কারাগারের ভয় আমার নেই কিন্তু কবরে যাওয়ার ইচ্ছাও আমার নেই
আবু হামজা
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ঘেঁষে বহুবার চলে গিয়েছি । কখনও বা চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী জ্যামে আটকে থেকেছি আর উঁচু প্রাচীরের অন্যপাশের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখিয়েছি।কিন্তু যখন আমি নিজে ঐ ভুবনের বাসিন্দা হয়েছি তখন সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করেছি কীভাবে একজন মানুষের জীবন একটা চার দেয়ালের মাঝে স্থির হয়ে যায়। কীভাবে সেকেন্ডের কাটা মিনিটে রূপান্তরিত হয় আর মিনিটের কাটা ঘন্টায়। কীভাবে একটা সামান্য দেয়াল মানুষকে তার এতদিনের ভোগ করা স্বাধীনতার মূল্য অনুধাবন করায়। রিক্সার টুংটাং আওয়াজ আর বাদাম ওয়ালার “ বাদাম বাদাম” হাকেও যে এতটা মধু আছে তা জেলখানার উঁচু দেয়ালই আমাকে প্রথম অনুভব করিয়েছে।
জীবনে বহুবার আমার পাশ *দিয়ে প্রিজন ভ্যানকে যেতে দেখেছি এবং ভ্যানের ছোট জানালা দিয়ে উৎসুক চোখগুলো দেখে তাদের জন্য ইনসাফের দোয়া করেছি। কিন্তু আমি নিজে যখন ঐ ভ্যানের সাওয়ারি হয়েছি এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এমন ঠাসাঠাসি ভিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকেছি, মাঘ মাসের শৈত্যপ্রবাহের শীতেও দরদর করে ঘেমে শরীরের পোশাক চুবচুবা করে ভিজিয়েছি। তখন সত্যিকারভাবে বুজতে পেরেছি ‘মানবাধিকার’ একটি কাল্পনিক শব্দ মাত্র । একে শুধু অভিধান আর নেতা-নেত্রীদের ভাষণেই পাওয়া যায় । বাস্তবে এর কোনই অস্তিত্ব নেই । ভেবে বিস্মিত হয়েছি, কেন আমাদের দেশে ২০ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্রিজন ভ্যানে ৫০ জনকে ঠেসে ঢুকানো হয় আর আমাদের তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীরা তা দেখেও না দেখার ভান করেন।
জেল কাউকে একদম ভেঙ্গে ফেলে আবার কাউকে আরো মজবুত করে গড়ে তোলে। আলহামদুলিল্লাহ , জেল আমাকে ভাঙ্গতে পারেনি বরং নতুন উদ্দম দান করেছে। এই জেলখানা-ই আমাকে সাইয়্যেদিনা ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের বন্দীদশার অনুভূতি *শিক্ষা দিয়েছে যা কোন কিতাব আমাকে কখনই দিতে পারেনি । এই জেল আমাকে আমার বোন আফিয়া সিদ্দিকার কষ্ট যতটা হৃদয়ঙ্গম করিয়েছে তা কোন মিডিয়া কখনো পারেনি। দীর্ঘ প্রায় এক বছর অন্যায়ভাবে কারাবন্দী জীবন কাটিয়েছি। মানুষ হিসেবে যখনই কিছুটা কষ্ট হয়েছে তখনই ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আফিয়া সিদ্দিকার ঘটনা আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে নতুন শক্তি দিয়েছে। আমার সেলের একদিকের দেয়ালে বড় করে *লিখে রেখেছিলাম,
These are the best days of my life
মানুষ অবাক হতো । কিন্তু আমাকে দেখে আমার লেখা বিশ্বাসও করতো । শুধু এই লেখাটা দেখার জন্যই অনেকে আমাদের তালিমের হালাকায় ভিড় জমাতো। আর, অদ্ভুত এক স্বপ্নদৃষ্টি প্রায় প্রতিটা *দিন আমি মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়ানো পাখিদের দিকে তাকিয়ে তাদের প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করেছি আর গুনগুন করে তিলাওয়াত করেছি,
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ صَافَّاتٍ وَيَقْبِضْنَ*ۚ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا الرَّحْمَٰنُ*ۚ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِيرٌ
অর্থাৎ, তারা কি লক্ষ্য করে না, তাদের মাথার উপর উড়ন্ত পক্ষীকুলের প্রতি পাখা বিস্তারকারী ও পাখা সংকোচনকারী? রহমান আল্লাহ-ই তাদেরকে স্থির রাখেন । তিনি সর্ব-বিষয় দেখেন।(সূরা মুলক:১৯)
জেলের পুরো সময়টাই আমি দুটি পাখার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলাম। বার বার আল্লাহ তা‘আলার কাছে দোয়া করেছি যেন তিনি আমাকে তার দুশমনের শৃংখল থেকে নিরাপদ রাখেন কিন্তু তাদের বু্লেট থেকে বঞ্চিত না করেন। এই দুনিয়াতে যেমন আছি ভালোই আছি কিন্তু জান্নাতে যেন দয়া করে তিনি আমাকে দুটি মস্তমড় পাখা দান করেন। আমি এই বেহায়া পাখিগুলোর ওপর কিছুটা প্রতিশোধ নিতে চাই।
আমি অনেক ভাইদের দেখেছি যারা জেলের ভয়ে জড়সড়। এরা দুনিয়ার সামান্য আরাম-আয়েশ হারানোর ভয়ে আর জেল হাজত এড়ানোর জন্য জেনে বুঝে আল্লাহ প্রদত্ত হক থেকে চোখ লুকিয়ে বেড়ায়। কেউ কেউ এমনকি আল্লাহর হুকুম লুকাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পর্যন্ত কিছু মাত্র দ্বিধা বোধ করছে না ।ভাই একটু চোখ খুলে দেখুন, যে কারাগারকে আপনি এত ভয় পাচ্ছেন তা আসলে কিছুই না । প্রকৃত ভয়ের জায়গা হচ্ছে কবর যা এড়ানোর কোন ব্যবস্থা-ই হয়ত আপনি নিচ্ছেন না।
জেল থেকে বেরুবার পর আমি যতবারই কবরস্থানের পাশ *দিয়ে গিয়েছি ততবারই কবরের দিকে তাকিয়ে বলেছি, “ হায় কবর! হায় কবর! নিশ্চয়ই তুমি অতি কঠিন ঠিকানা । বন্দীত্বের পূর্বে যেমন স্বাধীনতা কি জিনিস আমি বুজিনি, মৃত্যুর পূর্বেও তেমনি হায়াতের মর্ম বুজতে পারছি না । কারাগারের ভয় আমার নেই কিন্তু কবরে যাবার ইচ্ছাও আমার নেই ।”
ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! আমি মৃত্যু চাইনা, হায়াত চাই ।কবর চাই না সবুজ পাখির সিনা চাই ।একজোড়া পাখা চাই । আপনার রেদা (সন্তুষ্টি) চাই আর দ্বিদার চাই। আপনি আমাকে মৃত্যু থেকে হেফাজত করুন, কবর থেকে দূরে রাখুন।একটা বুলেট আমার জন্য মঞ্জুর করুন যা আমার সিনাকে ভেদ করে যাবে। আমাকে শাহাদাত দান করুন। আমাকে কবুল করুন।
আমিন ইয়া রব্বুল আলামিন।
ওয়াসসালাম
সংগৃহীত: শরীয়ত ম্যাগাজিন (মে,জুন ২০১৫ খ্রী., প্রস্তুতিমূলক সংখ্যা-২) থেকে কিছুটা সম্পাদনা করে এখানে পোস্ট করা হয়েছে।
আবু হামজা
পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ঘেঁষে বহুবার চলে গিয়েছি । কখনও বা চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী জ্যামে আটকে থেকেছি আর উঁচু প্রাচীরের অন্যপাশের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে কৌতূহল দেখিয়েছি।কিন্তু যখন আমি নিজে ঐ ভুবনের বাসিন্দা হয়েছি তখন সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করেছি কীভাবে একজন মানুষের জীবন একটা চার দেয়ালের মাঝে স্থির হয়ে যায়। কীভাবে সেকেন্ডের কাটা মিনিটে রূপান্তরিত হয় আর মিনিটের কাটা ঘন্টায়। কীভাবে একটা সামান্য দেয়াল মানুষকে তার এতদিনের ভোগ করা স্বাধীনতার মূল্য অনুধাবন করায়। রিক্সার টুংটাং আওয়াজ আর বাদাম ওয়ালার “ বাদাম বাদাম” হাকেও যে এতটা মধু আছে তা জেলখানার উঁচু দেয়ালই আমাকে প্রথম অনুভব করিয়েছে।
জীবনে বহুবার আমার পাশ *দিয়ে প্রিজন ভ্যানকে যেতে দেখেছি এবং ভ্যানের ছোট জানালা দিয়ে উৎসুক চোখগুলো দেখে তাদের জন্য ইনসাফের দোয়া করেছি। কিন্তু আমি নিজে যখন ঐ ভ্যানের সাওয়ারি হয়েছি এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এমন ঠাসাঠাসি ভিড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকেছি, মাঘ মাসের শৈত্যপ্রবাহের শীতেও দরদর করে ঘেমে শরীরের পোশাক চুবচুবা করে ভিজিয়েছি। তখন সত্যিকারভাবে বুজতে পেরেছি ‘মানবাধিকার’ একটি কাল্পনিক শব্দ মাত্র । একে শুধু অভিধান আর নেতা-নেত্রীদের ভাষণেই পাওয়া যায় । বাস্তবে এর কোনই অস্তিত্ব নেই । ভেবে বিস্মিত হয়েছি, কেন আমাদের দেশে ২০ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন প্রিজন ভ্যানে ৫০ জনকে ঠেসে ঢুকানো হয় আর আমাদের তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীরা তা দেখেও না দেখার ভান করেন।
জেল কাউকে একদম ভেঙ্গে ফেলে আবার কাউকে আরো মজবুত করে গড়ে তোলে। আলহামদুলিল্লাহ , জেল আমাকে ভাঙ্গতে পারেনি বরং নতুন উদ্দম দান করেছে। এই জেলখানা-ই আমাকে সাইয়্যেদিনা ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লামের বন্দীদশার অনুভূতি *শিক্ষা দিয়েছে যা কোন কিতাব আমাকে কখনই দিতে পারেনি । এই জেল আমাকে আমার বোন আফিয়া সিদ্দিকার কষ্ট যতটা হৃদয়ঙ্গম করিয়েছে তা কোন মিডিয়া কখনো পারেনি। দীর্ঘ প্রায় এক বছর অন্যায়ভাবে কারাবন্দী জীবন কাটিয়েছি। মানুষ হিসেবে যখনই কিছুটা কষ্ট হয়েছে তখনই ইউসুফ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আফিয়া সিদ্দিকার ঘটনা আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে নতুন শক্তি দিয়েছে। আমার সেলের একদিকের দেয়ালে বড় করে *লিখে রেখেছিলাম,
These are the best days of my life
মানুষ অবাক হতো । কিন্তু আমাকে দেখে আমার লেখা বিশ্বাসও করতো । শুধু এই লেখাটা দেখার জন্যই অনেকে আমাদের তালিমের হালাকায় ভিড় জমাতো। আর, অদ্ভুত এক স্বপ্নদৃষ্টি প্রায় প্রতিটা *দিন আমি মুক্ত আকাশে ভেসে বেড়ানো পাখিদের দিকে তাকিয়ে তাদের প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করেছি আর গুনগুন করে তিলাওয়াত করেছি,
أَوَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ صَافَّاتٍ وَيَقْبِضْنَ*ۚ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا الرَّحْمَٰنُ*ۚ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِيرٌ
অর্থাৎ, তারা কি লক্ষ্য করে না, তাদের মাথার উপর উড়ন্ত পক্ষীকুলের প্রতি পাখা বিস্তারকারী ও পাখা সংকোচনকারী? রহমান আল্লাহ-ই তাদেরকে স্থির রাখেন । তিনি সর্ব-বিষয় দেখেন।(সূরা মুলক:১৯)
জেলের পুরো সময়টাই আমি দুটি পাখার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিলাম। বার বার আল্লাহ তা‘আলার কাছে দোয়া করেছি যেন তিনি আমাকে তার দুশমনের শৃংখল থেকে নিরাপদ রাখেন কিন্তু তাদের বু্লেট থেকে বঞ্চিত না করেন। এই দুনিয়াতে যেমন আছি ভালোই আছি কিন্তু জান্নাতে যেন দয়া করে তিনি আমাকে দুটি মস্তমড় পাখা দান করেন। আমি এই বেহায়া পাখিগুলোর ওপর কিছুটা প্রতিশোধ নিতে চাই।
আমি অনেক ভাইদের দেখেছি যারা জেলের ভয়ে জড়সড়। এরা দুনিয়ার সামান্য আরাম-আয়েশ হারানোর ভয়ে আর জেল হাজত এড়ানোর জন্য জেনে বুঝে আল্লাহ প্রদত্ত হক থেকে চোখ লুকিয়ে বেড়ায়। কেউ কেউ এমনকি আল্লাহর হুকুম লুকাতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পর্যন্ত কিছু মাত্র দ্বিধা বোধ করছে না ।ভাই একটু চোখ খুলে দেখুন, যে কারাগারকে আপনি এত ভয় পাচ্ছেন তা আসলে কিছুই না । প্রকৃত ভয়ের জায়গা হচ্ছে কবর যা এড়ানোর কোন ব্যবস্থা-ই হয়ত আপনি নিচ্ছেন না।
জেল থেকে বেরুবার পর আমি যতবারই কবরস্থানের পাশ *দিয়ে গিয়েছি ততবারই কবরের দিকে তাকিয়ে বলেছি, “ হায় কবর! হায় কবর! নিশ্চয়ই তুমি অতি কঠিন ঠিকানা । বন্দীত্বের পূর্বে যেমন স্বাধীনতা কি জিনিস আমি বুজিনি, মৃত্যুর পূর্বেও তেমনি হায়াতের মর্ম বুজতে পারছি না । কারাগারের ভয় আমার নেই কিন্তু কবরে যাবার ইচ্ছাও আমার নেই ।”
ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! আমি মৃত্যু চাইনা, হায়াত চাই ।কবর চাই না সবুজ পাখির সিনা চাই ।একজোড়া পাখা চাই । আপনার রেদা (সন্তুষ্টি) চাই আর দ্বিদার চাই। আপনি আমাকে মৃত্যু থেকে হেফাজত করুন, কবর থেকে দূরে রাখুন।একটা বুলেট আমার জন্য মঞ্জুর করুন যা আমার সিনাকে ভেদ করে যাবে। আমাকে শাহাদাত দান করুন। আমাকে কবুল করুন।
আমিন ইয়া রব্বুল আলামিন।
ওয়াসসালাম
সংগৃহীত: শরীয়ত ম্যাগাজিন (মে,জুন ২০১৫ খ্রী., প্রস্তুতিমূলক সংখ্যা-২) থেকে কিছুটা সম্পাদনা করে এখানে পোস্ট করা হয়েছে।
Comment