৬
----------------------
তিন বিঘা করিডোর।
করিডোরের মাঝ বরাবর চলে গেছে একটি রাস্তা, যা দুই পার্শ্বস্থ জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তিন বিঘা দৈর্ঘ্যের এই ছিট মহলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা বিএসএফ ক্যাম্পে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য ছিট মহলের ভিতরেই পশ্চিম পাশে স্থাপন করা হয়েছে একটি মিনি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পূর্ব পাশে ইংরেজী “M” অক্ষরের আদলে তৈরি করা হয়েছে একটি ত্রিতল বিল্ডিং যেখানে বিএসএফ জোয়ানরা তাদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে। ত্রিতল এই বিল্ডিংয়ের আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়েছে বন্দীশালা ও টর্চার সেল। যেসব বন্দীদেরকে নিয়ে ভয়ের কারণ কম থাকে তাদেরকে এখানে আটক রাখা হয় আর গুরুত্বপূর্ণ কোন বন্দী থাকলে তাকে হত্যা করা হয় অথবা ইন্ডিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। নিচতলার দক্ষিণ সারিতে রয়েছে অস্ত্রাগার। হালকা-ভারী উভয় ধরনের অস্ত্রের মজুদ আছে এখানে। নিচতলার ঠিক মাঝ বরাবর একটি পেঁচানো সিঁড়ি দুইভাগ হয়ে দোতলায় গিয়ে মিশেছে। নিচ তলা এবং দোতলা মিলে মোট একশ’ জন বিএসএফ জোয়ান এখানে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে। আর তিনতলায় শুধু তারাই যেতে পারে যাদেরকে অনুমতি দেয়া আছে অথবা যাদেরকে ওখানে ডাকা হয়।
পূর্ব প্রান্ত থেকে আগত একটি রাস্তা করিডোরের ঠিক পিছনের অংশ বরাবর বাংলাদেশ সীমানার বুক চিরে কোনাকুনিভাবে পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে মিশে গেছে। রাস্তার উভয় প্রান্ত ভারতের সাথে সংযুক্ত। এই রাস্তাটিকে ভারত শুল্কমুক্ত ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে বিগত দশ বৎসর যাবত। কিন্তু কোন বাঙ্গালীর জন্য রাস্তাটি বাংলাদেশ সীমানার উপর-ও ব্যবহার করার অনুমতি নেই। তিন মাস আগে এই করিডোরের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে মেজর হরিপদ সিং এর উপর। চাল-চলনে গাম্ভীর্যতা থাকলেও কাজে কর্মে খুবই খতরনাক চরিত্রের অধিকারী এক অফিসার সে। চোখের ধূর্ত চাহুনিই বলে দেয় এর থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামো বৈ কিছু না।
তিনবিঘা করিডোর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ বরাবর এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ভারত পরিবেষ্টিত বাংলাদেশী ছিটমহল কুচলীবাড়ি। এর আয়তন আনুমানিক দুই বর্গকিলোমিটার। মোটে আটত্রিশটি পরিবারের বসবাস এখানে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি এই সব ছিটমহলের অধিবাসীরা জানতে পারেনি স্বাধীনতার প্রাপ্তি কী? বছরের পর বছর ধরে মৌলিক চাহিদার অধিকারটুকুও ক্ষুণ্ন করা হয়েছে ওদের।
কুচলীবাড়ি ছিটমহল, যেন ছবিতে আঁকা ছোট্ট একটি গ্রাম। হ্যাঁ, ঠিক তাই। এখানে বসবাসরত পরিবারগুলোর সদস্যরা মিলে একটা স্বতন্ত্র গ্রাম্য পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছে। গ্রামের উত্তরে গড়ে উঠেছে ছোট একটি বাজার, সপ্তাহে দুইদিন হাট বসে এখানে। বাজার আর গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর নিমার্ণ করা হয়েছে একটি মসজিদ। গ্রামের বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তি রমিজ মিয়া হচ্ছেন এই মসজিদের ইমাম। খুবই সাদাসিধে লোক, পরহেজগারও বটে। স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। ইমামতির পাশাপাশি একটা মোক্তবও দেখাশোনা করেন উনি। ছোট ছেলে-মেয়েদের দ্বীন শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে বড়দের দ্বীন শিক্ষারও তাগিদ দিয়েছেন খুব। যার কারণে কুরআন পড়া, নামাজ, রোযা ইত্যাদি আবশ্যক বিষয়ে গ্রামের সবাই কম-বেশি এগিয়ে গেছে। আর তাই গ্রামের প্রত্যেকটি পরিবার খুব সমীহ করে এই রমিজ মিয়াকে। মোক্তব চালানোর জন্য যে যা পারে তাই দিয়ে সাহায্য করে, এর পাশাপাশি ইমামতির জন্য যা পান তা দিয়ে ভালোই চলে যায় রমিজ মিয়ার ছোট্ট সংসার। খুব ধীর-স্থির একজন মানুষ এই রমিজ মিয়া। চলা-ফেরায়, কাজ-কর্মে। কিন্তু ইদানীং খুবই ব্যতিব্যস্ত দেখা যায় তাকে। হবেই বা না কেন? মাস দুয়েক পরেই তার বড় মেয়ে শাহিদা’র বিয়ে। বর এই গ্রামের-ই। বাজারের পাশে বাড়ি ওদের। নাম মোতালেব মিয়া। খুবই কর্মঠ ছেলে এই মোতালেব। বগুড়া জেলার ধুনটে বছর কামলার চুক্তিতে কাজ করে সে। গেল মাসে যখন বাড়িতে এসেছিলো তখনই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়েছে মোতালেব আর শাহীদা খাতুনের। সামনের মাসেই বাড়িতে চলে আসবে মোতালেব। ঘর দুইটা একটু মেরামত করতে হবে, বাজারে একটা দোকান দেওয়ার কথাও চলছে। অনেক কাজ বাকি আছে, খরচাপাতিও আছে বেশ। তাই বিয়ের এক মাস আগেই চলে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোতালেব। রমিজ মিয়ার বড় মেয়ের বিয়ে বলে গ্রামের সবার মাঝেই একটা আনন্দ বিরাজ করছে। করবেই বা না কেন? একে তো গ্রামের মুরুব্বী তিনি, সবাই তাকে খুব ভালোবাসে, সমীহ করে চলে। তার উপর উনি হচ্ছে মসজিদের ইমাম।
কিন্তু সবকিছুর পরেও একটা অজানা আশঙ্কা আজ তাড়া করে বেড়ায় কুচলীবাড়ি সিট মহলের বাসিন্দাদের। সরকারের উদাসীনতা, বিএসএফ জোয়ানদের অন্যায়-অত্যাচার একসময় এই ছিট মহলের মানুষদের কাছে মুজাহিদদের আসল পরিচয় স্পষ্ট করে দেয়। তারপর থেকে সবাই মুজাহিদদের পক্ষে পরোক্ষভাবে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রে রমিজ মিয়ার অবদান ছিলো উল্লেখ করার মত। সুযোগ পেলেই বিপদগ্রস্থ কোন মুজাহিদকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে তারা। দুই একজনকে তো বর্ডারের ওপারেও পার করে দিয়েছে।
কিন্তু একসময় বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই ছিটমহলের বাসিন্দাদের মনোভাব প্রকাশ হয়ে যায়। তখন থেকেই সরকার তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে, বন্ধ করে দিয়েছে সব ধরনের সাহায্য সহযোগীতার হাত। নেমে এসেছে অন্যায়-অত্যাচারের খরগ হস্ত। ছোট্ট গ্রামটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে তখন থেকেই। কিন্তু কোনভাবেই মুজাহিদদের সমর্থন থেকে তারা ফিরে আসেনি যদিও প্রতিনিয়ত এর জন্য অনেক মাসুল দিতে হচ্ছে তাদেরকে।
তিনবিঘা করিডোরের বৈঠক রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলো মেজর হরিপদ সিং। আক্রোশে চোখ লাল হয়ে উঠেছে তার, যেন একটা মাতাল যে কিছুক্ষণ আগে মদের বোতল খালি করে দিয়েছে। সামনের আসনে বসে আছে অঙ্কার দেব। একজন সিনিয়র জোয়ান। কিছুক্ষন আগেই যে হরিপদ সিংকে তাদের দুইজন গুপ্তচর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর শুনিয়েছে।
- অঙ্কার দেব, ওই দু’জনের কি গতকালই ফিরে আসার কথা ছিলো?
- জ্বী স্যার, বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এটা বলা ছিলো যে ভাড়া করা কোন দালালের মাধ্যমে যেন খবর দেয়। কিন্তু কোন খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না ওদের। এপারের দালালগুলোও কিছু বলতে পারছে না। দু'একজন বলেছে কয়েকদিন আগে নাকি পাটগ্রাম রেলষ্টেশনের আশপাশেই ছিলো ওরা দুইজন।
- ঠিক আছে, তুমি কাল সকালে পঞ্চাশ সদস্যের একটা টিম রেডি করে ফেলো। আগামী কাল দুপুরে কুচলীবাড়ি থেকে খোঁজ শুরু করে দাও। যদি কোন খোঁজ পাওয়া না যায় ওদের তাহলে জোয়ানদেরকে বলো সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিতে। আমি চাই কোন কিছুই যেন অক্ষত না থাকে। আর আসার সময় আমার জন্য কোন উপহার নিয়ে এসো।
বলতে গিয়ে কুটিল এক হাসি ফুটে উঠলো হরিপদ সিংয়ের মুখে। এক পৈশাচিক হাসি, যেন মানুষ না কোন শয়তান মুখ ভেঙ্গচিয়ে হাসছে। যদি ওর নিজের মেয়েও এই হাসি দেখতো তাহলে চিৎকার করে পালিয়ে যেতো তার কাছে থেকে। কিন্তু এই শয়তানেরা নিজের মেয়ে ব্যতীত পৃথিবীর সব মেয়েকে লোলুপ দৃষ্টিতেই দেখে থাকে।
- ইয়েস স্যার, বলে স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেলো অঙ্কার দেব। মনে মনে সেও ফন্দি আটতে শুরু করেছে কিভাবে কাল নিজের লালসাকে চরিতার্থ করবে। স্বয়ং ইবলীস যেন ওর মনে আনন্দের ঢেউ বইয়ে দিচ্ছিলো তখন।
পরের দিন। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আসর নামাজের আযান হবে।
রোজকার মত আজকেও দুপুরের পরে রমিজ মিয়ার বাড়ির উঠানে জমায়েত হয়েছে গ্রামের মহিলারা। বাড়ির কাজ-কাম সেরে এই সময় মহিলারা বসেই থাকে, ঘরের বারান্দায় বা উঠোন বসে গল্প-গুজব করে সবাই। তাই, রমিজ মিয়া প্রতিদিন দুপুরের পর গ্রামের মহিলাদেরকে নিয়ে ইসলামী কিচ্ছা-কাহিনী শোনানোর আসর বসায় তার বাড়ির উঠোনে। যখন মাঠে কোন কাজ থাকে না তখন পুরুষরাও এসে মাঝে মধ্যে যোগ দেয় এই আসরে।
উঠোনে গাছগুলোর বড় বড় ছায়ার নিচে পাটি বিছিয়ে বসেছে সবাই। রমিজ মিয়ার পাশেই বসেছে তার দুই মেয়ে শাহিদা খাতুন আর কোহিনূর। উনিশে পা দিয়েছে শাহিদা, অপরদিকে কোহিনূর সবে মাত্র তেরতে। দেখতে শুনতে দু’জনেই যথেষ্ট সুশ্রী। বাবার থেকে পরহেজগারিতাও শিখেছে দুই বোন। তন্ময় হয়ে শুনছে সবাই রমিজ মিয়ার কিচ্ছা। আজকে মুসা আ. আর ফেরাউনের কাহিনীর আলোচনা চলছে। কি করে মুসাকে আ. আল্লাহ ফেরাউনের ঘরে বড় করলো, ফেরাউনের স্ত্রী, মুসার (আ) মা, ফেরাউনের মেয়ের দাসী ইত্যাদি ইত্যাদি। রমিজ মিয়ার আবেগী কন্ঠে কারো কারো চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো বেদনার অশ্রু, কেউ কাঁদছিলো মাথা নিচু করে।
হঠাৎ মাঠের দিক থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে আসলো কয়েকজন পুরুষ, চিৎকার করে বলতে লাগলো,
- রমিজ চাচা, ও রমিজ চাচা......... ওরা আইসা পড়ছে।
- আবার........ কুত্তাগুলো আজ না আবার কি করে বসে, লক্ষণ তো ভালো বলে মনে হচ্ছে না। মহিলারা তোমরা সবাই আমার বাড়ির মধ্যে যাও। কেউ বাইরে বের হবা না। যাও..... কেউ কোন আওয়াজ করবা না, যাও.... বলতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় পাংশু হয়ে ওঠে রমিজ মিয়ার মুখমন্ডল।
মহিলাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেলো যেন। আল্লাহ আল্লাহ করতে শুরু করলো সবাই। অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু কাঁপতে লাগলো সবার বুক। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের কয়েকজন পুরুষকে ধরে নিয়ে রমিজ মিয়ার উঠোনে হাজির হলো মালাউন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের একটি টিম।
- রমিজ মিয়া, কয়েকদিন হলো আমাদের দুইজন লোককে খুঁজে পাচ্ছি না আমরা। বলো তো কারা? কোথায়া ওদেরকে আটক করে রেখেছে? ক্রুর হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো সিনিয়র জোয়ান অঙ্কার দেব।
- দেখো ছেলে, তোমাদের লোক কোথায় গেছে বা কাদের কাছে আছে আমাদেরকে এসব প্রশ্ন করায় কোন লাভ নেই। কারণ তোমরা খুব ভালো করেই জানো এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
- এ বুড়াভাম, কিসে ফায়দা হবে আর কিসে হবে না তা আমরা খুব ভালো করেই জানি। তোর গ্রামের সব লোককে উঠোনে হাজির কর্ এক্ষুনি। মহিলাদেরকেও হাজির করা।
- ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি, পুরুষরা সবাই এসে পড়বে। তোমরা এদেরকে যা কিছু ইচ্ছে জিজ্ঞেস করো কিন্তু মেয়েরা এখানে আসবে না।
- ওদেরকেই তো বেশি দরকার আমাদের। তোর বাড়ির ভিতর লুকিয়ে রেখেছিস সবাইকে তাই না? দূর থেকে তো তোর উঠোনেই বসে থাকতে দেখছিলাম ওদের। ডাক ওদের, কিভাবে ফায়দা হাসিল করতে হয় আজ শিখিয়ে দেবো তোদের।
- তোমরা যে কাজে এসেছো সে কাজে ওদের কোন প্রয়োজন হবে না। আমি কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি গ্রামের সবপুরুষকে এক্ষুনি ডেকে আনতে।
- একই কথা বারবার কেন বলছিস রে বুড়ো, মেয়েদের মধ্যে কি তুই আমাদের দুই লোককে লুকিয়ে রেখেছিস নাকি কোন আতঙ্কবাজ (মুজাহিদ) লুকিয়ে আছে তোর বাড়িতে? এই তোমরা কয়েকজন যাওতো ভিতর থেকে সব মেয়েকে এখানে নিয়ে আসো, যদি আসতে না চায় তাহলে টেনে হেঁচরে নিয়ে আসবে, যাও...
কয়েকজন জোয়ানকে ইশারা করলো অঙ্কার দেব। হুকুম পেয়ে বাড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেলো ওরা। রমিজ মিয়া দৌড়ে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ালো ওদের।
- খবরদার, ভিতরে যাবে না তোমরা। আমি সত্যি করে বলছি যে তোমাদের লোকদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
- এই বুড়ো চুপ থাক বলছি, বেশি বাড়াবাড়ি করবি তো চিরতরে চুপ করিয়ে দেবো বুঝলি।
হুঙ্কার দিয়ে উঠলো অঙ্কার দেব। কিন্তু রমিজ মিয়া ওদেরকে কোনভাবেই সামনে এগুতে দিচ্ছিলো না। হঠাৎ অঙ্কার দেব দৌড়ে গিয়ে রমিজ মিয়ার বুক বরাবর মারলো এক লাথি। ভারী বুট জুতোর লাথি খেয়ে বৃদ্ধ রমিজ মিয়া কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আঘাতের প্রচন্ডতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো যেন তার। কোৎ করে একটা শব্দ ছাড়া মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না রমিজ মিয়ার। গ্রামের বয়োজৈষ্ঠ ব্যক্তিকে এইভাবে হেনস্তা হতে দেখে চুপ থাকতে পারলো না পুরুষরা। দুই-তিন জন এগিয়ে গেলো তাকে ধরতে। জোয়ানদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছিলো কয়েকজন। কেউ কেউ অঙ্কার দেবের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলো। প্রেক্ষিতে শয়তান পেয়ে বসলো যেন অঙ্কার দেবকে। জোয়ানদেরকে হুকুম করলো পিটিয়ে সবগুলোর পিঠের ছাল তুলে নিতে। পৈশাচিক এক আনন্দে মেতে উঠলো যেন এক পাল কুকুর। বেধড়ক পেটাতে থাকলো গ্রামের পুরুষগুলোকে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় রমিজ মিয়াকে চামড়ার বেল্ট দিয়ে পেটাতে শুরু করলো অঙ্কার দেব। যেন কেয়ামত শুরু হয়ে গেলো রমিজ মিয়ার উঠোনে। ঠিক এমন সময় মাইকে ভেসে আসলো আযানের ধ্বনি। আসরের সময় হয়ে গেছে। আযানের ধ্বনি কানে আসায় হঠাৎ করেই রমিজ মিয়ার মধ্যে অসীম সাহস এসে ভিড় করলো যেন। অঙ্কারদেব কে উদ্দেশ্য করে উনি বলতে লাগলেন,
- হে জোয়ান, তুমিও তো কোন না কোন বাবার সন্তান। তুমিও তো একজন মানুষ। গ্রামের লোকগুলোকে এভাবে মারবে না বলে দিচ্ছি। ওরা একদম নির্দোষ। আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাও তোমরা। আযান হচ্ছে, বন্ধ করো এই অত্যাচার। না হলে আল্লাহর গজব পড়বে তোমাদের উপর।
- আল্লাহর গজব পড়বে আমাদের উপর তাই না! তো ডাক তোর আল্লাহকে। দেখি কোথায় তোদের আল্লাহ, কেমন তার গজব। আমরাই তো গজব হয়ে এসেছি তোদের উপর। চল্ তোদের আল্লাহর ঘড়ে চল্, দেখি কিসে তোদের সাহায্য করে আজ।
বলে অঙ্কার দেব জোয়ানদেরকে হুকুম করলো সব পুরুষকে মসজিদে নিয়ে যেতে। কাউকে হেঁটে যেতে দিলো না জোয়ানরা। টেনে-হিঁচরে নিয়ে যেতে থাকলো মসজিদের দিকে। আযান তখনো শেষ করেনি মোয়াজ্জিন। আযানরত অবস্থায়ই তার উপর হামলে পড়ে শয়তানগুলো। পেটাতে শুরু করলো ওখানেই, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে গেলো মোয়াজ্জিন। দৌড়ে মসজিদের বাইরে বেরিয়ে আসলো সে, লাঠি হাতে কয়েকজন জোয়ানও মোয়াজ্জিনের পিছে পিছে বেরিয়ে আসলো। কয়েকজন আগুন লাগিয়ে দিলো মসজিদের চারপাশে। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ায় মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে গেলো মসজিদের চারপাশ। ভার সইতে না পেরে পুড়ে যাওয়া বাঁশের খুঁটিগুলো চাল সমেত মাটিতে পড়ে গেলো। মারের চোটে চিৎকার করতে লাগলো গ্রামের পুরুষরা। ওদের আর্ত চিৎকারে ভারী হয়ে উঠলো চারপাশ। মসজিদের ওখান থেকে আবার সবাইকে রমিজ মিয়ার উঠোনে নিয়ে আসলো জোয়ানরা। নাক-মুখ ফেটে রক্ত পড়ছে সবার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কারো কারো। যন্ত্রনায় নীল হয়ে গেছে রমিজ মিয়ার মুখ। ব্যথায় শব্দ করতেও কষ্ট হচ্ছে তার। রাগে-দুঃখে কাঁপছিলো তার পুরো শরীর। ওই অবস্থায় সে সিনিয়র জোয়ান অঙ্কার দেবকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলো,
- তোদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কি কিছুই নেই? স্বজাতীর নই বলেই কি তোরা আমাদের সাথে এমন করতে পারিস? তোদের কারো কারো দাদার বয়সী আমি। লজ্জা করে না তোদের আমার মতো একজন অক্ষম বৃদ্ধের গায়ে হাত উঠাতে! মুজাহিদদের হাতে মার খেয়ে পালিয়ে এসে প্রতিশোধ তুলিস নিরাপরাধ মানুষের উপর তাই না! আল্লাহ একদিন ঠিক ঠিক এর বিচার করবেন। তোদের শাস্তি হবে এর চেয়েও ভয়ানক। একদিন মুজাহিদদের হাতেই তোরা ধ্বংস হয়ে যাবি।
অঙ্কার দেব হুঙ্কার দিয়ে তেড়ে গেলো রমিজ মিয়ার দিকে। সজোরে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিলো তাকে। মুখে নির্দয় হাসি টেনে বুকের উপর দাঁড়িয়ে গেলো সে। ভারী বুটের চাপে তড়পাতে লাগলো বৃদ্ধ রমিজ মিয়া। দরজার ফাঁক দিয়ে বাবার এরুপ অত্যাচার দেখে বাড়ির ভিতরে লুকিয়ে থাকতে পারলো না দুই বোন এবং রমিজ মিয়ার স্ত্রী। দৌড়ে ছুটে এসে বাবাকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো দুই বোন। শাহিদাকে ধরে ফেললো অঙ্কারদেব। কোহিনূর আর ওর মাকেও ধরে ফেললো কয়েকজন জোয়ান।
- এই বুড়ো, তুই তো ফায়দা হাসিলের কথা বলছিলি তাই না! দেখ তাহলে কিভাবে ফায়দা হাসিল করতে হয়।
বলেই শাহিদার বুক থেকে ওড়না টেনে মাটিতে ফেলে দিলো অঙ্কার দেব। কয়েকজন জোয়ান উল্লাস করতে করতে বাড়ির ভিতরে ছুটে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই নারীদের গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে উঠতে লাগলো আকাশ-বাতাস। রাগে কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্টে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো রমিজ মিয়া। পাশেই বাঁশের একটি মোটা কঞ্চি পড়ে ছিলো। সেটাই তুলে নিয়ে দৌড়ে গিয়ে এলোপাথারি আঘাত করতে লাগলো অঙ্কার দেবের মাথায়। শক্ত কঞ্চির আঘাতে কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসলো তৎক্ষনাৎ। আহত হয়ে শয়তান পেয়ে বসলো যেন অঙ্কারের মনে। মেয়ের ওড়না দিয়েই গাছের সাথে বেঁধে ফেললো রমিজ মিয়াকে। স্ত্রী মর্জিনা এক জোয়ানের বুটের আঘাতে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলো। তাকেও গাছের সাথে বেঁধে ফেললো জোয়ানরা। বাবার চোখের সামনেই দুই মেয়েকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ওদের পরনের কাপড় ছিড়তে শুরু করলো কয়েকজন জোয়ান। অন্য জোয়ানরা আহত পুরুষদেরকে বেঁধে ফেললো গাছের সাথে। চিৎকার করতে লাগলো শাহীদা আর কোহিনূর। দুই মেয়ের অসহায়ত্বে উল্লাসে ফেটে পড়লো শয়তানগুলো। বাবা রমিজ মিয়ার বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসলো, দু’চোখ বেয়ে টপ টপ করে ঝড়ে পড়তে লাগলো বেদনার অশ্রু। হায় আল্লাহ। মেহেরবান তুমি। এই দুর্বল বান্দাদের সাহায্য করো মাবুদ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মাবুদ আমার মৃত্যু দাও, আমাকে বধির করে দাও, চোখের দৃষ্টি নষ্ট করে দাও মাবুদ। হায় মাবুদ! নিজের মেয়ের অসহায়ত্ব আজ কি করে সহ্য করি, এতোবড় শাস্তি যে সহ্য করতে পারছি না গো মাবুদ। সাহায্য করো, বাঁচাও আমাদের।
চোখ বন্ধ করে রবের দরবারে হৃদয় নিংড়ানো আকুতি জানাচ্ছিলো রমিজ মিয়া। এক জোয়ান এসে গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায়ই বেল্ট দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করলো তাকে। পেটাতে পেটাতে সে চিৎকার করে বলতে লাগলো - চোখ খোল্ হারামজাদা। তোর নিজের মেয়ের বলাৎকার করা দেখতে হবে তোকে। কিন্তু চোখ খুলতে পারলো না রমিজ মিয়া, মারের চোটে একসময় অজ্ঞান হয়ে গেলো সে।
আমাদের ছেড়ে দাও, বাবা.... ও বাবা.... আলম চাচা....... রশিদ ভাই ...... ও আল্লাহ...আল্লাগো রক্ষা করো......... বাঁচাও আমাদের ...... আজ কোথায় আমাদের ভাইয়েরা?.... কোথায় বীর মুজিহদরা? কোথায় মুসলমান ভাইয়েরা........ তোমাদের বোনদের সম্ভ্রম ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে .....
সম্ভ্রম হারানো মেয়েদের গগনবিদারী আহাজারীতে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো আকাশ-বাতাস। সেই সাথে অবুঝ শিশুগুলো ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে কেঁদে চলছে। গাছের সাথে বেঁধে রাখা নিরুপায় আহত পুরুষরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। দু’চোখ দিয়ে যেন পানি নয় গরম রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো তাদের। চোখ বন্ধ করে সহ্য করতে লাগলো ইতিহাসের এক যন্ত্রনাদায়ক প্রত্যাবর্তনের। চোখের সামনে কারো মা, কারো বোন বা স্ত্রী, কারো মেয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছিলো নাপাক মুশরিকদের হাতে। কিছুক্ষণ আগেও যারা কুরআন থেকে মুসা-ফেরাউনের ঘটনা শুনছিলো। নবী প্রেমে চোখের পানি ফেলছিলো কেউ কেউ। সেই কান্না হঠাৎ করেই যেন রুপ নিলো এক বিভীষিকায়। তছনছ করে দিয়ে গেলো ওদের জীবন। পাল্টে দিয়ে গেলো জীবনের গতিপথ। যে পথে কন্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে যায়, কথক হারিয়ে ফেলে তার বাকশক্তি।
জীবনের সবকিছু ওলোট-পালোট করে দিয়ে একসময় চলে যায় পৈশাচিক মালাউনগুলো। যাবার আগে গাছে বাঁধা লোকদের বাঁধন খুলে দিয়ে যায় ওরা। এটাই হয়তো ওদের মানবতা। উম্মাহর সম্ভ্রম লুটে নিয়ে পুরুষের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া। কিন্তু, কি হবে এ বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে? আজ ওদেরই মা-বোন, স্ত্রী-কন্যা ওদের সামনেই আহত হয়ে পড়ে আছে। এ বেদনা কিসে মিটবে জানে না কেউ। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তাই হাহাকার করে ওঠে মানুষগুলো। প্রকৃতি যেন ভাষা হারিয়ে ফেলে ওদের কষ্টে। বাতাস হারিয়ে ফেলে তার গতিপথ। বন্ধ হয়ে যায় পাখির কিচির-মিচির শব্দ। শুধু শোনা যায় কতিপয় নারী-পুরুষের বুক ফাঁটা আহাজারী।
শরীরের ক্ষত শুকিয়ে যাবে একসময় ঠিকই, কিন্তু পৃথিবীতে বোধহয় এমন কেউ নেই, যে তাদের মনের ক্ষত মিটিয়ে দিতে পারবে আর। কিন্তু বদলা!!! কে নেবে এর বদলা? কিসে বদলা নেবে? কিসে হবে নিগৃত এই মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানোর ক্ষতিপূরণ। কোন পুরুষের বেঁচে থেকে কী লাভ যদি সে উম্মাহর মা-বোনদের সম্মানই রক্ষা করতে না পারে! উম্মাহর সেই বীররা কবে জেগে উঠবে? সেই সৈনিকরা কখন ঘুম থেকে উঠবে যারা এক মুসলিম রমনীর সম্ভ্রম রক্ষায় পুরো এক সেনাবাহিনীকে প্রেরণ করবে? কবে তাদের বুকের তাজা খুন ঝরাবে, কবে? যদি উম্মাহ তার সম্মান-ই হারিয়ে ফেলে, যদি উম্মাহ রক্তাক্ত হতেই থাকে - তাহলে কী হবে এই শরীরে দূষিত রক্ত পুষে?
৫ম পর্বের লিঙ্ক: https://dawahilallah.com/showthread....6%AC-%E0%A7%AB
to be continued inshaaAllaah....
[/SIZE][/SIZE]
Comment