জিহাদ নয়তো অবমাননা, তাই নিজেই বেছে নাও।
-শাইখ আবু ইয়াহিয় আল-লিবিব
-শাইখ আবু ইয়াহিয় আল-লিবিব
সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ তার অনুগত বান্দাদের উপর জিহাদ ফরয করেছেন এবং জিহাদ যে তাদের নিকট অপছন্দের তাও জানিয়ে দিয়েছেন যেঃ ﴾তোমাদের উপর জিহাদের বিধান দেয়া হল যদিও তোমাদের নিকট তা অপছন্দনীয়।﴿ [সূরা বাকারাহঃ আয়াত ২১৬]
অতএব দুঃখ-কষ্ট, অসুস্থতা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, নিজের কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালানো, ভয়, দূর্বোগ এবং পরিবার পরিজন ও নিজ বাসস্থল ত্যাগ করে দূরে থাকা- এইসবই এই ইবাদতের বাস্তবিক অংশ। ﴾আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ধন-সম্পদ, জীবন ও ফলফসালির ক্ষয় ক্ষতির মধ্য দিয়ে। সুখবর দাও ধের্য্যশীলদের।﴿ [সূরা বাকারাহঃ আয়াত ১৫৫]
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
﴾মদিনাবাসী ও তার আশে পাশের মরুবাসীদের জন্য সঙ্গত নয় আল্লাহর রসুলের সহগামী না হয়ে পিছনে রয়ে যাওয়া ও তাঁর জীবন অপেক্ষা নিজেদের জীবনকে বেশী প্রিয় মনে করা; কারণ আল্লাহর পথে তাদের তৃষ্ণা, ক্লামিত্ম এবং ক্ষুধায় ক্লিষ্ট হওয়া এবং কাফিরদের ক্রোধ উদ্রেক করে এমন পদক্ষিপ গ্রহণ করা এবং শত্রুদের নিকট হতে কিছু প্রাপ্ত হওয়া তাদের সৎকর্মরূপে গণ্য হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।﴿[সূরা তাওবাঃ আয়াত ১২০]
এই রকমই আরো কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে জিহাদ অপছন্দনীয় হয়ে উঠে তাদের জন্য যারা নিরাপদ, শামিত্মকামী এবং বিলাসী জীবন নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকতে আর ঝুকি নেয়া থেকে অনেক দূরে থাকতে চায়। এ কারণেই, অধিকাংশ ক্ষিত্রেই জিহাদ যা দাবী করে আর মানুষের কামনা-বাসনা যা চায় তা একে অপরের সাথে পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে।
ঠিক যেমনটি পরম করুনাময় মহান আল্লাহ বলেছেন, ﴾হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কি হল যখন তোমাদেরকে আল্লাহর পথে বের হতে বলা হয় তোমরা মাটিকে আঁকড়ে ধর? তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? কিন্তু আখিরাতের তুলনায় এ দুনিয়ার জীবন (অত্যন্ত) নগণ্য।﴿ [সূরা তাওবাঃ আয়াত ৩৮]
তিনি, সর্বপ্রশংসার অধিকারী, আরো বলেন, ﴾বল, তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ্, তাঁর রসূল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্নীয়স্বজন, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বানিজ্য যা তোমরা অচল হয়ে যাবে বলে ভয় করো, তোমাদের আবাস্থল যা তোমরা ভালবাসো, তাহলে তোমরা আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো, জেনে রেখো, আল্লাহ কখনো ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না।﴿[সূরা তাওবাঃ আয়াত ২৪]
এবং মহান আল্লাহ আরো বলেন, ﴾তুমি কি তাদেরকে দেখ নাই যাদেরকে বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সলাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও?’ অতঃপর যখন তাদের উপর জিহাদের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তার চেয়েও বেশি, এবং বলতে লাগলো, ‘হে আমাদের রব! আমাদের জন্য জিহাদের বিধান কেন দিলে? আমাদেরকে আর কিছুদিন অবকাশ দাও না?’ বল, দুনিয়ার এই ভোগ-সামগ্রী একেবারেই নগণ্য! আর যে ব্যক্তি (আল্লাহ তাআলাকে) ভয় করে তার জন্য পরকাল অনেক উত্তম। আর (সেই পরকালে) তোমাদের উপর বিন্দুমাত্রও জুলুম করবেন না।﴿ [সূরা নিসাঃ আয়াত ৭৭]
আর এ কারণেই, জিহাদের পথে দাবী করা হয় আত্মত্যাগ, এর গুরু দায়িত্বকে কাঁধে নেয়া, এর জন্য সব ধরনের মুসিবতের সামনা করা এবং এ সবই অত্যন্ত সবরের সাথে করতে হয়। অথচ আমাদের অন্তর এগুলো করতে অস্বিকার করে, দুনিয়ার চাকচিক্যের সাথে লেগে থাকতে পছন্দ করে এবং নিজেকে নিজেই দুনিয়ার সবচেয়ে নিচু স্তর পর্যন্ত নামাতে দেয়। এই অন্তর দুনিয়ার জীবনের ভোগ-বিলাস করতে ব্যস্ত থাকে এবং এতেই সে সন্তুষ্ট।
আর তাই আত্নার সামনে রয়েছে এমন যুদ্ধ, যাতে আছে মৃত্যু ও আতঙ্ক আর তার পিছনে রয়েছে বর্তমান জীবন যাতে আছে বংশধর ও ধন-সম্পত্তি। সুতরাং আত্না হয় সামনে জিহাদের পথে এগিয়ে যেতে পারে নতুবা জিহাদে সুফল পাওয়া সত্বেও পা পিছলিয়েই দুনিয়াতেই মগ্ন হয়ে থাকতে পারে। এ কারণেই, আত্মা এ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্থ কারণ সে চায় সবকিছু নগদ এবং বাকিতে কোন কিছুই সে গ্রহণ করতে নারাজ।
হয় জিহাদ নয়তো অপমানিত হওয়া, সিদ্ধান্ত আপনারঃ
এই বিষয়ের রহস্য আমরা উদঘাটন করতে পারি রসূল ﷺ এর এই বাণীর মাধ্যমেঃ ‘‘যখন তোমরা বাই‘আ আল-‘ইনা (এক ধরনের সুদের ব্যবসা) করবে, ষাঁড়ের লেজের পিছনে ছুটবে, ক্ষিত-খামার করেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ পরিত্যাগ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর অপমান চাপিয়ে দিবেন, যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের দ্বীনে ফিরে আস।’’ এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, জিহাদকে সবকিছুর উপরে প্রাধান্য দিতে হবে এবং কেউ বর্তমান জীবনে মগ্ন থাকার অজুহাতে এটাকে অবহেলা করতে পারবে না। তবে যদি জিহাদে অংশ নেয়ার পাশাপাশি ক্ষিত-খামারে কাজ করা যায় সেটা ভিন্ন কথা। অন্যথায়, প্রাধান্য দেয়া হয়েছে জিহাদকে যেখানে জান-মাল ও দ্বীন সংরক্ষিত থাকে। ইমাম ইবনে রাজাব আল-হানবালী رحمهالله বলেছেন, ‘এ জন্যই সাহাবীগণ تক্ষিত-খামারে কাজ করতেন না, কারণ এতে জিহাদ থেকে দূরে সরে যাওয়া হয়।’
শহীদ ইমাম ইবনে আন-নুহাশ رحمهالله উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, এই হাদীসের অর্থ হল, যদি মুসলিমরা জিহাদ থেকে দূরে সরে গিয়ে ক্ষিত-খামার ও কৃষি কাজে মগ্ন হয়ে থাকে, তখন শত্রুরা তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে এবং এ কারণে বিপর্যয়ের সময়ে মুসলিমদের অপ্রস্তুত আর মোকাবিলা করার অক্ষমতা দেখা দিবে। এর আরও কারণ হলো, তাদের এই অবস্থায় (ভোগ-বিলাস, সুসজ্জিত আবাস ও আরাম প্রিয়তা) জীবন-যাপন করাকে নেমে নেয়া।
আর তাই আল্লাহ তাদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত লাঞ্চণা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখবেন যা থেকে তারা পরিত্রাণ পাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের ফরজ দায়িত্বগুলো অর্থাৎ কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, তাদের প্রতি কঠোর হওয়া, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা, ইসলাম ও এর অনুসারীদের সহযোগীতা করা, আল্লাহর কালেমাকে সবার উপরে তুলে ধরা এবং কুফর ও তাঁর অনুসারীদেরকে লাঞ্চিত করা আবার পালন করা শুরু করে দেয়।
আর তাই আল্লাহ তাআলা তাদের উপর লাঞ্চণাকর ও অমর্যাদাকর অবস্থা বিরাজিত রাখবেন, এমন পর্যায় পর্যন্ত যখন তাদের নিজেদের আজাদ করতে বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে- কাফেরদের সাথে লড়াই করা, তাদের প্রতি কঠোর হওয়া, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি কোমল হওয়া ও তাদের সমর্থন করা, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, মানুষ ও মানুষের বিধান অবজ্ঞা করে মহান আল্লাহর বাণীকে সর্বোচ্চ মর্যাদয় তুলে ধরা।
রসূল ﷺ এর সেই হাদীসঃ ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজ দ্বীনে ফিরে আসো’’ - এর দ্বারা তিনি ইঙ্গিত করেছেন, একদিকে জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও তা পরিহার করা আর অন্যদিকে দুনিয়ার প্রতি আস্থা ও নির্ভরশীল হয়ে পরা হচ্ছে নামান্তরে দ্বীনকে ত্যাগ করা ও এর থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং গুনাহগার ও অপরাধী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
এখানে দ্বীন ত্যাগ করা মানে এই নয় যে -মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন- সেই ধরনের কুফরী করা যার কারণে একজন তার দ্বীন থেকে বের হয়ে যায় যা অনেকে মনে করতে পারে। আমার এটি মনে করি কোন বিজ্ঞ আলিমগণই এ ধরনের কথা বলবেন না যে, কোন মুসলিম যদি ইচ্ছাকৃতভাবে জিহাদ পরিত্যাগ করে এবং দুনিয়ার জীবনে মগ্ন হয়ে থাকে, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে। তবে, -মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন- জিহাদ পরিত্যাগ করে দুনিয়ায় মগ্ন থাকার প্রকৃত অর্থ এই যে, কাফির দুশমনরা মুসলিমদের দেশগুলোর উপর আধিপত্য বিস্তার করবে। এর ফলশ্রুতিতে, দুশমনরা দ্বীনের প্রতি কটাক্ষপূর্ণ মানবরচিত আইন বাস্তবায়ন করবে এবং তাদের হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতার সাথে হক্ব ও হক্বপন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে। এ সবকিছুর ফলে যা হবে, দুর্নীতির প্রসার ঘটবে, কুফরী ছড়িয়ে পড়বে, দ্বীন দূর্বল হয়ে পড়বে এবং একই সাথে দ্বীন থেকে সাধারণ মানুষের অন্তরের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে। আর সময়ের স্রোতে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নিবে যারা না হক্বকে চিনতে পারবে আর না চিনবে দ্বীন, বরং ভ্রামিত্ম ও কুফরকে সাথে নিয়ে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠতে থাকবে। আমরা আল্লাহর কাছে এর থেকে আশ্রয় চাই। এর সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ হচ্ছে আন্দালুসিয়া -যা এখন ভুলে যাওয়া অতীত হয়েগিয়েছে। এর মানে হচ্ছে কাফিরদেরকে মুসলিমদের ভূমিগুলো থেকে বের করে দেয়া এবং সেই ভূমি ও মুসলিমদের দ্বীনকে রক্ষা করা জিহাদ ছাড়া আর অন্য কোন ভাবে সম্ভব নয়। এছাড়াও এই হাদীসটি আরো বুঝায় যে, দা‘য়ীদের প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাতে মানুষ ‘জিহাদ’ নামক ইবাদতের দিকে ফিরে আসে এবং এর দায়িত্ব পালনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়। কারণ জিহাদই হচ্ছে একমাত্র বৈধ পথ যার মাধ্যমে এ সকল সমস্যার সঠিক সমাধান হবে এবং দ্বীন তার প্রকৃত অবস্থানে ফিরে আসতে পারবে যাতে এই দ্বীন হবে সম্মানিত ও কুফর হবে লাঞ্চিত, আর ইসলাম হবে প্রসারিত এবং শির্ক হবে দমিত।
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আল-হালিমী কিছু উক্তি করেছেন যেখানে তিনি এই হাদীসটির ব্যাখ্যার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এই কারণে কিছু দ্বীনি আলিমগণ জিহাদকে ইসলামের মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং তা যথার্থ ঠিক যেমন ইমাম ইবনে কাসিম আল-হানবালী رحمهالله তার ‘আলা আল-রাউদ সংকলনে বলেছেন, ‘‘কিছু আলিমগণ জিহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসেবে গণ্য করে, যে কারণে তারা অন্য পাঁচটি স্তম্ভের পরই এটির উলেস্নখ করে থাকেন। ’’
Comment