ইন্নাল হামদা লিল্লাহি নাহমাদুহু ওয়া নাসতায়িনুহু মাই ইয়াহদিহিল্লাহু ফালা মুদিল্লা লাহু ওয়া মাই ইয়ুদলিল ফালা হাদিয়া লাহু ওয়া আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।
বইটির মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমাদের কয়েকটি বিষয় স্মরণে রাখতে পারি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো কাবুল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি শুধুমাত্র মুসলিমদের সমাজে ছিল না। বরং, কাফেরদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকর কম অহংকারী তারা কাছে শুরু থেকে বিষয়টি পরিষ্কার ছিল সৈন্য প্রত্যাহার বিলম্বিত হবে আমেরিকার জন্য ক্ষতি তত বৃদ্ধি পাবে।
আরো কিছু বিষয়, যেমন:
==> বইটি ২০১৭ সালের রাখা হয়েছে তখনো আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসেনি।
==> এই বইয়ের লেখক একজন কাফের। তাই শায়েখদের ও মুজাহিদদের জন্য সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করেনি। এখানে শায়খদের জন্য যে সম্মাণসূচক শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা অনুবাদের পক্ষ থেকে ব্যবহার করা হয়েছে।
==> এবং বুঝার সুবিধার্থে কিছু কিছু বিষয় মূল লেখার সাথেই ব্যাকেটে () দেওয়া হয়েছে।
২০০১ সালের মার্কিন আগ্রাসন ও (অন্যায় ভাবে) তালেবান সরকারকে উৎখাতের পর থেকে আফগানিস্তানে এক নির্মম আগ্রাসন চলমান রয়েছে। যা দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। ২০১৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিশ্রুত ও ঘোষিত 'চূড়ান্ত সৈন্য প্রত্যাহার' এর বহুবছর পার হয়ে গেছে। অথচ, মার্কিন সামরিক বাহিনী আজও নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে দেশে ফেরার সাহস পাচ্ছে না। কেননা ওয়াশিংটন স্পষ্টভাবে জানে যে, আমেরিকান ডলার ও সামরিক শক্তির (পদাতিক, বিমান এবং বিশেষ অপারেশন বাহিনীর) সহায়তা ছাড়া কাবুলের '' জাতীয় ঐক্য সরকার' এক মুহুর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারবেনা। ফলে আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম বৈদেশিক সম্মুখ যুদ্ধ ২০২০-এ পদার্পণ করতে যাচ্ছে।
সন্দেহাতীতভাবে,'অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম' (বর্তমানে অপারেশন ফ্রিডম সেন্টিনেল) শুরু থেকেই ব্যর্থ হওয়ার পথে ছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ৯/১১ দায়ীদের আটক বা হত্যা করতে বারংবার ব্যর্থ হওয়ার পর; তিনি তার ব্যর্থতাকে ঢাকতে আফগানের রাজনীতে হস্তক্ষেপ এবং 'জাতি গঠন'-এর মতো স্লোগান দেওয়া আরম্ভ করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি সক প্রকার সতর্কতা উপেক্ষা করেন। জর্জ বুশ কাবুলে একটি মার্কিন বান্ধব সরকার স্থাপন করেছিলেন। তার দাবি ছিল যে, এটি আফগানের সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামী মৌলবাদকে ধ্বংস করে সাধারণ জনগণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু, তার দাবির সাত বছর পর, যখন তিনি ক্ষমতা ছাড়ছিলেন তখন তার উপদেষ্টারা তাকে দুটি বিষয় সতর্ক করেছিলেন:
এক, তিনি ২০০১ সালে যে তালেবান সরকারকে উৎখাত করেছিলেন তা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
দুই, কাবুলের যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সরকার ভেঙে পড়ার দ্বার প্রান্তে রয়েছে।
আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসে বুশের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তার সমালোচনার মূল বিষয় ছিল ল, আফগাম যুদ্ধে বুশের অমানোযোগিতা ও অবহেলা। ওবামা আফগান যুদ্ধকে এমন এক যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন 'যা জিততেই হবে'। তিনি মার্কিন জনগণকে এই যুদ্ধের বিজয় প্রতিশ্রুতি দেন। আর তার পতিশ্রুতি রক্ষার জন্য (নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত) ওবামা আফগান যুদ্ধকে আরো উস্কে দিয়েছিলেন। তবুও, তিনি তার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার শাসনামলে ইউএস আর্মি জেনারেল ডেভিড পেট্রিয়াস এবং 'সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি এর থিংক ট্যাংক' (চিন্তাবিদদরা) বিদ্রোহ দমনের জন্য একটি মতবাদ প্রকাশ করে। এই মতবাদের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার লক্ষ্যগুলোর সাথে সমন্বয় করে (লক্ষ্যগুলোকে ভিত্তি করে) সমগ্র আফগান সমাজকে পরিবর্তন করা। এইজন্য আফগানে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানো হবে। তারা দিনে ভালো মানুষদের (সরকার ও জনগণকে) জয় করবে (শিক্ষা, অর্থ ও ত্রাণের মাধ্যমে) এবং রাত্রে বিশেষ বাহিনী খারাপ লোকদের (মুজাহিদের) সন্ধান (বন্দী ও হত্যা) করবে। তাদের মতে এই কৌশলগুলোর স্থানীয় সরকারকে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে পুনর্গঠনের সহায়তা করবে। যা পরবর্তীতে দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারবে। তারা তাদের এই মতবাহকে জনগণের কাছে বিজয়ের রূপরেখা হিসাবে তুলে ধরে হয়েছিল। যদিও পরিশেষে তাদের এই মতবাদ এই - এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল।
এই তথাকথিত মতবাদের অর্জন ছিল দশ হাজারের অধিক আফগানির মৃত্যু; আর বিনিয়োগ ছিল শত শত মার্কিনী ও এর মিত্র সৈন্যদের জীবন। মার্কিন প্রতিরক্ষা ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট ক্রমাগত তীব্র আগ্রাসন - তালেবান ও তাদের সহযোগী হাক্কানি নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শক্তি সামান্য পরিমাণও হ্রাস করতে পারেনি। বরং, তালেবান এখন (২০১৭ সালে) যতটা শক্তিশালী যুদ্ধের শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ততটা শক্তিশালী আর কখনোই ছিল না। তারা রাতের বেলায় প্রায় অর্ধেক দেশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দিনের বেলাও এই নিয়ন্ত্রণে পরিধি খুব কম না। যখন জানা যায় যে, (শায়খ) মোল্লা ওমর(রাহি ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেছেন তখন দলটি কিছুটা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে স্বঘোষিত খলিফা 'আবু বকর বাগদাদী'-র খেলাফত ঘোষণার পর দল থেকে বিভক্ত একটি অংশ খিলাফতের আনুগত্য ঘোষণা করে।
জাতিসংঘের গণনা মোতাবেক, ২০১৬ সালে আফগান বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। সহিংসতা (আগ্রাসন ও প্রতিরোধের) মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, ওবামা সামরিক বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। তখন আফগানিস্তানে সৈন্যসংখ্যা গিয়ে পৌঁছে সাড়ে আট হাজারে। তার তা ছিল ওবামার পূর্বপরিকল্পনা থেকে চার হাজার বেশি। তার প্রেসিডেন্সির শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মরিয়া প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। তিনি ৩০০ জন মেরিন সৈন্যকে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য আফগানের দক্ষিণে মোতায়েন করেন।
বিশিষ্ট মার্কিনী চিন্তাবিদরা (থিঙ্কট্যাংকরা) আফগানি সৈন্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে ১লাখে উপনীত করার জন্য আহ্বান করছেন। যাতে পুনরায় 'ব্যাটল অফ হার্ডস এন্ড মাইন্স' (মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ) পরিচালনা করা যায়। এবং পাশাপাশি জাতি গঠন, বিদ্রোহ বিরোধী নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। কাগজে কলমে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে মার্কিন আফগান যুদ্ধের(জিহাদের) পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু, আফগান জনগণও এখানে অবস্থানরত মার্কিন ও মিত্র বাহিনীর জন্য এই যুদ্ধ আজও চলমান।
আফগান আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের শুরু হওয়ার পর থেকে বহু জেনারেল ক্ষমতা এসেছেন এবং (অবসরে) চলেও গেছেন। কিন্তু, তাদের পরামর্শ (আদর্শ) সবসময় একই ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল
আফগানিস্তানে আগ্রাসন ৯/১১ হামলার প্রতিশোধরূপে শুরু হলেও খুবই দ্রুতই জটিল রূপ ধারণ করেছে। শুরুতে আল-কায়দাকে(শায়খদের, মুজাহিদের এবং ট্রেন ক্যাম্পগুলো) লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হয়েছিল যাদের তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছিলেন। তবে, এই অভিযানগুলো ধীরে ধীরে একটি বিস্তৃত সামরিক দখলদারিত্ব, জাতি গঠনের প্রকল্প (নিপীড়ন) এবং অবিরাম যুদ্ধের রূপান্তরিত হয়। আমেরিকা কাবুলের যে সরকার স্থাপন করেছিল তা আফগানের উত্তরের অবস্থিত তাজিক, হাজারা, উজবেক, তুর্কিমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোত্রের রাজনৈতিক ও দাঙ্গাবাজ নেতাদের নিয়ে গঠন হয়েছিল। আর আফগানের দক্ষিণ ও পূর্ব অবস্থিত আরো জঘন্য দাঙ্গাবাজ ও অপরাধী পাশতুনদের সাথে নিয়ে তারা দেশে পরিচালনা করেছিল। এই জোট কখনোই সাধারণ জনগণের - এমনকি তারা নিজ নিজ গোত্রেরও সঠিক প্রতিনিধিত্ব করেনি। এই জোটের নেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি।
ফলস্বরূপ, আফগানিস্তানের সাধারন জনগণ (জাতি ও গোত্র নির্বিশেষে) তালেবান সাথে মিলে মার্কিন আগ্রাসন ও নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করছে। বর্তমানে (২০১৭ সালে) তালেবান কোন মিলিশিয়া বাহিনী বা ছায়া সরকার নয়; বরং, তালেবান এখন কিছু অঞ্চলে একমাত্র কার্যকরী সরকার। বহু, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা (যেমন: জেনারেল পেট্রিয়াস) স্বীকার করেছে যে, বিদ্রোহীদের (মুজাহিদদের) অপরাধ ও বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (বিচার ব্যবস্থা) আমেরিকার সমর্থিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়পরায়ণ। ফলে, তালেবানদের দখলকৃত অঞ্চলে তারা আরো বেশি জনসমর্থন পাচ্ছে।
আজ (২০১৭ সালে)দেড় দশকেরও বেশি সময়ের আগ্রাসনের পর, যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট। মার্কিন সরকার আফগানিস্তানে তার লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার চেয়েও হাস্যকর বিষয় হলো, তারা যে রাষ্ট্র গঠন করেছে তা মোটেও টেকসই নয়। কেননা, যে মুহূর্তে মার্কিন দখলদারিত্ব শেষ হবে ঠিক সেই মুহূর্তে কাবুল সরকার তাসের ঘরের মত ভেঙে পরবে। এই অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের পেছনে যে সকল রাজনীতিবিদ, জেনারেল ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওকালতি করেছেন তারা বিশ্বের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। আফগান সমস্যা সমাধান ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যারা সর্বদাই "আরো একটু সময়, অর্থ ও সামরিক শক্তি"র আবেদন করেছেন তাদের প্রতিশ্রুতি মরীচিকা ব্যতীত আর কিছুই নয় তা আজ সকলের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
মূল সত্য হল আমেরিকার আফগান যুদ্ধ একটি অপূরণীয় বিপর্যয়ের প্রতীক। এটি শুরু থেকেই একটি ফাঁদ হিসেবে পরিকল্পিত ছিল। আমেরিকা যে শুধু তার শত্রুদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এমনি নয়; বরং একই সঙ্গে নিজেদেরকেও ধ্বংস করছে, ঠিক যেমন (শায়খ) ওসামা বিন লাদেন (রাহি এবং আল-কায়েদা চেয়েছিল।
এই বইটি হলো আমেরিকান জনগণের সামনে এই ভুলে যাওয়া যুদ্ধের বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। কারণ শুধুমাত্র অহংকার এবং পরাজয় স্বীকার করতে না চাওয়ার গোড়ামির কারণে আমেরিকানরা এই বিপর্যয়কর নীতির সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। যা আফগানিস্তানের জন্য নয়, বরং উভয়ের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হচ্ছে।
বইটির মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমাদের কয়েকটি বিষয় স্মরণে রাখতে পারি তাহলে আমরা বুঝতে পারবো কাবুল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি শুধুমাত্র মুসলিমদের সমাজে ছিল না। বরং, কাফেরদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকর কম অহংকারী তারা কাছে শুরু থেকে বিষয়টি পরিষ্কার ছিল সৈন্য প্রত্যাহার বিলম্বিত হবে আমেরিকার জন্য ক্ষতি তত বৃদ্ধি পাবে।
আরো কিছু বিষয়, যেমন:
==> বইটি ২০১৭ সালের রাখা হয়েছে তখনো আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসেনি।
==> এই বইয়ের লেখক একজন কাফের। তাই শায়েখদের ও মুজাহিদদের জন্য সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করেনি। এখানে শায়খদের জন্য যে সম্মাণসূচক শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা অনুবাদের পক্ষ থেকে ব্যবহার করা হয়েছে।
==> এবং বুঝার সুবিধার্থে কিছু কিছু বিষয় মূল লেখার সাথেই ব্যাকেটে () দেওয়া হয়েছে।
ভূমিকা:
২০০১ সালের মার্কিন আগ্রাসন ও (অন্যায় ভাবে) তালেবান সরকারকে উৎখাতের পর থেকে আফগানিস্তানে এক নির্মম আগ্রাসন চলমান রয়েছে। যা দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। ২০১৪ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতিশ্রুত ও ঘোষিত 'চূড়ান্ত সৈন্য প্রত্যাহার' এর বহুবছর পার হয়ে গেছে। অথচ, মার্কিন সামরিক বাহিনী আজও নিজেদের বিজয় ঘোষণা করে দেশে ফেরার সাহস পাচ্ছে না। কেননা ওয়াশিংটন স্পষ্টভাবে জানে যে, আমেরিকান ডলার ও সামরিক শক্তির (পদাতিক, বিমান এবং বিশেষ অপারেশন বাহিনীর) সহায়তা ছাড়া কাবুলের '' জাতীয় ঐক্য সরকার' এক মুহুর্তের জন্যও টিকে থাকতে পারবেনা। ফলে আমেরিকার ইতিহাসের দীর্ঘতম বৈদেশিক সম্মুখ যুদ্ধ ২০২০-এ পদার্পণ করতে যাচ্ছে।
সন্দেহাতীতভাবে,'অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম' (বর্তমানে অপারেশন ফ্রিডম সেন্টিনেল) শুরু থেকেই ব্যর্থ হওয়ার পথে ছিল। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ৯/১১ দায়ীদের আটক বা হত্যা করতে বারংবার ব্যর্থ হওয়ার পর; তিনি তার ব্যর্থতাকে ঢাকতে আফগানের রাজনীতে হস্তক্ষেপ এবং 'জাতি গঠন'-এর মতো স্লোগান দেওয়া আরম্ভ করেন। এই ক্ষেত্রে তিনি সক প্রকার সতর্কতা উপেক্ষা করেন। জর্জ বুশ কাবুলে একটি মার্কিন বান্ধব সরকার স্থাপন করেছিলেন। তার দাবি ছিল যে, এটি আফগানের সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামী মৌলবাদকে ধ্বংস করে সাধারণ জনগণের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু, তার দাবির সাত বছর পর, যখন তিনি ক্ষমতা ছাড়ছিলেন তখন তার উপদেষ্টারা তাকে দুটি বিষয় সতর্ক করেছিলেন:
এক, তিনি ২০০১ সালে যে তালেবান সরকারকে উৎখাত করেছিলেন তা পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
দুই, কাবুলের যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত সরকার ভেঙে পড়ার দ্বার প্রান্তে রয়েছে।
আরেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসে বুশের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তার সমালোচনার মূল বিষয় ছিল ল, আফগাম যুদ্ধে বুশের অমানোযোগিতা ও অবহেলা। ওবামা আফগান যুদ্ধকে এমন এক যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন 'যা জিততেই হবে'। তিনি মার্কিন জনগণকে এই যুদ্ধের বিজয় প্রতিশ্রুতি দেন। আর তার পতিশ্রুতি রক্ষার জন্য (নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত) ওবামা আফগান যুদ্ধকে আরো উস্কে দিয়েছিলেন। তবুও, তিনি তার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। তার শাসনামলে ইউএস আর্মি জেনারেল ডেভিড পেট্রিয়াস এবং 'সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি এর থিংক ট্যাংক' (চিন্তাবিদদরা) বিদ্রোহ দমনের জন্য একটি মতবাদ প্রকাশ করে। এই মতবাদের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার লক্ষ্যগুলোর সাথে সমন্বয় করে (লক্ষ্যগুলোকে ভিত্তি করে) সমগ্র আফগান সমাজকে পরিবর্তন করা। এইজন্য আফগানে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানো হবে। তারা দিনে ভালো মানুষদের (সরকার ও জনগণকে) জয় করবে (শিক্ষা, অর্থ ও ত্রাণের মাধ্যমে) এবং রাত্রে বিশেষ বাহিনী খারাপ লোকদের (মুজাহিদের) সন্ধান (বন্দী ও হত্যা) করবে। তাদের মতে এই কৌশলগুলোর স্থানীয় সরকারকে তৃণমূল পর্যায়ে থেকে পুনর্গঠনের সহায়তা করবে। যা পরবর্তীতে দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারবে। তারা তাদের এই মতবাহকে জনগণের কাছে বিজয়ের রূপরেখা হিসাবে তুলে ধরে হয়েছিল। যদিও পরিশেষে তাদের এই মতবাদ এই - এই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল।
এই তথাকথিত মতবাদের অর্জন ছিল দশ হাজারের অধিক আফগানির মৃত্যু; আর বিনিয়োগ ছিল শত শত মার্কিনী ও এর মিত্র সৈন্যদের জীবন। মার্কিন প্রতিরক্ষা ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট ক্রমাগত তীব্র আগ্রাসন - তালেবান ও তাদের সহযোগী হাক্কানি নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শক্তি সামান্য পরিমাণও হ্রাস করতে পারেনি। বরং, তালেবান এখন (২০১৭ সালে) যতটা শক্তিশালী যুদ্ধের শুরু হওয়ার পর থেকে তারা ততটা শক্তিশালী আর কখনোই ছিল না। তারা রাতের বেলায় প্রায় অর্ধেক দেশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দিনের বেলাও এই নিয়ন্ত্রণে পরিধি খুব কম না। যখন জানা যায় যে, (শায়খ) মোল্লা ওমর(রাহি ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেছেন তখন দলটি কিছুটা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে স্বঘোষিত খলিফা 'আবু বকর বাগদাদী'-র খেলাফত ঘোষণার পর দল থেকে বিভক্ত একটি অংশ খিলাফতের আনুগত্য ঘোষণা করে।
জাতিসংঘের গণনা মোতাবেক, ২০১৬ সালে আফগান বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। সহিংসতা (আগ্রাসন ও প্রতিরোধের) মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, ওবামা সামরিক বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। তখন আফগানিস্তানে সৈন্যসংখ্যা গিয়ে পৌঁছে সাড়ে আট হাজারে। তার তা ছিল ওবামার পূর্বপরিকল্পনা থেকে চার হাজার বেশি। তার প্রেসিডেন্সির শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মরিয়া প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। তিনি ৩০০ জন মেরিন সৈন্যকে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য আফগানের দক্ষিণে মোতায়েন করেন।
বিশিষ্ট মার্কিনী চিন্তাবিদরা (থিঙ্কট্যাংকরা) আফগানি সৈন্য সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে ১লাখে উপনীত করার জন্য আহ্বান করছেন। যাতে পুনরায় 'ব্যাটল অফ হার্ডস এন্ড মাইন্স' (মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ) পরিচালনা করা যায়। এবং পাশাপাশি জাতি গঠন, বিদ্রোহ বিরোধী নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা যায়। কাগজে কলমে, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে মার্কিন আফগান যুদ্ধের(জিহাদের) পরিসমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু, আফগান জনগণও এখানে অবস্থানরত মার্কিন ও মিত্র বাহিনীর জন্য এই যুদ্ধ আজও চলমান।
আফগান আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের শুরু হওয়ার পর থেকে বহু জেনারেল ক্ষমতা এসেছেন এবং (অবসরে) চলেও গেছেন। কিন্তু, তাদের পরামর্শ (আদর্শ) সবসময় একই ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল
'আমরা এখনই যেতে পারি না। আমরা কখনোই যেতে পারি না।'
তাদের এই পরামর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য, যতদিন ড্রোন ও বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে পরাজয়কে প্রতিরোধ করা যায় ততদিন আমেরিকা থাকবে এবং যুদ্ধ চলবে। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আফগানের সৈন্য সংখ্যা কাবুলের কৌশলগত প্রয়োজনীয়তার চেয়ে ওয়াশিংটনের রাজনীতির উপর বেশি নির্ভর করে, তাই বর্তমানে (২০১৭ সালের) বিপর্যয়ের পর আফগান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আফগানিস্তানে আগ্রাসন ৯/১১ হামলার প্রতিশোধরূপে শুরু হলেও খুবই দ্রুতই জটিল রূপ ধারণ করেছে। শুরুতে আল-কায়দাকে(শায়খদের, মুজাহিদের এবং ট্রেন ক্যাম্পগুলো) লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো হয়েছিল যাদের তালেবান সরকার আশ্রয় দিয়েছিলেন। তবে, এই অভিযানগুলো ধীরে ধীরে একটি বিস্তৃত সামরিক দখলদারিত্ব, জাতি গঠনের প্রকল্প (নিপীড়ন) এবং অবিরাম যুদ্ধের রূপান্তরিত হয়। আমেরিকা কাবুলের যে সরকার স্থাপন করেছিল তা আফগানের উত্তরের অবস্থিত তাজিক, হাজারা, উজবেক, তুর্কিমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোত্রের রাজনৈতিক ও দাঙ্গাবাজ নেতাদের নিয়ে গঠন হয়েছিল। আর আফগানের দক্ষিণ ও পূর্ব অবস্থিত আরো জঘন্য দাঙ্গাবাজ ও অপরাধী পাশতুনদের সাথে নিয়ে তারা দেশে পরিচালনা করেছিল। এই জোট কখনোই সাধারণ জনগণের - এমনকি তারা নিজ নিজ গোত্রেরও সঠিক প্রতিনিধিত্ব করেনি। এই জোটের নেতাদের মূল লক্ষ্য ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি।
ফলস্বরূপ, আফগানিস্তানের সাধারন জনগণ (জাতি ও গোত্র নির্বিশেষে) তালেবান সাথে মিলে মার্কিন আগ্রাসন ও নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করছে। বর্তমানে (২০১৭ সালে) তালেবান কোন মিলিশিয়া বাহিনী বা ছায়া সরকার নয়; বরং, তালেবান এখন কিছু অঞ্চলে একমাত্র কার্যকরী সরকার। বহু, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা (যেমন: জেনারেল পেট্রিয়াস) স্বীকার করেছে যে, বিদ্রোহীদের (মুজাহিদদের) অপরাধ ও বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (বিচার ব্যবস্থা) আমেরিকার সমর্থিত সরকারের চেয়ে অনেক বেশি ন্যায়পরায়ণ। ফলে, তালেবানদের দখলকৃত অঞ্চলে তারা আরো বেশি জনসমর্থন পাচ্ছে।
আজ (২০১৭ সালে)দেড় দশকেরও বেশি সময়ের আগ্রাসনের পর, যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট। মার্কিন সরকার আফগানিস্তানে তার লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তার চেয়েও হাস্যকর বিষয় হলো, তারা যে রাষ্ট্র গঠন করেছে তা মোটেও টেকসই নয়। কেননা, যে মুহূর্তে মার্কিন দখলদারিত্ব শেষ হবে ঠিক সেই মুহূর্তে কাবুল সরকার তাসের ঘরের মত ভেঙে পরবে। এই অবর্ণনীয় বিপর্যয়ের পেছনে যে সকল রাজনীতিবিদ, জেনারেল ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওকালতি করেছেন তারা বিশ্বের কাছে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। আফগান সমস্যা সমাধান ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যারা সর্বদাই "আরো একটু সময়, অর্থ ও সামরিক শক্তি"র আবেদন করেছেন তাদের প্রতিশ্রুতি মরীচিকা ব্যতীত আর কিছুই নয় তা আজ সকলের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
মূল সত্য হল আমেরিকার আফগান যুদ্ধ একটি অপূরণীয় বিপর্যয়ের প্রতীক। এটি শুরু থেকেই একটি ফাঁদ হিসেবে পরিকল্পিত ছিল। আমেরিকা যে শুধু তার শত্রুদের পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এমনি নয়; বরং একই সঙ্গে নিজেদেরকেও ধ্বংস করছে, ঠিক যেমন (শায়খ) ওসামা বিন লাদেন (রাহি এবং আল-কায়েদা চেয়েছিল।
এই বইটি হলো আমেরিকান জনগণের সামনে এই ভুলে যাওয়া যুদ্ধের বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। কারণ শুধুমাত্র অহংকার এবং পরাজয় স্বীকার করতে না চাওয়ার গোড়ামির কারণে আমেরিকানরা এই বিপর্যয়কর নীতির সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। যা আফগানিস্তানের জন্য নয়, বরং উভয়ের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হচ্ছে।
Comment