
আল ফিরদাউস এর সম্পাদক মুহতারাম ইবরাহীম হাসান হাফিযাহুল্লাহ’র কলাম:
কাশ্মীরের কান্না, পাকিস্তানের নিষ্ঠুর নীরবতা — উম্মাহর প্রতি এক ঘৃণ্য দ্বিচারিতা
কাশ্মীরের মাটি রক্তে ভেজা, আকাশে শুধু আর্তনাদের প্রতিধ্বনি। দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে কাশ্মীরি মুসলিমদের স্বপ্ন, ইজ্জত, আর জীবন। নারীর সম্ভ্রম লুট হচ্ছে, শিশুদের হাসি ছিনতাই হচ্ছে, বৃদ্ধদের চাপা কান্নার আওয়াজ গুলির শব্দে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এই অমানবিক অত্যাচারের মুখে, যে প্রশ্নটি উম্মাহর বুক চিরে ওঠে, তা একটাই—পাকিস্তান কোথায়? কোথায় সেই দেশ, যারা নিজেদের কাশ্মীরের ‘অভিভাবক’ বলে দাবি করে?
পাকিস্তানের রাজপথে ‘কাশ্মীর দিবস’ পালিত হয়, কথিত জাতিসংঘে ফাঁপা বক্তৃতা দেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবতা? বাস্তবতা হলো, কাশ্মীরের রক্তাক্ত মাটির পাশে পাকিস্তানের শাসকরা দাঁড়ায় না— তারা ব্যস্ত থাকে পশ্চিমা প্রভুদের তোষামোদে, ডলারের পাহাড় গুনতে। যখন কাশ্মীরের আকাশ লাল হয়ে ওঠে মুসলিমদের রক্তে, ইসলামাবাদে শোনা যায় শুধু কূটনৈতিক বিবৃতির ফিসফিস আর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ফাঁকা আওয়াজ।
১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান ভারতের সাথে যে কয়টি যুদ্ধে কাশ্মীরের নামে লড়েছে বলে দাবি করে, সেগুলো আসলে কী ছিল? এই যুদ্ধগুলো কাশ্মীরিদের মুক্তির জন্য ছিল না, ইসলামের পতাকা উড্ডীন করতেও ছিল না। এগুলো ছিল রাজনৈতিক খেলা, কূটনৈতিক স্বার্থ হাসিলের মঞ্চ। কাশ্মীরি মুসলিমদের রক্ত আর কান্নাকে পাকিস্তান ব্যবহার করেছে তাদের ক্ষমতার দাবা-খেলার ট্রাম কার্ড হিসেবে। এটাও মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধগুলোতে পাকিস্তান আর্মির একক অবদান ছিলনা, বরং কাবায়েল সহ পুরো পাকিস্তানের জিহাদী জনতা এবং জিহাদী সংগঠনগুলো ব্যপক অবদান রেখেছে। মুজাহিদিনরা চেয়েছিলেন এই জিহাদের ধারা অব্যাহত রাখতে, কিন্তু পাকিস্তান যখন তার রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করে ফেলেছে-তখন কাশ্মীরের মুজাহিদদেরকে ভয়াবহ ভাবে দমন করেছে, কাশ্মীর জিহাদকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
কাশ্মীর জিহাদের জন্য নিবেদিত মাওলানা মাসউদ আজহারকে পাকিস্তান সরকারই গৃহবন্দী করে রেখেছে। অথচ তিনি এবং তার জামাত কখনোই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেননি। তার দলকে কাশ্মীরে জিহাদ করতে বারবার বাঁধাগ্রস্ত করেছে এই পাকিস্তানি আর্মিই। কাশ্মীর জিহাদের আরেক মহানায়ক কমান্ডার ইলিয়াস কাশ্মীরী রহিমাহুল্লাহকে কারাগারে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতন করেছে পাকিস্তানি আর্মিই। বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন সাংবাদিক সেলিম শেহজাদের লেখা বই, যেটা বাংলায় অনুদিত হয়েছে “আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায়” নামে ।
যখন কাশ্মীর জিহাদের জন্য নিবেদিত মাওলানা মাসউদ আজহার ভারতের জেলে বন্দী ছিলেন, তার সংগঠনের মুজাহিদরা তার মুক্তির জন্য ভারতের একটা যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। আকাশে থাকা অবস্থায় মুজাহিদরা বিমানটিকে যখন দুনিয়ার কোনো দেশের মাটিতে নামানোর অনুমতি পাচ্ছিলেন না, কিংবা নিরাপদ বোধ করছিলেন না-তখন সেই বিমানকে পাকিস্তানের সেক্যুলার সরকার অভ্যর্থনা জানায়নি, বরং ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের মাটিতেই অবতরণ করে। এবং ইমারতে ইসলামিয়্যাহ আফগানিস্তানের সহযোগিতায় ভারত সরকারের সাথে দরকষাকষি করে বিমানের যাত্রীদের মুক্তির বিনিময়ে মাওলানা মাসউদ আজহারকে মুক্ত করা হয়।
আজকে সেই ইমারতকে বলা হচ্ছে ইন্ডিয়ার দালাল, আর পাকিস্তানকে বলা হচ্ছে কাশ্মীরের ত্রাণকর্তা!! ন্যরেটিভের নামে এমন জোকস তৈরি করা কেবল বেইনসাফ লোকদের পক্ষেই সম্ভব…।
পাকিস্তানের হাতে আজ শত শত পারমাণবিক অস্ত্র, উন্নত যুদ্ধবিমান, আর গোয়েন্দা প্রযুক্তি। কিন্তু এই শক্তি কার জন্য? উম্মাহর জন্য নয়। এই অস্ত্রগুলো তাক করা হয়েছে নিজেদের দেশের মাটিতে ইসলামের পক্ষে কথা বলা মুজাহিদদের দিকে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাওহিদের পতাকাবাহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
আফগানিস্তানে যখন মার্কিন ড্রোন মুসলিম গ্রামগুলো ধ্বংস করছিল, তখন পাকিস্তানের আকাশসীমা, সামরিক ঘাঁটি, আর গোয়েন্দা তথ্য ছিল আমেরিকার হাতে। শত শত নিরীহ মুসলিম নারী, শিশু, বৃদ্ধ, আর যুবক এই ড্রোন হামলায় শহীদ হয়েছে—যাদের রক্তের দাগ আজও পাকিস্তানের মাটিতে শুকোয়নি। আরও দুঃখের বিষয়, এই হামলার কিছু ঘটেছে পাকিস্তানের নিজস্ব ভূখণ্ডে—ওয়াজিরিস্তান, বেলুচিস্তান, খাইবারে। অর্থাৎ, পাকিস্তানের শাসকরা তাদের নিজেদের মুসলিম নাগরিকদের আকাশ থেকে হত্যা করতে দিয়েছে, শুধু প্রভু আমেরিকার হুকুম পালন করতে!
সাম্প্রতিক সময়েও পাকিস্তানের এই বিশ্বাসঘাতকতার ধারা অব্যাহত। তারা আফগানিস্তানের নিরীহ মুসলিমদের ওপর বোমা হামলা চালিয়েছে, অসংখ্য আফগান মুসলিমের রক্ত ঝরিয়েছে। আফগানিস্তানের ইসলামী ইমারত ধ্বংস করার জন্য তারা আমেরিকার ঘৃণ্য ও সম্পূর্ণ ইসলাম-বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। ইমারতে ইসলামিয়া যখন উম্মাহর স্বার্থে নিজেদের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করছে এবং সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমেরিকা আফগানিস্তানের ইসলামী ইমারত ধ্বংস করার হীন ষড়যন্ত্রে বাগরাম ঘাঁটি দাবি করে। তালেবান মুজাহিদিনরা বাগরাম ঘাঁটি এবং আফগানিস্তানের কোনো বিষয়ে আমেরিকাকে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করায়, আমেরিকা তাদের পালিত কুকুর পাকিস্তানকে লেলিয়ে দিয়েছে। আর পাকিস্তানও প্রভুর দায়িত্ব পালন করতে ইমারতে ইসলামিয়াতে বোমা হামলা চালিয়ে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে শহীদ করেছে। শুধু তাই নয়, তালিবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহর ভারত সফরকেও কেন্দ্র করে তারা মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, যদিও বাস্তবিক অর্থে ভারতের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আর পদক্ষেপ নিবেই বা কেন..! এটা তো তাদের প্রভু আমেরিকা কর্তৃক কোন এজেন্ডায় থাকে না!
“যদি কোনো মুসলমান অত্যাচারের শিকার হয়, তবে সমগ্র উম্মাহ তার পাশে দাঁড়াবে”—এই পবিত্র নীতি পাকিস্তানের শাসকদের কাছে একটি ফাঁকা কথা। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান—সবখানেই তারা লোকদেখানো মুখে প্রতিবাদ করে, কিন্তু হৃদয়ে পশ্চিমা দাসত্বের শৃঙ্খল বহন করে। তাদের রাজনীতি ইসলামের নয়—এ হলো স্বার্থ, ক্ষমতা, আর পশ্চিমা প্রভুদের সন্তুষ্টির রাজনীতি।
যদি পাকিস্তান সত্যিই ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের আদর্শে চলত, তাহলে তাদের সেনাবাহিনী জালিমের পক্ষে নয়, মজলুমের পাশে দাঁড়াত। কিন্তু বাস্তবে ইসলামাবাদ আজ শুধুই প্রাসাদ, চুক্তি, আর রাজনৈতিক নাটকের শহর। সেখানে কাশ্মীরের কান্না পৌঁছায় না।
পাকিস্তানের শাসকদের এই বিশ্বাসঘাতকতা শুধু কাশ্মীরের নয়, পুরো উম্মাহর প্রতি এক নির্মম প্রতারণা। তাওহিদের পতাকা যখন উড্ডীন হবে, তখন তা পাকিস্তানের ডলারের গোলামির হাতে নয়—ইমারতে ইসলামিয়ার মুজাহিদিনদের হাতেই উড্ডীন হবে ইনশাআল্লাহ।
পড়ুন-
তাওহিদের পতাকা বনাম ডলারের গোলামী: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ- (১)
তাওহিদের পতাকা বনাম ডলারের গোলামী: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ- (২)
Comment