৩.
রাত নয়টা পেরিয়ে গেছে।
সময়টা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। একটানা মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে চলছে। এমন বাতাস মনে হয় যেন হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন অব্যক্ত উদাসীনতায় ছেয়ে যায় মন। এমন কিছুর জন্য ব্যাকুলতা অনুভব হয় যা এই পৃথীবিতে নেই। এমন বিরহ যার রেশ অন্তরে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। এই ব্যাকুলতা জান্নাত ছাড়া আর কোন কিছুর জন্য নয়, এই বিরহ হূরে ঈনের বিরহ ছাড়া আর কারো জন্য নয়। আর সমগ্র উদাসীনতা মহান রবের সান্নিধ্য পাবার জন্যই। বাড়ির বাগানে প্রিয় নিম গাছের নিচে বসে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খুব আনমনা হয়ে গিয়েছিলো সালমান। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে একটু চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকায় সে। সালমানের অষ্টাদশী বোন নুসরাত ওর দিকে এগিয়ে আসছে। একমাত্র বোন ওর, বয়সে ওর থেকে ৭ বৎসরের ছোট। খুবই আদরের। নুসরাত সাধারণত ওর বাব-মা’র সাথে ঢাকাতেই থাকে। বড় হয়েছে সেখানেই। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে মেয়েদের জন্য পরিচালিত দাওরা প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। সপ্তাহখানেকের ছুটিতে বাবা-মা’র সাথে বাড়িতে এসেছে সে।
দুই ভাই-বোনে খুব আন্তরিকতা-সৌহার্দতা পূর্ব থেকেই ছিলো। কিন্তু এই আন্তরিকতা বহুগুণে বেড়ে যায় যখন ওরা পরিবারিকভাবে আনসার আল-ইসলামের মুজাহিদদের জন্য কাজ শুরু করে। আর জিহাদের এই পথে নুসরাতের অগ্রযাত্রা একটু কাকতালীয়-ই ছিলো। ২০১৬ সালের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস নুসরাতের সামনে সত্যের এক নতুন দ্বার খুলে দিয়েছিলো। স্ট্যাটাসটা ছিলো ওর কোন এক বান্ধবীর ভাইয়ের। ওটা এতটাই নির্জলা আর প্রাণবন্ত ছিলো যে, স্ট্যাটাসের প্রত্যেকটা লাইন নুসরাতের এখনো হুবহু মনে আছে। সেখানে লিখা ছিলো –
“আমি যেদিন পাকিস্থানের বোন ডক্টর আফিয়া সিদ্দিকী এবং ইরাকের বোন ফাতিমার চিঠি পড়ি, সেদিন আমি এতটাই কেঁদেছি যে কেউ কান্না শুনতে পাবে এই ভয়ে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। কোন ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম না। একজন নিগৃত হয়েছে টেক্সাস কারাগারে আর একজন আবুগারিবে। কিন্তু এই দুই বোন হয়তো কোনদিন জানবে না, তাদের এক কুলাঙ্গার ভাই বাংলাদেশে বসে অশ্রু বিসর্জন দেয়া ছাড়া তাদের জন্য আর কিছুই করতে পারেনি। তবে সবাই জেনে রেখো, আজ থেকে আমি বদলে গেলাম। আমি আমার বোনদের জন্য বদলে গেলাম।
সবাই জেনে রেখো, পাকিস্থানের আফিয়া সিদ্দকী আর ইরাকের ফাতিমা আমার দুই বোন ছিলো।“
স্ট্যাটাসটি পড়ার পরে নুসরাত ব্যাকুল হয়ে ওঠে ড. আফিয়া সিদ্দকী এবং ফাতিমা সম্পর্কে জানার জন্য। এরা কারা ছিলো এবং তাদের জীবনে কি ঘটেছিলো। আর কি এমন লিখা ছিলো তাদের চিঠিতে যা পড়ে অচেনা এক যুবক মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কেঁদেছিলো?
এরপর নুসরাতের খুব বেশি সময় লাগেনি ড. আফিয়া সিদ্দিকী এবং ফাতিমা সম্পর্কে কিছু অসহনীয় যন্ত্রনাদায়ক সত্য জানতে। তাদের সম্পর্কে জানার পরে এবং তাদের চিঠি পড়ার পর থেকে বারংবার নিজেকে কল্পনা করেছে সেই অবস্থায় যা এই দুই বোনের জীবনকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। আর শিউরে উঠেছে নৃশংস নির্যাতনের কথা ভেবে।
তারপর থেকেই নুসরাত এক অজানা আগ্রহ অনুভব করে মুজাহিদদের সম্পর্কে জানার, যারা বারংবার মুসলিম বন্দী নারীদের ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো এবং অনেককে মুক্ত করছিলো। ওই সময় সে হাতে পায় মিশরের এক মহীয়সী নারী জয়নাব আল গাজালীর কারাবন্দী জীবনের উপর লিখা “কারাগারের রাতদিন” বইটি। ব্যস, চিন্তার চেয়ে-ও দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিলো ওর দৈনন্দিন জীবনে। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় আনসার আল ইসলাম পরিচালিত মহিলাদের দাওয়া বিভাগ “ফিমেল উইংস” এর এক বোনের মাধ্যমে সত্যের দ্বার পুরোপুরি উন্মুক্ত হয়ে যায় ওর সামনে। এর পরেই সে ছুটে যায় তার প্রানপ্রিয় বড় ভাই সালমানের কাছে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সেদিনের সে কথোপোকথন আজ-ও ওদের অন্তরে নাড়া দিয়ে যায় যেন,
- ভাইয়া, আমি একটা বিশেষ কথা তোমাকে বলতে চাই যা আমি তোমার পরামর্শ বা অনুমতি ব্যতীতই জেনেছি। বুঝতে পারছি না, এটা ঠিক হয়েছে কিনা!
- বোন আমার, কি বিষয় জেনেছিস তুই আমাকে তা নির্দ্বধায় খুলে বল। বেঠিক কিছু হলে আমি তোকে শুধরে দেবো।
- ভাইয়া এতোদিন আমি তোমাকে মাঝে মধ্যেই জিজ্ঞেস করতাম মুজাহিদদের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে আর এগুলো আমি জানতাম মিথ্যার মুখোশধারী তথাকথিত মিডিয়াগুলো থেকে। তুমি খুব ধৈর্য নিয়ে আমাকে বুঝাতে আর যা আমার বুঝে আসবে না তুমি তা এড়িয়ে যেতে। একটা কথা তুমি বারবার বলতে যে, সময় হলে তুই নিজেই সব জানতে পারবি।
- হ্যা, তুই ঠিক বলেছিস বোন, কিন্তু আজকে কি তুই নতুন কোনো বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করতে চাস?
- না ভাইয়া, আমি তোমাকে আমার অভিমত জানাতে এসেছি।
- কি বিষয়ে বোন?
- মুজাহিদরাই সত্যের উপর আছে, আর তাদের বিষয়ে প্রচারিত বিষয়গুলো স্রেফ মিথ্যা প্রাপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কথাগুলো বলে নুসরাত খুব আড়ষ্ট হয়ে পড়েছিলো। আর সেদিন বোনের মুখে এই কথাগুলো শুনে পিলে চমকে গিয়েছিলো সালমানের। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠেছিলো ওর বুক। এটা খুবই আনন্দের বিষয় ছিলো যে নুসরাত সত্য জেনে গেছে কিন্তু কোনো ভূল মাধ্যম থেকে জানেনি তো? অথবা তার বোন গোয়েন্দাদের পাঁতা কোন ফাঁদে পা দেয়নি তো? বোনকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেঁপে গিয়েছিলো ওর,
- নুসরাত, বোন আমার, তুই এগুলো কোথায় জেনেছিস? আমাকে একেবারে খুলে বল। কোনো কিছু বলত ভূলবি না। বল, কোথা থেকে কিভাবে তুই এগুলো জেনেছিস?
এরপর নুসরাত ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে শুরু করে ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা সালমানকে খুলে বলে। সালমান পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়, যখন সে জানতে পারে আনসার আল ইসলাম পরিচালিত মহিলাদের দাওয়া বিভাগ “ফিমেল উইংস” এর মাধ্যমে নুসরাত সব জেনেছে। তারপরে-ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঢাকাস্থ দাওয়া’হ বিভাগে যোগাযোগ করে সে। এবং জানতে পারে তার বোন কোনো তাগুতের ফাঁদে জড়ায়নি। বরং আল্লাহ খুব সহজে নুসরাতকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। সালমান ভক্তিতে রবের দরবারে লুটিয়ে পড়েছিলো সেদিন। আর নুসরাত-ও আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলো যখন সালমান তাকে জানিয়েছিলো যে, সে নিজেই আনসার আল ইসলামের দাওয়া’হ বিভাগের একজন সক্রিয় কর্মী। নুসরাত খুবই অবাক হয়েছিলো এটা জেনে যে, তার ভাই বিগত পাঁচ বৎসর যাবত মুজাহিদদের সাথে কাজ করছে অথচ সে নিজে কিছুই বুঝতে পারেনি। এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত, একটানা ছয় মাস নুসরাত “ফিমেল উইংস” এর মাধ্যমে দাওয়া’হ কোর্স গ্রহণ করে। অত:পর শুরু করে দাওয়া’হ কার্যক্রম এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেই ভর্তি হয়ে যায় দাওরা বিভাগে।
নুসরাতকে এগিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করে সালমন,
- কিছু বলবি বোন?
- ভাইয়া, একটা প্রিয় নাশিদ শুনতে ইচ্ছে করছে তোমার কন্ঠে।
- কোন নাশিদ? মৃদু হেসে জবাব দেয় সালমান।
- “চলো তাদের পথেই পা বাড়াই......” এটা
- একটা মজার বিষয় জানিস, যে ভাই এই নাশিদটা লিখেছেন এবং গেয়েছেন উনি এখন আমাদের এই এরিয়াতেই সফরে এসেছেন।
- তাই নাকি, বিস্মিত হয়ে প্রতিউত্তর করে নুসরাত। ইস্ যদি উনার মুখে শুনতে পেতাম!
- উনার কন্ঠে শুনতে হলে অডিওটাই শুনতে হবে। উনি তো তোকে সামনে বসিয়ে নাশিদ শুনাবে না, বলে হেসে ফেলে সালমান। আচ্ছা শোন তাহলে, বলে গাওয়া শুরু করে সালমান।
নিস্তব্ধ রাতে খুবই আবেগী হয়ে ওঠে ওর কন্ঠস্বর। এক মায়াবী আচ্ছন্নতা ছেঁয়ে যায় দু’ ভাই-বোনের মন। প্রকৃতি-ও যেন নিশ্চুপ হয়ে সঙ্গী হয় ওদের। ছেলের কন্ঠে নাশিদ শুনে সামনের বেলকনিতে বেড়িয়ে আসেন ওদের বাবা-মা।প্রশান্তিতে অন্তর জুড়িয়ে যায় অভিভাবকদ্বয়ের। চোখ ভিজে ওঠে আনন্দাশ্রুতে। দুই ছেলে মেয়েকে রবের পথ চিনিয়ে দিতে বাবা-মায়ের কোন চেষ্টাকে আল্লাহ বিনষ্ট করেননি। নিশ্চয় রব মুমিনদের কোন আমলকে নষ্ট করেন না....
১ম পর্বের লিঙ্ক:https://dawahilallah.com/showthread....5354#post25354
২য় পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....6%AC-%E0%A7%A8
to be continued inshaaAllaah...[/SIZE]
Comment