“ফিলিস্তিনের স্মৃতি ”
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – সপ্তদশ পর্ব
।।শহীদ ড. আবদুল্লাহ আযযাম রহ. ||
এর থেকে – সপ্তদশ পর্ব
টাকার বিনিময়ে ফিলিস্তিনের ভূমি বিক্রয়
ফিলিস্তিনের ভূমি বণ্টনের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখে। ব্রিটেন ফিলিস্তিনে এজেন্ট নিয়োগ করেছিলো। তারা তাদেরকে নিজেদের ভূমি ত্যাগ করতে উৎসাহিত করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রিটেন তাদেরকে তাদের জন্যে নির্ধারিত ভূমি প্রদান করে। ১৯৪৮ সালে ১৫ই মে ব্রিটিশ এজেন্সির (ব্রিটিশ ম্যান্ডেট) মেয়াদ শেষ হয়। ইংরেজরা ইহুদিদেরকে বা আরবদেরকে তাদের চুক্তি অনুযায়ী ভূমি প্রদান করে। ১৯৪৮ সালে ১৫ই মে ব্রিটিশরা যখন ফিলিস্তিন থেকে বেরিয়ে আসে তখন ইহুদিদের ভূমির পরিমাণ ৩ মিলিয়ন একরের বেশি ছিলো না। ফিলিস্তিনের মোট ভূমির পরিমাণ ছিলো ২৭ মিলিয়ন একর। এই ভূমি তারা কীভাবে পেলো? সাধারণভাবে এই অপবাদ দেয়া হয়ে থাকে যে, ফিলিস্তিনি জাতি তাদের ভূমি বিক্রি করে দিয়েছে। আমি আপনাদেরকে সংখ্যা উল্লেখ করে বলতে চাই ইহুদিরা কীভাবে এই ভূমির মালিক হলো। তুরস্কের খেলাফত ব্যবস্থার শেষের দিকে কমিটি অব ইউনিয়ন এ্যান্ড প্রগ্রেস'-এর যেসব তুর্কি নেতা সুলতানকে অপসারিত করেছিলো, ইহুদিরা তাদের থেকে ঘুষ হিসেবে পেয়েছে ৬ লাখ ৫০ হাজার একর ভূমি। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের পক্ষ থেকে ইহুদি এজেন্সি (Jewish Agency) বিনা পয়সায় পেয়েছে ৩ লাখ একর ভূমি। বিটিশ সরকারের প্রতিনিধি কর্তৃপক্ষ প্রতীকী মূল্যে জুইশ এজেন্সির কাছে বিক্রি করেছে ২ লাখ একর ভূমি। দুই খ্রিস্টান আর্চবিশপ ও তাদের পরিবার বিক্রি করেছে মারজ ইবনে আমের এলাকার ৪ লাখ একর ভূমি। সুলতান আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে উপঢৌকনের নামে ব্রিটেন ইহুদিদেরকে প্রদান করে হুলা ও বিসান অঞ্চলের ৬৫ হাজার একর ভূমি। তাইয়ান আল-বয়রুতির পরিবার ইহুদিদের কাছে বিক্রি করে আল- হাওয়ারেস উপত্যকার ৩২ হাজার একর ভূমি। সিরিয়া ও লেবাননের তাইয়ান আল-বয়রুতি, কুব্বানি, আল জাযায়েরি পরিবার এবং খ্রিস্টান আর্চবিশপ পরিবার বিক্রি করে তুলেকারাম, জানিন ও বিসান অঞ্চলের ২৮ হাজার একর ভূমি। বিশ্বাসঘাতকতা করে ফিলিস্তিনের কিছু মুনাফিক ইহুদিদের কাছে বিক্রি করে ৩ লাখ একর ভূমি। এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এরা মুজাহিদ ও বিদ্রোহীদের হাতে হত্যা ও জবাইয়ের শিকার হয়। ব্রিটিশরা ১৫ই মে ফিলিস্তিন থেকে বেরিয়ে আসার আগের দিনগুলোতে ইহুদি এজেন্সিকে দিয়ে দেয় ১ মিলিয়ন ৪ লাখ ২৫ হাজার একর ভূমি। সব মিলিয়ে ইহুদিরা সাড়ে ৩ মিলিয়ন একর ভূমির মালিক হয়।
এরপর ইংরেজ জেনারেল গ্লুব পাশার (Lieutenant General Sir John Bagot Glubb) নেতৃত্বে সাতটি আরব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে। তারা ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে ৯ মাস অবস্থান করে। হায়, এরা যদি ফিলিস্তিনে প্রবেশ না করতো? এই নয় মাসে ইহুদিরা কী নিয়েছে? আল-লুদ ও রামাল্লা থেকে নিয়েছে ৯ লাখ ৫০ হাজার একর ভূমি পূর্বজালিলি ও পশ্চিমজালিলি থেকে নিয়েছে ২ মিলিয়ন একর ভূমি; আশ-শোনা, রুদাস ও মানাতিকে খলিল থেকে নিয়েছে ১ মিলিয়ন ৬ লাখ ৭৫ হাজার একর ভূমি; নাকাব মরুভূমি ও রণকৌশলগত এলাকা থেকে নিয়েছে ১২ মিলিয়ন ৭ লাখ একর ভূমি। আরব সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশের পর ইহুদিরা মোট দখল করে সাড়ে ১৭ মিলিয়ন একর ভূমি। আগের সাড়ে ৩ মিলিয়ন আর এই নয় মাসে দখলকৃত সাড়ে ১৭ মিলিয়ন—মোট ২১ মিলিয়ন একর ভূমি ইহুদিরা দখল করে। ফিলিস্তিনিদের জন্যে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ৬ মিলিয়ন একর ভূমি।
আরব সেনাবাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতা
ফিলিস্তিনিরা কী করেছে? ফিলিস্তিনিরা প্রতিরোধ করেছে। পরে আরব সেনারা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে তাদেরকে বলে, তোমরা প্রতিরোধ-লড়াই ত্যাগ করো। আমরাই তোমাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করবো। ফলে ফিলিস্তিনিরা ধোঁকা খেয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। আমি আমার বাবাকে একটি বন্দুকের গল্প বলতে শুনেছি। তিনি বন্দুকটি কেনার জন্যে জানিন থেকে উত্তর আলেপ্পোতে গিয়েছিলেন এবং একশো স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বন্দুকটি কিনেছিলেন।
ফিলিস্তিনের মুসলমানেরা ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪৮ বা ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত প্রতিরোধ-লড়াই করেছে। তারপর আরব সেনাবাহিনী আল-লুদ ও রামাল্লায় প্রবেশ করে। আপনারা আল-লুদ ও রামাল্লায় ছয়মাসে যা ঘটেছিলো তার দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করুন এবং গ্রহণ করুন। ফিলিস্তিনিরা সবসময় সেখানে সতর্ক পাহারায় থাকতো। নারীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাহারায় থাকতো আর পুরুষরা সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত পাহারায় থাকতো। কোনো ইহুদি আল-লুদ ও রামাল্লার ধারেকাছে যাওয়ারও সুযোগ পায় নি।
আল-লুদ ও রামাল্লা এলাকা দুটি লম্বায় ৪৮ কিলোমিটার। জেনারেল গ্লুব পাশার অনুগামী হয়ে ইংরেজ কমান্ডার মিস্টার ল্যাস-এর নেতৃত্বে জর্ডানের সেনাবাহিনীর একশো পঞ্চাশ জন সৈনিক আল-লুদ ও রামাল্লায় প্রবেশ করে এবং কমান্ডার ল্যাস তাদেরকে ৪৮ কিলোমিটারব্যাপী বণ্টন করে দেন। প্রত্যেক এক কিলোমিটারে থাকবে তিনজন সৈনিক আর তাদের সবার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকবেন দুইজন কর্মকর্তা। শেষে একদিন অস্ত্রবিরতি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর চাপ প্রয়োগের ফলে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশ প্রতিনিধিদল ফিলিস্তিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একমাস পর ১৯৪৮ সালের জুন মাসে এই চুক্তি ফিলিস্তিনি জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তারপর কী ঘটে? ইহুদিরা চেকোস্লোভাকিয়া থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশে যেসব ইহুদি ছিলো তাদেরকে নিয়ে আসে। তারা নিজেদের সঙ্গে অন্যদের শক্তির সমতা নিরূপণের চেষ্টা করে। অবশেষে একদিন—চুক্তির সময়সীমার ভেতরেই—ইহুদিরা আল-লুদ ও রামাল্লায় হামলা করে বসে। মাত্র দুই ঘণ্টায় তারা রামাল্লা ও আল-লুদ দখল করে নেয়। হ্যাঁ, মাত্র দুই ঘণ্টায়! আরব সৈনিকরা ফিলিস্তিনে প্রবেশের সময় এই ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো যে, কেউ যদি অস্ত্র বা গোলাবরুদ বহনকারী কোনো ফিলিস্তিনিকে পায় সে যেনো তাকে ধরে মার্শাল কোর্টে উপস্থিত করে। তাকে মার্শাল কোর্টে ফাঁসি দেয়া হবে। আরব যুবকেরা ক্রোধে জ্বলে ওঠে। মিশরের ইসলামি আন্দোলনের সত্তর জন যুবক একটি বিমানে ওঠে এবং ফিলিস্তিনে প্রবেশের জন্যে আম্মানে আসে। জেনারেল গ্লুব পাশা বিমানটিকে আম্মান ত্যাগ করে সরাসরি কায়রোতে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়। যুবকদের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলা হয়। রাজা ফারুক[1] তাদের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে।
[1] ইনি মিসরের সর্বশেষ রাজা প্রথম ফারুক। ১৯৩৬ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে তাঁর পিতা রাজা প্রথম ফুয়াদের স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৩৭ সালের ২৯ জুলাই ফারুকের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁর চাচা আমির মুহাম্মদ আলি ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফারুক প্রথমে জনপ্রিয় থাকলেও স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড ও ভোগ-বিলাসে মত্ত হওয়ার পর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং গণবিরোধিতা দেখা দেয়। ১৯৫২ সালে জেনারেল মুহাম্মদ নাজিবের নেতৃত্বে সেনা-অভ্যুত্থানের ফলে রাজা ফারুকের পতন ঘটে এবং এ-বছরের ১৬ই জুলাই তিনি ইউরোপে নির্বাসিত হন। ফারুক ১৯২০ সালে কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ সালে রোমে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে মিসরের ভূমিতে দাফন করার দাবি জানানো হলে সরকার তা মেনে নেয়। ফারুকের প্রথম স্ত্রী সাফিনাজ ফুল ফাকার এবং দ্বিতীয় স্ত্রী নারিমান সাদেক। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে একমাত্র সন্তান আহমদ ফুয়াদ।
আরও পড়ুন
ষষ্ঠদশ পর্ব