সম্মানিত ভাইয়েরা খুবই তথ্যবহুল একটি ডকুমেন্টারি- সবাই পড়বেন। অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পারবেন। ইনশা আল্লাহ। আমি হুবহু লেখাটি তুলে দিচ্ছি। বিশেষ করে সম্মানিত ভাই আবু আনোয়ার আল হিন্দি হাফিজাহুল্লাহর প্রতি আবেদন রইল-এই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে আপনি একটি লেখা পোস্ট করবেন। তাহলে বাংলাদেশে জিহাদের ইতিহাসের ব্যাপারে সবার একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকবে। ওয়াসসালাম।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা : প্রথম পর্যায়
গোড়াপত্তন আফগান মুজাহিদদের হাতে
গুলশানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ এক ভয়ংকর স্তরে পৌঁছেছে। ব্যক্তি, আক্রমণ, লক্ষ্যবস্তু ও অস্ত্রের ধরন বিশ্লেষণ করে একে দেশে বিপজ্জনক জঙ্গিবাদের তৃতীয় পর্যায় বলা যায়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল আফগানফেরত মুজাহিদদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে জঙ্গিদের তৎপরতার সময়টাকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আশির দশকের মধ্যভাগে জন্ম নেওয়া মুসলিম মিল্লাত বাহিনী ও শেষ দিকে জন্ম নেওয়া হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজি-বি) এ দেশে প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি সংগঠন বলা যায়। এর এক দশক পর জন্ম নেয় জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), যার লক্ষ্য ছিল দেশে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা। জেএমবির জন্মের ঠিক এক দশক পর উত্থান ঘটে বর্তমানে সক্রিয় দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর। এর একটি ব্লগার হত্যার ঘটনায় জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম। এরা আল–কায়েদার অনুসারী। অপর গোষ্ঠীকে পুলিশ বলছে ‘নব্য জেএমবি’। তবে তারা নিজেদের ইসলামিক স্টেট বা আইএস বলে দাবি করে। এই দুই গোষ্ঠীতেই মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও যুক্ত হয়েছেন, যার একটি রূপ দেখা গেছে গুলশানে।
সূচনায় মুসলিম মিল্লাত বাহিনী: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশি মুজাহিদদের প্রত্যাবর্তনের আগে, ১৯৮৬ সালে ‘মুসলিম মিল্লাত বাহিনী’ গঠন করেন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মতিউর রহমান। এর কয়েক বছর আগে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে লড়াই করতে। এ জন্য তাঁরা ভাতাও পেয়েছিলেন। একই সময়কালে ফ্রিডম পার্টিও অনেককে প্রশিক্ষণের জন্য লিবিয়ায় পাঠিয়েছিল।
মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার শিমুলিয়ায় নিজ গ্রামে আস্তানা গড়ে তোলেন। পাঁচ একরের ওই আস্তানায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু এলাকায় তিনি পীর মতিউর নামে পরিচিতি পান।
পাকুন্দিয়ার ওই আস্তানায় সদস্যদের থাকার জন্য ১৩১টি ঘর ও বেশ কিছু তাঁবু এবং ৬১টি পরিখা (বাংকার) তৈরি করা হয়েছিল। ছিল নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। একটা মাদ্রাসাও করা হয়েছিল সেখানে। নাম ‘শিমুলিয়া ফরজে আইন মাদ্রাসা’। তার ফরজে কেফায়া বিভাগে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো। ওই প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক ছাত্রের সবাই ছিল কুমিল্লা, যশোর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার।
১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে পুলিশ পীর মেজর (অব.) মতিউর রহমানের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। আড়াই দিন ধরে চলে ওই বন্দুকযুদ্ধ। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ ২১ জন নিহত হন। আহত হন ২০ জন। পুলিশের পাঁচ শতাধিক সদস্য ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মর্টারের গোলাবর্ষণও করতে হয়েছিল। আহত অবস্থায় পালাতে গিয়ে পীর মতিউর ও তাঁর ৪৮ সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। তাঁর আস্তানা থেকে রাইফেল, রিভলবার, বন্দুক, তির-ধনুক, বল্লম, লাঠি, তলোয়ারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি, খাকি পোশাক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হয় ২৭টি পাসপোর্ট, যেগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা ছিল। দেশে ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর সশস্ত্র তৎপরতার ওটাই ছিল প্রথম বহিঃপ্রকাশ।
পীর মতিউর রহমানের গ্রেপ্তারের পর মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর আর কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। যদিও মতিউর রহমান পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে যান। এরপর তাঁর গতিবিধির ওপর কোনো নজরদারি করা হয়নি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে সর্বশেষ জানা গিয়েছিল, মতিউর রহমান তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বসবাস করছেন। তবে গত দুই বছর চেষ্টা করেও তাঁর সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
হুজি-বির জন্ম ও বিস্তার: পেশাগত কারণে দেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে ১২ বছর ধরে অনুসন্ধান করছেন এ প্রতিবেদক। এই দীর্ঘ সময়ে সরকারি-বেসরকারি ওয়াকিবহাল বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার নথি, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সংগঠনগুলোর নিজস্ব মুখপত্র, পুস্তিকা পর্যালোচনায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, আফগান যুদ্ধ চলাকালে এ দেশ থেকে প্রকাশ্যে মুজাহিদ সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখন ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে ব্যানার টানিয়েও সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছিল।
আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শেষের দিকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে বা যে দেশে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হবে, সেখানে মুজাহিদ পাঠানো। বাংলাদেশে সংগঠনটির শাখা খোলা হয়েছিল মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের হয়ে লড়াই করার জন্য।
১৯৮৯ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। কিন্তু ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় মাওলানা ফারুকী নিহত হন। পরে ১৯৯২ সালে ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে হুজি-বি। আফগানফেরত মুজাহিদদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা ছিলেন এ দেশে ভারতের দেওবন্দ ধারার মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং হানাফি মাজহাবের। তবে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। আফগান যুদ্ধের সময় তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এই নেতাদের গড়া সংগঠন হুজি-বিকে এ দেশে জঙ্গি তৎপরতার গোড়াপত্তনকারী বলে মনে করা হয়।
সংগঠনের শুরুর দিকে এসব আফগান মুজাহিদ ছিলেন এ দেশে দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে বিরাট শ্রদ্ধার পাত্র। আর সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আরাকানের ‘মজলুম মুসলমানদের’ পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁরা বাছাই করা সদস্যদের জন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে নানা খবর বের হয়েছিল।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল হুজি-বির উত্থান ও বিস্তারপর্ব। হুজি-বির সমসাময়িক সময়ে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংগঠিত ও সক্রিয় হয় রোহিঙ্গাদের দুই সশস্ত্র সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) ও এআরএনও (আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন)। হুজি-বি ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ছিল একে অন্যের সহযোগী। তখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতার নামে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিও থেকে বিপুল অর্থসাহায্যও এসেছিল বলে পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে বিডিআর-র*্যাব বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র উদ্ধার করেছিল, যা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর বলে ধারণা করা হয়।
নাশকতার শুরু; ৬ বছরে ১৩ হামলা: ওই সময় মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানকালে হুজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, ১৯৯৮ সালের দিকে আরাকানভিত্তিক সংগঠনগুলোতে আর্থিকসহ নানা বিষয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তৈরি হয়। ওই সময় থেকে হুজি-বি আরাকান থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেশের ভেতরে তৎপরতা বাড়ায়। সংগঠনটি প্রথম নাশকতামূলক বোমা হামলা করে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। কিন্তু তখন পর্যন্ত এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষয়ে দেশবাসীর তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তখনকার সরকারও এ মামলায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্যদের আসামি করে তদন্ত শেষ করে।
উদীচীর হামলার সাত মাসের মাথায় ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হন। তারপর ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখার ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রথম হরকাতুল জিহাদ ও মুফতি হান্নানের নাম জানাজানি হয়। তবে মুফতি হান্নানকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এরপর ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে, ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে গির্জায়, ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা পর্যন্ত হুজি-বি ৬ বছরে দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে মোট ১০৯ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০ জনের বেশি মানুষ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।
এর মধ্যে হুজি-বির জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ হামলা চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায়। ওই গ্রেনেড হামলায় ২২ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর আর্জেস গ্রেনেড আলোচনায় আসে। একই ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এসব গ্রেনেডের চালান এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
পরবর্তী সময়ে মুফতি হান্নানসহ একাধিক জঙ্গিনেতা আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, এসব গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে। আনোয়ার চৌধুরী ছাড়া বাকি হামলার বেশির ভাগই ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মতো পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত সত্য উদ্*ঘাটন করতে পারেনি। উপরন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি সরকার। যদিও এসব হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী মুফতি হান্নানকে বিএনপি সরকারের আমলেই ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডার আস্তানা থেকে র*্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁকে টানা ১২০ দিন রিমান্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর তখনই মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলেছিলেন। কিন্তু র*্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা গোপন করে। মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টার শুরু থেকেই এ বিষয়সহ হুজি-বির তৎপরতার বিষয়ে প্রথম আলো টানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে থাকে পুরো তথ্য। পরে ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে মুফতি হান্নান, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে অধিকতর তদন্ত করিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে। মামলাটির বিচার চলছে এখন।
তিনটি ধারার সৃষ্টি: ২০০৭ সালে হুজি-বি যখন প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছিল তখন এর আমির মাওলানা আবদুস দাবি করেছিলেন, ১৯৯৮-৯৯ সালে হুজি-বি তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছিল, যার একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন গোপালগঞ্জের মুফতি আবদুল হান্নান। আরেক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের মুফতি আবদুর রউফ। আর হুজির মূলধারাটি আবদুস সালাম, সিলেটের হাফেজ ইয়াহিয়া, কিশোরগঞ্জের মুফতি শফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার আবদুল হাই, খুলনার শেখ ফরিদদের নেতৃত্বে ছিল। আবদুস সালাম গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি এমনটা দাবি করেছিলেন বলে জানা যায়।
এর মধ্যে মুফতি হান্নান হুজি নামেই তৎপরতা চালালেও মুফতি রউফের সংগঠনের সর্বশেষ নাম ছিল তাআমির উদ-দীন বাংলাদেশ। অবশ্য হুজির মূলধারার দাবিদার অংশের নেতারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছিলেন, মুফতি হান্নান হুজি নামে তৎপরতা চালালেও তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে হান্নান পাকিস্তানে হরকাতুল মুজাহিদীনের সঙ্গে যুক্ত হন বলে তাঁদের দাবি।
হুজি-বির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্রের দাবি, মুফতি হান্নান ও তাঁর সংগঠন একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ছিলেন একজন সমন্বয়ক। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের কেউ কেউ হুজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে এমন তথ্য-প্রমাণ মেলায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয় এবং কয়েকজন রাজসাক্ষী হন।
হুজির নেতারা তিন ভাগে ভাগ হওয়ার দাবি করলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্তে যুক্ত সিআইডির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার মতে, ভেতরে ভেতরে তাঁরা সবাই ছিলেন এক।
বিএনপি সরকারের সর্বশেষ মেয়াদে (২০০১-০৬) জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা, ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতার (২০০৪ সালে রাজশাহীর তিনটি উপজেলায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তৎপরতা) অভিযোগ প্রকট ছিল। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলা চালানোর পর বিএনপি সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সক্রিয় হয়। এরপর জেএমবির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনে। কিন্তু মুফতি হান্নান ছাড়া হুজির আর কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি তখন। হুজির নেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার বিষয়েও প্রথম আলোতে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০০৫ সালে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হুজির মূলধারার দাবিদার অংশ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা: হুজি-বিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে। এরপর বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এক দফা ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হুজি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মকর্তার পরামর্শে আবার নাম পাল্টে ইসলামি গণ-আন্দোলন বা আইডিপি (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি) নামে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করে। তারা পল্টনে দলীয় কার্যালয় খোলে এবং নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে। তখন প্রথম আলোতে এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। মার্কিন দূতাবাস থেকেও এ দলটির নিবন্ধনের বিষয়ে আপত্তি দেওয়া হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত দলটি কমিশনের নিবন্ধন পায়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজির কথিত মূলধারাসহ তিন অংশেরই প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিরা গ্রেপ্তার হন। মূলত এরপর এ দেশে হুজি বা প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি দলটির যুগের সমাপ্তি ঘটে। যদিও মাঝে হুজির কারাবন্দী নেতা মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে আবু জাফরের কিছু অনুসারী নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।
২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি টাইমস-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ইসলামি জঙ্গি তৎপরতার ব্যাধিটির জন্ম পাকিস্তানের করাচি ও খোস্তে। এখন তা পাচার হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই সর্বত্র পাকিস্তানি প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, আফগান ফেরত মুজাহিদরা কেবল বাংলাদেশে নয়, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, চেচনিয়াসহ নানা দেশে জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছিল। এরা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি হতে পারে তা ১৯৯৯ সাল থেকে হুজি-বির নাশকতার পর থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, তার আগে ১৯৯৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট জিহাদের যে ডাক দিয়েছিল, যেটা আল-কায়েদা সনদ হিসেবে পরিচিত, তাতে ফজলুর রহমান নামে এক বাংলাদেশির সই ছিল। সেই ফজলুর রহমান কে-তা এখনো জানা যায়নি।
শাফকাত মুনীর বলেন, এখন দেশে যে জঙ্গিবাদ চলছে, তা বুঝতে এর অতীতটা পর্যালোচনা করতে হবে। আফগান যুদ্ধে কতজন বাংলাদেশি অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে কতজন হুজি-বিতে যোগ দিয়েছিল, বাকিরা কোথায় আছে, এ সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা : প্রথম পর্যায়
গোড়াপত্তন আফগান মুজাহিদদের হাতে
গুলশানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদ এক ভয়ংকর স্তরে পৌঁছেছে। ব্যক্তি, আক্রমণ, লক্ষ্যবস্তু ও অস্ত্রের ধরন বিশ্লেষণ করে একে দেশে বিপজ্জনক জঙ্গিবাদের তৃতীয় পর্যায় বলা যায়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল আফগানফেরত মুজাহিদদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে।
দেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে জঙ্গিদের তৎপরতার সময়টাকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে আশির দশকের মধ্যভাগে জন্ম নেওয়া মুসলিম মিল্লাত বাহিনী ও শেষ দিকে জন্ম নেওয়া হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজি-বি) এ দেশে প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি সংগঠন বলা যায়। এর এক দশক পর জন্ম নেয় জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), যার লক্ষ্য ছিল দেশে শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করা। জেএমবির জন্মের ঠিক এক দশক পর উত্থান ঘটে বর্তমানে সক্রিয় দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর। এর একটি ব্লগার হত্যার ঘটনায় জড়িত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম। এরা আল–কায়েদার অনুসারী। অপর গোষ্ঠীকে পুলিশ বলছে ‘নব্য জেএমবি’। তবে তারা নিজেদের ইসলামিক স্টেট বা আইএস বলে দাবি করে। এই দুই গোষ্ঠীতেই মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও যুক্ত হয়েছেন, যার একটি রূপ দেখা গেছে গুলশানে।
সূচনায় মুসলিম মিল্লাত বাহিনী: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশি মুজাহিদদের প্রত্যাবর্তনের আগে, ১৯৮৬ সালে ‘মুসলিম মিল্লাত বাহিনী’ গঠন করেন চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মতিউর রহমান। এর কয়েক বছর আগে কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি ফিলিস্তিনে গিয়েছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে লড়াই করতে। এ জন্য তাঁরা ভাতাও পেয়েছিলেন। একই সময়কালে ফ্রিডম পার্টিও অনেককে প্রশিক্ষণের জন্য লিবিয়ায় পাঠিয়েছিল।
মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর মতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার শিমুলিয়ায় নিজ গ্রামে আস্তানা গড়ে তোলেন। পাঁচ একরের ওই আস্তানায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেন। কিন্তু এলাকায় তিনি পীর মতিউর নামে পরিচিতি পান।
পাকুন্দিয়ার ওই আস্তানায় সদস্যদের থাকার জন্য ১৩১টি ঘর ও বেশ কিছু তাঁবু এবং ৬১টি পরিখা (বাংকার) তৈরি করা হয়েছিল। ছিল নিজস্ব জেনারেটরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। একটা মাদ্রাসাও করা হয়েছিল সেখানে। নাম ‘শিমুলিয়া ফরজে আইন মাদ্রাসা’। তার ফরজে কেফায়া বিভাগে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হতো। ওই প্রতিষ্ঠানের তিন শতাধিক ছাত্রের সবাই ছিল কুমিল্লা, যশোর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার।
১৯৮৯ সালের ১২ ডিসেম্বরে পুলিশ পীর মেজর (অব.) মতিউর রহমানের আস্তানায় অভিযান চালাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয়। আড়াই দিন ধরে চলে ওই বন্দুকযুদ্ধ। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ ২১ জন নিহত হন। আহত হন ২০ জন। পুলিশের পাঁচ শতাধিক সদস্য ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মর্টারের গোলাবর্ষণও করতে হয়েছিল। আহত অবস্থায় পালাতে গিয়ে পীর মতিউর ও তাঁর ৪৮ সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। তাঁর আস্তানা থেকে রাইফেল, রিভলবার, বন্দুক, তির-ধনুক, বল্লম, লাঠি, তলোয়ারসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলি, খাকি পোশাক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হয় ২৭টি পাসপোর্ট, যেগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ভিসা ছিল। দেশে ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর সশস্ত্র তৎপরতার ওটাই ছিল প্রথম বহিঃপ্রকাশ।
পীর মতিউর রহমানের গ্রেপ্তারের পর মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর আর কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। যদিও মতিউর রহমান পরবর্তী সময়ে জামিনে বেরিয়ে যান। এরপর তাঁর গতিবিধির ওপর কোনো নজরদারি করা হয়নি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে সর্বশেষ জানা গিয়েছিল, মতিউর রহমান তাঁর দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বসবাস করছেন। তবে গত দুই বছর চেষ্টা করেও তাঁর সম্পর্কে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
হুজি-বির জন্ম ও বিস্তার: পেশাগত কারণে দেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে ১২ বছর ধরে অনুসন্ধান করছেন এ প্রতিবেদক। এই দীর্ঘ সময়ে সরকারি-বেসরকারি ওয়াকিবহাল বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার নথি, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সংগঠনগুলোর নিজস্ব মুখপত্র, পুস্তিকা পর্যালোচনায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, আফগান যুদ্ধ চলাকালে এ দেশ থেকে প্রকাশ্যে মুজাহিদ সংগ্রহ করা হয়েছিল। তখন ঢাকায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে ব্যানার টানিয়েও সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছিল।
আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের শেষের দিকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের খোস্ত রণাঙ্গনে হুজির জন্ম হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, যেখানে বা যে দেশে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হবে, সেখানে মুজাহিদ পাঠানো। বাংলাদেশে সংগঠনটির শাখা খোলা হয়েছিল মিয়ানমারের আরাকানে স্বাধীনতাকামী রোহিঙ্গা মুসলমানদের হয়ে লড়াই করার জন্য।
১৯৮৯ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশোরের মনিরামপুরের মাওলানা আবদুর রহমান ফারুকী। কিন্তু ওই বছরই আফগানিস্তানের খোস্তে মাইন অপসারণের সময় মাওলানা ফারুকী নিহত হন। পরে ১৯৯২ সালে ৩০ এপ্রিল ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে হুজি-বি। আফগানফেরত মুজাহিদদের বেশির ভাগই এর সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁরা ছিলেন এ দেশে ভারতের দেওবন্দ ধারার মাদ্রাসায় শিক্ষিত এবং হানাফি মাজহাবের। তবে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকে পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। আফগান যুদ্ধের সময় তাঁরা গেরিলাযুদ্ধ ও ভারী অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এই নেতাদের গড়া সংগঠন হুজি-বিকে এ দেশে জঙ্গি তৎপরতার গোড়াপত্তনকারী বলে মনে করা হয়।
সংগঠনের শুরুর দিকে এসব আফগান মুজাহিদ ছিলেন এ দেশে দেওবন্দ ধারার কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে বিরাট শ্রদ্ধার পাত্র। আর সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা আরাকানের ‘মজলুম মুসলমানদের’ পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন। তাঁরা বাছাই করা সদস্যদের জন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। এসব প্রশিক্ষণকেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে নানা খবর বের হয়েছিল।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ছিল হুজি-বির উত্থান ও বিস্তারপর্ব। হুজি-বির সমসাময়িক সময়ে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় সংগঠিত ও সক্রিয় হয় রোহিঙ্গাদের দুই সশস্ত্র সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) ও এআরএনও (আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন)। হুজি-বি ও রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ছিল একে অন্যের সহযোগী। তখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহযোগিতার নামে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন এনজিও থেকে বিপুল অর্থসাহায্যও এসেছিল বলে পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে খবর বের হয়। ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৫ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির জঙ্গল থেকে বিডিআর-র*্যাব বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র উদ্ধার করেছিল, যা রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠনগুলোর বলে ধারণা করা হয়।
নাশকতার শুরু; ৬ বছরে ১৩ হামলা: ওই সময় মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানকালে হুজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, ১৯৯৮ সালের দিকে আরাকানভিত্তিক সংগঠনগুলোতে আর্থিকসহ নানা বিষয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তৈরি হয়। ওই সময় থেকে হুজি-বি আরাকান থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেশের ভেতরে তৎপরতা বাড়ায়। সংগঠনটি প্রথম নাশকতামূলক বোমা হামলা করে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। কিন্তু তখন পর্যন্ত এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষয়ে দেশবাসীর তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তখনকার সরকারও এ মামলায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতা তরিকুল ইসলামসহ অন্যান্যদের আসামি করে তদন্ত শেষ করে।
উদীচীর হামলার সাত মাসের মাথায় ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হন। তারপর ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছে ও হেলিপ্যাডে বোমা পেতে রাখার ঘটনা ধরা পড়ার পর প্রথম হরকাতুল জিহাদ ও মুফতি হান্নানের নাম জানাজানি হয়। তবে মুফতি হান্নানকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এরপর ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে রমনার বটমূলে, ৩ জুন গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরে গির্জায়, ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা পর্যন্ত হুজি-বি ৬ বছরে দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে মোট ১০৯ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০ জনের বেশি মানুষ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান।
এর মধ্যে হুজি-বির জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ হামলা চালায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায়। ওই গ্রেনেড হামলায় ২২ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী। এ ঘটনার পর আর্জেস গ্রেনেড আলোচনায় আসে। একই ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে এসব গ্রেনেডের চালান এসেছিল পাকিস্তান থেকে।
পরবর্তী সময়ে মুফতি হান্নানসহ একাধিক জঙ্গিনেতা আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, এসব গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে। আনোয়ার চৌধুরী ছাড়া বাকি হামলার বেশির ভাগই ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু আগের আওয়ামী লীগ সরকারের মতো পরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত সত্য উদ্*ঘাটন করতে পারেনি। উপরন্তু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে বিএনপি সরকার। যদিও এসব হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী মুফতি হান্নানকে বিএনপি সরকারের আমলেই ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডার আস্তানা থেকে র*্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। তাঁকে টানা ১২০ দিন রিমান্ডে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর তখনই মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলেছিলেন। কিন্তু র*্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা গোপন করে। মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টার শুরু থেকেই এ বিষয়সহ হুজি-বির তৎপরতার বিষয়ে প্রথম আলো টানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে থাকে পুরো তথ্য। পরে ২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে ২১ আগস্ট মামলার নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়। ২০০৮ সালে মুফতি হান্নান, বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এসে অধিকতর তদন্ত করিয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে। মামলাটির বিচার চলছে এখন।
তিনটি ধারার সৃষ্টি: ২০০৭ সালে হুজি-বি যখন প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছিল তখন এর আমির মাওলানা আবদুস দাবি করেছিলেন, ১৯৯৮-৯৯ সালে হুজি-বি তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছিল, যার একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন গোপালগঞ্জের মুফতি আবদুল হান্নান। আরেক অংশের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের মুফতি আবদুর রউফ। আর হুজির মূলধারাটি আবদুস সালাম, সিলেটের হাফেজ ইয়াহিয়া, কিশোরগঞ্জের মুফতি শফিকুল ইসলাম, কুমিল্লার আবদুল হাই, খুলনার শেখ ফরিদদের নেতৃত্বে ছিল। আবদুস সালাম গ্রেপ্তারের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি এমনটা দাবি করেছিলেন বলে জানা যায়।
এর মধ্যে মুফতি হান্নান হুজি নামেই তৎপরতা চালালেও মুফতি রউফের সংগঠনের সর্বশেষ নাম ছিল তাআমির উদ-দীন বাংলাদেশ। অবশ্য হুজির মূলধারার দাবিদার অংশের নেতারা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছিলেন, মুফতি হান্নান হুজি নামে তৎপরতা চালালেও তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল মুজাহিদীনের যোগাযোগ ছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে হান্নান পাকিস্তানে হরকাতুল মুজাহিদীনের সঙ্গে যুক্ত হন বলে তাঁদের দাবি।
হুজি-বির বিষয়ে ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্রের দাবি, মুফতি হান্নান ও তাঁর সংগঠন একটা পর্যায়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ছিলেন একজন সমন্বয়ক। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের কেউ কেউ হুজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তে এমন তথ্য-প্রমাণ মেলায় কয়েকজন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয় এবং কয়েকজন রাজসাক্ষী হন।
হুজির নেতারা তিন ভাগে ভাগ হওয়ার দাবি করলেও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্তে যুক্ত সিআইডির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার মতে, ভেতরে ভেতরে তাঁরা সবাই ছিলেন এক।
বিএনপি সরকারের সর্বশেষ মেয়াদে (২০০১-০৬) জঙ্গিগোষ্ঠীর বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকা, ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতার (২০০৪ সালে রাজশাহীর তিনটি উপজেলায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবির তৎপরতা) অভিযোগ প্রকট ছিল। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি দেশব্যাপী বোমা হামলা চালানোর পর বিএনপি সরকার জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সক্রিয় হয়। এরপর জেএমবির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনে। কিন্তু মুফতি হান্নান ছাড়া হুজির আর কোনো উল্লেখযোগ্য নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি তখন। হুজির নেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার বিষয়েও প্রথম আলোতে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ২০০৫ সালে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হুজির মূলধারার দাবিদার অংশ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।
প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা: হুজি-বিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ২০০৫ সালের অক্টোবরে। এরপর বিএনপি সরকারের শেষ দিকে এক দফা ব্যর্থ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হুজি একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মকর্তার পরামর্শে আবার নাম পাল্টে ইসলামি গণ-আন্দোলন বা আইডিপি (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি) নামে প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করে। তারা পল্টনে দলীয় কার্যালয় খোলে এবং নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে। তখন প্রথম আলোতে এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। মার্কিন দূতাবাস থেকেও এ দলটির নিবন্ধনের বিষয়ে আপত্তি দেওয়া হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত দলটি কমিশনের নিবন্ধন পায়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজির কথিত মূলধারাসহ তিন অংশেরই প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিরা গ্রেপ্তার হন। মূলত এরপর এ দেশে হুজি বা প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি দলটির যুগের সমাপ্তি ঘটে। যদিও মাঝে হুজির কারাবন্দী নেতা মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে আবু জাফরের কিছু অনুসারী নতুন নামে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা সবাই গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যান।
২০০৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি টাইমস-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, ইসলামি জঙ্গি তৎপরতার ব্যাধিটির জন্ম পাকিস্তানের করাচি ও খোস্তে। এখন তা পাচার হয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই সর্বত্র পাকিস্তানি প্রভাব পরিলক্ষিত হবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো শাফকাত মুনীর প্রথম আলোকে বলেন, আফগান ফেরত মুজাহিদরা কেবল বাংলাদেশে নয়, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, চেচনিয়াসহ নানা দেশে জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করেছিল। এরা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কতটা হুমকি হতে পারে তা ১৯৯৯ সাল থেকে হুজি-বির নাশকতার পর থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, তার আগে ১৯৯৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্ট জিহাদের যে ডাক দিয়েছিল, যেটা আল-কায়েদা সনদ হিসেবে পরিচিত, তাতে ফজলুর রহমান নামে এক বাংলাদেশির সই ছিল। সেই ফজলুর রহমান কে-তা এখনো জানা যায়নি।
শাফকাত মুনীর বলেন, এখন দেশে যে জঙ্গিবাদ চলছে, তা বুঝতে এর অতীতটা পর্যালোচনা করতে হবে। আফগান যুদ্ধে কতজন বাংলাদেশি অংশ নিয়েছিল, তাদের মধ্যে কতজন হুজি-বিতে যোগ দিয়েছিল, বাকিরা কোথায় আছে, এ সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
Comment