ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার নিদর্শনসমূহ – মৌলভি আবদুল হাদি
দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানই আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্ধারিত সেই আস্তানা যেখানে সমসাময়িক কুফফার পরাশক্তিদের স্বভাবজাত ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত এখানেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের ও ধ্বংসের সূত্রপাত এখানেই এবং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা কাফিরদের যে সম্মিলিত সামরিক শক্তি আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল, সমগ্র বিশ্ব আজ তাদের নাকানি চুবানি খাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করছে। ইসলামী ইমারাতের মুজাহিদদের কাছে পরাজিত হয়ে পশ্চিমা জোটের প্রায় সব পরাশক্তি যেমন আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্যরা যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে এবং পরাজয় স্বীকারের সাহসের অভাবে তারা এই প্রত্যাহারকেই নিজেদের অবলম্বন বানিয়েছে।
এই ১৩ বছর ধরে কিভাবে ইসলামী ইমারাত প্রচণ্ড শক্তিশালী এই সম্মিলিত সামরিক জোটের মোকাবিলা করেছে? দেশী-বিদেশী মিলিয়ে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্যের সম্পূর্ণ সশস্ত্র ও সুসজ্জিত এই বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য কিভাবে তারা নিজেদের গোষ্ঠী ও সৈন্যদের প্রস্তুত করেছে? কিভাবে এই ইমারাত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে এবং নিজ সৈন্যদের মধ্যে জাতিভেদ ও বিক্ষোভকে স্থান না দিয়ে কিভাবে শক্তি ও সংহতির দিকে তাদের পরিচালিত করেছে? আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ রহমত ও সাহায্যে এই ইমারাতের একটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও সুচিন্তিত জিহাদি ব্যবস্থাপনা রয়েছে যা প্রতি পদে পদে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মানসিক, সামরিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক এবং যুক্তিভিত্তিক প্রস্তুতি অর্জনে সহায়তা করেছে এবং এই অসম যুদ্ধের ফলাফল একটি প্রভাবশালী দলের বিরুদ্ধে পার্থিব বিচারে দুর্বল ও ক্ষতবিক্ষত একটি দলের অনুকূলে পরিচালিত করেছে।
ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার নিদর্শনগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলঃ
১. শরীয়াহ আঁকড়ে ধরা এবং কেবলমাত্র ইসলাম থেকেই নীতিমালা গ্রহণ করা
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের ব্যবস্থাপনার মূল শক্তির উৎস হল ইসলামী শরীয়াহ এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে এই শরীয়াহর সকল নীতিমালার প্রতি আনুগত্য, কারণ তালিবানরা কোন আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তি দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত নয় বা তাদের নিজস্ব কোন মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই; এই আন্দোলন এবং ইমারাতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ কোন দীর্ঘমেয়াদী ভোগদখল বা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতি থেকে সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ধারণ করা কোন জাতীয়তাবাদী আদর্শের ফলাফল নয়; এটি কোন আন্তর্জাতিক সামরিক জোটের সদস্যও নয় যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সুরক্ষা ও প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করতে পারবে বা এটি কোন উচ্চ প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত কোন বাহিনী নয় যারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ও শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের নিরাপত্তা ও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারবে। বরং সবাই দেখেছে কিভাবে এই ইমারাতের উত্থান থেকে শুরু করে এই পর্যায়ে উন্নীত হতে কি কি পর্যায় একে অতিক্রম করতে হয়েছে, তারা দেখেছে কিভাবে জিহাদি আদর্শে উজ্জীবিত প্রাক্তন আলেম ওলামা ও কমান্ডারদের নেতৃত্বে পরিচালিত ও কিছু জুনিয়র তালিবান (ছাত্র) যারা কেবল ধর্মীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কারণেই যোগদান করেছিল তাদের নিয়ে গঠিত একটি আত্মসচেতন ধর্মীয় আন্দোলন বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। দীর্ঘ বিষ বছরের সংগ্রামের ফলে এই আন্দোলন আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক পরিপক্কতা লাভ করেছে এবং তারা আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্তর্জাতিক সামরিক জোটের বিরুদ্ধে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি, ধৈর্য, সাহস ও শক্তির সাথে লড়াই করে তাদের লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য করেছে।
তালিবানের ধর্মীয় প্রতিপত্তির কারণে মুসলিম জাতি তাদের সমর্থন করেছে, তাদের উপহার দিয়েছে একটি নিষ্ঠাবান, স্বেচ্ছাসেবী ও আন্তরিক সেনাবাহিনী আর শত্রুর মোকাবিলায় তাদের আধ্যাত্মিক ও মানসিকভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে।
সুসময়ে-দুঃসময়ে শরীয়াহ আঁকড়ে ধরে থাকা, এর উপর ভিত্তি করে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সকল অনৈসলামিক মতবাদ এবং শরীয়াহ বিরোধী সকল রাষ্ট্রীয় আইন পরিত্যাগ, ইত্যাদি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তালিবান সারা বিশ্বের মুসলিমদের চোখে একটি বিশুদ্ধ ইসলামী প্রতীকে পরিণত করেছিল। সকল উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতিগুলোর কাছে তালিবান হয়ে উঠেছিল ইসলামী জাগরণের একটি মডেল যা ছিল সমসাময়িক কুফফার পরাশক্তিদের প্রভাবমুক্ত একটি ইসলামী সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার নীল নকশা সম্পন্ন।
সময়ের পরিক্রমায় বিংশ শতাব্দীতে অনেক সারা ইসলামী বিশ্বব্যাপী অনেক ইসলামী আন্দোলনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, কিন্তু আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য বিষাক্ত চেতনার মিশ্রণের কারণে কোনটাই নিজেদের ইসলামী চেতনা ধরে রাখতে পারেনি। ফলস্বরূপ তারা মুসলিমদের বিশ্বাস হারিয়ে রসাতলে গিয়েছিল, এবং গনতন্ত্রপন্থী, পশ্চিমাদের পক্ষপাতি, জাতীয়তাবাদী ও বিপথগামি দলে পরিণত হয়েছিল।
তালিবানদের ক্ষমতার মূল উৎস হল বিশুদ্ধ ইসলাম শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা, অন্যান্য সকল বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করা এবং যে ইসলামী নীতির জন্য তারা ১০ হাজার জীবন দিয়েছে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেওয়া; বিনিময়ে তারা খুবই অল্প রাজনৈতিক ও দুনিয়াবি ফায়দা লাভ করতে পেরেছে। যদি তারা অন্যান্য আদর্শ বা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো হতে কিছুমাত্র অনুপ্রেরণাও নিত তাহলে তাদের ভাগ্যও ঐসকল দলের মতই হত যারা কেবল নামে মাত্র ইসলামী দল কিন্তু তারা ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলোর সাথে গনতান্ত্রিক কাঠামোতে জোটবদ্ধ এবং যাদের কিছু অংশ সমগ্র ইসলামী বিশ্বব্যাপী মুজাহিদদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
২. জিহাদি সমাধানে বিশ্বাস ও শত্রুদের সাথে প্রীতির সম্পর্ক পুনর্গঠনে অস্বীকৃতি
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের আরেকটি নিদর্শন হল তাদের কাছে সত্যিকারের পরিবর্তন সাধনের একমাত্র উপায় হল জিহাদি সমাধান এবং সেই সাথে এই মহৎ কর্ম সম্পাদনের জন্য শিক্ষা ও দাওয়াহ, এই আন্দোলন কোনদিন অলস ভূমিকাও পালন করে নি এবং কোনদিন শত্রুকে কিছুমাত্র সুযোগ-সুবিধাও দেয়নি।
তলিবান মুসলিম বিশ্বে চলমান সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে; যতক্ষণ না পর্যন্ত আধিপত্য ও ক্ষমতা তাকওয়াবান ও সৎকর্মশীলদের হাতে না যাচ্ছে এবং ইসলামী সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততক্ষণ যথার্থ কোন পরিবর্তন আসবে না। এই বাস্তবতা রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এবং অন্যান্য বিখ্যাত নেতাদের জীবনী থেকেও উপলব্ধি করা সম্ভব যারা সত্যিকার পরিবর্তন এনেছিলেন। গত শতাব্দীতে অনেক আন্দোলন ও ইসলামী দল সশস্ত্র জিহাদ ত্যাগের মাধ্যমে তাদের আদর্শ, দাওয়াহ, রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনীতি ‘সংশোধন’ করতে চেয়েছিল যেন এর মাধ্যমে তারা পরিবর্তন আনতে পারে। বিভিন্ন সংস্থা তৈরি, বিভিন্ন জায়গায় তাদের লক্ষ লক্ষ সদস্য প্রেরণ, গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন, ধর্ম নিরপেক্ষ, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য পন্থীদের সাথে জোট গঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এবং তাদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় অপচয়; এতকিছুর পরও না তারা পেরেছে কোন পরিবর্তন সাধন করতে, না পেরেছে সমাজের সংশোধন করতে, উল্টো তারা নিজেরাই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ও গণতন্ত্রের বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা অনুনয় বিনুনয় ও অনুযোগের মাধ্যমে এই অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, বিদেশী কর্তৃত্বকে সংশোধন করে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল; কিন্তু এই পদ্ধতি এই ধরণের লোকদের যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক কারণ তারা বুলেট আর ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া অন্য কোন ভাষা বুঝে না।
যদিও তালিবান আদর্শিকভাবে সাইয়্যিদ কুতুবের চিন্তাধারার উত্তরাধিকারী নয়, কিন্তু সায়্যিদ কুতুবের সেই নীতিকে তারা বাস্তবে কাজে লাগিয়ে দেখিয়েছে যে নীতি অনুযায়ী – এই দুর্নীতিগ্রস্থ ও অশিক্ষিত সরকার ব্যবস্থার সাথে মিলেমিশে তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক কাঠামোতে কার্যক্রম পরিচালনা করে কখনোই যে তাদের সংশোধিত করা সম্ভব নয়, বরং এই সরকার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটন করে ও তাদের উচ্ছিষ্ট বর্জন করে এই ধ্বংসাবশেষের উপর ইসলামী বুনিয়াদ ও চিন্তা চেতনাসম্পন্ন নতুন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, কারণ এই সিস্টেম কোনদিনই সংশোধিত হবে না বা শরীয়াহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।
পরিবর্তন সাধনের জন্য দাওয়াহ ও জিহাদের ক্ষেত্রে তালিবান স্বাভাবিক ও নবুওয়্যাতের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল, তারা অভ্যন্তরীণ ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলোর সাথে সমন্বয়সাধনের সকল প্রচেষ্টাকে বর্জন করেছিল এবং অহংকারী আমেরিকার নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ক্রুসেডার জোটের সামনে মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল। তারা না নিজেদের নীতির সাথে আপোষ করেছিল, না শত্রুদের সাথে সমন্বয়সাধনের জন্য নিজদের নীতি ও পন্থা বিসর্জন দিয়েছিল। এবং তাদের এরুপ অবস্থানের কারণে আল্লাহ্* তাদের জিহাদে বরকত ঢেলে দিলেন এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অত্যাচারী শত্রুকে তাদের হাতে পরাজিত করলেন। তালিবানের রাজনৈতিক ও সামরিক বিচারবুদ্ধি প্রমাণ করেছিল যে মাদ্রাসা, মিম্বর আর মেহরাবের সন্তানেরা সেই সব বিদেশী শক্তির আয়ত্তাধীন ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও দলগুলোর চাইতেও বেশি বোধশক্তিসম্পন্ন যারা নিজদের আলোকিত দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা পাশ্চাত্য কুফরি ধ্যান ধারণার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, মুসলিম জাতিগুলোর আশা আকাঙ্খার সাথে তাদের অবস্থান বেমানান।
দাওয়াহ ও জিহাদের নবুওয়্যাতি পদ্ধতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও মুসলিম যুবসমাজকে ইসলামী পুনর্জাগরন ও স্বাধীনতার দিকে আহ্বান, তালিবান ও ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শন, যা অনেক জিহাদি আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে এরুপ আহ্বানের ফলে বাস্তবিকই অত্যাচারী শাসকদের ভিত নড়ে গেছে।
৩. প্রশস্ত ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত/পরিবারকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শন হল এই আন্দোলনের ধারা কোন নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী বা এলাকাতে সীমাবদ্ধ নয় এবং অন্যান্য সকলকে কম গুরুত্ব দিয়ে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় না।
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পশতুন, তাজিক, বেলুচ, উজবেক, নুরিস্তানি, পাশাই এবং অন্যান্য জাতির লোকদের সংমিশ্রণ এবং এই একটি বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের কারণে এই আন্দোলনের ধারা সমগ্র আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত কয়েক দশকে বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনেক সংগঠিত ইসলামী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটতে দেখা গেছে কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতার বণ্টন, ইসলামী ধ্যান ধারণার জায়গা দখল করে নিয়েছিল। এর ফলে এসব দল তাদের জনপ্রিয়তা হারায় এবং একসময় এসব দল ব্যক্তি ও পরিবারের অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল আমাদের প্রাক্তন জিহাদি দলগুলো এবং আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর কিছু ইসলামী দল।
যাই হোক, নিজেদের ক্রমবিকাশে তালিবান গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে, তারা কখনোই নিজেদের কোন নির্দিষ্ট জাতি বা কিছু নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সুযোগের দরজা সবার জন্য তারা উন্মুক্ত রেখেছে এবং জিহাদের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগের মাধ্যমে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের বিরুদ্ধে গত ১৪ বছর ধরে চলমান এই ভয়ংকর দীর্ঘ ও খাপখোলা যুদ্ধে অনেক মুজাহিদ ও নেতাদের শাহাদাত বরণ ও কারাদণ্ডের ফলেও তারা কোনদিন কোন ক্ষেত্রেই জনশক্তির স্বল্পতায় পড়েনি, তাৎক্ষণিক প্রতিস্থাপনের মত জনবল সবসময়ই প্রস্তুত ছিল। বাদাখশান থেকে হেলমান্দ এবং হেরাত থেকে নাঙ্গারহার পর্যন্ত কখনোই তারা জনশক্তিতে শুন্যতা অনুভব করেনি কারণ সবাই তাদেরকে তাদের অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মনে করত এবং কেউ কোন নির্দিষ্ট জাতি বা পরিবারকেই মুখ্য আর বাকিদের গৌণ মনে করত না।
৪. বিভেদ ও মতবিরোধের অনুপস্থিতি
আদর্শিক সম্পর্ক বজায় না রেখে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কারণে যেসব আন্দোলন এবং সংস্থা একসময় পিছু হটে এবং এর নেতৃস্থানীয়রা জনসাধারণের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়, সেসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ পরিণতির মূল কারণ হল বিভেদ ও মতবিরোধ। যাই হোক, এমনটা খুব কমই দেখা যায় যে একটি আন্দোলন নির্দিষ্ট কিছু ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে যখন নেতৃস্থানীয় লোকজনও জনসাধারণের মত ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে।
তালিবানের সাধারণ পদস্থ সৈনিকরা সর্বদাই অনুপ্রেরণা পেয়েছিল কারণ তাদের নেতৃস্থানীয়রা যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। একারনে তালিবানের প্রায় ৮০% নেতা হয়ত শরীরের কোন অঙ্গ হারিয়েছেন অথবা কোন পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন বা অনেক বছর জালিমের কারাগারে বন্দী থেকেছেন। সাধারনভাবেই নেতাদের এমন পরিস্থিতিতে দেখলে তাদের উপর অনুসারীদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে যায়।
তালিবানের একজন নেতা হওয়ার অর্থ ধন-সম্পদ ও কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া নয়, বরং নিজের জন্য মৃত্যু বা অন্ধকার কারাগারকে আমন্ত্রণ জানানো। এমনই যখন অবস্থা, তখন কেন নেতৃত্ব বা পদমর্যাদার জন্য কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত হবে?
তালিবানের শত্রুরা গত ২০ বছর ধরে অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে এসেছে তালিবান সৈন্যদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য কিন্তু কোনটাই ফলপ্রসূ হয়নি। সৈন্যদের এই ঐক্যের ফলে পার্থিব বিচারে ও সামরিকভাবে দুর্বল, মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী, দেশী-বিদেশী মিলিয়ে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্যের একটি সম্পূর্ণ সশস্ত্র বাহিনীকে পরাভূত করেছে।
তালিবান সৈন্যদের মধ্যে চিড় ও ফাটল ধরা তখনই সম্ভব যখন তারা জাতিগত, ধর্মীয় এবং পার্থিব বিভেদ গুলোকে প্রশ্রয় দেবে এবং জিহাদি নীতিমালার উপর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বকে প্রাধান্য দেবে।
৫. সকল রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডে ইসলামের সম্পৃক্ততা বিবেচনা
তালিবানের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শ হল সকল সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের সম্পৃক্ততা নিয়ে গভীর বিবেচনা; অর্থাৎ ন্যায়বিচার, আইনগত, নৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মত সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও ইসলামী নীতিসমূহের আলোকে পরিচালিত হয়। আমেরিকা ও পশ্চিমা কুফফারদের বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে তারা জিহাদ হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। তারা এই যুদ্ধকে রাজনৈতিক সংগ্রাম বা জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ হিসেবে কখনোই বিবেচনা করেনি; যদি তারা রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই ইসলামী নীতিমালার আলোকেই করেছে, আর যদি জনসাধারণ তাদের এই যুদ্ধকে বৈধতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই ইসলামের আলোকে এই যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে।
তালিবানদের জিহাদি প্রয়াস, যুদ্ধের অনুপ্রেরণা, রাজনৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষাদান, শত্রুদের সাথে আচরণ এবং অন্যান্য সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে বিদ্যমান সকল যুক্তিই দৃঢ় ইসলামী নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের সাথে এরুপ দৃঢ় সম্পর্কের কারণে আল্লাহ্* তাআলার রহমতে তারা নিজ জাতির মধ্যেই হাজার হাজার শাহাদাত পিয়াসি মুজাহিদদের সাহায্য পেয়েছে, দুয়া পেয়েছে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ থেকে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সাহায্য পেয়েছে।
সুতরাং যতদিন রাশিয়া ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদের ভিত্তি ছিল ইসলাম ততদিন মুসলিমরা একে জিহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল এবং সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করেছিল, কিন্তু যখন জিহাদি নেতারা ভুল রাজনৈতিক চাল, সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল তখন তারা তাদের ধর্মীয় প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলল এবং কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অনৈসলামিক দল ও সরকারব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক করেছিল। এসব কারণে আল্লাহ্* তাআলা শুধু তাদের ইসলামী সরকারব্যবস্থা গঠন করা থেকে বঞ্চিতই করলেন না বরং এই নেতারাই ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে একজোট হয়ে মাফিয়া, মিলিশিয়া, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং পাশ্চাত্য পন্থী দল হিসেবে কাজ করতে লাগল এবং নির্লজ্জের মতন মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডার জোটকে সাহায্য করল এবং পশ্চিমাদের হাতের পুতুলে পরিণত হল।
৬. যুদ্ধের সময়কার সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বসমূহ ভাগ করে দেওয়া
তালিবানদের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল যে তারা যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি খুব দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেছে যেন অরাজকতা ও দাঙ্গা-ফাসাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। বরং সুশৃঙ্খলভাবেই তারা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং স্থানীয় পরিস্থিতি খুব ভালভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে।
জনসাধারণের মাঝে কেউ যেন অবৈধ দল গঠন করে বা অস্ত্র হাতে নিয়ে এই অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে, তালিবান সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে এবং সামরিক-বেসামরিক সকল পরিস্থিতি একটি সুনিপুণ কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সংগ্রামটাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা প্রাদেশিক ও জেলাভিত্তিক শাসক, বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ, সামরিক অধিনায়ক, দলনেতা নিয়োগ করেছে, এবং তার চেয়েও বড় কথা হল কোন ভুল ত্রুটি হয়ে গেলে সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে তারা শুধু যুদ্ধটাকেই শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখেনি বরং বিশৃঙ্খলা, অন্যায়-অনাচার, অবৈধ দল ও অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত- এসবের কোনটাই যেন জনসাধারণের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাড়াতে পারে সে ব্যবস্থাও করেছিল।
এ কারণে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাসমূহের চেয়ে তালিবানদের স্বাধীন করা অঞ্চলগুলোতে শান্তি ও ন্যায়বিচার তুলনামূলক অনেক ভালভাবেই বহাল রয়েছে, তাই জনসাধারণও তাদের সকল আইনি ও বিচার সংক্রান্ত মামলা তালিবান আদালতেই নিয়ে যায়।
যদিও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তালিবানদের বিচার ব্যবস্থা অনুকরণীয় আদর্শ নয়, কিন্তু আমেরিকার হাতের পুতুল শাসক দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থার চেয়ে সবদিক দিয়েই তা হাজার গুনে ভালো।
অন্যান্য সকল আন্দোলনের মত আজকের তালিবানও জনসাধারণেরই এক গণজোয়ার। এর নিজস্ব কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি কিছু ত্রুটিও আছে যা ইনশাআল্লাহ্* সামনে লেখায় আমরা উল্লেখ করব। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, তালিবান অসাধারণ জ্ঞান ও সাহসের সাথে এক আন্তর্জাতিক পরাশক্তির মোকাবিলা করেছে এবং এইভাবে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক নীল নকশা তৈরি করে দিয়ে গেছে যা অন্যান্য সকল জাতিগুলোর জন্য অনুসরণীয়।
সূত্রঃ shahamat-english.com
(collected)
দেখে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানই আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নির্ধারিত সেই আস্তানা যেখানে সমসাময়িক কুফফার পরাশক্তিদের স্বভাবজাত ধ্বংসের সূত্রপাত ঘটেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত এখানেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের ও ধ্বংসের সূত্রপাত এখানেই এবং আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা কাফিরদের যে সম্মিলিত সামরিক শক্তি আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল, সমগ্র বিশ্ব আজ তাদের নাকানি চুবানি খাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করছে। ইসলামী ইমারাতের মুজাহিদদের কাছে পরাজিত হয়ে পশ্চিমা জোটের প্রায় সব পরাশক্তি যেমন আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি, স্পেন, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্যরা যুদ্ধের ময়দান থেকে নিজেদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে এবং পরাজয় স্বীকারের সাহসের অভাবে তারা এই প্রত্যাহারকেই নিজেদের অবলম্বন বানিয়েছে।
এই ১৩ বছর ধরে কিভাবে ইসলামী ইমারাত প্রচণ্ড শক্তিশালী এই সম্মিলিত সামরিক জোটের মোকাবিলা করেছে? দেশী-বিদেশী মিলিয়ে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্যের সম্পূর্ণ সশস্ত্র ও সুসজ্জিত এই বিশাল বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য কিভাবে তারা নিজেদের গোষ্ঠী ও সৈন্যদের প্রস্তুত করেছে? কিভাবে এই ইমারাত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে এবং নিজ সৈন্যদের মধ্যে জাতিভেদ ও বিক্ষোভকে স্থান না দিয়ে কিভাবে শক্তি ও সংহতির দিকে তাদের পরিচালিত করেছে? আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অশেষ রহমত ও সাহায্যে এই ইমারাতের একটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও সুচিন্তিত জিহাদি ব্যবস্থাপনা রয়েছে যা প্রতি পদে পদে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে মানসিক, সামরিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক এবং যুক্তিভিত্তিক প্রস্তুতি অর্জনে সহায়তা করেছে এবং এই অসম যুদ্ধের ফলাফল একটি প্রভাবশালী দলের বিরুদ্ধে পার্থিব বিচারে দুর্বল ও ক্ষতবিক্ষত একটি দলের অনুকূলে পরিচালিত করেছে।
ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার নিদর্শনগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলঃ
১. শরীয়াহ আঁকড়ে ধরা এবং কেবলমাত্র ইসলাম থেকেই নীতিমালা গ্রহণ করা
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের ব্যবস্থাপনার মূল শক্তির উৎস হল ইসলামী শরীয়াহ এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে এই শরীয়াহর সকল নীতিমালার প্রতি আনুগত্য, কারণ তালিবানরা কোন আন্তর্জাতিক সামরিক শক্তি দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত নয় বা তাদের নিজস্ব কোন মজবুত অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই; এই আন্দোলন এবং ইমারাতের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ কোন দীর্ঘমেয়াদী ভোগদখল বা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতি থেকে সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে ধারণ করা কোন জাতীয়তাবাদী আদর্শের ফলাফল নয়; এটি কোন আন্তর্জাতিক সামরিক জোটের সদস্যও নয় যার মাধ্যমে তারা নিজেদের সুরক্ষা ও প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করতে পারবে বা এটি কোন উচ্চ প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত কোন বাহিনী নয় যারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ও শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের নিরাপত্তা ও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারবে। বরং সবাই দেখেছে কিভাবে এই ইমারাতের উত্থান থেকে শুরু করে এই পর্যায়ে উন্নীত হতে কি কি পর্যায় একে অতিক্রম করতে হয়েছে, তারা দেখেছে কিভাবে জিহাদি আদর্শে উজ্জীবিত প্রাক্তন আলেম ওলামা ও কমান্ডারদের নেতৃত্বে পরিচালিত ও কিছু জুনিয়র তালিবান (ছাত্র) যারা কেবল ধর্মীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কারণেই যোগদান করেছিল তাদের নিয়ে গঠিত একটি আত্মসচেতন ধর্মীয় আন্দোলন বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। দীর্ঘ বিষ বছরের সংগ্রামের ফলে এই আন্দোলন আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক পরিপক্কতা লাভ করেছে এবং তারা আমেরিকার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্তর্জাতিক সামরিক জোটের বিরুদ্ধে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি, ধৈর্য, সাহস ও শক্তির সাথে লড়াই করে তাদের লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য করেছে।
তালিবানের ধর্মীয় প্রতিপত্তির কারণে মুসলিম জাতি তাদের সমর্থন করেছে, তাদের উপহার দিয়েছে একটি নিষ্ঠাবান, স্বেচ্ছাসেবী ও আন্তরিক সেনাবাহিনী আর শত্রুর মোকাবিলায় তাদের আধ্যাত্মিক ও মানসিকভাবে উৎসাহ প্রদান করেছে।
সুসময়ে-দুঃসময়ে শরীয়াহ আঁকড়ে ধরে থাকা, এর উপর ভিত্তি করে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সকল অনৈসলামিক মতবাদ এবং শরীয়াহ বিরোধী সকল রাষ্ট্রীয় আইন পরিত্যাগ, ইত্যাদি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য তালিবান সারা বিশ্বের মুসলিমদের চোখে একটি বিশুদ্ধ ইসলামী প্রতীকে পরিণত করেছিল। সকল উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতিগুলোর কাছে তালিবান হয়ে উঠেছিল ইসলামী জাগরণের একটি মডেল যা ছিল সমসাময়িক কুফফার পরাশক্তিদের প্রভাবমুক্ত একটি ইসলামী সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার নীল নকশা সম্পন্ন।
সময়ের পরিক্রমায় বিংশ শতাব্দীতে অনেক সারা ইসলামী বিশ্বব্যাপী অনেক ইসলামী আন্দোলনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, কিন্তু আদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং অন্যান্য বিষাক্ত চেতনার মিশ্রণের কারণে কোনটাই নিজেদের ইসলামী চেতনা ধরে রাখতে পারেনি। ফলস্বরূপ তারা মুসলিমদের বিশ্বাস হারিয়ে রসাতলে গিয়েছিল, এবং গনতন্ত্রপন্থী, পশ্চিমাদের পক্ষপাতি, জাতীয়তাবাদী ও বিপথগামি দলে পরিণত হয়েছিল।
তালিবানদের ক্ষমতার মূল উৎস হল বিশুদ্ধ ইসলাম শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে থাকা, অন্যান্য সকল বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করা এবং যে ইসলামী নীতির জন্য তারা ১০ হাজার জীবন দিয়েছে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেওয়া; বিনিময়ে তারা খুবই অল্প রাজনৈতিক ও দুনিয়াবি ফায়দা লাভ করতে পেরেছে। যদি তারা অন্যান্য আদর্শ বা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো হতে কিছুমাত্র অনুপ্রেরণাও নিত তাহলে তাদের ভাগ্যও ঐসকল দলের মতই হত যারা কেবল নামে মাত্র ইসলামী দল কিন্তু তারা ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলোর সাথে গনতান্ত্রিক কাঠামোতে জোটবদ্ধ এবং যাদের কিছু অংশ সমগ্র ইসলামী বিশ্বব্যাপী মুজাহিদদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
২. জিহাদি সমাধানে বিশ্বাস ও শত্রুদের সাথে প্রীতির সম্পর্ক পুনর্গঠনে অস্বীকৃতি
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের আরেকটি নিদর্শন হল তাদের কাছে সত্যিকারের পরিবর্তন সাধনের একমাত্র উপায় হল জিহাদি সমাধান এবং সেই সাথে এই মহৎ কর্ম সম্পাদনের জন্য শিক্ষা ও দাওয়াহ, এই আন্দোলন কোনদিন অলস ভূমিকাও পালন করে নি এবং কোনদিন শত্রুকে কিছুমাত্র সুযোগ-সুবিধাও দেয়নি।
তলিবান মুসলিম বিশ্বে চলমান সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে; যতক্ষণ না পর্যন্ত আধিপত্য ও ক্ষমতা তাকওয়াবান ও সৎকর্মশীলদের হাতে না যাচ্ছে এবং ইসলামী সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততক্ষণ যথার্থ কোন পরিবর্তন আসবে না। এই বাস্তবতা রাসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এবং অন্যান্য বিখ্যাত নেতাদের জীবনী থেকেও উপলব্ধি করা সম্ভব যারা সত্যিকার পরিবর্তন এনেছিলেন। গত শতাব্দীতে অনেক আন্দোলন ও ইসলামী দল সশস্ত্র জিহাদ ত্যাগের মাধ্যমে তাদের আদর্শ, দাওয়াহ, রাজনীতি, শিক্ষা ও অর্থনীতি ‘সংশোধন’ করতে চেয়েছিল যেন এর মাধ্যমে তারা পরিবর্তন আনতে পারে। বিভিন্ন সংস্থা তৈরি, বিভিন্ন জায়গায় তাদের লক্ষ লক্ষ সদস্য প্রেরণ, গণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন, ধর্ম নিরপেক্ষ, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য পন্থীদের সাথে জোট গঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এবং তাদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় অপচয়; এতকিছুর পরও না তারা পেরেছে কোন পরিবর্তন সাধন করতে, না পেরেছে সমাজের সংশোধন করতে, উল্টো তারা নিজেরাই ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ও গণতন্ত্রের বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তারা অনুনয় বিনুনয় ও অনুযোগের মাধ্যমে এই অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, বিদেশী কর্তৃত্বকে সংশোধন করে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল; কিন্তু এই পদ্ধতি এই ধরণের লোকদের যুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক কারণ তারা বুলেট আর ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া অন্য কোন ভাষা বুঝে না।
যদিও তালিবান আদর্শিকভাবে সাইয়্যিদ কুতুবের চিন্তাধারার উত্তরাধিকারী নয়, কিন্তু সায়্যিদ কুতুবের সেই নীতিকে তারা বাস্তবে কাজে লাগিয়ে দেখিয়েছে যে নীতি অনুযায়ী – এই দুর্নীতিগ্রস্থ ও অশিক্ষিত সরকার ব্যবস্থার সাথে মিলেমিশে তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক কাঠামোতে কার্যক্রম পরিচালনা করে কখনোই যে তাদের সংশোধিত করা সম্ভব নয়, বরং এই সরকার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটন করে ও তাদের উচ্ছিষ্ট বর্জন করে এই ধ্বংসাবশেষের উপর ইসলামী বুনিয়াদ ও চিন্তা চেতনাসম্পন্ন নতুন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, কারণ এই সিস্টেম কোনদিনই সংশোধিত হবে না বা শরীয়াহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।
পরিবর্তন সাধনের জন্য দাওয়াহ ও জিহাদের ক্ষেত্রে তালিবান স্বাভাবিক ও নবুওয়্যাতের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল, তারা অভ্যন্তরীণ ধর্ম নিরপেক্ষ দলগুলোর সাথে সমন্বয়সাধনের সকল প্রচেষ্টাকে বর্জন করেছিল এবং অহংকারী আমেরিকার নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ক্রুসেডার জোটের সামনে মাথা নত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল। তারা না নিজেদের নীতির সাথে আপোষ করেছিল, না শত্রুদের সাথে সমন্বয়সাধনের জন্য নিজদের নীতি ও পন্থা বিসর্জন দিয়েছিল। এবং তাদের এরুপ অবস্থানের কারণে আল্লাহ্* তাদের জিহাদে বরকত ঢেলে দিলেন এবং জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অত্যাচারী শত্রুকে তাদের হাতে পরাজিত করলেন। তালিবানের রাজনৈতিক ও সামরিক বিচারবুদ্ধি প্রমাণ করেছিল যে মাদ্রাসা, মিম্বর আর মেহরাবের সন্তানেরা সেই সব বিদেশী শক্তির আয়ত্তাধীন ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও দলগুলোর চাইতেও বেশি বোধশক্তিসম্পন্ন যারা নিজদের আলোকিত দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা পাশ্চাত্য কুফরি ধ্যান ধারণার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, মুসলিম জাতিগুলোর আশা আকাঙ্খার সাথে তাদের অবস্থান বেমানান।
দাওয়াহ ও জিহাদের নবুওয়্যাতি পদ্ধতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ও মুসলিম যুবসমাজকে ইসলামী পুনর্জাগরন ও স্বাধীনতার দিকে আহ্বান, তালিবান ও ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শন, যা অনেক জিহাদি আন্দোলনের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এবং অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে এরুপ আহ্বানের ফলে বাস্তবিকই অত্যাচারী শাসকদের ভিত নড়ে গেছে।
৩. প্রশস্ত ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত/পরিবারকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শন হল এই আন্দোলনের ধারা কোন নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী বা এলাকাতে সীমাবদ্ধ নয় এবং অন্যান্য সকলকে কম গুরুত্ব দিয়ে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় না।
তালিবান আন্দোলন ও ইসলামী ইমারাতের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পশতুন, তাজিক, বেলুচ, উজবেক, নুরিস্তানি, পাশাই এবং অন্যান্য জাতির লোকদের সংমিশ্রণ এবং এই একটি বিশুদ্ধ বৈশিষ্ট্যের কারণে এই আন্দোলনের ধারা সমগ্র আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত কয়েক দশকে বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনেক সংগঠিত ইসলামী আন্দোলনের উদ্ভব ঘটতে দেখা গেছে কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতার বণ্টন, ইসলামী ধ্যান ধারণার জায়গা দখল করে নিয়েছিল। এর ফলে এসব দল তাদের জনপ্রিয়তা হারায় এবং একসময় এসব দল ব্যক্তি ও পরিবারের অধিকারভুক্ত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল আমাদের প্রাক্তন জিহাদি দলগুলো এবং আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর কিছু ইসলামী দল।
যাই হোক, নিজেদের ক্রমবিকাশে তালিবান গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে, তারা কখনোই নিজেদের কোন নির্দিষ্ট জাতি বা কিছু নির্দিষ্ট পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং সুযোগের দরজা সবার জন্য তারা উন্মুক্ত রেখেছে এবং জিহাদের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগের মাধ্যমে তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের বিরুদ্ধে গত ১৪ বছর ধরে চলমান এই ভয়ংকর দীর্ঘ ও খাপখোলা যুদ্ধে অনেক মুজাহিদ ও নেতাদের শাহাদাত বরণ ও কারাদণ্ডের ফলেও তারা কোনদিন কোন ক্ষেত্রেই জনশক্তির স্বল্পতায় পড়েনি, তাৎক্ষণিক প্রতিস্থাপনের মত জনবল সবসময়ই প্রস্তুত ছিল। বাদাখশান থেকে হেলমান্দ এবং হেরাত থেকে নাঙ্গারহার পর্যন্ত কখনোই তারা জনশক্তিতে শুন্যতা অনুভব করেনি কারণ সবাই তাদেরকে তাদের অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মনে করত এবং কেউ কোন নির্দিষ্ট জাতি বা পরিবারকেই মুখ্য আর বাকিদের গৌণ মনে করত না।
৪. বিভেদ ও মতবিরোধের অনুপস্থিতি
আদর্শিক সম্পর্ক বজায় না রেখে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কারণে যেসব আন্দোলন এবং সংস্থা একসময় পিছু হটে এবং এর নেতৃস্থানীয়রা জনসাধারণের রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়, সেসব আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ পরিণতির মূল কারণ হল বিভেদ ও মতবিরোধ। যাই হোক, এমনটা খুব কমই দেখা যায় যে একটি আন্দোলন নির্দিষ্ট কিছু ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে যখন নেতৃস্থানীয় লোকজনও জনসাধারণের মত ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে।
তালিবানের সাধারণ পদস্থ সৈনিকরা সর্বদাই অনুপ্রেরণা পেয়েছিল কারণ তাদের নেতৃস্থানীয়রা যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। একারনে তালিবানের প্রায় ৮০% নেতা হয়ত শরীরের কোন অঙ্গ হারিয়েছেন অথবা কোন পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন বা অনেক বছর জালিমের কারাগারে বন্দী থেকেছেন। সাধারনভাবেই নেতাদের এমন পরিস্থিতিতে দেখলে তাদের উপর অনুসারীদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে যায়।
তালিবানের একজন নেতা হওয়ার অর্থ ধন-সম্পদ ও কল্যাণ লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া নয়, বরং নিজের জন্য মৃত্যু বা অন্ধকার কারাগারকে আমন্ত্রণ জানানো। এমনই যখন অবস্থা, তখন কেন নেতৃত্ব বা পদমর্যাদার জন্য কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত হবে?
তালিবানের শত্রুরা গত ২০ বছর ধরে অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করে এসেছে তালিবান সৈন্যদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য কিন্তু কোনটাই ফলপ্রসূ হয়নি। সৈন্যদের এই ঐক্যের ফলে পার্থিব বিচারে ও সামরিকভাবে দুর্বল, মাত্র কয়েক হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী, দেশী-বিদেশী মিলিয়ে প্রায় ৬ লক্ষ সৈন্যের একটি সম্পূর্ণ সশস্ত্র বাহিনীকে পরাভূত করেছে।
তালিবান সৈন্যদের মধ্যে চিড় ও ফাটল ধরা তখনই সম্ভব যখন তারা জাতিগত, ধর্মীয় এবং পার্থিব বিভেদ গুলোকে প্রশ্রয় দেবে এবং জিহাদি নীতিমালার উপর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বকে প্রাধান্য দেবে।
৫. সকল রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডে ইসলামের সম্পৃক্ততা বিবেচনা
তালিবানের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি নিদর্শ হল সকল সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের সম্পৃক্ততা নিয়ে গভীর বিবেচনা; অর্থাৎ ন্যায়বিচার, আইনগত, নৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মত সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও ইসলামী নীতিসমূহের আলোকে পরিচালিত হয়। আমেরিকা ও পশ্চিমা কুফফারদের বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে তারা জিহাদ হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। তারা এই যুদ্ধকে রাজনৈতিক সংগ্রাম বা জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ হিসেবে কখনোই বিবেচনা করেনি; যদি তারা রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই ইসলামী নীতিমালার আলোকেই করেছে, আর যদি জনসাধারণ তাদের এই যুদ্ধকে বৈধতার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে তবে তা অবশ্যই ইসলামের আলোকে এই যুদ্ধের ন্যায্যতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে।
তালিবানদের জিহাদি প্রয়াস, যুদ্ধের অনুপ্রেরণা, রাজনৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষাদান, শত্রুদের সাথে আচরণ এবং অন্যান্য সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে বিদ্যমান সকল যুক্তিই দৃঢ় ইসলামী নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামের সাথে এরুপ দৃঢ় সম্পর্কের কারণে আল্লাহ্* তাআলার রহমতে তারা নিজ জাতির মধ্যেই হাজার হাজার শাহাদাত পিয়াসি মুজাহিদদের সাহায্য পেয়েছে, দুয়া পেয়েছে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ থেকে বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক সাহায্য পেয়েছে।
সুতরাং যতদিন রাশিয়া ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমাদের জিহাদের ভিত্তি ছিল ইসলাম ততদিন মুসলিমরা একে জিহাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল এবং সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করেছিল, কিন্তু যখন জিহাদি নেতারা ভুল রাজনৈতিক চাল, সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছিল তখন তারা তাদের ধর্মীয় প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলল এবং কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অনৈসলামিক দল ও সরকারব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক করেছিল। এসব কারণে আল্লাহ্* তাআলা শুধু তাদের ইসলামী সরকারব্যবস্থা গঠন করা থেকে বঞ্চিতই করলেন না বরং এই নেতারাই ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে একজোট হয়ে মাফিয়া, মিলিশিয়া, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং পাশ্চাত্য পন্থী দল হিসেবে কাজ করতে লাগল এবং নির্লজ্জের মতন মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডার জোটকে সাহায্য করল এবং পশ্চিমাদের হাতের পুতুলে পরিণত হল।
৬. যুদ্ধের সময়কার সকল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বসমূহ ভাগ করে দেওয়া
তালিবানদের জিহাদি ব্যবস্থাপনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল যে তারা যুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি খুব দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করেছে যেন অরাজকতা ও দাঙ্গা-ফাসাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। বরং সুশৃঙ্খলভাবেই তারা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং স্থানীয় পরিস্থিতি খুব ভালভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছে।
জনসাধারণের মাঝে কেউ যেন অবৈধ দল গঠন করে বা অস্ত্র হাতে নিয়ে এই অশান্ত পরিস্থিতির সুযোগ নিতে না পারে, তালিবান সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে এবং সামরিক-বেসামরিক সকল পরিস্থিতি একটি সুনিপুণ কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সংগ্রামটাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা প্রাদেশিক ও জেলাভিত্তিক শাসক, বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ, সামরিক অধিনায়ক, দলনেতা নিয়োগ করেছে, এবং তার চেয়েও বড় কথা হল কোন ভুল ত্রুটি হয়ে গেলে সরাসরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসবের মাধ্যমে তারা শুধু যুদ্ধটাকেই শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখেনি বরং বিশৃঙ্খলা, অন্যায়-অনাচার, অবৈধ দল ও অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত- এসবের কোনটাই যেন জনসাধারণের ক্ষতির কারণ না হয়ে দাড়াতে পারে সে ব্যবস্থাও করেছিল।
এ কারণে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাসমূহের চেয়ে তালিবানদের স্বাধীন করা অঞ্চলগুলোতে শান্তি ও ন্যায়বিচার তুলনামূলক অনেক ভালভাবেই বহাল রয়েছে, তাই জনসাধারণও তাদের সকল আইনি ও বিচার সংক্রান্ত মামলা তালিবান আদালতেই নিয়ে যায়।
যদিও অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তালিবানদের বিচার ব্যবস্থা অনুকরণীয় আদর্শ নয়, কিন্তু আমেরিকার হাতের পুতুল শাসক দ্বারা পরিচালিত ব্যবস্থার চেয়ে সবদিক দিয়েই তা হাজার গুনে ভালো।
অন্যান্য সকল আন্দোলনের মত আজকের তালিবানও জনসাধারণেরই এক গণজোয়ার। এর নিজস্ব কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি কিছু ত্রুটিও আছে যা ইনশাআল্লাহ্* সামনে লেখায় আমরা উল্লেখ করব। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, তালিবান অসাধারণ জ্ঞান ও সাহসের সাথে এক আন্তর্জাতিক পরাশক্তির মোকাবিলা করেছে এবং এইভাবে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য এক নীল নকশা তৈরি করে দিয়ে গেছে যা অন্যান্য সকল জাতিগুলোর জন্য অনুসরণীয়।
সূত্রঃ shahamat-english.com
(collected)
Comment