“ফিলিস্তিনের স্মৃতি ”
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – নবম পর্ব
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – নবম পর্ব
ইসলাম প্রতিরক্ষামূলক ধর্ম নয়
যাঁরা এই দীনের সম্পর্কে লিখেছেন, বর্তমান সময়ে নিপীড়িত মুসলিম বংশধরদের জিহাদের স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে লিখেছেন—যদিও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বহন করেন, তবু তাঁরা লিখেছেন—এই ধর্ম প্রতিরক্ষামূলক ধর্ম! হায়, এই ধর্ম কীসের প্রতিরক্ষা করবে?! এই দীন কি আরব ভূখণ্ডকে রক্ষা করবে না-কি আরব উপদ্বীপকে রক্ষা করবে! কীসের প্রতিরক্ষা করবে? যদি তাঁরা বলেন, এই দীন রক্ষা করে মানুষকে এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ও নীতিমালাকে তাহলে তো কথা নেই। কিন্তু যদি বলেন, এই দীন কোনো ভূখন্ডের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা তাহলে তাদের এটা কেমন জ্ঞান! আফসোস তাদের এই জ্ঞানের প্রতি! যদি রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দীনকে প্রতিরক্ষামূলক মনে করতেন, যদি হযরত আবু বকর ও উমর রা. এই দীনকে প্রতিরক্ষামূলক মনে করতেন, তাহলে তাঁরা যে কিসরা ও কায়সারের রাজত্বকে ছিন্নভিন্ন করার জন্যে, তাদের সিংহাসনকে টুকরো-টুকরো করার জন্যে অবিরাম সৈন্যদল প্রেরণ করেছেন, কেনো করেছেন? এসবের অর্থ কী? হযরত উসমান ও আলী রা. এবং পরবর্তী সময়ে উমাইয়া ও আব্বাসিয়া শাসকগণ যে ধারাবহিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় বিরাট বিরাট সেনাদল প্রেরণ করেছেন সেগুলোর অর্থ কী? হযরত উসমান রা.-এর খেলাফতের সময় আরমেনিয়া ও আজারবাইজানে এবং ককেশাস পর্বত থেকে ইউরোশিয়া পর্যন্ত যে সেনাদল প্রেরণ করা হয়েছে তাঁরা কীসের প্রতিরক্ষা করেছেন? কোন জিনিস রক্ষার জন্যে তাঁরা জিহাদ করেছেন? হিজরি পঁচিশ সাল থেকে নিয়ে তাঁরা রাশিয়াকে জয় করছিলেন না-কি নিজেদের প্রতিরক্ষা করছিলেন? তাঁরা কি তখন আরব উপদ্বীপের প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন? হায় হায়! যাঁরা জিহাদ সম্পর্কে লিখেছেন তাঁরা যদি জিহাদের অর্থ বুঝতেন! জিহাদের স্বভাব-প্রকৃতি যদি তাঁদের বোধগম্য হতো! জিহাদের চরিত্র সম্পর্কে যদি তাঁদের জ্ঞান থাকতো!
অবশ্যই আমাদেরকে জিহাদের পাঠ এমনভাবে নিতে হবে যেনো আমরা আমাদের দীনের স্বভাব-প্রকৃতি সম্পর্কে বলতে লজ্জাবোধ না করি। কুণ্ঠা যেনো আমাদের কণ্ঠরোধ না করে এবং ভীরুতা যেনো আমাদের দুর্বল করে না দেয়। আমরা আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে ওয়াদা করেছি— আমরা মানবিকতার কল্যাণে শহীদ হবো। আমাদের রব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
“তিনি তাঁর রাসুলকে হেদায়েত ও সত্যদীনসহ প্রেরণ করেছেন সকল দীনের ওপর তাকে বিজয়ী করার জন্যে, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।' [সুরা সাফ : আয়াত ৯]
আল্লাহপাক আমাদেরকে আদেশ দিয়ে বলেছেন—
فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَغَفُورٌ رَحِيمٌ
'নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদেরকে বন্দি করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্যে ওত পেতে থাকবে। কিন্তু তারা যদি তওবা করে, সালাত আদায় করে এবং যাকাত দেয় তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' [সুরা তওবা : আয়াত ৫]
সকল মানবের মুক্তির জন্যে এই দীনের আবির্ভাব ঘটেছে। তাহলে কীভাবে এই দীন প্রতিরক্ষামূলক হবে? তা কি মক্কার ভূমিকে প্রতিরক্ষা করবে না-কি মদিনার ভূমিকে প্রতিরক্ষা করবে না-কি আরব উপদ্বীপকে প্রতিরক্ষা করবে? যাঁরা আমার এই বক্তব্যের বিরোধিতা করতে চান তাঁদের উচিত হবে এই দীনের স্বভাব-প্রকৃতি বোঝা এবং আমাদের নেতা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর 'পথ'কে জানা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন—
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، مَا مِنْ كَلْمٍ يُكْلَمُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلَّا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَهَيْئَتِهِ حِينَ كُلِمَ، لَوْنُهُ لَوْنُ دَمٍ، وَرِيحُهُ مِسْكٌ، وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَوْلَا أَنْ يَشُقَّ عَلَى الْمُسْلِمِينَ مَا قَعَدْتُ خِلَافَ سَرِيَّةٍ تَغْزُو فِي سَبِيلِ اللهِ أَبَدًا، وَلَكِنْ لَا أَجِدُ سَعَةً فَأَحْمِلَهُمْ، وَلَا يَجِدُونَ سَعَةً، وَيَشُقُّ عَلَيْهِمْ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنِّي، وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَوَدِدْتُ أَنِّي أَغْزُو فِي سَبِيلِ اللهِ فَأُقْتَلُ، ثُمَّ أَغْزُو فَأُقْتَلُ، ثُمَّ أَغْزُو فَأُقْتَلُ
'যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ সেই সত্তার শপথ, আল্লাহর পথে যে-পরিমাণ যখম হবে, কিয়ামতের দিন সেই পরিমাণ যখম নিয়ে উপস্থিত হবে; তার রং হবে রক্তের এবং ঘ্রাণ হবে মিসকের। যাঁর হাতে মুহম্মদের প্রাণ সেই সত্তার শপথ, আমি যদি মুসলমানদের ব্যাপারে আশঙ্কা না করতাম তাহলে আমি কখনো আল্লাহর পথে লড়াইকারী কোনো দলের পেছনে থেকে যেতাম না। কিন্তু সবার জন্যে সওয়ারি সরবরাহ করতে পারছি না। তাদের নিজেদেরও সওয়ারি সংগ্রহ করার সামর্থ্য নেই। আমার সঙ্গে জিহাদের অংশগ্রহণ না করা তাদেরকে পীড়া দেয়। যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ সেই সত্তার শপথ, আমি খুবই আকাঙ্ক্ষা করি যে আল্লাহর পথে লড়াই করি এবং নিহত হই। আবার লড়াই করি এবং নিহত হই। এবং আবার লড়াই করি এবং নিহত হই।[1]
হযরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন—
إِنَّ الله زَوَى لِي الْأَرْضَ فَرَأَيْتُ مَشَارِقَها وَمَغَارِبَهَا وإِن أُمَّتِي سَيَبْلُعُ مُلْكُهَا مَا زُوِيَ لِي مِنْهَا، وَأُعْطِيتُ الْكَنْزَيْنِ الأَحْمَرَ والأَصْفَرَ، وَإِنِّي سَأَلْتُ رَبِّيَ لِأُمَّتِي أَنْ لَا يُهْلِكَهَا بِسَنَةٍ عَامَّةٍ، وَأَنْ لا يُسَلَّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوا مِنْ سِوَى أَنْفُسِهِمْ فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ، وَإِنَّ رَبِّيَ قَالَ:يا محمد إِنِّي إِذا قَضَيْتُ فَضَاءً فإنّهُ لا يُرَد، وإنّي أَعْطَيْتُكَ لِأُمِّتِكَ أَنْ لَا أَهْلِكَهُمْ بِسَنَةٍ عَامَّةٍ أَسَلَّطَ عَلَيْهِمْ عَدُوا من سِوَى أَنْفُسِهِمْ فَيَسْتَبِيحَ بَيْضَتَهُمْ، وَلَوْ اجْتَمَعَ عَلَيْهِمْ مَنْبِأَقْطَارِهَا
“নিশ্চয় আল্লাহপাক আমার জন্যে জমিনের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্ত বিস্তৃত করে দিয়েছেন। আমার জন্যে আল্লাহপাক যেই পর্যন্ত ভূমিকে বিস্তৃত করেছেন সেই পর্যন্ত আমার উম্মতের রাজত্ব পৌঁছাবে। আমাকে দুটি ভাণ্ডার দেয়া হয়েছে; তার একটি লাল, অপরটি হলুদ। আমি আমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করেছি যে তিনি যেনো আমার উম্মতকে মহামারী দিয়ে ধ্বংস না করেন এবং তাদের ওপর যেনো বহিঃশত্রু চাপিয়ে না দেন, ফলে তাদের শক্তি লুপ্ত হয়, যদিও তারা চারদিক দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।[2] তেমনি তিনি আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—
لَيَبْلُغَنَّ هَذَا الْأَمْرُ مَا بَلَغَ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَلَا يَتْرُكُ اللهُ بَيْتَ مَدَرٍ وَلَا وَبَرٍ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ هَذَا الدِّينَ بِعِزٍّ عَزِيزٍأَوْ بِذُلٍّ ذَلِيلٍ عِزًّا يُعِزُّ اللَّهُ بِهِ الْإِسْلَامَ وَذُلًّا يُذِلُّ اللَّهُ بِهِ الْكُفْرَ '
যেখানে রাতের শেষ আছে এবং দিনের শুরু আছে সেখান পর্যন্ত এই দীন পৌছাবে। নগরে বা গ্রামে কোনো ঘর অবশিষ্ট থাকবে না যে-ঘরে আল্লাহপাক সম্মানিতকে সম্মান করার মাধ্যমে এবং হীনকে লাঞ্ছিত করার মাধ্যমে এই দীন প্রবেশ করাবেন না। সেই সম্মানের দ্বারা দীনে-ইসলাম সম্মানিত হবে এবং লাঞ্ছনার দ্বারা কুফর লাঞ্ছিত হবে। [3]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, আমরা রোমকে শাসন করবো। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, 'দুইটি শহরের কোনটি আগে বিজিত হবে; কনস্টান্টিনোপ্ল না-কি রোম?' তিনি উত্তর করলেন, 'বরং হিরাক্লিয়াসের শহর (বাইজানটাইন) প্রথমে বিজিত হবে।' বাইজানটাইন ৮৫৭ হিজরিতে বিজিত হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহে অবশ্যই একদিন রোম বিজিত হবে।
অবশিষ্ট রাখে নি; আল্লাহর জন্যেও নয়। এই দীন এসেছে ইসলামি দাওয়াতকে সামনে রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে। এই ইসলামি দাওয়াত সকল মানবের জন্যে। শয়তানদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয় তারা আপনাকে দীন পৌঁছে দেয়ার জন্যে আহ্বান করবে। সুতরাং জিহাদ সেইসব রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতাকে দূর করবে যেগুলো আল্লাহর এই দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর এই দীন সব মানুষের কাছে পেশ করা হবে। যার ইচ্ছা ঈমান গ্রহণ করবে আর যার ইচ্ছা কুফরি করবে। আর আমরা চাই, আমাদের তরবারি ধারণ করা এবং সিংহরূপে আবির্ভূত হওয়া ব্যতীত প্রত্যেক মানুষ যেনো এই দীন গ্রহণ করে। এটা ভ্রান্তিবিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এই ভ্রান্তিবিলাসিতা তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা বাস করে আরামদায়ক অট্টালিকায় এবং বিভোর থাকে স্বপ্ন ও সুখনিদ্রায় ।
জিহাদ ছাড়া অবস্থা আমাদের অনুকূলে আসবে না এবং জিহাদ ব্যতীত সূর্যের নিচে আমাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে না। সশস্ত্র লড়াই ছাড়া বিশ্বমানবের কাছে আমাদের কোনো ওজন থাকবে না। তাদের অন্তরে আমাদের কোনো মূল্য থাকবে না। আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন—
فَقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ لَا تُكَلِّفُ إِلَّا نَفْسَكَ وَحَرِّضِ الْمُؤْمِنِينَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَكُفَّ بَأْسَ الَّذِينَ كَفَرُوا وَاللَّهُ أَشَدُّ بَأْسًا وَأَشَدُّ تَنْكِيلًا
সুতরাং আল্লাহর পথে লড়াই করো; তোমাকে শুধু তোমার নিজের জন্যে দায়ী করা হবে এবং তুমি মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করো। হয়তো আল্লাহ কাফেরদের শক্তি সংযত করবেন। আল্লাহ শক্তিতে প্রবলতর এবং শাস্তিদানে কঠোরতর। [সুরা নিসা আয়াত ৮৪]
আল্লাহপাক তাঁর রাসুলকে লড়াইয়ে আদেশ দিয়েছেন এমনকি তিনি একা হলেও, এবং তিনি তাঁকে আরেকটি আদেশ দিয়েছেন তা হলো— আপনি কাফেরদের শক্তি প্রতিহত করার জন্যে মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করুন। সুতরাং কিতাল বা লড়াই হলো কাফেরদের শক্তি সংযত করার জন্যে এবং তাদের দাপটকে খর্ব করার জন্যে; এই লড়াই তাদের মানসিকতাকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে এবং তাদের প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার জন্যে, যাতে আমরা গোটা দুনিয়ার বুকে সকল মানুষের কাছে রাসুল-নির্দেশিত রহমত নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিতে পারি।
[1] সহিহ মুসলিম: হাদিস ১৮৭৬ : কানযুল উম্মাল হাদিস ১০৬৪০; মুসনাদে আহমদ : হাদিস ৭১৫৭।
[2] সহিহ মুসলিম: হাদিস ২০০৯; সুনানে তিরমিযি : হাদিস ২২০৪;
[3] মুসনাদে আহমাদ : হাদিস ১৬৯৫৭, ১৬৯৯৮, কানযুল উম্মাল : হাদিস ১৩৪৫
আরও পড়ুন
অষ্টম পর্ব