ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে পাকিস্তানের প্রোপাগান্ডার খণ্ডন -(২)

আল ফিরদাউসের সম্পাদক মুহতারাম ইবরাহীম হাসান হাফিযাহুল্লাহ’র কলাম:
আফগানিস্তানের ধূলিময় পাহাড় থেকে উঠে আসা সেই অদম্য চেতনা, যা বিশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কথিত সুপার পাওয়ার আমেরিকা ও ন্যাটোর সেনাবাহিনীকে লজ্জাজনকভাবে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে—আজ সেই চেতনা ইসলামী ইমারতের রূপে দাঁড়িয়ে আছে। এটি কোনো সাধারণ বিজয় নয়; এটি আল্লাহর রহমতে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের পুনর্জন্ম, যা শুধু আফগান মুসলিমদের নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে। কল্পনা করুন, একদা বিশ্বের সুপারপাওয়াররা যে দেশটিকে দখল করে রাখতে চেয়েছিল, আজ সেই দেশ এশিয়ার মানচিত্রে এক নতুন শক্তির উদয় ঘটাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, এই ইমারত একদিন পরাশক্তির মর্যাদায় পৌঁছে যাবে, যা উম্মাহর স্বার্থ রক্ষার জন্য এক অটুট দুর্গ হয়ে দাঁড়াবে।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে যুদ্ধে সহযোগিতা করা কিংবা কাফেরদের মতাদর্শ গ্রহণ করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কুরআনুল কারিমের ভাষায় এগুলো হল মুয়ালাত, তথা, কাফেরদের সঙ্গে মিত্রতা, অন্তরঙ্গতা, ও কাফেরদের নিকট পরাধীনতা। গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম গ্রহণ করে নেওয়ার মাধ্যমে এবং আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার মাধ্যমে পাকিস্তান এই নিষিদ্ধ কাজগুলো করেছে এবং করে যাচ্ছে। অন্যদিকে কাফেরদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ। ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান এই বৈধ কাজটুকুই করছে। কোনো মুসলিমের বিরুদ্ধে কখনোই তারা কোনো কাফেরকে সাহায্য করেন নি, এটা তাদের ইতিহাসেই নেই, বরং এটা তাদের রেডলাইন যা তারা কখনোই অতিক্রম করেন না। এরপরেও পাকিস্তান সরকার এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত লোকজন প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে আফগানিস্তানকে দালালির মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।
খুব বেশিদিন হয়নি, ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখনো বৈশ্বিকভাবে তারা অবরোধের শিকার। একটা আত্মনির্ভরশীল ইসলামী রাষ্ট্রও যদি কাফেরদের সাথে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখে-সেটাই শরিয়তে বৈধ। সেখানে অবরোধের শিকার একটা রাষ্ট্র তো বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার ক্ষেত্রে রীতিমত “জরুরত” তথা অপারগতার শিকার। মুসলিম জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করার জন্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরিয়তেও যেহেতু বিষয়টা নিষিদ্ধ নয় তাই ইয়ারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান এই অপশন গ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিককালে ইমারতে ইসলামিয়া তাদের কূটনৈতিক জাল বিস্তার করার চেষ্টা করছে বিশ্বের বিভিন্ন কোণে। রাশিয়া, চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে, যা আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক বন্ধন গড়ে উঠছে, যা ইসলামী ইমারতকে আরও শক্তিশালী করবে। এটি কোনো অস্থায়ী প্রচেষ্টা নয়; এটি ইসলামি ইমারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার এবং বিশ্ব দরবারে ইসলামী রাষ্ট্রের মজবুত অবস্থান তৈরি করার একটি সচেতন যাত্রা। কাফেরদের সাথে মুয়ামালাত-ব্যবসা-বাণিজ্য জায়েজ হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলে কখনোই একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকা সম্ভব হবেনা।
এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর ২০২৫-এ, যখন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ইমারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহ নয়াদিল্লিতে পা রাখলেন। এটি ছিল ২০২১ সালের পর প্রথম এমন উচ্চপদস্থ সফর, যা জাতিসংঘের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা অস্থায়ীভাবে শিথিল করে সম্ভব হয়েছে। মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহ রাশিয়া থেকে সরাসরি দিল্লি উড়ে এলেন, এবং এই সাত দিনের সফরে (৯-১৬ অক্টোবর) তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করলেন, গেলেন দারুল উলুম দেওবন্দে। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য? দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করা। ভারত কাবুলে তাদের দূতাবাস পুনরায় খুলবে বলে ঘোষণা করেছে, এবং আফগান শুষ্ক ফলের রপ্তানি, স্বাস্থ্যসেবা, বন্দর সুবিধা—এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এই সফর দক্ষিণ এশিয়ায় ইমারতে ইসলামিয়ার প্রভাব বিস্তারের এক মাইলফলক। ইসলামী বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ভারতীয় উপমহাদেশে আফগানিস্তানের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে, যা উম্মাহর স্বার্থে একটি কৌশলগত লাভ। ভারতের মতো একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা মানে আফগান মুসলিমদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ, এই উপমহাদেশে ইমারতে ইসলামিয়ার নেতাদের নীতি নির্ধারক হওয়ার সম্ভাব্য উপায় – যা হয়তো দূর ভবিষ্যতে হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা নির্যাতিত মুসলিমদের পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে ইনশাআল্লাহ। এবং ইমারতে ইসলামিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে সফর করেছেন, বিভিন্ন আলোচনা করছেন— কোনো দালালি বা গোলামির মাধ্যমে নয়, বরং মাথা উঁচু করে, ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করে। মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহ’র সঙ্গে ভারতীয় নেতা ও সাংবাদিকদের বৈঠকেও ইসলাম-সম্পর্কিত বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে উম্মাহর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে।
কিন্তু ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, কোন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রের শাসকেরা কোন কাফের রাষ্ট্রে সফর করলে তারা নিজেরা নিজেদের কাফেরদের কাছে নতজানু তে বিলিয়ে দেয়। আর ইমারতে ইসলামিয়ার সফর হয়েছে মাথা উঁচু করে।
কিন্তু এই চিত্রের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে একটা কালো ছায়া—পাকিস্তানের নোংরা প্রোপাগান্ডা। মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহ’র সফরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি মিডিয়া ও তাদের সমর্থকরা শুরু করেছে একটা নির্লজ্জ অভিযান: ইমারতে ইসলামিয়াকে “ভারতের দালাল” বলে চিহ্নিত করা! এটি কি হাস্যকর নয়? যারা নিজেরাই উম্মাহর সঙ্গে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আজ আফগানিস্তানের স্বাধীন কূটনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা গল্প: পাকিস্তান কথিতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার “উম্মাহর প্রতিনিধি”, আর আফগানিস্তান ভারতের পক্ষপাতী! কিন্তু বাস্তবতা? পাকিস্তানের এই প্রোপাগান্ডা সফরের সময়কালে গাদ্দার পাকিস্তান আফগানিস্তানে বোমা হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তানের ইতিহাস- উম্মাহর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার এক দীর্ঘ দাস্তান! তাদের সামরিক বাহিনী, যার জন্ম ব্রিটিশ উপনিবেশের নোংরা গর্ভ থেকে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে ও ফিলিস্তিনে ব্রিটিশদের পক্ষে লড়াই করেছে উসমানী খিলাফার বিরুদ্ধে। সেই বাহিনী আজও আমেরিকার ইশারায় চলছে। তারা পাকিস্তানে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে! কাদিয়ানি বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে মুসলিমদের উপর নির্মম হামলা—সবই তাদের হাতে। আফগানিস্তানে আমেরিকার ২০ বছরের যুদ্ধে তারা তালেবানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে, শীর্ষস্থানীয় আলেমদের গুপ্তহত্যা করেছে, ওয়াজিরিস্তানে আমেরিকার নির্দেশে গণহত্যা চালিয়েছে যাতে শত শত নারী-শিশু মারা গেছে।
আর আজও এই অত্যাচার থামেনি। কাবায়েলি অঞ্চলে বোমা হামলায় নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, আর সাম্প্রতিককালে ফিলিস্তিনের সমর্থনে, পাকিস্তানে টিএলপি নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে প্রাণঘাতী হামলায় বিক্ষোভকারীদের কয়েকজনকে হতাহত করেছে।
পাকিস্তান নিজেদের মুসলিমদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে বুলি ঝরালেও ভারতীয় মুসলিমদের জন্য তারা কখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আর আজ তারা তালেবানকে “ভারতের এজেন্ট” বলে! অথচ ইমারতে ইসলামিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিমদের হারানো খিলাফাহ পুনরুদ্ধারের জন্য, আরকান থেকে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর থেকে উইঘুর, আফ্রিকা থেকে লেবানন-সিরিয়ার মাজলুম উম্মাহকে মুক্ত করার জন্য। যার শাসক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্মচারী পর্যন্ত উম্মাহর মুক্তিতে নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাশ্মীর, উইঘুর কিংবা আরব-দুনিয়ার যে যেখান থেকে নির্যাতিত হয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন, তালেবানরা তাদের সবাইকেই সম্মানের সাথে আশ্রয় দিয়েছেন। কখনোই কোনো মুসলিমকে তারা কাফেরদের হাতে তুলে দেননি।
অন্যদিকে পাকিস্তান ডক্টর আফিয়া সিদ্দিকাসহ শত শত মুসলিম নারী-পুরুষকে কাফেরদের হাতে তুলে দিয়েছে।অথচ এই জালিম পাকিস্তান – যাদের হাত অগণিত মুসলিম-মুজাহিদের খুনে রঞ্জিত হয়ে আছে! আজ এই জালিমরাই ইমারতে ইসলামিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে! তারা ইসলামী ইমারতের ক্ষতির নেশায় বিভোর হয়ে আছে।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায়, এই অন্ধকার ফুরিয়ে আসবে। ইমারতে ইসলামিয়ার এই সাহসী পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের আলো দেখাচ্ছে। পাকিস্তানের জুলুমের দেনা একদিন মুসলিমদের হাতেই শোধ হবে—আজ না হয় কাল। আফগানিস্তানের এই যাত্রা উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করুক।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইমারতে ইসলামিয়াকে শক্তিশালী করুন। আমীন।
Comment