই অস্ত্রভাণ্ডার থেকেও সুবিধা নিচ্ছে[ ]।
এই অপরিমিত ও নিরবচ্ছিন্ন সাহায্যের ইতিহাস নতুন নয়। প্রফেসর থমাস স্টফার (Thomas Stauffer) একজন আমেরিকান অর্থনীতিবিদ, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নীতি ও তার অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি তাঁর রিপোর্ট ‘The Costs to the U.S. of the Israeli-Palestinian Conflict’-এ লিখেছেন যে, ১৯৪৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ইসরাঈলকে মোট ৩ ট্রিলিয়ন ডলার (৩০ লাখ কোটি ডলার) সাহায্য দিয়েছে।
আমেরিকা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন চুক্তি বা সহায়তার আওতায় ইসরাঈলকে সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছে। ২০১৬ সালে উভয়ের মধ্যে একটি ১০ বছরের চুক্তি হয়, যার অধীনে আমেরিকা ইসরাঈলকে বার্ষিক ৩.৮ বিলিয়ন ডলার (৩৮০ কোটি ডলার) সামরিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এবং এটি ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে।
কেউ একজন যথার্থই বলেছেন— “আমেরিকার বাইরে আমেরিকার সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটির নাম ইসরাঈল।” গত পনেরো মাসের যুদ্ধও এই সত্যটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকার দৃষ্টিতে ইসরাঈলের এতটা গুরুত্ব কেন? তারা ইসরাঈলের জন্য এত কিছু ত্যাগ করছে কেন? ইসরাঈলের জন্য ঝুঁকিকে নিজেদের জন্য সমান ঝুঁকি হিসেবে গণ্য করছে কেন?
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমেরিকান খ্রিস্টানরা ধর্মীয় কারণে ইহুদীদের সাহায্য করাকে নিজেদের কর্তব্য মনে করে। এজন্যই ইসরাঈলকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আমেরিকায় ব্যাপক ঐক্যমত্য রয়েছে।”
এছাড়া, আমেরিকায় ইসরাঈলি লবি AIPAC-এর (আমেরিকান ইসরাঈল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি) বিশাল প্রভাবও এর একটি বড় কারণ। এই লবির উদ্দেশ্য কখনই শান্তি নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো হোয়াইট হাউস, কংগ্রেস এবং মিডিয়ার মাধ্যমে ইসরাঈলের জন্য সর্বোচ্চ সাহায্য আদায় করা।
এই ব্যাখ্যা সঠিক, তবে ড. আবদুল ওহাব আল-মাসিরি ইসরাঈল-আমেরিকা সম্পর্কের জটিল গিঁটকে আরও গভীরভাবে উন্মোচন করেছেন। ড. আল-মাসিরি ছিলেন জায়নবাদ বিশেষজ্ঞ এবং এই বিষয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অধ্যাপক ও গবেষক। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন:
“ইসরাঈলের জন্য আমেরিকার সাহায্যকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন না, এটি আসলে আমেরিকার কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) বিনিয়োগ। কারণ সত্যি বলতে, আমেরিকার নিজেরই ইসরাঈলের প্রয়োজন। আপনি ইসরাঈলকে আমেরিকার একটি যুদ্ধবহর হিসেবেই বিবেচনা করুন, আলাদা দেশ হিসেবে নয়! দেখুন! জায়নবাদীরা বলে যে ইসরাঈল আমেরিকার নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যদি ইসরাঈল না থাকত, তাহলে আরব বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমেরিকাকে আরব সাগরে পাঁচটি বড় যুদ্ধবহর মোতায়েন করতে হত, যেখানে একটি যুদ্ধবহরে বছরে দশ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অর্থাৎ, যদি ইসরাঈল না থাকত, তাহলে আমেরিকাকে এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে রাখতে বছরে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হত, অথচ এখন তারা ইসরাঈলকে বছরে মাত্র দশ মিলিয়ন ডলার দেয়। তাই আমি বারবার এই সত্যটি উল্লেখ করেছি যে, জায়নবাদী এজেন্ডার সাফল্যের কারণ আমেরিকার ওপর তাদের আধিপত্য নয়, বরং আমেরিকার নিজস্ব ঔপনিবেশিক প্রয়োজন। থিওডর হার্জেল (জায়নিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা) দেখেছিলেন যে পশ্চিমা বিশ্ব ও আমেরিকার ঔপনিবেশিক এজেন্ডার সাথে আমাদের জায়নিস্ট (জায়নবাদী) পরিকল্পনা পুরোপুরি খাপ খায়, তিনি তাদের এই আকাঙ্ক্ষা দেখে নিজের প্রয়োজন তাদের সামনে তুলে ধরলেন এবং এভাবেই তিনি সফল হলেন।”[ ] [ ]
আল-জাজিরার প্রতিনিধি যখন ড. মাসিরিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমেরিকার সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে কি ইসরাঈলের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাবে?” তখন ড. মাসিরি জবাবে বললেন: “নিঃসন্দেহে ইসরাঈল ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং এই অনুভূতি জায়নবাদীদের নিজেদেরও আছে। তারা লিখেছে যে, যদি কখনও আমাদের খরচ বেড়ে যায় এবং আমেরিকার পক্ষে আমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাহলে ইসরাঈলের পতন ঘটবে।”
ড. মাসিরি আরও বলেন, “ইসরাঈলের অস্তিত্বের মূল উপাদানগুলি তার অভ্যন্তরে নয়, বরং বাইরে—অর্থাৎ আমেরিকায় নিহিত। আমি এও বলি যে, ইসরাঈল অভ্যন্তরীণ কারণে ধ্বংস হবে না, বরং বাইরের শক্তি, যারা তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এবং বাঁচিয়ে রেখেছে, সেগুলোই যদি ধ্বংস হয়, তাহলেই ইসরাঈল ধ্বংস হবে!”[ ]
ঔপনিবেশিকযুগশেষহয়নি
কেমন যেন ফিলিস্তিনে শুধু ইসরাঈলেরই দখল নেই, বরং আমেরিকারও দখল আছে। আর আমেরিকা না থাকলে ইসরাঈলের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। এরপর, ফিলিস্তিনে ইসরাঈলি দখলদারিত্বের পিছনে আমেরিকার একটি বড় উদ্দেশ্য হলো— দুনিয়ায় নিজের ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। সেই ব্যবস্থা হলো আমেরিকার সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য, যা মুসলিম বিশ্বের ওপর খুবই সুপরিকল্পিতভাবে নিজের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো চাপিয়ে দেয়। সত্যি কথা হলো, মুসলিম বিশ্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত যে ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে চলে গিয়েছিল, তা আজও বিদ্যমান।
অবশেষে উসমানীয় খিলাফতের পতন ঘটল, কিন্তু সেই উপনিবেশ আজও রয়ে গেছে। ব্রিটেন, ইতালি ও ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক যুগ শেষ হয়েছে, কিন্তু উপনিবেশের দ্বিতীয় যুগ এখনো চলমান। আগে যদি সাত সমুদ্র পেরিয়ে ইংরেজরা এসে আমাদের ওপর শাসন চালাত, আর আমাদের জনগণ অনুভব করত যে তারা পরাজিত ও অধীন— তবে আজ সেই একই উপনিবেশ আমেরিকার রূপে আমাদের ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু আমাদেরকে বলা হচ্ছে যে, আমরা স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত! অথচ বাস্তবতা হলো, মুসলমানদের এমন এক ইঞ্চি জমিও নেই, যা আমেরিকার কর্তৃত্বের বাইরে। আফগানিস্তান এখানে ব্যতিক্রম, যেখানে জিহাদের বরকতেই আমেরিকা নিজের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রথমপর্ব