দ্বীনের বিধানগুলো মানার ক্ষেত্রে কি আমরা আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি?
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে যিনি আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ভালো-মন্দের মালিক, যাঁর কাছে আমাদের সব চাওয়া, যাঁর জন্যে আমাদের ভালোবাসা, একমাত্র যাঁর ওপরই আমাদের ভরসা। শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর; তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবাগণ এবং যারা তাঁদের অনুসারী তাঁদের উপর।
আমরা প্রত্যেকে অন্তরে ঈমান ধারণ করি। সে অর্থে আমরা সবাই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি। কারণ তাওয়াক্কুল ঈমানের একটি অপরিহার্য অংশ। তাওহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একমাত্র আল্লাহর ওপর ঈমান আনার মানে একমাত্র তাঁর ওপর ভরসা করা। ভরসা মানে এ নয় যে, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁকে মানি। কিন্তু যখন দুঃখ বা পরীক্ষা আসে; তখন দূরে সরে যাই। ভরসা মানে এই যে, সব সময়ই তাঁকে ভালোবাসা। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করা। কারও রক্ত চক্ষুকে পরোয়া না করা।
তাওয়াক্কুল কী?
শাব্দিকভাবে তাওয়াক্কুল অর্থ ভরসা করা, নির্ভর করা। এ শব্দটি الوكالة থেকে নির্গত হয়েছে। অর্থাৎ সকল ব্যাপার আল্লাহর প্রতি ন্যস্ত করে তাঁর ওপর ভরসা করা। যে তাওয়াক্কুল করে তাকে বলা হয় মুতাওয়াক্কিল। সুতরাং মুতাওয়াক্কিল মুমিনের অপর আরেকটি নাম।
মুমিন ব্যক্তি যখন কোন বিপদে আক্রান্ত হয়; তখন সে তার রবের আশ্রয় নিয়ে বিষয়টি তাঁর প্রতি ন্যস্ত করে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু। তাঁর রহমতের চেয়ে অধিক আর কারো রহমত হতে পারে না। তিনিই সব কিছু করতে সক্ষম। অন্য কেউ নয়। তিনিই হেদায়েত দাতা । আর বান্দা যখন বুঝবে এবং এই বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা। তিনিই সব কিছু পরিচালনা করেন। আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া মাখলুক কারো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না, তখন তার অন্তর শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত হবে। তার সকল কাজ আল্লাহর জন্যেই হবে। ফলে সে কোন মাখলুকের পরোয়া না করে একমাত্র আল্লাহর কাছেই আশ্রয় প্রার্থী হবে এবং তাঁকেই ভয় করবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবে না।
কার ওপর তাওয়াক্কুল?
পূর্ব যুগের মুশরিকদের যখন জিজ্ঞাসা করা হতো, এ আসমান জমিন কার বানানো? তারা বলতো, আল্লাহর বানানো। কিন্তু তাদের মুশরিক বলা হয় কেন? আসমান জমিনের সৃষ্টিকর্তা কে? এর জবাবে আল্লাহর নাম বললেও কেন তারা মুসলমান হিসেবে গণ্য হয়নি? কারণ তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করতো না। আর এই একত্ববাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তাওয়াক্কুল। ঐ সব মুশরিকরা দেব-দেবীর ওপর ভরসা করতো। জ্ঞানের জন্যে এ দেবী, ধন-সম্পদের জন্যে এ দেবতা এমনই ছিল তাদের বিশ্বাস! এখনো আমাদের আশেপাশে এমন মানুষ কম নয়, যারা দেব-দেবীর পূজা করছে আর তাদের ওপরই আস্থা রাখছে। আবার কেউ মাজার-কবর, পীর পূজা করছে এবং তাদের ওপরই ভরসা করছে!
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলেন-
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ
“আর তোমরা ভরসা করো পরাক্রমশালী করুণাময়ের ওপর।” (সূরা শুআরা: ২১৭)
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ
“ভরসা করো চিরঞ্জীবের ওপর; যার কোন মৃত্যু নাই।” –(সূরা ফুরকান – ৫৮)
আসবাব গ্রহণ তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়…
আসবাব গ্রহণ করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়। প্রকৃত অর্থে, তাওয়াক্কুল হল অন্তরের কাজ। আর অন্তরের কাজ হল আল্লাহর ওপর নির্ভর করা, তাঁর ওপর ভরসা করা। এ কথার বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ তা‘আলাই ক্ষতি ও উপকার করার মালিক।
তাওয়াক্কুল করতে হবে আসবাব গ্রহণ করে। আসবাব গ্রহণ করা ব্যতীত নয়। আমরা নিজেদের মন-মেজাজ দ্বারা বুঝতে যাব না। বরং এ বোঝার ক্ষেত্রেও আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন -
وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ
“আপনি তাদের সাথে পরামর্শ করুন। আর যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নিবেন; তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন।” –(সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, একজন সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন-
يا رسول الله أعقلها -أي الناقة- وأتوكل، أو أطلقها وأتوكل؟!
হে আল্লাহর রাসূল! আমি কী উটটি বেঁধে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবো? না উটটা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবো?!
قال: اعقلها وتوكل
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-“আগে উট বাঁধো, তারপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো।”
মুতাওয়াক্কিল আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র
যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে। সে আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়।
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ
“যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)
তাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট
আল্লাহর ওপর যারা তাওয়াক্কুল করে তাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আল্লাহ তাদের দায়িত্ব নিয়ে নেন। তাদেরকে গোমরাহী হতে রক্ষা করে সঠিক পথ দেখান।
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহ তার জন্যে যথেষ্ট হয়ে যান।” -সূরা তালাক: ০৩
তাওয়াক্কুলের দাবীদার
আমরা অনেকে তাওয়াক্কুল করার দাবী করি। অন্যকেও নসিহত করি। কিন্তু নিজের বেলায় তার আমল করি না। তাওয়াক্কুলের সাথে রয়েছে তাকওয়ার নিবিড় সম্পর্ক। কারণ কেউ যখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে; তখন তার অন্তরে আল্লাহর জন্যে তাকওয়া ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। আর আমি যদি সত্যিকারের মুত্তাকীই হয়ে থাকি; তবে কেন জেল-জরিমানা, মাদরাসা-মক্তব ও বেতন-ভাতা বন্ধের ভয় পাই?
কেন মনে করি আল্লাহর দেয়া একটি ফরয বিধান পালন করলে আমাকে জেলে যেতে হবে? আমাকে বন্দী করা হবে? আমার মাদরাসা একেবারে তালাবন্ধ হয়ে যাবে? এ কাজে জড়ালে বন্ধ হয়ে যাবে আমার মাদরাসার পড়ালেখা? বন্ধ হয়ে যাবে আমার বেতন-ভাতা?
আমরা যদি এসব চিন্তাই করে থাকি; তবে কি আমরা নিজের সংকীর্ণ আকল আর স্থূল বুদ্ধির ওপর ভরসা করছি না? আমরা কি নিজের কিঞ্চিৎ মানব জ্ঞান দ্বারা চিন্তা করছি না?
আমি যদি মনে করে থাকি, তারা আমাকে জেলে দিবে। তাহলে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কীভাবে হোল? আমি তো মনে করি, তাওয়াক্কুল হল পৃথিবীর সকলে মিলে আমার একটি ক্ষতি করতে চাইলে, যতক্ষণ না আল্লাহ তার ইচ্ছা করেন; ততক্ষণ তারা সে ক্ষতিটি করতে পারে না। তাহলে জেলকে ভয় পেয়ে কি আমি আমার ঈমান হারাবো?
আমি যদি ভাবি জিহাদের কথা বললে তারা আমার মাদরাসা বন্ধ করে দিবে। আমার বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে তো ক্ষমতাবান হিসেবে আমি তাগুতকেই মানছি। অথচ সকল ক্ষমতা আল্লাহর। তিনি যা করেন তাই হয়। মাদরাসা, বেতন-ভাতা বন্ধের ভয় করে আমি কি ঈমান হারাবো?
আমি জীবন গড়ার, ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করছি; তো সে ক্ষেত্রে তাগুতকে সমীহ করেই চলছি; তাদেরকে ভয় করছি। তাহলে কার জন্যে আমার ইলম শেখা হচ্ছে? আর কার জন্যে আমার ক্যারিয়ার গড়া হচ্ছে? আমি সত্য প্রচার করলে, জিহাদের প্রস্তুতি নিলে তারা আমার মাদরাসা, আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। আর এক্ষেত্রে আমি এই জ্বালানো-পূরানোর ভয়ে ফরয বিধান উপেক্ষা করছি। তাহলে কোথায় আমার ঈমান? কোথায় তাওহীদ? কোথায় গেল আমার তাকওয়া আর তাওয়াক্কুল?
শুধু কি গুনাহ ত্যাগ করলেই তাওয়াক্কুল হয়? নাকি বিধানগুলো পালন করার ক্ষেত্রেও তাওয়াক্কুল প্রয়োজনীয়?
(লেখাটি আল বালাগ ম্যাগাজিনের ৩য় সংখ্যা থেকে সংগৃহীত ও অনূদিত)
Comment