এরদোয়ান: শক্তিহীনের শক্তি যখন মিডিয়া
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর১৩:৩৯, জুলাই ২০, ২০১৬
টু দ্য পয়েন্ট—
তুরস্কে ১৫ জুলাই রাত দশটায় সেনাবাহিনীর একাংশ ক্যু করলো। মুহূর্তে ইস্তাম্বুল-আঙ্কারার পথে পথে নেমে পড়লো সেনাবাহিনীর ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ট্রুপবাস। আকাশে উড়তে লাগলো জঙ্গিবিমান, চপার কপ্টার। দেশীয় সকল টিভি চ্যানেল ও রেডিও’র সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হলো। দখল করা হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সরকারি অফিস। রাত বারোটায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘোষণা এলো— সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনগণ কেউ যেন ঘরের বাইরে না আসে...! যদ্দেশে যদাচার—তুর্কিরা রাত দুপুরের অভ্যুত্থানটা শঙ্কা-ভয়ে মেনে নিলো।
রাত সাড়ে বারোটায় প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান অজ্ঞাত স্থান থেকে ‘সিএনএন’ টিভি চ্যানেলের তুর্কি অফিসে ‘ফেসটাইম’ নামের একটি আইফোন অ্যাপের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন— ক্যু করেছে সেনাবাহিনীর পথভ্রষ্ট একদল সৈনিক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে আসছি। আপনারা সবাই পথে নেমে আসুন। বিমানবন্দর ঘেরাও করে রাখুন...!
ফলশ্রুতিতে কী ঘটলো, তা তো পৃথিবীবাসী সবাই দেখেছেন।
এখানে দেখার বিষয় দুটো—
এক. আমেরিকান টিভি চ্যানেল ‘সিএনএন’ যদি প্রেসিডেন্টের এই ভিডিও ম্যাসেজটি প্রচারে অস্বীকৃতি জানাতো, তাহলে কী ঘটতো? জনগণ কি এরদোয়ানের ঘোষণা জানতে পারতো? তারা কি পথে নেমে সেনাবাহিনীর ট্যাংক প্রতিহত করে বিমানবন্দরের দখল নিতে পারতো? এরদোয়ানের পক্ষেও কি সম্ভব হতো ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নেমে আবার জনগণের রাষ্ট্রনায়ক হতে?
এককথায়— না!
জনগণ জানতেই পারতো না কোথায় কী ঘটছে। কারণ অভ্যুত্থানকামী সেনারা ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ সকল সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সম্প্রচার বন্ধ ছিল দেশীয় সকল রেডিও-টিভি চ্যানেলের। সিএনএন বিদেশি চ্যানেল বলে এর টেরিস্ট্রোরিয়াল সম্প্রচার হতো তুরস্কের বাইরে থেকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ সুযোগটি নিয়েছেন। যদিও পরবর্তীতে কিছু সময়ের জন্য সিএনএন তুরস্ক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সুতরাং প্রত্যক্ষদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে— প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সেনাবাহিনীর ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, কামান আর বন্দুকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন স্রেফ একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। তিনি অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন একটি টিভি চ্যানেল ও একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে।
গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে পরশুদিন পর্যন্ত একটি প্রবাদ পৃথিবীর বুকে জ্যান্ত ছিল, কিন্তু পরশু রাতে প্রবাদটির সলীল সমাধি ঘটে গিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আরেকটি প্রবাদ। নতুন প্রবাদটি আগেরটির চেয়ে শক্তিশালী, আরও বেশি ভয়াবহ, আরও বেশি চক্রান্তিক। তবে সামগ্রিকভাবে প্রবাদটির কার্যকরণ পৃথিবীবাসীর জন্য নতুন এক চিন্তার দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
পুরনো প্রবাদটি আমরা জানি- ‘বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেক যুদ্ধ করে সেনাবাহিনী, বাকি অর্ধেক মিডিয়া’। কিন্তু নতুন প্রবাদটি বলছে ভিন্নকথা- ‘বর্তমান পৃথিবীর পুরো যুদ্ধটাই করে মিডিয়া’! অন্তত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এটাই প্রমাণ করলেন। এখানে পর্দার আড়ালের রাজনীতি ও কূটকৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে সেনাপ্রধানের অসংহতি নিয়েও। ক্যুর প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অসহমতের ব্যাপারেও কথা বলতে চাইবেন কেউ কেউ। কিন্তু এসবই বকওয়াজ হয়ে যেতো যদি না প্রেসিডেন্ট রাত সাড়ে বারোটায় সিএনএনে ওই ভাষণটি না দিতেন। সেনাবাহিনীর ওই অংশটি আরও কিছু সময় যদি অতিবাহিত করতে পারতো তাহলে দেখা যেতো, এখন ভোল পাল্টানো অধিকাংশ পক্ষই তাদের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইছে।
এ ক্যু’র পেছনে অবশ্যই পশ্চিমা কোনও না কোনও শক্তির হাত ছিল। সেটা আমেরিকা হতে পারে, রাশিয়া কিংবা ফ্রান্স, ব্রিটেন, ফ্রান্সও হতে পারে। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ যেমন মিসর, ইসরায়েল, বাশার অধ্যুষিত সিরিয়ার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। যে সেনা অফিসাররা ক্যু করেছেন তারা এসব দেশের উৎসাহী কিংবা মৌন সম্মতি নিয়েই ট্যাংক নামিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর যেসব রাজনৈতিক দল ভেজা বেড়াল হয়ে প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেছেন, তাদের অনেকের সমর্থনও যে অভ্যুত্থানরত সেনা অফিসাররা আগেই আদায় করেছিলেন, এটাও আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়।
কেননা একটু ক্যু কখনোই একদিনেই হুট করে- ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে হয় না। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়, সুবিন্যস্ত গেমপ্ল্যান বানাতে হয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোতে রিপ্লেস করার মতো যাবতীয় রসদ স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়, পুরো দেশের সেনানিবাসের ব্লুপ্রিন্ট সাজাতে হয়, জনগণকে মুঠিতে রাখতে কঠিন ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়, নিখুঁত টাইমিং ঠিক করতে হয়, দেশ-বিদেশের থিঙ্কট্যাঙ্কদের সমর্থন ও পরামর্শ নিতে হয় এবং আরও অনেক বিষয় সুপরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তারপর অভ্যুত্থানে নামতে হয়। অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসাররা এসব কিছু না করেই ময়দানে নেমেছিলেন- এমন ভাবাটা স্রেফ বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তারা সবদিক থেকে প্রস্তুতি নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো একটিমাত্র টিভি চ্যানেল এবং আইফোনের নগন্য একটি ফ্রি অ্যাপ ‘ফেসটাইম’।
মিডিয়া বলুন কিংবা সোস্যাল মিডিয়া, এটাকে আমি বলি- Power of Powerless ‘শক্তিহীনের শক্তি’। বর্তমান সিএনএন, বিবিসি, রয়টার, এনবিসি, এএফপি বা প্রভাবশালী যেকোনও মিডিয়া গ্রুপ ইচ্ছা করলেই যেকোনও দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে যুদ্ধ থামিয়েও দিতে পারে। যদি মিডিয়াকে সেভাবে চালিত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান রাত সাড়ে বারোটায় ঘোষণা দেওয়ার আগ মুহূর্তের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার চিত্রগুলো একটু চিন্তা করে দেখুন। বাইরে রাস্তায় সেনাদের ট্যাংক, আকাশে হেলিকপ্টার-জঙ্গিবিমান, সারাদেশে কারফিউ, সমস্ত টিভি চ্যানেল-রেডিও স্টেশন বন্ধ, সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ। পৃথিবীর বড় বড় মিডিয়াগুলো, যেমন- এনবিসি, টেলিগ্রাফ, বিবিসি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ফক্স নিউজ, স্পুটনিক, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন নিউজ দিচ্ছে- তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান, ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সামরিক সরকার, প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান ক্ষমতাচ্যুত ইত্যাদি। সাধারণ জনতা এসব সংবাদ পড়ে যারপরনাই শঙ্কিত হয়ে ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু যখনই সিএনএন তুর্ক-এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রজব এরদোয়ান জনতাকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে বললেন তখন কেউ আর দ্বিধায় ভুগেনি। কারণ এটা দেশ বাঁচানোর প্রশ্ন, বন্দুকের নলের বিরুদ্ধে আইনের শাসনের সওয়াল। প্রেসিডেন্টের ঘোষণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। মানুষ দল-মত নির্বিশেষে পথে নেমে পড়েন। কাছাকাছি যারা ছিলেন তারা বিমানবন্দরে চলে যান। বিমানবন্দরে অবস্থানরত সৈনিকদের ট্যাংকের চারপাশে মৌমাছির মতো জড়ো হতে থাকেন। সেনাবাহিনীর সাহস ছিল না এতো মানুষের ওপর ট্যাংক উঠিয়ে দিয়ে কিংবা কামান দেগে ম্যাসাকার করার। আর অন্যান্য যারা দূরবর্তী ছিলেন, তারা রাস্তায় নেমে সৈনিকদের ট্যাংক ও সাজোয়া যানের গতিরোধ করার চেষ্টা করেন। অনেককেই ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়তে দেখা গেছে। এটাই ছিল প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাওয়ার, পাওয়ার অব পাওয়ারলেস।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেওয়ার সময় কিন্তু বলেননি- আমার দল একে পার্টির সকল নেতা-কর্মী পথে নেমে আসুন। বরং তিনি বলেছেন- তুরস্কের ‘সকল জনগণ’ রাস্তায় নেমে আসুন এবং প্রতিহত করুন। সকল জনগণকে তিনি তার সুহৃদ ভেবেছেন। বিরোধী দল বা বিরোধী মতাবলম্বী বলে কাউকে নির্দিষ্ট করেননি।
আরেকটি বিষয়ও দ্রষ্টব্য, জনগণ যারা রাত্রিবেলা ভয়হীনভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তারা কেউ কিন্তু হাতে এরদোয়ানের ছবি সম্বলিত পোস্টার নিয়ে আসেনি। তারা এসেছিলো চাঁদ-তারা খচিত তুরস্কের রক্তিম জাতীয় পতাকা হাতে। এটাও দেশপ্রেমের একটা শক্তিশালী সিম্বল। তারা এরদোয়ানের ব্যক্তিপুজায় লিপ্ত নয়, বরং দেশের স্বার্থেই তারা এরদোয়ানকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় বারবার।
অথচ আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের দুপাশে তাকালে কেবল হাজার হাজার নেতাই চোখে পড়ে।
লেখক: গল্পকার
সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর১৩:৩৯, জুলাই ২০, ২০১৬
টু দ্য পয়েন্ট—
তুরস্কে ১৫ জুলাই রাত দশটায় সেনাবাহিনীর একাংশ ক্যু করলো। মুহূর্তে ইস্তাম্বুল-আঙ্কারার পথে পথে নেমে পড়লো সেনাবাহিনীর ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ট্রুপবাস। আকাশে উড়তে লাগলো জঙ্গিবিমান, চপার কপ্টার। দেশীয় সকল টিভি চ্যানেল ও রেডিও’র সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হলো। দখল করা হলো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সরকারি অফিস। রাত বারোটায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ঘোষণা এলো— সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনগণ কেউ যেন ঘরের বাইরে না আসে...! যদ্দেশে যদাচার—তুর্কিরা রাত দুপুরের অভ্যুত্থানটা শঙ্কা-ভয়ে মেনে নিলো।
রাত সাড়ে বারোটায় প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান অজ্ঞাত স্থান থেকে ‘সিএনএন’ টিভি চ্যানেলের তুর্কি অফিসে ‘ফেসটাইম’ নামের একটি আইফোন অ্যাপের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন— ক্যু করেছে সেনাবাহিনীর পথভ্রষ্ট একদল সৈনিক। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে আসছি। আপনারা সবাই পথে নেমে আসুন। বিমানবন্দর ঘেরাও করে রাখুন...!
ফলশ্রুতিতে কী ঘটলো, তা তো পৃথিবীবাসী সবাই দেখেছেন।
এখানে দেখার বিষয় দুটো—
এক. আমেরিকান টিভি চ্যানেল ‘সিএনএন’ যদি প্রেসিডেন্টের এই ভিডিও ম্যাসেজটি প্রচারে অস্বীকৃতি জানাতো, তাহলে কী ঘটতো? জনগণ কি এরদোয়ানের ঘোষণা জানতে পারতো? তারা কি পথে নেমে সেনাবাহিনীর ট্যাংক প্রতিহত করে বিমানবন্দরের দখল নিতে পারতো? এরদোয়ানের পক্ষেও কি সম্ভব হতো ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে নেমে আবার জনগণের রাষ্ট্রনায়ক হতে?
এককথায়— না!
জনগণ জানতেই পারতো না কোথায় কী ঘটছে। কারণ অভ্যুত্থানকামী সেনারা ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ সকল সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সম্প্রচার বন্ধ ছিল দেশীয় সকল রেডিও-টিভি চ্যানেলের। সিএনএন বিদেশি চ্যানেল বলে এর টেরিস্ট্রোরিয়াল সম্প্রচার হতো তুরস্কের বাইরে থেকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ সুযোগটি নিয়েছেন। যদিও পরবর্তীতে কিছু সময়ের জন্য সিএনএন তুরস্ক কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সুতরাং প্রত্যক্ষদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে— প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সেনাবাহিনীর ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, কামান আর বন্দুকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন স্রেফ একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। তিনি অভ্যুত্থানের বিপরীতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন একটি টিভি চ্যানেল ও একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে।
গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে পরশুদিন পর্যন্ত একটি প্রবাদ পৃথিবীর বুকে জ্যান্ত ছিল, কিন্তু পরশু রাতে প্রবাদটির সলীল সমাধি ঘটে গিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আরেকটি প্রবাদ। নতুন প্রবাদটি আগেরটির চেয়ে শক্তিশালী, আরও বেশি ভয়াবহ, আরও বেশি চক্রান্তিক। তবে সামগ্রিকভাবে প্রবাদটির কার্যকরণ পৃথিবীবাসীর জন্য নতুন এক চিন্তার দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
পুরনো প্রবাদটি আমরা জানি- ‘বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেক যুদ্ধ করে সেনাবাহিনী, বাকি অর্ধেক মিডিয়া’। কিন্তু নতুন প্রবাদটি বলছে ভিন্নকথা- ‘বর্তমান পৃথিবীর পুরো যুদ্ধটাই করে মিডিয়া’! অন্তত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এটাই প্রমাণ করলেন। এখানে পর্দার আড়ালের রাজনীতি ও কূটকৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে সেনাপ্রধানের অসংহতি নিয়েও। ক্যুর প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অসহমতের ব্যাপারেও কথা বলতে চাইবেন কেউ কেউ। কিন্তু এসবই বকওয়াজ হয়ে যেতো যদি না প্রেসিডেন্ট রাত সাড়ে বারোটায় সিএনএনে ওই ভাষণটি না দিতেন। সেনাবাহিনীর ওই অংশটি আরও কিছু সময় যদি অতিবাহিত করতে পারতো তাহলে দেখা যেতো, এখন ভোল পাল্টানো অধিকাংশ পক্ষই তাদের পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইছে।
এ ক্যু’র পেছনে অবশ্যই পশ্চিমা কোনও না কোনও শক্তির হাত ছিল। সেটা আমেরিকা হতে পারে, রাশিয়া কিংবা ফ্রান্স, ব্রিটেন, ফ্রান্সও হতে পারে। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ যেমন মিসর, ইসরায়েল, বাশার অধ্যুষিত সিরিয়ার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। যে সেনা অফিসাররা ক্যু করেছেন তারা এসব দেশের উৎসাহী কিংবা মৌন সম্মতি নিয়েই ট্যাংক নামিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর যেসব রাজনৈতিক দল ভেজা বেড়াল হয়ে প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করেছেন, তাদের অনেকের সমর্থনও যে অভ্যুত্থানরত সেনা অফিসাররা আগেই আদায় করেছিলেন, এটাও আন্দাজ করা কঠিন কিছু নয়।
কেননা একটু ক্যু কখনোই একদিনেই হুট করে- ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে হয় না। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়, সুবিন্যস্ত গেমপ্ল্যান বানাতে হয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোতে রিপ্লেস করার মতো যাবতীয় রসদ স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়, পুরো দেশের সেনানিবাসের ব্লুপ্রিন্ট সাজাতে হয়, জনগণকে মুঠিতে রাখতে কঠিন ফিল্ডওয়ার্ক করতে হয়, নিখুঁত টাইমিং ঠিক করতে হয়, দেশ-বিদেশের থিঙ্কট্যাঙ্কদের সমর্থন ও পরামর্শ নিতে হয় এবং আরও অনেক বিষয় সুপরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তারপর অভ্যুত্থানে নামতে হয়। অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসাররা এসব কিছু না করেই ময়দানে নেমেছিলেন- এমন ভাবাটা স্রেফ বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তারা সবদিক থেকে প্রস্তুতি নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলো একটিমাত্র টিভি চ্যানেল এবং আইফোনের নগন্য একটি ফ্রি অ্যাপ ‘ফেসটাইম’।
মিডিয়া বলুন কিংবা সোস্যাল মিডিয়া, এটাকে আমি বলি- Power of Powerless ‘শক্তিহীনের শক্তি’। বর্তমান সিএনএন, বিবিসি, রয়টার, এনবিসি, এএফপি বা প্রভাবশালী যেকোনও মিডিয়া গ্রুপ ইচ্ছা করলেই যেকোনও দেশে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে যুদ্ধ থামিয়েও দিতে পারে। যদি মিডিয়াকে সেভাবে চালিত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান রাত সাড়ে বারোটায় ঘোষণা দেওয়ার আগ মুহূর্তের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার চিত্রগুলো একটু চিন্তা করে দেখুন। বাইরে রাস্তায় সেনাদের ট্যাংক, আকাশে হেলিকপ্টার-জঙ্গিবিমান, সারাদেশে কারফিউ, সমস্ত টিভি চ্যানেল-রেডিও স্টেশন বন্ধ, সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ। পৃথিবীর বড় বড় মিডিয়াগুলো, যেমন- এনবিসি, টেলিগ্রাফ, বিবিসি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ফক্স নিউজ, স্পুটনিক, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন নিউজ দিচ্ছে- তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান, ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সামরিক সরকার, প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান ক্ষমতাচ্যুত ইত্যাদি। সাধারণ জনতা এসব সংবাদ পড়ে যারপরনাই শঙ্কিত হয়ে ঘরের দরজায় খিল এঁটে বসে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু যখনই সিএনএন তুর্ক-এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রজব এরদোয়ান জনতাকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে বললেন তখন কেউ আর দ্বিধায় ভুগেনি। কারণ এটা দেশ বাঁচানোর প্রশ্ন, বন্দুকের নলের বিরুদ্ধে আইনের শাসনের সওয়াল। প্রেসিডেন্টের ঘোষণা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে। মানুষ দল-মত নির্বিশেষে পথে নেমে পড়েন। কাছাকাছি যারা ছিলেন তারা বিমানবন্দরে চলে যান। বিমানবন্দরে অবস্থানরত সৈনিকদের ট্যাংকের চারপাশে মৌমাছির মতো জড়ো হতে থাকেন। সেনাবাহিনীর সাহস ছিল না এতো মানুষের ওপর ট্যাংক উঠিয়ে দিয়ে কিংবা কামান দেগে ম্যাসাকার করার। আর অন্যান্য যারা দূরবর্তী ছিলেন, তারা রাস্তায় নেমে সৈনিকদের ট্যাংক ও সাজোয়া যানের গতিরোধ করার চেষ্টা করেন। অনেককেই ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়তে দেখা গেছে। এটাই ছিল প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাওয়ার, পাওয়ার অব পাওয়ারলেস।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেওয়ার সময় কিন্তু বলেননি- আমার দল একে পার্টির সকল নেতা-কর্মী পথে নেমে আসুন। বরং তিনি বলেছেন- তুরস্কের ‘সকল জনগণ’ রাস্তায় নেমে আসুন এবং প্রতিহত করুন। সকল জনগণকে তিনি তার সুহৃদ ভেবেছেন। বিরোধী দল বা বিরোধী মতাবলম্বী বলে কাউকে নির্দিষ্ট করেননি।
আরেকটি বিষয়ও দ্রষ্টব্য, জনগণ যারা রাত্রিবেলা ভয়হীনভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তারা কেউ কিন্তু হাতে এরদোয়ানের ছবি সম্বলিত পোস্টার নিয়ে আসেনি। তারা এসেছিলো চাঁদ-তারা খচিত তুরস্কের রক্তিম জাতীয় পতাকা হাতে। এটাও দেশপ্রেমের একটা শক্তিশালী সিম্বল। তারা এরদোয়ানের ব্যক্তিপুজায় লিপ্ত নয়, বরং দেশের স্বার্থেই তারা এরদোয়ানকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায় বারবার।
অথচ আমাদের দেশের রাস্তাঘাটের দুপাশে তাকালে কেবল হাজার হাজার নেতাই চোখে পড়ে।
লেখক: গল্পকার
Comment