তুফানুল আকসা: দখলদার ইহুদিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এক অনন্য অধ্যায়

আল ফিরদাউসের সম্পাদক মুহতারাম ইবরাহীম হাসান হাফিযাহুল্লাহ’র কলাম:
আজ, ৭ অক্টোবর ২০২৫। ইসলামের ইতিহাসের পৃষ্ঠা খুললেই এই তারিখটি লাল আগুনের অক্ষরে লেখা থাকবে- ‘তুফানুল আকসা’। দুই বছর আগে আজকের এই দিনে, দখলদার ইসরায়েলের অবরোধ, জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের হামাসের সামরিক শাখা “আল-কাসসাম ব্রিগেড” এর মুজাহিদিনরা এক বজ্রঘাতের মতো আঘাত হেনেছিলেন দখলদারের মসনদে। আল-কাসসাম ব্রিগেডের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সেই অভিযান শুধুমাত্র একটি সামরিক পদক্ষেপ ছিল না; এটি ছিল শতাব্দীর দুঃখ, জুলুম নিপীড়ন, আর রক্তাক্ত ইতিহাসের প্রতিবাদ। তুফানুল আকসা ছিল ফিলিস্তিনের মাজলুমদের হৃদয় থেকে উঠে আসা এক গর্জন—“আমরা গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ নয়, তাওহীদের ভূমিতে স্বাধীনতায় বাঁচতে চাই”।
ফিলিস্তিন—একটি নাম, যা শুধু মানচিত্রের একটি ভূখণ্ড নয়, বরং রুখে দাঁড়ানো মাজলুম মুসলিম জাতির এক অনন্য নজির। ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই ভূমি রক্তে রঞ্জিত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের দখলে। তারপর থেকে এই অঞ্চলে জন্ম নেয়নি কোনো মুক্ত সকাল, বরং প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিরা দেখে নতুন ধ্বংস, নতুন শোক, নতুন কবর।
ইসরায়েল শুধু ভূমি দখল করেনি—তারা দখল করেছে এক জাতির স্বপ্ন, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ। পশ্চিম তীরে এখন ৬ লক্ষাধিক ইহুদি সেটলার অবৈধ বসতি গড়ে তুলেছে; ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ভেঙে, তাদের জমি দখল করে, তাদেরই নিজ ভূমিকে টুকরো টুকরো দ্বীপে পরিণত করেছে।
গাজা—যেন একটি উন্মুক্ত কারাগার। ২০০৭ সাল থেকে অবরোধে থাকা এই ভূখণ্ডে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ বেঁচে আছে অকল্পনীয় দুঃসহ জীবনে। খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ, পানি—সবই সীমিত, প্রায় অস্তিত্বহীন। শিশুরা জন্মায় এক যুদ্ধক্ষেত্রে, বড় হয় ধ্বংসস্তূপের পাশে, ঘুমাতে যায় ড্রোনের গুঞ্জনে। হাসপাতালের ইনকিউবেটরে বিদ্যুৎ না থাকায় নবজাতকের মৃত্যু এখন নিত্যদিনের সংবাদ। অথচ, কথিত সভ্য পৃথিবী নীরব—অন্ধ, বধির, নির্বিকার।
সন্ত্রাসী ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গাজা এখন এক ছাইভস্ম নগরী। শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি গণহত্যা, একটি জাতিকে মুছে ফেলার পরিকল্পিত অভিযান। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি যখন পশ্চিমা শক্তির পূজা করে, তখন মানবতার আর্তনাদ হারিয়ে যায় কূটনীতির করিডোরে।
ঠিক সেই অন্ধকারের মধ্যেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের মুজাহিদিনরা ঝড় তোলে—‘তুফানুল আকসা’। হামাসের সামরিক শাখা “আল-কাসাম ব্রিগেডস” যখন দখলদার ইসরায়েলের সীমান্ত অতিক্রম করে, হাজারো রকেট ছুঁড়ে, তখন এই বধির বিশ্ব হতবাক হয়ে দেখে—যে জাতিকে দশক ধরে নিঃশেষ করতে চাওয়া হয়েছে, তারা এখনও জীবিত, এখনও লড়তে জানে। এটি ছিল ফিলিস্তিনের মুক্তির হুঙ্কার, আল-আকসার সম্মান রক্ষার আহ্বান, আর ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে জিহাদের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।
তুফানুল আকসা দেখিয়েছিল—অবরোধ দিয়ে মুজাহিদিনদের জিহাদের তামান্না কে বন্দি করা যায় না। ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে গাজার মুজাহিদরা এক সুসংগঠিত অভিযানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল, প্রতিরোধ শুধু গোলা-বারুদের শক্তি নয়; এটি তাওহীদ ও কুরবানীর লড়াই।
আজ দুই বছর পরও সেই আগুন নিভে যায়নি। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মুজাহিদিনরা প্রতিনিয়ত জিহাদের বায়াত নিচ্ছে। দখলদারদের প্রতিটি আঘাতে নিভে যাওয়ার বদলে তারা স্বাধীনতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গে জেগে উঠছে।
তুফানুল আকসা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—যে জাতির বুকের মধ্যে তাওহীদের আগুন জ্বলে, যারা দখলদারদের গোলামিতে বাঁচতে চায় না, আল-আকসার ভালোবাসা যাদের হৃদয়ে জ্বলে, তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। দখলদারের নিপীড়ন যতই দীর্ঘ হোক, একদিন না একদিন মুক্তির ভোর আসবেই ইনশাআল্লাহ।
Comment