৫ই মে সারাদিন ... পয়েন্টে থেকে বিকেলে মূল পয়েন্টে পৌঁছোই আমরা। সন্ধ্যার খানিক পূর্বে শাপলা চত্বরের লোহার বেষ্টনীর ভেতরে ঢুকি। মাগরিব-এশায় শাপলার নিচের শ্যাওলা-সবুজ পানি দিয়ে ওযু করে নামাজ পড়ি।
যখন মূল ঘটনা শুরু হয় তখন আমি ঘুমে ছিলাম। শব্দ পেয়ে উঠে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াতে শুরু করি। তখন একজনের ফোন থেকে বাসায় ফোন দিয়ে বলি, মা, দুআ কইরো, আর বাসায় নাও আসতে পারি।
আমি সেদিন কিছুই দেখিনি,
দেখেছি কেবল শহীদী রঙ মেখে শুয়ে ছিল কিছু মানুষ। একজনকে ধরে ওঠাতে চাইলে তার মুখ থেকে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে আমার পায়ের ওপর। পেছন ফিরে দেখি কিছু খেলোয়াড় খেলার যন্ত্রপাতি (!) নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে ট্রাকের নিচে গিয়ে পালালাম, তখনো শুনছিলাম মঞ্চ থেকে কার যেন গগনবিদারী আওয়াজ, ‘ভাইয়েরা, আপনারা শান্ত হন, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।’
একটু পরেই আমাকে ট্রাকের নিচ থেকে টেনে বের করা হলো, কে যেন আদর করে (!) আমার পিঠে বুট দিয়ে লাথি দিল। একজন কালো পোশাক পড়া খেলোয়াড় আমাকে ধরে বলল, ‘কিরে মোল্লা, মা-বাপরে এতিম করতে আসছস? কয় টাকা পাইছস? ভাগ তাড়াতাড়ি।’
আমি দৌড়ে এক এটিএম বুথের দরজায় গিয়ে দারোয়ানের পায়ে পড়লাম। আর্তনাদ মাখা স্বরে বললাম, চাচা, একটু ভেতরে ঢোকার সুযোগ দিন। আমি এখান থেকে ... পথ চিনি না। ভোর হলেই চলে যাব। আশ্রয় দেয়ার পরিবর্তে তিনি আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। চোখ ফেটে অশ্রু বের হয়, শুধু এটুকুই তাকে বলি, আল্লাহ আপনাকে ছাড়বে না।
খালি পা, গায়ের জামা ছেঁড়া, সঙ্গীহারা আমি এ পথ থেকে ও পথ ছোটাছুটি করতে থাকি। কত জায়গায় একটু আশ্রয় নেয়ার আবদার করেছি, উপহাস আর গালি ছাড়া কিছুই জোটেনি সেদিন।
শেষ রাতের দিকে এক সিএনজি চালক আমাকে পথ দেখিয়ে বলে, এদিক দিয়ে ... চলে যান, হুজুর। আর জীবনেও আন্দোলনে নাইমেন না।
এরপর কীভাবে যেন ... চলে আসি। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে ফজরের পর মাদরাসায় পৌঁছি। ঘটনার আকস্মিকতায় টানা দুই দিন বোবা ছিলাম আমি। চোখের সামনে কতকিছুই ঘটে গেল!
নাহ! কিছুই দেখিনি আমি। কে বলে মানুষ মরেছে সেদিন! শহীদরা কখনো মরে না কি? তাঁরা তো তাঁদের রবের কাছে অপেক্ষমাণ, নিজ চোখে জালেমদের পরিণতি দেখবেন বলে!
এরপর ভেঙে পড়িনি, আরও শক্তি সঞ্চার করে রাজপথে নেমেছি বহুবার! শোককে শোকরানায় পরিণত করিনি; বরং ক্ষোভ আর আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছি সেদিনের জলজ্যান্ত সাক্ষী হয়ে।
(Collected)
Comment