আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক
প্রসংশা শুধু আল্লাহ্*র জন্য, কারন তিনিই সমস্ত প্রশংসার মালিক, শুধু মালিকই নন বরং সমস্ত উত্তম প্রশংসা শুধু মাত্র আল্লাহ্*র জন্যই। আল্লাহ ব্যাতিত কেউ এটা দাবি করতে পারেনা। আমাদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, স্বীকার করি বা না করি, প্রশংসা তো শুধুমাত্র সেই মহান আল্লাহ্*র জন্যই! আর কেউ যদি বলে, না আমি ও প্রশংশার দাবীদার, তাহলে তাকে আমরা বলবো, "বেশ তো তুমি এক কাজ করো, প্রশংসা যদি নিতে চাও, নিজেকে প্রশংসার দাবীদার প্রমান করতে চাও তবে তেমন একটা কাজ করে কেন দেখাও না!
আল্লাহ তোমার জন্মের আগে থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্য কে পুর্ব থেকে উঠিয়ে এনে পশ্চিমে ডুবিয়ে দেন, তুমি আক দিন পশ্চিম থেকে উঠিয়ে এনে পুর্বে ডুবিয়ে দাও, মাত্র একদিন!
আল্লাহ বলছেন, "তারা কি এমন কিছু বলে যে সম্পর্কে আমি তাদের কাছে কোন দলিল/প্রমান পাঠাইনি"
আমরা চোখ খুলে একটা ব্যাস্ত পৃথিবী দেখি! সবকিছু অনেক ব্যাস্ত, সবাই অনেক ব্যাস্ত! কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না, চিন্তা করার ফুরসত পায় না। জিন্দেগী টা কেমন যেন চাবি দেয়া পুতুল হয়ে গেছে। সকালে উঠে রাতে ডুবে! খায়, ঘুমায়, হাসে, কাঁদে.. ঘুরে ফিরে ..
অতি তুচ্ছ বিষয় পাহাড় সমান গুরুত্ব বহন করে আমাদের সামনে হাজির হয়! আপনি মনে করেন একটা পাখি, সবার মাথার উপর দিয়ে যদি উড়ে যেতে পারতেন তাহলে দেখতেন, সবাই কত ব্যাস্ত। সত্য করে বললে ঠিক ব্যাস্ত নয়, মোহাবিষ্ট, উদ্ভ্রান্ত! আমি দেখি, সকাল বেলা ছোট ছোট বাচ্চা স্কুলে যায়, তার শরীর স্কুলের দিকে যায়, কিন্তু চোখের ভাষা আমি উদ্দেশ্যহীন দেখেছি! আমি দেখেছি এসি লাগানো কোস্টারে আর এসি লাগানো মার্সিডিজে মানুষকে অফিসে যেতে, বাইরের আবরনে কোন খুঁত নাই, সবচেয়ে দামি সুগন্ধি তার চারপাশ মাতিয়ে রাখে, কিন্তু তার চোখ উদাস, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফেসবুক ব্রাউজ করে, কিংবা কানে হেডফোন ঠেসে দিয়ে বসে থাকে! আমি দেখেছি মানুষ যখন অফিস থেকে ঘরে ফিরে, তারা ফিরে আসা গরুর পালের চেয়েও বেশি ক্লান্ত থাকে.... এমন উদাহরন অসংখ্য, আর হবেই বা না কেন? কারন আমাদের প্রত্যেক টা মুহূর্ত আর প্রত্যেকটা কাজ উদ্দেশ্য হীন হয়ে গেছে! আমি মানুষ কে হাসতে দেখেছি, উচ্চ কন্ঠে! আমার পাশ থেকে, কিন্তু তারা যা দেখে হেসেছে তার মধ্যে আমি বিন্দু মাত্র হাসির কোন উপকরন খুঁজে পাইনি। শুধু মাত্র বলার জন্য বলছি না, আসলেই সত্য! আমি ভেবেছি তাহলে তারা হাসছে কেন? পরে উত্তর পেয়েছি, কারন তাকে হাসতে হবে ..তার অন্তর প্রকৃত আনন্দ থেকে অনেক দূরে এখন সে তার ইচ্ছা মত যেকোন একটা কিছু কে হাসির উপাদান বানিয়ে নেয়।
আমার কথা যদি বিশ্বাস না করেন, আমি প্রমান দিয়ে দেই.. আমি দেখেছি মানুষ সেলফি তুলে ক্লিক করার আগ মুহূর্তে তার মুখে যে হাসি থাকে ক্লিক শেষ হয়ে যাবার পর তার সেই হাসি উধাও হয়ে যায়, এখনো কি বিশ্বাস করবেন না, সে হাসে কারন তাকে হাসতে হবে তাই। এক শাইখ খুব সুন্দর করে বলছিলেন, মানুষ ফেসবুকে স্মাইলি সেলফি কেন দেয়? কারন তার বাস্তব জীবনে প্রকৃত আনন্দের মুহুর্তের এত বেশি অভাব যে সে বাধ্য হয় মিথ্যা আনন্দের আর সুখের অভিনয় করতে!
একটা সমাজ ঘুরছে, দিন রাত এভাবে ঘুরছে, কে কোথা থেকে কোন জায়গায় চলে যাচ্ছে কোন ঠিকানা নাই! দুনিয়ার মোহ, ভ্রান্ত মতবাদ, ছলনা, প্রতারনা, নাপাকি, ফাহেশা, বেহায়াপনা লাগামছাড়া ভাবে আমাদের পেচিয়ে নিয়ে এক দুর্বিসহ পাপের গুহায় নিয়ে যাচ্ছে! আর পাপ মানুষকে ক্লান্ত করে দেয়, জীবনী শক্তি নষ্ট করে ফেলে।
অনেক ভাই হয়তো বলবেন এগুলো তো জানা কথা, এগুলো নতুন করে বলার মধ্যে কি আছে? জানা কথা অবশ্যই কিন্তু করে বলার একটা কারন অবশ্যই আছে... এটা হচ্ছে একজন ভালো ডাক্তার যখন রোগের চিকিৎসা দেন তখন তিনি রোগের তাৎক্ষনিক উপসর্গ কে খুব বেশি বিবেচনায় না এনে রোগের পিছনের উপসর্গ গুলো খুঁজে দেখেন। কারন সেটাই রোগের মূল কারন।
আল্লাহ বলছেন, কেউ যদি আমাকে ভুলে যায় আমি তাকে ভুলে যাবো" আর আল্লাহ যদি কাউকে ভুলে যান তবে তার অবস্তাহ কেমন হতে পারে। আল্লাহ বলছেন, যে আমার স্মরন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আমি তার জন্য একটা শয়তান নিযুক্ত করে দেই। আমাদের আজকের এই অবস্থার পিছনে মূল কারন আমরা আল্লাহ কে ভুলে গেছি, আরো বাস্তবসম্মত ভাবে বলতে গেলে, আমরা আল্লাহ কে পরিত্যাগ করেছি। আমাদের জিন্দেগি তে প্রত্যেক্টা অনর্থক কাজ করার সময় আছে কিন্তু আল্লাহ কে স্মরন করার মত কোন সময় নাই।
আমি আরো একটু ভাংতে চাই ...
আমাদের অন্তর গুলো আজ আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্কিত না। আমাদের অন্তর আজ আল্লাহ্ সম্পর্কে অনুভূতি শুন্য! সমস্ত তুচ্ছ বিষয়ে অন্তরে আবেগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু আল্লাহ্*র ব্যাপারে অন্তর মরা কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। দুনিয়ার তুচ্ছ কোন বিষয়ে অন্তর বিগলিত হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ যখন বলেন, "আল্লাহু নূর উস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ" তখন এই কথা আমাদে দিলে প্রবেশ করে না অনুভুতি জাগায়না! "আল্লাহ", "নূর", "আস সামাওয়াত", "আল আরদ" এই শব্দ গুলো আমাদের প্রভাবিত করেনা। আমাদের পুলকিত করেনা। দুনিয়ার সামান্য আতশবাজি আমাদের পুলকিত করে কিন্তু, "আল্লাহু নূর উস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ" এ কথা আমাদের পুলকিত করে না! আফসোস, বড় আফসোস ....
কিন্তু কেন? কেন আমাদের এই হাল? অধিকাংশই আমরা মুসলিম পরিবারে বড় হই, ইসলামের শিক্ষা পাই, (আমি একেবারে জাহেল সমাজের কথা যদি বাদ দেই) আলহামদুলিল্লাহ এখনো অনেক পরিবার দ্বীন কে আবার নিজেদের জিন্দেগি তে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তারপরেও দেখা যায় আমাদের সন্তানদের উপরে তার প্রভাব খুবই সামান্য! কেন? সন্তান আমার নামায পড়ে, রোজা রাখে, কুরআন পড়ে তবুও কথায় যেন কি একটা নাই! কি সেটা ....
সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। একজন দিনমজুর সারা দিন মাটি কাটে তার মানে এই নয় যে সে মাটি কাটা পছন্দ করে, আর একজন বছরে একবার বিশাল আয়োজন করে মাছ ধরতে যায় তার মানে এই নয় যে সে মাছ ধরা অপছন্দ করে। বরং বাস্তবতা সম্পূর্ণ উলটা, মাত্র একবার মাছ ধরতে যে যায়, তার কাছে ঐ মাছ ধরাটাই সবচেয়ে প্রিয়, আর যে সারাদিন মাটি কাটে তার কাছে মাটি কাটাই সবচেয়ে অপ্রিয়! সমস্ত কিছুর আগে হচ্ছে আমার রবের সাথে আমার সম্পর্ক। আমার রবের প্রতিটা হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা আমাকে আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্কিত করবে! আল্লাহ্*র আরও কাছে নিয়ে যাবে। আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দাহদের মধ্যে কতক এমন আছে যারা আমার ফরজ ইবাদত গুলো যথাযথ ভাবে আদায় করে, এরপর সে নফল ইবাদত করতে থাকে আর এক পর্যায়ে এমন ইবাদত করতে থাকে যে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি, আমি তখন হয়ে যাই তার হাত, তার কান, তার পা!
এই হচ্ছে সেই নার্ভ পয়েন্ট.. নার্ভ পয়েন্ট! এই জায়গায় আমরা কখনো তাকাইনা! ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে আমাদের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, যদি না হয় তাহলে আবার গোড়াতে ফিরে আসতে হবে। আর এই কাজ সময় সাপেক্ষ এবং মনোযোগের দাবীদার! এই শিক্ষাই আমাদের কেউ দেয় না, আমরা কেউকে দেই না। সবচেয়ে বড় কথা এই শিক্ষা দেয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আমাদের জ্ঞান হবার সময় থেকে। একজন লোক ইংরেজি কথা বলতে পারে আর আরেকজন ইংরেজি লেখা দেখে দেখে পড়তে পারে। এরা দুইজনে কি এক! একজন ইংরেজি কে বুঝে এবং সে অনুযায়ী নিজের ভাব কে প্রকাশ করতে পারে। আর আরেকজন শুধু তোতাপাখির মত কিছু বুলি আওড়ায়।
আল্লাহ্*র সাথে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেছে তোতাপাখির মত। আমরা শুধু কিছু বুলি আওড়াই, কিন্তু এর গভীর অর্থ, এর গভীর প্রশান্তি অধরাই থেকে যায়। আর এজন্যই তো আমাদের জিন্দেগীর কোন পরিবর্তন আসেনা। আর এক শাইখ বলেছিলেন, "আপনি যদি সামনে না যান তার মানে আপনি নিশ্চিত পিছনে যাচ্ছেন, আমাদের জন্য স্থিতি অবস্থা বলে কিছু নাই, ঈমান হয় বাড়ে, না হয় কমে, এটা কখনো স্থির থাকেনা" ফলে কি হলো, সেই ৫বছর থেকে নামজ পড়ে আসছি, কুরআন পড়ে আসছি, কিন্তু তার গভীর কে আমি স্পর্শ করতে পারিনি আর এভাবে আমি ২০ বছর ধরে নামাজ পড়ে এসে ২৫ বছর বয়সে যখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, তখন আমার সামনে আল্লাহ্*র আয়াত, "তোমরা অশ্লীলতার ধারে পাশেও যেওনা" স্রেফ কলমের কালির কিছু লেখা হয়ে গেলো। এমন কি কেউ যদি আমাকে বুঝাতেও চায় তাও আমি বুঝতে পারিনা, আন্তরিকতা থাকা স্বত্বেও .. আমি পারিনা... স্রেফ পারিনা .. কেন? কারন আমার দীর্ঘ ২০ বছরে আমি কখনো এরকম কিছু করিনি। আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক তো আর একদিনে হয় না! আর এজন্যই আজ আমাদের অবস্থা বড় অদ্ভুত হয়ে গেছে! আল্লাহ বলছেন,
"শয়তান তাদের ভ্রান্ত বিষয়গুলোকে সুদর ভাবে উপস্থাপন করে"
এইভাবে সময়ের স্রোতে আজ আমরা দিশে হারা এক সমাজে পরিণত হয়েছি।
আল্লাহ যে বলেছেন, কেউ যখন আল্লাহ কে বাদ অন্য কাউকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নেয়, আল্লাহ তখন তাকে তার ইলাহ এর হাতে ছেড়ে দেন, আর আজ আমাদের সমাজে আমাদের উপরে কত রকম ইলাহ জেঁকে বসে আছে, আমরা টেরও পাইনা।
এজন্য সবার আগে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করা। আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক তৈরির শিক্ষা দেয়া, সন্তান কে যেভাবে হাত ধরে হাটতে শিখানো হয় তার চেয়েও অধিক সময় এবং যত্ন নিয়ে সন্তান কে আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক করা শিখাতে হবে। আলাহ কে চিনতে শেখাতে হবে। শাইখ আওলাকি (রহঃ) একবার বলছিলেন "যখন আমরা আল্লাহ্*র কোন সিফাত নিয়ে আলোচনা করি, তখন সেটা আমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারিনা, আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দয়া আর আল্লাহ্*র দয়া এক না। আমাদের ক্ষমা আর আল্লাহর ক্ষমা এক না। শুরুতেই আমাদের এই বিষয় টা পরিষ্কার থাকতে হবে" এই বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের সন্তানদের আল্লাহ্*র সিফাত কে উপলব্ধি করাতে ব্যার্থ হই! এজন্য আমাদের সন্তান আল্লাহ্*র কাছে দুয়া করার চেয়ে কোচিং সেন্টারের উপরে বেশি ভরসা করতে পছন্দ করে!
আমাদের এই পরিনতি এক দিনে হয়নি আর একখান থেকে ফিরে যাওয়া এক দিনেও সম্ভব নয়, তবে আমাদের এখন থেকে চেষ্টা শুরু করতে হবে, না হলে হয়তো আর কখোনই হবেনা।
এক শাইখ এক ঘটনা বলছিলেন, "একজন মাতাল, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিলোনা, রাস্তায় বসে মদ খেতো আর নামাজের সময় মুসল্লিদের বিভিন্ন কটু কথা বলত। একদিন মুসল্লিরা মসজিদ এ গিয়ে দেখেন ফজর সলাতে প্রথম কাতারে সেই মাতাল ব্যাক্তি, জোহর সলাতে প্রথম কাতারে সেই ব্যাক্তি, আসর সলাতেও তাই .. এবার একজন গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো তোমার ঘটনা বল দেখি। সেই ব্যাক্তি বললো, "তোমরা প্রতিদিন নামাজে যেতে কিন্তু তা আমার মনে কোন দাগ কাটতোনা। কিন্তু বিগত দিন মাগরিব এর আজানেরর সময় মুয়াজ্জিন যখন বললো, আল্লাহুআকবর.. আমার মনে হলো সেটা আমার হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করেছে, আমি সাথে সাথে বাড়ি ফিরে গেলাম, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, আমার সমস্ত শরীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, আর আমি হাত তুলে আল্লাহ্*র কাছে দুয়া করলাম,
... ইয়া আল্লাহ আমার আর আপনার মাঝে একটা দেয়াল আছে যা আমি সরাতে পারিনা কিন্তু আপনি পারেন আপনি আমার আর আপনার মাঝের সেই দেয়াল কে সেই বাধা কে সরিয়ে দিন" আর এরপর থেকে আমি এখানে!
ইয়া আল্লাহ আপনি আমাদের জন্য সহজ করে দেন আর আমাদের অন্তর কে আপনার সাথে সম্পর্ক করারা জন্য প্রশস্ত এবং পবিত্র করে দেন।
প্রসংশা শুধু আল্লাহ্*র জন্য, কারন তিনিই সমস্ত প্রশংসার মালিক, শুধু মালিকই নন বরং সমস্ত উত্তম প্রশংসা শুধু মাত্র আল্লাহ্*র জন্যই। আল্লাহ ব্যাতিত কেউ এটা দাবি করতে পারেনা। আমাদের ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, স্বীকার করি বা না করি, প্রশংসা তো শুধুমাত্র সেই মহান আল্লাহ্*র জন্যই! আর কেউ যদি বলে, না আমি ও প্রশংশার দাবীদার, তাহলে তাকে আমরা বলবো, "বেশ তো তুমি এক কাজ করো, প্রশংসা যদি নিতে চাও, নিজেকে প্রশংসার দাবীদার প্রমান করতে চাও তবে তেমন একটা কাজ করে কেন দেখাও না!
আল্লাহ তোমার জন্মের আগে থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিদিন সূর্য কে পুর্ব থেকে উঠিয়ে এনে পশ্চিমে ডুবিয়ে দেন, তুমি আক দিন পশ্চিম থেকে উঠিয়ে এনে পুর্বে ডুবিয়ে দাও, মাত্র একদিন!
আল্লাহ বলছেন, "তারা কি এমন কিছু বলে যে সম্পর্কে আমি তাদের কাছে কোন দলিল/প্রমান পাঠাইনি"
আমরা চোখ খুলে একটা ব্যাস্ত পৃথিবী দেখি! সবকিছু অনেক ব্যাস্ত, সবাই অনেক ব্যাস্ত! কেউ কারো দিকে তাকানোর সময় পায় না, চিন্তা করার ফুরসত পায় না। জিন্দেগী টা কেমন যেন চাবি দেয়া পুতুল হয়ে গেছে। সকালে উঠে রাতে ডুবে! খায়, ঘুমায়, হাসে, কাঁদে.. ঘুরে ফিরে ..
অতি তুচ্ছ বিষয় পাহাড় সমান গুরুত্ব বহন করে আমাদের সামনে হাজির হয়! আপনি মনে করেন একটা পাখি, সবার মাথার উপর দিয়ে যদি উড়ে যেতে পারতেন তাহলে দেখতেন, সবাই কত ব্যাস্ত। সত্য করে বললে ঠিক ব্যাস্ত নয়, মোহাবিষ্ট, উদ্ভ্রান্ত! আমি দেখি, সকাল বেলা ছোট ছোট বাচ্চা স্কুলে যায়, তার শরীর স্কুলের দিকে যায়, কিন্তু চোখের ভাষা আমি উদ্দেশ্যহীন দেখেছি! আমি দেখেছি এসি লাগানো কোস্টারে আর এসি লাগানো মার্সিডিজে মানুষকে অফিসে যেতে, বাইরের আবরনে কোন খুঁত নাই, সবচেয়ে দামি সুগন্ধি তার চারপাশ মাতিয়ে রাখে, কিন্তু তার চোখ উদাস, উদ্দেশ্যহীন ভাবে ফেসবুক ব্রাউজ করে, কিংবা কানে হেডফোন ঠেসে দিয়ে বসে থাকে! আমি দেখেছি মানুষ যখন অফিস থেকে ঘরে ফিরে, তারা ফিরে আসা গরুর পালের চেয়েও বেশি ক্লান্ত থাকে.... এমন উদাহরন অসংখ্য, আর হবেই বা না কেন? কারন আমাদের প্রত্যেক টা মুহূর্ত আর প্রত্যেকটা কাজ উদ্দেশ্য হীন হয়ে গেছে! আমি মানুষ কে হাসতে দেখেছি, উচ্চ কন্ঠে! আমার পাশ থেকে, কিন্তু তারা যা দেখে হেসেছে তার মধ্যে আমি বিন্দু মাত্র হাসির কোন উপকরন খুঁজে পাইনি। শুধু মাত্র বলার জন্য বলছি না, আসলেই সত্য! আমি ভেবেছি তাহলে তারা হাসছে কেন? পরে উত্তর পেয়েছি, কারন তাকে হাসতে হবে ..তার অন্তর প্রকৃত আনন্দ থেকে অনেক দূরে এখন সে তার ইচ্ছা মত যেকোন একটা কিছু কে হাসির উপাদান বানিয়ে নেয়।
আমার কথা যদি বিশ্বাস না করেন, আমি প্রমান দিয়ে দেই.. আমি দেখেছি মানুষ সেলফি তুলে ক্লিক করার আগ মুহূর্তে তার মুখে যে হাসি থাকে ক্লিক শেষ হয়ে যাবার পর তার সেই হাসি উধাও হয়ে যায়, এখনো কি বিশ্বাস করবেন না, সে হাসে কারন তাকে হাসতে হবে তাই। এক শাইখ খুব সুন্দর করে বলছিলেন, মানুষ ফেসবুকে স্মাইলি সেলফি কেন দেয়? কারন তার বাস্তব জীবনে প্রকৃত আনন্দের মুহুর্তের এত বেশি অভাব যে সে বাধ্য হয় মিথ্যা আনন্দের আর সুখের অভিনয় করতে!
একটা সমাজ ঘুরছে, দিন রাত এভাবে ঘুরছে, কে কোথা থেকে কোন জায়গায় চলে যাচ্ছে কোন ঠিকানা নাই! দুনিয়ার মোহ, ভ্রান্ত মতবাদ, ছলনা, প্রতারনা, নাপাকি, ফাহেশা, বেহায়াপনা লাগামছাড়া ভাবে আমাদের পেচিয়ে নিয়ে এক দুর্বিসহ পাপের গুহায় নিয়ে যাচ্ছে! আর পাপ মানুষকে ক্লান্ত করে দেয়, জীবনী শক্তি নষ্ট করে ফেলে।
অনেক ভাই হয়তো বলবেন এগুলো তো জানা কথা, এগুলো নতুন করে বলার মধ্যে কি আছে? জানা কথা অবশ্যই কিন্তু করে বলার একটা কারন অবশ্যই আছে... এটা হচ্ছে একজন ভালো ডাক্তার যখন রোগের চিকিৎসা দেন তখন তিনি রোগের তাৎক্ষনিক উপসর্গ কে খুব বেশি বিবেচনায় না এনে রোগের পিছনের উপসর্গ গুলো খুঁজে দেখেন। কারন সেটাই রোগের মূল কারন।
আল্লাহ বলছেন, কেউ যদি আমাকে ভুলে যায় আমি তাকে ভুলে যাবো" আর আল্লাহ যদি কাউকে ভুলে যান তবে তার অবস্তাহ কেমন হতে পারে। আল্লাহ বলছেন, যে আমার স্মরন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আমি তার জন্য একটা শয়তান নিযুক্ত করে দেই। আমাদের আজকের এই অবস্থার পিছনে মূল কারন আমরা আল্লাহ কে ভুলে গেছি, আরো বাস্তবসম্মত ভাবে বলতে গেলে, আমরা আল্লাহ কে পরিত্যাগ করেছি। আমাদের জিন্দেগি তে প্রত্যেক্টা অনর্থক কাজ করার সময় আছে কিন্তু আল্লাহ কে স্মরন করার মত কোন সময় নাই।
আমি আরো একটু ভাংতে চাই ...
আমাদের অন্তর গুলো আজ আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্কিত না। আমাদের অন্তর আজ আল্লাহ্ সম্পর্কে অনুভূতি শুন্য! সমস্ত তুচ্ছ বিষয়ে অন্তরে আবেগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু আল্লাহ্*র ব্যাপারে অন্তর মরা কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। দুনিয়ার তুচ্ছ কোন বিষয়ে অন্তর বিগলিত হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ যখন বলেন, "আল্লাহু নূর উস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ" তখন এই কথা আমাদে দিলে প্রবেশ করে না অনুভুতি জাগায়না! "আল্লাহ", "নূর", "আস সামাওয়াত", "আল আরদ" এই শব্দ গুলো আমাদের প্রভাবিত করেনা। আমাদের পুলকিত করেনা। দুনিয়ার সামান্য আতশবাজি আমাদের পুলকিত করে কিন্তু, "আল্লাহু নূর উস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ" এ কথা আমাদের পুলকিত করে না! আফসোস, বড় আফসোস ....
কিন্তু কেন? কেন আমাদের এই হাল? অধিকাংশই আমরা মুসলিম পরিবারে বড় হই, ইসলামের শিক্ষা পাই, (আমি একেবারে জাহেল সমাজের কথা যদি বাদ দেই) আলহামদুলিল্লাহ এখনো অনেক পরিবার দ্বীন কে আবার নিজেদের জিন্দেগি তে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তারপরেও দেখা যায় আমাদের সন্তানদের উপরে তার প্রভাব খুবই সামান্য! কেন? সন্তান আমার নামায পড়ে, রোজা রাখে, কুরআন পড়ে তবুও কথায় যেন কি একটা নাই! কি সেটা ....
সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। সেটা হচ্ছে সম্পর্ক। একজন দিনমজুর সারা দিন মাটি কাটে তার মানে এই নয় যে সে মাটি কাটা পছন্দ করে, আর একজন বছরে একবার বিশাল আয়োজন করে মাছ ধরতে যায় তার মানে এই নয় যে সে মাছ ধরা অপছন্দ করে। বরং বাস্তবতা সম্পূর্ণ উলটা, মাত্র একবার মাছ ধরতে যে যায়, তার কাছে ঐ মাছ ধরাটাই সবচেয়ে প্রিয়, আর যে সারাদিন মাটি কাটে তার কাছে মাটি কাটাই সবচেয়ে অপ্রিয়! সমস্ত কিছুর আগে হচ্ছে আমার রবের সাথে আমার সম্পর্ক। আমার রবের প্রতিটা হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা আমাকে আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্কিত করবে! আল্লাহ্*র আরও কাছে নিয়ে যাবে। আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দাহদের মধ্যে কতক এমন আছে যারা আমার ফরজ ইবাদত গুলো যথাযথ ভাবে আদায় করে, এরপর সে নফল ইবাদত করতে থাকে আর এক পর্যায়ে এমন ইবাদত করতে থাকে যে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলি, আমি তখন হয়ে যাই তার হাত, তার কান, তার পা!
এই হচ্ছে সেই নার্ভ পয়েন্ট.. নার্ভ পয়েন্ট! এই জায়গায় আমরা কখনো তাকাইনা! ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে আমাদের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, যদি না হয় তাহলে আবার গোড়াতে ফিরে আসতে হবে। আর এই কাজ সময় সাপেক্ষ এবং মনোযোগের দাবীদার! এই শিক্ষাই আমাদের কেউ দেয় না, আমরা কেউকে দেই না। সবচেয়ে বড় কথা এই শিক্ষা দেয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় আমাদের জ্ঞান হবার সময় থেকে। একজন লোক ইংরেজি কথা বলতে পারে আর আরেকজন ইংরেজি লেখা দেখে দেখে পড়তে পারে। এরা দুইজনে কি এক! একজন ইংরেজি কে বুঝে এবং সে অনুযায়ী নিজের ভাব কে প্রকাশ করতে পারে। আর আরেকজন শুধু তোতাপাখির মত কিছু বুলি আওড়ায়।
আল্লাহ্*র সাথে আমাদের সম্পর্ক হয়ে গেছে তোতাপাখির মত। আমরা শুধু কিছু বুলি আওড়াই, কিন্তু এর গভীর অর্থ, এর গভীর প্রশান্তি অধরাই থেকে যায়। আর এজন্যই তো আমাদের জিন্দেগীর কোন পরিবর্তন আসেনা। আর এক শাইখ বলেছিলেন, "আপনি যদি সামনে না যান তার মানে আপনি নিশ্চিত পিছনে যাচ্ছেন, আমাদের জন্য স্থিতি অবস্থা বলে কিছু নাই, ঈমান হয় বাড়ে, না হয় কমে, এটা কখনো স্থির থাকেনা" ফলে কি হলো, সেই ৫বছর থেকে নামজ পড়ে আসছি, কুরআন পড়ে আসছি, কিন্তু তার গভীর কে আমি স্পর্শ করতে পারিনি আর এভাবে আমি ২০ বছর ধরে নামাজ পড়ে এসে ২৫ বছর বয়সে যখন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম, তখন আমার সামনে আল্লাহ্*র আয়াত, "তোমরা অশ্লীলতার ধারে পাশেও যেওনা" স্রেফ কলমের কালির কিছু লেখা হয়ে গেলো। এমন কি কেউ যদি আমাকে বুঝাতেও চায় তাও আমি বুঝতে পারিনা, আন্তরিকতা থাকা স্বত্বেও .. আমি পারিনা... স্রেফ পারিনা .. কেন? কারন আমার দীর্ঘ ২০ বছরে আমি কখনো এরকম কিছু করিনি। আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক তো আর একদিনে হয় না! আর এজন্যই আজ আমাদের অবস্থা বড় অদ্ভুত হয়ে গেছে! আল্লাহ বলছেন,
"শয়তান তাদের ভ্রান্ত বিষয়গুলোকে সুদর ভাবে উপস্থাপন করে"
এইভাবে সময়ের স্রোতে আজ আমরা দিশে হারা এক সমাজে পরিণত হয়েছি।
আল্লাহ যে বলেছেন, কেউ যখন আল্লাহ কে বাদ অন্য কাউকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নেয়, আল্লাহ তখন তাকে তার ইলাহ এর হাতে ছেড়ে দেন, আর আজ আমাদের সমাজে আমাদের উপরে কত রকম ইলাহ জেঁকে বসে আছে, আমরা টেরও পাইনা।
এজন্য সবার আগে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করা। আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক তৈরির শিক্ষা দেয়া, সন্তান কে যেভাবে হাত ধরে হাটতে শিখানো হয় তার চেয়েও অধিক সময় এবং যত্ন নিয়ে সন্তান কে আল্লাহ্*র সাথে সম্পর্ক করা শিখাতে হবে। আলাহ কে চিনতে শেখাতে হবে। শাইখ আওলাকি (রহঃ) একবার বলছিলেন "যখন আমরা আল্লাহ্*র কোন সিফাত নিয়ে আলোচনা করি, তখন সেটা আমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারিনা, আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দয়া আর আল্লাহ্*র দয়া এক না। আমাদের ক্ষমা আর আল্লাহর ক্ষমা এক না। শুরুতেই আমাদের এই বিষয় টা পরিষ্কার থাকতে হবে" এই বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের সন্তানদের আল্লাহ্*র সিফাত কে উপলব্ধি করাতে ব্যার্থ হই! এজন্য আমাদের সন্তান আল্লাহ্*র কাছে দুয়া করার চেয়ে কোচিং সেন্টারের উপরে বেশি ভরসা করতে পছন্দ করে!
আমাদের এই পরিনতি এক দিনে হয়নি আর একখান থেকে ফিরে যাওয়া এক দিনেও সম্ভব নয়, তবে আমাদের এখন থেকে চেষ্টা শুরু করতে হবে, না হলে হয়তো আর কখোনই হবেনা।
এক শাইখ এক ঘটনা বলছিলেন, "একজন মাতাল, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিলোনা, রাস্তায় বসে মদ খেতো আর নামাজের সময় মুসল্লিদের বিভিন্ন কটু কথা বলত। একদিন মুসল্লিরা মসজিদ এ গিয়ে দেখেন ফজর সলাতে প্রথম কাতারে সেই মাতাল ব্যাক্তি, জোহর সলাতে প্রথম কাতারে সেই ব্যাক্তি, আসর সলাতেও তাই .. এবার একজন গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলো তোমার ঘটনা বল দেখি। সেই ব্যাক্তি বললো, "তোমরা প্রতিদিন নামাজে যেতে কিন্তু তা আমার মনে কোন দাগ কাটতোনা। কিন্তু বিগত দিন মাগরিব এর আজানেরর সময় মুয়াজ্জিন যখন বললো, আল্লাহুআকবর.. আমার মনে হলো সেটা আমার হৃদয়ে গিয়ে প্রবেশ করেছে, আমি সাথে সাথে বাড়ি ফিরে গেলাম, আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, আমার সমস্ত শরীর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, আর আমি হাত তুলে আল্লাহ্*র কাছে দুয়া করলাম,
... ইয়া আল্লাহ আমার আর আপনার মাঝে একটা দেয়াল আছে যা আমি সরাতে পারিনা কিন্তু আপনি পারেন আপনি আমার আর আপনার মাঝের সেই দেয়াল কে সেই বাধা কে সরিয়ে দিন" আর এরপর থেকে আমি এখানে!
ইয়া আল্লাহ আপনি আমাদের জন্য সহজ করে দেন আর আমাদের অন্তর কে আপনার সাথে সম্পর্ক করারা জন্য প্রশস্ত এবং পবিত্র করে দেন।
Comment