৪.
আনসার আল ইসলামের সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে রংপুরে। পাটগ্রামে গ্রেফতারকৃত দুইজন গুপ্তচরকে সেইদিন রাতেই রংপুর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটি এজেন্ডাকে হাতে নিয়ে আব্দুল্লাহ উমায়েরকে এই কেন্দ্রে যেতে হতো। কিন্তু এখন এজেন্ডা তৈরি হয়েছে তিনটা। একটা পূর্ব নির্ধারিত ছিলো আর পরের দুইটা এজেন্ডা সামনে এসেছে গুপ্তচর গ্রেফতার হওয়ার কারণে। রংপুরে রওনা দেয়ার আগের রাতে হায়দায় ভাই এবং আরো দুইজন সিনিয়রের সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করে নিলো আব্দুল্লাহ। ঠিক হলো প্রথমে গুপ্তচরদের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে তারা কি সরাসরি ইন্ডিয়ার চর নাকি দেশীয় মুনাফিক দালালদের মধ্য থেকে কেউ। এরপরে সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের শরীয়াহ বিভাগের চার জন আলেমসহ কিছু বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তির সাথে জরুরী আলোচনা সেরে নিতে হবে। এবং সবশেষে এই অঞ্চলের অ্যাসল্ট টিমের কমান্ডার হায়দার, সেকেন্ড ইন কমান্ড আসাদ, ব্যাক আপ টিম প্রধান আরমান এবং ইমারজেন্সী ইউনিট প্রধান সালমান সহ মিশনের পুরো পরিকল্পনা রিভিউ করতে হবে। প্রধান কেন্দ্র থেকে পাঠানোর কারণে স্বভাবতই এই সম্পূর্ণ মিশনের দায়িত্ব আব্দুল্লাহ’র উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। গত দুইদিন পাটগ্রামে থাকা অবস্থায় ওদের প্রধান কাজ ছিলো মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অ্যাসল্ট নির্ধারিত স্থানে নিরাপত্তার সাথে পৌঁছে দেয়া। যার কারণে এই দুই দিন চোখের পাতা এক করার সময় খুব কমই পেয়েছে ওরা। আর একাজে ওদের সাথে সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় ছিলো গেরিলা ইউনিটের দুর্ধর্ষ সাত জন মুজাহিদ।
পাটগ্রাম থেকে রংপুরে পৌঁছার একাধিক রুট থাকার পরেও মাশোয়ারার মাধ্যমে ঠিক করা হলো পাটগ্রাম রেলষ্টেশন থেকে মেইল ট্রেনে পরবর্তী ১ম স্টপেজে নামবে ওরা। এরপর লোকাল একটি বাজার দিয়ে তিস্তা নদীর রুট ধরে রংপুর-লালমনিরহাট সংযোগ সেতুর পূর্বে পনের মিনিট দূরত্বে গাড়ি থেকে নেমে যাবে। এই পর্যন্ত যাত্রা হবে লোকাল অটো গাড়িতে। তারপর সেখান থেকে প্রধান রাস্তা ধরে না চলে রাস্তা থেকে নেমে পশ্চিম পাশের আবাদী ক্ষেতের সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটতে হবে নদী পর্যন্ত। নদীতে পার হওয়ার জন্য আগে থেকেই নৌকা ঠিক করা থাকবে।
নদী পার হয়ে মূল রাস্তা দিয়ে না গিয়ে আবারো হাঁটতে হবে ২-৩ কিলোমিটারের মতো। এরপর নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছার পর সেখান থেকে মাইক্রো বাসে করে সরাসরি রংপুর কেন্দ্রে।
এই সম্পূর্ণ সফরে সবাই হালকা অ্যাসল্ট সঙ্গে রাখবে। আর কেন্দ্রে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তিনটা বিশেষ পয়েন্টে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট মোট তিনটা ইমারজেন্সী টিম প্রস্তুত থাকবে। চাইলে ওরা খুব সহজেই সেতু পার হয়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারতো, কিন্তু সেতুর এপার আর ওপারে স্থানীয় পুলিশ চেকপোষ্ট বসিয়েছে। ফাইট করে ওপারে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। কিন্তু প্রধান কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আছে যে, মূল মিশন সম্পন্ন হওয়ার আগে গেরিলা ইউনিট সবধরনের সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকবে। তা না হলে মিশন ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে যেটা কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার রংপুর এক্সপ্রেসে উঠেছিলো ওরা। আব্দুল্লাহ, হায়দার, আসাদ ও আরমান। পরবর্তী স্টপেজে পৌঁছতে সময় লেগেছে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা। সেতু সংলগ্ন রাস্তায় পৌঁছার পরে ঘড়ি দেখলো আব্দুল্লাহ। দশটা বাজতে তেরো মিনিট বাকি। অটো থেকে নামার পরে ওরা চারজন সোজা সামনের দিকে কিছুদূর হেঁটে গেলো যাতে কেউ সন্দেহ না করে এবং কেউ ওদেরকে ফলো করছে কিনা তা বোঝার জন্য। কেউ ফলো করছে না এটা নিশ্চিত হয়ে ওরা আবার উল্টো দিক হাঁটা শুরু করলো। চারজনের পরনেই গ্রাম্য পোশাক এবং প্রত্যেকের হাতে একটি করে বাজারের ব্যাগ। দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশের কোন গ্রামের বাসিন্দা বাজার-সদাই করে বাড়ি ফিরছে। অটো থেকে যেখানে নেমেছিলো তার-ও কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো ওরা। রাস্তার মোড়ে পৌঁছে সোজা পশ্চিম পাশে নেমে গেলো সবাই। প্রথমে হায়দার এবং আব্দুল্লাহ একটু পরে আসাদ ও আরমান। নেমে যাওয়ার আগে খুব ভালো করে খেয়াল করে নিলো কেউ ওদেরকে দেখছে কি না। অন্ধকার রাত্রি হওয়ার কারনে সামনে এগুতে একটু সমস্যা হলেও সেতুর ল্যাম্পপোষ্টগুলো দেখে দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো ওরা যেখানে নৌকা রাখা আছে। নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে গেরিলা ইউনিটের দুইজন সদস্য। ওরা আছে মাঝির বেশে। কিন্তু দুইজনের কাছেই যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের মজুদ আছে যদিও সবগুলোই হালকা ধাঁচের। প্রায় দশ পনের মিনিট হাঁটার পরে হায়দার সবাইকে এক জায়গায় বসে পড়তে বললো। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আব্দুল্লাহ,
- কোন কিছু কি চোখে পড়েছে ভাই? কোন সমস্যা?
- না ভাই, আমি একা গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসি সব ঠিকঠাক আছে কি না। তারপর এসে আপনাদের নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।
হায়দার সামনে এগিয়ে গেলো। নদীতে পানি অনেক কম। চর পরে গেছে অনেক জায়াগায়। শুকনো বালির উপর বসে পড়লো বাকি তিনজন। আব্দুল্লাহ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলো নিকটবর্তী অতীতে। নয় বৎসর আগে প্রথম এই এলাকায় সফরে এসেছিলো সে। তখন সেতুর কাজ চলছিলো। নদী পার হতে হতো নৌকাতেই। গরমের দিনে এই ঘাট পার হওয়ার সময় প্রত্যেকবার একটা করে আইসক্রীম কিনতো ঘাট পারের বাজার থেকে। মাগরিব নামাজের সময় ও-পারে পৌঁছে যেতো। নামাজ পড়তো ও-পারের ঘাটে টিনের একচালা নামাজ ঘড়ে। সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাসে প্রানটা জুড়িয়ে যেতো। লোকাল বাজার এলাকা থেকে সাইকেলে করে আসাদ ভাইয়ের সাথে গন্তব্যস্থলে রওনা করতো। আসাদ ভাই সাইকেল চালাতো আর আব্দুল্লাহ পিছনের সিটে বসে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রাখতো পথ দেখার জন্য। অন্ধকারে কখনো কখনো এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকুনি খেয়ে ব্যথা পেতো দুজনেই। একবার তো আসাদ সাইকেল এক ক্ষেতের মধ্যে চালিয়ে দিয়েছিলো। কথাটা মনে পড়তেই হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো আব্দুল্লাহ। অবাক হয়ে আসাদ ও আরমান দু’জনেই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,
- একা একা হাসছেন কেন ভাই?
- আসাদ আমাকে সাইকেলে খুব ঝাঁকুনি খাওয়াতো সেই কথা মনে পড়ায় হেসে ফেলেছি।
- ঝাঁকুনি খাওয়াতো মানে? প্রশ্ন করলো আরমান
- নয় বৎসর আগে যখন এখানে আসতাম তখন সামনের বাজার থেকে সাইকেলে করে আসাদ ভাই আমাকে নিয়ে যেতো। তখন রাস্তা এতো ভালো ছিলো না, তারমধ্যে আমি আসতাম রাতে। দীর্ঘ সফর করে এসে রাতের অন্ধকারে প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে থাকতে থাকতে আমার পিঠ ব্যথা হয়ে যেতো। আর বেকায়দায় পড়তাম যখন কোথাও ঝাঁকুনি খেতাম। একবার তো আসাদ ভাই রাস্তা থেকে সাইকেলটা এক তামাক ক্ষেতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।
- তাই নাকি ভাই, আসাদ ভাই তো কখনো আমাকে এটা বলেনি। এই বার বুঝতে পেরেছি কেন আসাদ ভাইয়ের আব্বা ভাইকে মোটরসাইকেল চালাতে দিতো না। বলেই আরমানও হেসে ফেললো আর অন্ধকার হলেও আসাদ-ও যে মুচকি মুচকি হাসছিলো তা ওরা বুঝতে পারছিলো।
কিছুক্ষণের জন্য সবাই আবার নীরব হয়ে গেলো, রাতের মতো। যেনো রাত তার কিছু প্রিয় অতিথিকে নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখছে। আর থেকে থেকে নদীর পানির হালকা শব্দ যেনো শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ওদের।
- ভাই সবাই চলে আসেন নৌকা প্রস্তুত
হয়দার ভাইয়ের ডাকে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ওরা চারজন, দু:সাহসী অভিযাত্রী ওরা। যারা যৌবনকে খেল-তামাশায় না ডুবিয়ে বেছে নিয়েছে এক কন্টকাকীর্ণ পথ। যে পথ রচিত হয়েছে শহীদের রক্তে। উম্মাহ আজ এই পথিকের পথ চেয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। চতুর্দিকে জালিমের বিষধর সাপগুলো দংশন করেই যাচ্ছে আর উম্মাহ সাহায্যের আর্তি নিয়ে হাহাকার করে মরছে। আর এ ডাক শুনে ওরা ঘুমিয়ে থাকতে পারেনি। আপন ঘড় থেকে বের হয়েছে যেন উম্মাহ ঘড়ে নিরাপদ থাকে। ওরা বিনিদ্র রজনী কাটায় যেন উম্মাহ শান্তিতে ঘুমাতে পারে।
রাত এগারটা পেরিয়ে গেছে।
সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় কেন্দ্র, রংপুর।
ছয় তলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং। পাশাপাশি তিনতলা বিশিষ্ট আরেকটি বিল্ডিং। বাহির থেকে দেখে মনে হয় দুইটা বিল্ডিংয়ের মধ্যে কোন সংযোগ নেই। কিন্তু দুইটা বিল্ডিং-ই পরস্পর সংযুক্ত আছে তিনটা আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোরের মাধ্যমে। কিন্তু বাহিরে কোন সংযোগ সিঁড়ি নেই। এখান থেকে আশেপাশে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ আনসার আল ইসলামের মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রণে। এই নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে মোট মুজাহিদ রয়েছে দুইশত তেত্রিশ জন। যাদের প্রত্যেকেই গেরিলা হামলার পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধে প্রশিক্ষিত। আসন্ন মিশনকে সামনে রেখে পাটগ্রামে মজুদ রাখা হয়েছে আরো একশ’ জন প্রশিক্ষিত মুজাহিদকে।
কেন্দ্রের আন্ডারগ্রাউন্ড বন্দীশালার একটি রুমে বসে আছে আব্দুল্লাহ, হায়দার, আসাদ, আরমান এবং সালমান। ওদের সামনে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে আটককৃত দুইজন চরকে। কি করতে হবে আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছে আব্দুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা।
- আরে আপনারা এদেরকে বেঁধে রেখেছেন কেন, এদের চেহারা দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে এরা আমাদের ভাই-ব্রেরাদার, কৃত্রিম উষ্মা প্রকাশ করে বললো আব্দুল্লাহ।
- না ভাই, আপনি জানেন না এরা ইন্ডিয়ার চর। সালমান কিঞ্চিৎ রাগ প্রকাশ করে বললো।
- কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এরা বাংলাদেশী, হয়তো টাকার লোভে এরা গুপ্তচরের কাজ করতে এসেছিলো।
নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে শুনে চেয়ারে বাঁধা দুই গুপ্তচর চেচিয়ে বললো,
- জ্বী স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন। উনারা মানতেই চায় না আমরা বাংলাদেশী। আমাদের সাথে থাকা জাতীয় পরিচয় পত্র-ও দেখিয়েছি, কিন্তু উনারা কোনভাবেই মানতে চাচ্ছেন না।
- মনে মনে একটু হেসে ফেললো আব্দুল্লাহ, তাছাড়া তোমরা তো হিন্দী-ও বোঝো না তাই না?
- জ্বী স্যার, আমরা হিন্দী বলতেও পারিনা বুঝতেও পারি না। আমরা তো খেটে খাওয়া মানুষ। বাংলাই ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারি না। আর অন্যকোন ভাষাতো দূরেই থাকলো।
- আহা, আপনারা এদের উপর খুব অন্যায় করেছেন দেখছি। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো আব্দুল্লাহ। হঠাৎ হিন্দিতে আব্দুল্লাহ বলে উঠলো, আচ্ছা ওরা যখন স্বীকার করছে না তাহলে ওদেরকে বিবস্ত্র করে ওদের অন্ডকোষে দুইটা করে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখুন আপনারা।
সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো দু্ই বন্দী,
- স্যার, এমনটি করবেন না স্যার, আমরা তো মরে যাবো তাহলে। স্বজাতীকে এই রকম অত্যাচার আপনারা করতে পারবেন স্যার?
- কোন্ রকম অত্যাচার? জিজ্ঞেস করলো আব্দুল্লাহ
- এই যে এখনি বললেন ইটা বেঁধে ঝুলিয়ে দেবেন
- কিন্তু তোমরা তো কিছুক্ষণ আগে বললে যে তোমরা হিন্দী বোঝো না বলতেও পারো না
ফাঁদে পড়ে গেছে বুঝতে পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করা শুরু করলো দুই গুপ্তচর। সঙ্গীদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো আব্দুল্লাহ। আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোর দিয়ে চলে গেলো পাশের তিনতলা বিল্ডিংয়ে। ওখানে অপেক্ষা করছে সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের চারজন বরেণ্য আলেম এবং কয়েকজন বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
৩য় পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....6%AC-%E0%A7%A9
to be continued inshaaAllaah...
আনসার আল ইসলামের সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে রংপুরে। পাটগ্রামে গ্রেফতারকৃত দুইজন গুপ্তচরকে সেইদিন রাতেই রংপুর কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটি এজেন্ডাকে হাতে নিয়ে আব্দুল্লাহ উমায়েরকে এই কেন্দ্রে যেতে হতো। কিন্তু এখন এজেন্ডা তৈরি হয়েছে তিনটা। একটা পূর্ব নির্ধারিত ছিলো আর পরের দুইটা এজেন্ডা সামনে এসেছে গুপ্তচর গ্রেফতার হওয়ার কারণে। রংপুরে রওনা দেয়ার আগের রাতে হায়দায় ভাই এবং আরো দুইজন সিনিয়রের সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করে নিলো আব্দুল্লাহ। ঠিক হলো প্রথমে গুপ্তচরদের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে তারা কি সরাসরি ইন্ডিয়ার চর নাকি দেশীয় মুনাফিক দালালদের মধ্য থেকে কেউ। এরপরে সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের শরীয়াহ বিভাগের চার জন আলেমসহ কিছু বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তির সাথে জরুরী আলোচনা সেরে নিতে হবে। এবং সবশেষে এই অঞ্চলের অ্যাসল্ট টিমের কমান্ডার হায়দার, সেকেন্ড ইন কমান্ড আসাদ, ব্যাক আপ টিম প্রধান আরমান এবং ইমারজেন্সী ইউনিট প্রধান সালমান সহ মিশনের পুরো পরিকল্পনা রিভিউ করতে হবে। প্রধান কেন্দ্র থেকে পাঠানোর কারণে স্বভাবতই এই সম্পূর্ণ মিশনের দায়িত্ব আব্দুল্লাহ’র উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। গত দুইদিন পাটগ্রামে থাকা অবস্থায় ওদের প্রধান কাজ ছিলো মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অ্যাসল্ট নির্ধারিত স্থানে নিরাপত্তার সাথে পৌঁছে দেয়া। যার কারণে এই দুই দিন চোখের পাতা এক করার সময় খুব কমই পেয়েছে ওরা। আর একাজে ওদের সাথে সার্বক্ষণিকভাবে সক্রিয় ছিলো গেরিলা ইউনিটের দুর্ধর্ষ সাত জন মুজাহিদ।
পাটগ্রাম থেকে রংপুরে পৌঁছার একাধিক রুট থাকার পরেও মাশোয়ারার মাধ্যমে ঠিক করা হলো পাটগ্রাম রেলষ্টেশন থেকে মেইল ট্রেনে পরবর্তী ১ম স্টপেজে নামবে ওরা। এরপর লোকাল একটি বাজার দিয়ে তিস্তা নদীর রুট ধরে রংপুর-লালমনিরহাট সংযোগ সেতুর পূর্বে পনের মিনিট দূরত্বে গাড়ি থেকে নেমে যাবে। এই পর্যন্ত যাত্রা হবে লোকাল অটো গাড়িতে। তারপর সেখান থেকে প্রধান রাস্তা ধরে না চলে রাস্তা থেকে নেমে পশ্চিম পাশের আবাদী ক্ষেতের সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটতে হবে নদী পর্যন্ত। নদীতে পার হওয়ার জন্য আগে থেকেই নৌকা ঠিক করা থাকবে।
নদী পার হয়ে মূল রাস্তা দিয়ে না গিয়ে আবারো হাঁটতে হবে ২-৩ কিলোমিটারের মতো। এরপর নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছার পর সেখান থেকে মাইক্রো বাসে করে সরাসরি রংপুর কেন্দ্রে।
এই সম্পূর্ণ সফরে সবাই হালকা অ্যাসল্ট সঙ্গে রাখবে। আর কেন্দ্রে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত তিনটা বিশেষ পয়েন্টে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট মোট তিনটা ইমারজেন্সী টিম প্রস্তুত থাকবে। চাইলে ওরা খুব সহজেই সেতু পার হয়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারতো, কিন্তু সেতুর এপার আর ওপারে স্থানীয় পুলিশ চেকপোষ্ট বসিয়েছে। ফাইট করে ওপারে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। কিন্তু প্রধান কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আছে যে, মূল মিশন সম্পন্ন হওয়ার আগে গেরিলা ইউনিট সবধরনের সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকবে। তা না হলে মিশন ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে যেটা কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না।
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার রংপুর এক্সপ্রেসে উঠেছিলো ওরা। আব্দুল্লাহ, হায়দার, আসাদ ও আরমান। পরবর্তী স্টপেজে পৌঁছতে সময় লেগেছে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা। সেতু সংলগ্ন রাস্তায় পৌঁছার পরে ঘড়ি দেখলো আব্দুল্লাহ। দশটা বাজতে তেরো মিনিট বাকি। অটো থেকে নামার পরে ওরা চারজন সোজা সামনের দিকে কিছুদূর হেঁটে গেলো যাতে কেউ সন্দেহ না করে এবং কেউ ওদেরকে ফলো করছে কিনা তা বোঝার জন্য। কেউ ফলো করছে না এটা নিশ্চিত হয়ে ওরা আবার উল্টো দিক হাঁটা শুরু করলো। চারজনের পরনেই গ্রাম্য পোশাক এবং প্রত্যেকের হাতে একটি করে বাজারের ব্যাগ। দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশের কোন গ্রামের বাসিন্দা বাজার-সদাই করে বাড়ি ফিরছে। অটো থেকে যেখানে নেমেছিলো তার-ও কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো ওরা। রাস্তার মোড়ে পৌঁছে সোজা পশ্চিম পাশে নেমে গেলো সবাই। প্রথমে হায়দার এবং আব্দুল্লাহ একটু পরে আসাদ ও আরমান। নেমে যাওয়ার আগে খুব ভালো করে খেয়াল করে নিলো কেউ ওদেরকে দেখছে কি না। অন্ধকার রাত্রি হওয়ার কারনে সামনে এগুতে একটু সমস্যা হলেও সেতুর ল্যাম্পপোষ্টগুলো দেখে দেখে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো ওরা যেখানে নৌকা রাখা আছে। নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছে গেরিলা ইউনিটের দুইজন সদস্য। ওরা আছে মাঝির বেশে। কিন্তু দুইজনের কাছেই যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রের মজুদ আছে যদিও সবগুলোই হালকা ধাঁচের। প্রায় দশ পনের মিনিট হাঁটার পরে হায়দার সবাইকে এক জায়গায় বসে পড়তে বললো। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আব্দুল্লাহ,
- কোন কিছু কি চোখে পড়েছে ভাই? কোন সমস্যা?
- না ভাই, আমি একা গিয়ে নিশ্চিত হয়ে আসি সব ঠিকঠাক আছে কি না। তারপর এসে আপনাদের নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।
হায়দার সামনে এগিয়ে গেলো। নদীতে পানি অনেক কম। চর পরে গেছে অনেক জায়াগায়। শুকনো বালির উপর বসে পড়লো বাকি তিনজন। আব্দুল্লাহ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলো নিকটবর্তী অতীতে। নয় বৎসর আগে প্রথম এই এলাকায় সফরে এসেছিলো সে। তখন সেতুর কাজ চলছিলো। নদী পার হতে হতো নৌকাতেই। গরমের দিনে এই ঘাট পার হওয়ার সময় প্রত্যেকবার একটা করে আইসক্রীম কিনতো ঘাট পারের বাজার থেকে। মাগরিব নামাজের সময় ও-পারে পৌঁছে যেতো। নামাজ পড়তো ও-পারের ঘাটে টিনের একচালা নামাজ ঘড়ে। সন্ধ্যার মৃদু-মন্দ বাতাসে প্রানটা জুড়িয়ে যেতো। লোকাল বাজার এলাকা থেকে সাইকেলে করে আসাদ ভাইয়ের সাথে গন্তব্যস্থলে রওনা করতো। আসাদ ভাই সাইকেল চালাতো আর আব্দুল্লাহ পিছনের সিটে বসে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রাখতো পথ দেখার জন্য। অন্ধকারে কখনো কখনো এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকুনি খেয়ে ব্যথা পেতো দুজনেই। একবার তো আসাদ সাইকেল এক ক্ষেতের মধ্যে চালিয়ে দিয়েছিলো। কথাটা মনে পড়তেই হালকা শব্দ করে হেসে ফেললো আব্দুল্লাহ। অবাক হয়ে আসাদ ও আরমান দু’জনেই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,
- একা একা হাসছেন কেন ভাই?
- আসাদ আমাকে সাইকেলে খুব ঝাঁকুনি খাওয়াতো সেই কথা মনে পড়ায় হেসে ফেলেছি।
- ঝাঁকুনি খাওয়াতো মানে? প্রশ্ন করলো আরমান
- নয় বৎসর আগে যখন এখানে আসতাম তখন সামনের বাজার থেকে সাইকেলে করে আসাদ ভাই আমাকে নিয়ে যেতো। তখন রাস্তা এতো ভালো ছিলো না, তারমধ্যে আমি আসতাম রাতে। দীর্ঘ সফর করে এসে রাতের অন্ধকারে প্রায় এক ঘন্টার মতো সময় সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে থাকতে থাকতে আমার পিঠ ব্যথা হয়ে যেতো। আর বেকায়দায় পড়তাম যখন কোথাও ঝাঁকুনি খেতাম। একবার তো আসাদ ভাই রাস্তা থেকে সাইকেলটা এক তামাক ক্ষেতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।
- তাই নাকি ভাই, আসাদ ভাই তো কখনো আমাকে এটা বলেনি। এই বার বুঝতে পেরেছি কেন আসাদ ভাইয়ের আব্বা ভাইকে মোটরসাইকেল চালাতে দিতো না। বলেই আরমানও হেসে ফেললো আর অন্ধকার হলেও আসাদ-ও যে মুচকি মুচকি হাসছিলো তা ওরা বুঝতে পারছিলো।
কিছুক্ষণের জন্য সবাই আবার নীরব হয়ে গেলো, রাতের মতো। যেনো রাত তার কিছু প্রিয় অতিথিকে নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে দেখছে। আর থেকে থেকে নদীর পানির হালকা শব্দ যেনো শুভেচ্ছা জানাচ্ছে ওদের।
- ভাই সবাই চলে আসেন নৌকা প্রস্তুত
হয়দার ভাইয়ের ডাকে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। ওরা চারজন, দু:সাহসী অভিযাত্রী ওরা। যারা যৌবনকে খেল-তামাশায় না ডুবিয়ে বেছে নিয়েছে এক কন্টকাকীর্ণ পথ। যে পথ রচিত হয়েছে শহীদের রক্তে। উম্মাহ আজ এই পথিকের পথ চেয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। চতুর্দিকে জালিমের বিষধর সাপগুলো দংশন করেই যাচ্ছে আর উম্মাহ সাহায্যের আর্তি নিয়ে হাহাকার করে মরছে। আর এ ডাক শুনে ওরা ঘুমিয়ে থাকতে পারেনি। আপন ঘড় থেকে বের হয়েছে যেন উম্মাহ ঘড়ে নিরাপদ থাকে। ওরা বিনিদ্র রজনী কাটায় যেন উম্মাহ শান্তিতে ঘুমাতে পারে।
রাত এগারটা পেরিয়ে গেছে।
সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলীয় কেন্দ্র, রংপুর।
ছয় তলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং। পাশাপাশি তিনতলা বিশিষ্ট আরেকটি বিল্ডিং। বাহির থেকে দেখে মনে হয় দুইটা বিল্ডিংয়ের মধ্যে কোন সংযোগ নেই। কিন্তু দুইটা বিল্ডিং-ই পরস্পর সংযুক্ত আছে তিনটা আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোরের মাধ্যমে। কিন্তু বাহিরে কোন সংযোগ সিঁড়ি নেই। এখান থেকে আশেপাশে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ আনসার আল ইসলামের মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রণে। এই নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে মোট মুজাহিদ রয়েছে দুইশত তেত্রিশ জন। যাদের প্রত্যেকেই গেরিলা হামলার পাশাপাশি সম্মুখ যুদ্ধে প্রশিক্ষিত। আসন্ন মিশনকে সামনে রেখে পাটগ্রামে মজুদ রাখা হয়েছে আরো একশ’ জন প্রশিক্ষিত মুজাহিদকে।
কেন্দ্রের আন্ডারগ্রাউন্ড বন্দীশালার একটি রুমে বসে আছে আব্দুল্লাহ, হায়দার, আসাদ, আরমান এবং সালমান। ওদের সামনে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে আটককৃত দুইজন চরকে। কি করতে হবে আগেই পরিকল্পনা করে নিয়েছে আব্দুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা।
- আরে আপনারা এদেরকে বেঁধে রেখেছেন কেন, এদের চেহারা দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে এরা আমাদের ভাই-ব্রেরাদার, কৃত্রিম উষ্মা প্রকাশ করে বললো আব্দুল্লাহ।
- না ভাই, আপনি জানেন না এরা ইন্ডিয়ার চর। সালমান কিঞ্চিৎ রাগ প্রকাশ করে বললো।
- কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে এরা বাংলাদেশী, হয়তো টাকার লোভে এরা গুপ্তচরের কাজ করতে এসেছিলো।
নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে শুনে চেয়ারে বাঁধা দুই গুপ্তচর চেচিয়ে বললো,
- জ্বী স্যার, আপনি ঠিক বলেছেন। উনারা মানতেই চায় না আমরা বাংলাদেশী। আমাদের সাথে থাকা জাতীয় পরিচয় পত্র-ও দেখিয়েছি, কিন্তু উনারা কোনভাবেই মানতে চাচ্ছেন না।
- মনে মনে একটু হেসে ফেললো আব্দুল্লাহ, তাছাড়া তোমরা তো হিন্দী-ও বোঝো না তাই না?
- জ্বী স্যার, আমরা হিন্দী বলতেও পারিনা বুঝতেও পারি না। আমরা তো খেটে খাওয়া মানুষ। বাংলাই ঠিকমত গুছিয়ে বলতে পারি না। আর অন্যকোন ভাষাতো দূরেই থাকলো।
- আহা, আপনারা এদের উপর খুব অন্যায় করেছেন দেখছি। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললো আব্দুল্লাহ। হঠাৎ হিন্দিতে আব্দুল্লাহ বলে উঠলো, আচ্ছা ওরা যখন স্বীকার করছে না তাহলে ওদেরকে বিবস্ত্র করে ওদের অন্ডকোষে দুইটা করে ইট বেঁধে ঝুলিয়ে রাখুন আপনারা।
সাথে সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠলো দু্ই বন্দী,
- স্যার, এমনটি করবেন না স্যার, আমরা তো মরে যাবো তাহলে। স্বজাতীকে এই রকম অত্যাচার আপনারা করতে পারবেন স্যার?
- কোন্ রকম অত্যাচার? জিজ্ঞেস করলো আব্দুল্লাহ
- এই যে এখনি বললেন ইটা বেঁধে ঝুলিয়ে দেবেন
- কিন্তু তোমরা তো কিছুক্ষণ আগে বললে যে তোমরা হিন্দী বোঝো না বলতেও পারো না
ফাঁদে পড়ে গেছে বুঝতে পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করা শুরু করলো দুই গুপ্তচর। সঙ্গীদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো আব্দুল্লাহ। আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোর দিয়ে চলে গেলো পাশের তিনতলা বিল্ডিংয়ে। ওখানে অপেক্ষা করছে সীমান্তবর্তী উত্তরাঞ্চলের চারজন বরেণ্য আলেম এবং কয়েকজন বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।
৩য় পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....6%AC-%E0%A7%A9
to be continued inshaaAllaah...
Comment