দুঃখেভরা ঈদ :কিছু আবেগের গল্প
এক.
হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখল আয়ান । সকাল সাড়ে পাঁচটা । ফজরের নামাজ পড়ে মাত্র বাহিরে বের হয়েছে । মনটা কেন খারাপ বুঝতেই পারছে না । এলাকার রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আনমনে । প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই একটা করে গরু বাঁধা । কিছুক্ষণ পরেই এগুলোর কুরবানি দেওয়া হবে । হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে ধাতস্থ হল সে । পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কলার নেইমটা দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মোবাইলের দিকে । এখন কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না । তারপরেও রিসিভ করল ।
- কীরে দোস্ত, কোথায় তুই ?? ভুলে গেছিস নাকি ?
- না । ভুলব কেন ?
- সবাই চলে এসেছে । তুইই এখনো আসিসনি ।
- আচ্ছা আসছি ।
কথাটা বলে বাম দিকের মোড় ঘুরে পাঁচতলা সাদা বিল্ডিংটার দিকে যেতে শুরু করল আয়ান । একান্ত বাধ্য হয়েই পা চালাচ্ছে । নাফিসদের বাসায় যাওয়ার একদমই ইচ্ছা নেই তার । কিন্তু না গেলে ওদের জ্বালায় থাকতে পারবে না । তাই বাধ্য হয়েই যাওয়া ।
ঢাকায় থাকে ওরা । চার বছর ধরে ঢাকায় সপরিবারে থাকছে । মসজিদে যাওয়া আসার সুবাদে পরিচয় হয়েছে এলাকার কিছু ধার্মিক ছেলের সাথে । সম্পর্কটা বেশ গাঢ় । এলাকার যে কোনো উন্নয়নমূলক ও সেবামূলক কাজে সবাই একসাথে অংশগ্রহণ করে । কিন্তু মাঝে মাঝে একটু আধটু পাগলামি করা এখনো বন্ধ করতে পারেনি । প্রতি কুরবানি ঈদে তারা সে কাজটিই করে । সেজন্যই আজ সবাই নাফিসদের বাসায় একত্রিত হচ্ছে । নাফিস বড়লোকের ছেলে । সাধারণত সব ভালো কাজেই স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় । এলাকার সবাই তাকে চেনে । ভালোও বাসে ।
কলিংবেলে চাপ দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান । দরজা খুলতেই সালাম দিল সে । নাফিসের আব্বু ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিলেন ।
- ও আয়ান, আসো আসো । তোমরা তো আমাকে আজকে বাসাতেই ব্যয়াম করাবে মনে হচ্ছে । হাসিমুখে কথাটা বললেন আনোয়ার সাহেব ।
মুখে হাসি নিয়ে ভেতরে ঢুকল আয়ান । নাফিসের রুমে ঢুকে দেখে সবাই তার দিকে চেয়ে আছে । যেন মস্তবড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে সে । একবার সবার দিকে তাকিয়ে সোফার খালি জায়গাটায় বসে পড়ল সে । পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে গলা খাকারি দিল ।
- আচ্ছা ভাইলোগ, অবশেষে আয়ান সাহেবের শুভাগমন ঘটেছে । কথাটা বলে যেন আয়ানকে একটা খোঁচা দিল সাদমান ।
- ওও, আসলে । আসলে আমি ভুলে গেছিলাম । মনে ছিল না । আয়ান যেন সাফাই গাইছে ।
- হইছে আর বাহানা দিতে হবে না । সাদমান বলল ।
- কী রে আয়ান, এবারও তোর মন খারাপ কেন ? প্রতি ঈদেই তোর হয়টা কী হ্যা ?? একটু রেগেই যেন কথাটা বলল তাহসিন ।
- ও কিছু না । তোরা শুরু কর । আয়ানের মনমরা কন্ঠ ।
- আচ্ছা শোন সবাই । নাফিস বলছে । অন্যান্য বারের মত এবারও আমরা এলাকার প্রত্যেক কুরবানির বাড়িতে যাব । গিয়ে কুরবানি সালামি নেব ।
- অন্যান্য বার তো এই সালামির টাকা দিয়ে আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসি । আশপাশের সব রেস্টুরেন্ট তো আমাদের ঘোরা শেষ । এবার কোনটা ?? নতুন কিছু ট্রাই করবি নাকি ?? সাকিব বলল ।
- ঠিক বলেছিস । নাফিস বলছে । এবার না হয় ধানমন্ডির দিকে যাওয়া যাক । কী বলিস তোরা ??
সবাই একবাক্যে মেনে নিল নাফিসের কথা । কিন্তু নাফিস খেয়াল করল আয়ানের মুখভার ভাবটা তখনো যায়নি । এখানে আসার পর দুই একবার হ্যা হু ছাড়া আর কিছুই বলেনি সে ।
- নাফিস গলা খাকারি দিয়ে বলল । আচ্ছা শোন । আমরা এখন বের হব । আধা ঘন্টার মধ্যে সালামি তোলা শেষ করে সব টাকা আয়ানের কাছে জমা রাখব । তারপর ঈদের নামায পড়ে সবাই বাসায় চলে আসবি । এলাকার গরুগুলো জবাই করে ফ্রেশ হয়ে এগারোটার দিকে আমরা বের হব । কী বলিস তোরা ??
আচ্ছা ঠিক আছে । বলে সবাই বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হল ।
- শোন, শোন সবাই । সাদমানের ডাকে সবাই ওর দিকে তাকাল । নাফিস, তোরাও তো কুরবানি দিচ্ছিস । তাই সবার আগে আংকেলকে দিয়েই শুরু করা যাক । সবাই সাদমানের কথায় হো হো করে হেসে উঠল ।
- ঠিক আছে । চল । আব্বুকে বলি । নাফিস বলল । তবে আব্বুকে পটানোর দায়িত্ব কিন্তু শাহরিয়ারের । ও তো এক মুহূর্তেই যে কাউকে দাওয়াত দিয়ে মসজিদে আনতে বেশ পটু । তো এখানে তোর কিছু জালওয়া দেখা দেখি ।
- ওকে বয়েজ । ঠিক আছে চল । শাহরিয়ারের গদগদ কন্ঠে সবাই হেসে ফেলল ।
পাঁচজনের দল গিয়ে উপস্থিত হল আনোয়ার সাহেবের রুমে ।
- আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল । কেমন আছেন? শরীর স্বাস্থ্য কেমন ? মনটা কেমন ?? শাহরিয়ারের কথার ফুলঝুরি শুরু হল ।
- ওয়া আলাইকুমুস সালাম । ভালোই তো ছিলাম এতক্ষণ । তুমি একসাথে যতগুলো প্রশ্ন করেছ, তার উত্তর দিতে দিতে তো মনে হয় অসুস্থ হয়ে যাব । হাসি মুখে বললেন নাফিসের বাবা ।
- আঙ্কেল কোনো সমস্যা নেই । দানের নিয়তে আমাদেরকে কুরবানির সালামিটা দিয়ে দেন । তাহলে আর অসুস্থ হতে হবে না । হাদীসে আছে দান বিপদ দূর করে । তাহলে অসুস্থ হওয়ার আগেই আপনি অগ্রিম সুস্থতা পেয়ে যাবেন । আর তাছাড়া আমরা তো ছোট মানুষ । ছোটদের প্রতি হাদীসে অনুগ্রহ ও স্নেহ করতে বলা হয়েছে । সালামিটা দিয়ে আপনি সেই সওয়াবটাও পেয়ে যাবেন । এক ঢিলে দুই পাখি । কথাগুলো বলে থামল শাহরিয়ার ।
- বাবা তুমি তো ভালোই বলতে পারো । এ জন্য মসজিদে তোমার আলোচনা শুনতে ভালোই লাগে । আমাকে আর পটাতে হবে না । বুঝতে পেরেছি । ঠিক আছে এই নাও পাঁচ হাজার । হাদিয়া ও ঈদের সালামি । ঈদ মোবারক ।
- আপনাকেও অসংখ্য শুকরিয়া । ঈদ মোবারক । তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম ।
- আচ্ছা তোমাদের সাথে আরেকজন আছে না ? আয়ান ? সে কোথায় ?
- আঙ্কেল এই তো আমি । মুখভার করা চেহারা নিয়ে পেছন থেকে সামনে এগিয়ে আসল আয়ান ।
- তোমার মন খারাপ মনে হচ্ছে । বাসায় ঢোকার সময়ই তোমাকে দেখে বুঝতে পেরেছি । কী হয়েছে ?
- বাবা ওর কথা বলো না । নাফিস বলছে । প্রত্যেক ঈদেই ওর মন খারাপ থাকে । কাউকেই কিছু বলে না । মনমরা হয়ে বাসায় পড়ে থাকে । সারাদিন একা একা থেকে পরদিন বের হয় ।
- ওও আচ্ছা । ঠিক আছে তোমরা যাও । আর হ্যা সবার থেকে সালামি আর কত নিবে এবার নিজেরা সালামি দেওয়ার তো ব্যবস্থা করো ।
- তাহসিন শাহরিয়ারকে খোঁচা দিয়ে বলল : কী রে কী বলছেন ?
- আরে বিয়ে করার কথা বলছেন । শাহরিয়ার বলল ।
- তা, আঙ্কেল, নাফিসকে তো তাহলে আগে এই সুযোগ করে দেওয়া উচিত আপনার । মুখ ফসকে যেন বলে ফেলল শাহরিয়ার ।
- ইয়ে মানে । ওর তো এখনো পড়ালেখা করার ইচ্ছা আছে । শেষ করুক । তারপর । তোমাদের তো মনে হয় শেষ । তাই তোমাদের বলছি । একটু যেন লজ্জা পেলেন নাফিসের বাবা ।
- আচ্ছা আঙ্কেল চেষ্টা করব । বলে হাসতে হাসতে সবাই বের হয়ে আসল ।
- কী রে নাফিস তোর আব্বু তো তোকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত মানব বানাতে চায় । বলেই হেসে উঠল সবাই ।
দুই.
নামাযের জন্য মসজিদে এসে বসেছে পাঁচ বন্ধু । এক ফুট দূরত্ব রেখে সবাই জায়নামায বিছিয়ে বসেছে । খতীব সাহেব কুরবানির ইতিহাস আলোচনা করছেন । আয়ান মনযোগসহ শুনলেও কেমন যেন উসখুস করছে তার ভেতর । অজান্তেই চোখের কোণায় পানি জমছে । সে বারবার হাত দিয়ে মুছে ফেলছে । পাশে নাফিস বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে । বুঝতে পারছে না আয়ানের এত দুঃখ কিসের । আজ এই রহস্যের সমাধান করেই ছাড়বে সে । বয়ান শেষে নামায পড়ল ওরা । খুতবা শেষ করে এখন খতীব সাহেব মুনাজাতের জন্য হাত তুলেছেন । এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার, এমপি , মন্ত্রী সবার জন্য দোআ করছেন । দেশে করোনা পরিস্থিতি দূর করার জন্য দুআ করছেন । সবাই আবেগ নিয়ে দুআ করছে । আয়ান দু হাত তুলে কিছুই বলতে পারছে না । তার শুধু দু চোখ ভিজে আসছে । দরদর করে পানি ঝরছে চোখ দিয়ে । খুব কষ্টে মুখ চেপে আছে সে । মুখ খুললেই তার ভেতরের কষ্টগুলো চিৎকার আকারে বের হয়ে আসবে । সে চায় না এখন চিৎকার করে কেঁদে সবার সামনে বেকুব হতে । তাছাড়া এই আনন্দের দিনে এভাবে কাঁদলে লোকে কী বলবে । তাই নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে । মুনাজাত শেষ করে ঠোঁট চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ বসে থাকল । আনমনে কী যেন ভাবছে । তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ইন্টারনেটে দেখা কিছু দুঃসহ ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য । কান্না থামিয়ে রাখতে পারছে না । ভাবছে , প্রতিটি আনন্দের সময়েই কেন তার এই বেদনার কথাগুলো মনে পড়ে ? প্রতি ঈদে সবাই যখন আনন্দ করে তখন সে বাইরেই বের হতে পারে না । তীব্র যন্ত্রণায় যেন কুকড়ে যায় । তার মনে চায় একাকি কোনো ঘরে বসে চিৎকার করে কাঁদতে । কিন্তু সে পারে না । ওর এক বন্ধু ছিল গ্রামের বাড়িতে । ওর বাবা ছিল না । প্রতি ঈদে সে মন খারাপ করে কবরস্থানে গিয়ে বাবার কবর দেখে আসত । সারাদিন ঘরে বসে বাবার অতীতের স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করত । আনন্দের দিনগুলোতেই তার বাবার কথা মনে পড়ত আর সে কষ্টেই শেষ করত আনন্দের মুহূর্তগুলো । এভাবে এই কষ্টের স্মৃতিচারণের মাঝেই সে খুঁজে নিয়েছিল তার আনন্দ । আয়ান ভাবে , হয়ত তারও এমন কিছু হয়েছে । তাই আনন্দের দিনে কষ্ট পেতেই সে ভালবাসে ।
- কী রে বসে আছিস কেন ? বের হবি না ? নাফিসের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল আয়ানের ।
মুখ ফিরিয়ে দেখে মসজিদ খালি । কেউ নেই । সবাই বের হয়ে গেছে । শুধু নাফিস, শাহরিয়ার, তাহসিন আর সাদমান তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে । আর সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।
- ও হ্যা চল । বলেই জায়নামাযটা গুছিয়ে নিয়ে উঠে পড়ল আয়ান ।
মসজিদের মূল ফটকে এসে নাফিস আয়ানের হাত ধরে থামাল ।
- কী হল ? আয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ।
- চার বছর ধরে তোর এই অবস্থা দেখছি । প্রতি ঈদেই তোর মন খারাপ থাকে । মনমরা হয়ে থাকিস তুই । এবার আমরা এটা জানবই । এটা বলতেই হবে এবার । নাফিসের দৃঢ় কন্ঠ ।
- না তেমন কিছু না । দুর্বল ভাবে বলল আয়ান ।
- নাফিস ঠিক বলেছে । তাহসিন তাল মেলালো । এবার বলতেই হবে আমাদের ।
- আচ্ছা ঠিক আছে । বলব । একটু পরে । নাফিস ধরা গলায় বলল ।
- ঠিক আছে । তোরা সবাই চল । আগে আমাদের বাসায় মিষ্টিমুখ হবে । তারপর একে একে তোদের সবার বাসায় । নাফিস বলল ।
তিন.
নাফিসদের গরু জবাই করে সবাই এখন নাফিসের রুমে বসে আছে । সবার দৃষ্টি আয়ানের দিকে । টেবিলে হরেক রকমের মিষ্টান্ন ।
- এবার শুরু কর । নাফিস বলল ।
- হ্যা । আচ্ছা । নিজেকে যেন ধাতস্থ করে নিল আয়ান । আসলে কোথা থেকে শুরু করব কিছু বুঝতে পারছি না ।
- শুরু কর যে কোনো জায়গা থেকে । শাহরিয়ার বলল ।
- আসলে প্রতি ঈদ আসলে আমার ভেতর চেপে রাখা কিছু কষ্ট জেগে ওঠে । সুখের সময় মানুষের মাঝে তার হারানো প্রিয়জনদের কথা খুব বেশি মনে হয় । যেমন যার পিতা নেই সে ঈদের দিনই দেখবি তার পিতাকে বেশি মনে করে । তেমনি আমার বিষয়টা । তবে আমার কথাগুলো শুনে হয়ত তোদের কাছে পাগলামি বা অতিরঞ্জন মনে হতে পারে । সে জন্য আমি দুঃখিত । এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি । এটা আমি শরঈ হুকুমও বলব না । আবার আনন্দ বাদ দিয়ে আনন্দের দিনকে বিষাদময় করে তুলতেও বলব না ।
প্রতি ঈদে আমার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মজলুম মুসলিমদের কথা খুব বেশি বেশি মনে পড়ে । এতটাই মনে পড়ে যে, নিজেকে ধরে রাখতে পারি না । অনলাইনে দেখা নির্যাতনের চিত্রগুলো চোখের সামনে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে । প্রতিটি নির্যাতন আমার হৃদয়কে বিষিয়ে তোলে । তাই নিজের অজান্তেই প্রতি ঈদে অনেক বেশিই কষ্ট পাই । এই দিনগুলোতেই আমার খুব কান্না আসে । মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে মন চায় ।
আয়ান কথাগুলো বলছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে । ওর চোখ থেকে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছে । নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারছে না । সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মত । সবার চোখেই যেন জোয়ার এসেছে ।
আয়ান বলে চলেছে, আজ যখন নাফিসদের গরুটা জবাই করা হল তখন আমি ওখানে থাকতে পারিনি । কারণ এই দৃশ্য দেখে আমার হিন্দুস্তানের কথা মনে হয়েছে । আমরা কত সহজেই গরু কুরবানি দিতে পারছি । কিন্তু হিন্দে আমার ভাইদের গরু কুরবানির অপরাধে নিজেদের জানের কুরবানি দিতে হচ্ছে । আজ যখন মসজিদে দুআ হচ্ছিল তখন আমি খুব কেঁদেছি । জানিস কেন ?? কারণ খতীব সাহেব সবার জন্য দুআ করেছেন । কুফরী শাসনব্যবস্থার সাথে জড়িত কুফুরী আকিদা পোষণকারী ব্যক্তিরাও খতীব সাহেবের দুআ থেকে বঞ্চিত হয়নি । কিন্তু তিনি দুআতে সিরিয়া, ইয়ামান, জিনজিয়াং, আরাকান, কাশ্মির ও অন্যান্য ভূখন্ডের মুজাহিদ ও বন্দি তো দূরের কথা নির্যাতিত মুসলিম ভাই বোনদের কথা একটি বারও উল্লেখ করেননি । আচ্ছা বল তো, তারা কি আমাদের কেউই হয় না ?? তারা কি আমাদের একটু দুআও পেতে পারে না ??
পৃথিবীর দেশে দেশে আমাদের কত হাজার হাজার মুসলিম ও মুজাহিদ ভাই বন্দি , আমি কীভাবে আনন্দ করতে পারি ? এই ঈদের দিনগুলো আসলেই আমার এই কষ্টগুলো তাজা হয়ে ওঠে । মনে হয় আমি যেন গাদ্দার হয়ে গেছি । নিজেকে মুনাফিক মনে হয় । এই মুহূর্তেও কাশ্মির, সিরিয়া বা জিনজিয়াংয়ে লাশের সারিতে কেউ হয়ত নিজের প্রিয়জনের লাশ খুঁজছে । বাংলাদেশের কারাগারে আমাদের কত আলেম, দাঈ ও মুজাহিদ ভাই নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে । তাদের পরিবারের ছোট্ট সোনামনিটি হয়ত দরজার আওয়াজ শুনে আব্বু আব্বু বলে দৌঁড়ে এসে আব্বুকে না পেয়ে কষ্টের বোঝা নিয়ে ছলছলে চোখে ফিরে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করছে : আব্বু কখন আসবে ??
সেই মায়েরা তাদের কী উত্তর দিচ্ছেন তা আর কল্পনা করতে পারি না । এত শক্তি আমাকে আল্লাহ দেননি । এত সব কষ্ট বুকে রেখে আমি মুখে হাসি ফোটাতে পারি না । এটা অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের আনন্দের দিন । আমাদের আনন্দ করা উচিত । কিন্তু আমার অপারগতা যে আমি অনেক কষ্ট করেও তা পারছি না । এজন্য আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ।
- সবাই চোখ মুছছে । কিন্তু এই অশ্রু তো থামবার নয় । কেউ কিছু বলতে পারছে না । একটি আবদ্ধ কক্ষে কিছু যুবকের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ ।
আয়ান আবার বলল, আমি জানি অনেকের কাছে এটা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে । মুসলিম উম্মাহ নির্যাতিত বলে কি সবসময় মুখ ভার করে রাখতে হবে ? এমন প্রশ্নও হয়ত তোদের ভেতর আসছে । কিন্তু আমার উদ্দেশ্য এটা না । আমি বলছি না , সবসময় মুখ ভার করে বিষণ্ন হয়ে ঘরবন্ধি হয়ে থাকতে । বলছি না, আনন্দপ্রকাশ থেকে বিরত থাকতে । আমি এসব কিছুই বলছি না । আমি শুধু আমার অপারগতা আর কষ্টটুকু তোদের সাথে শেয়ার করলাম । এটা কোনো আদেশও না যে, সবার আমার মত হতে হবে । তাই এমন কিছু মনে করবি না ।
যাই হোক । তোদের সবাইকে রক্তিম ঈদের শুভেচ্ছা । তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম ।
- আবারও নীরবতা । কেউ কিছু বলতে পারছে না ।
- আচ্ছা আমাদের সালামি কত উঠেছে, আয়ান ? নাফিস বলল ।
- এই তো প্রায় বিশ হাজার ।
- আমরা এখন থেকে আমাদের সালামির টাকা দিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে খাব না । নাফিস ধরা গলায় বলে চলেছে । আমাদের প্রতি ঈদের সালামি আমরা দেশের বাইরে মুজাহিদদের জন্য দান করে দিব । আমাদের পাঠানো টাকা দিয়ে একটি বুলেটও যদি কিনে শত্রুর বুক ঝাঝরা করার জন্য ব্যবহার হয় তবেই আমাদের স্বার্থকতা । তাছাড়া মুজাহিদিনের জন্য আমরা এখন থেকে পুরো এলাকায় আলাদাভাবে দাওয়াতী ক্যাম্পেইন করব । ডোনেশন সংগ্রহ করব এবং প্রতি ঈদে তা আমরা মুজাহিদিনদের নিকট পাঠাব । ইনশাআল্লাহ । তোদের কারো কোনো দ্বিমত আছে ??
- এই কাজে আবার দ্বিমত থাকবে কেন ?? আমরা সবাই রাজি । শাহরিয়ার বলল ।
হ্যা হ্যা আমরা সবাই রাজি । সকলেই স্বমস্বরে বলে উঠল ।
- তো চল এই বিশ হাজার টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করি । নাফিস বলছে । ইমারাতে ইসলামিয়্যা তো তিনদিনের যুদ্ধ বিরতি দিয়েছে । আমরা এই টাকাটা পাঠাব । দুআ করব, যুদ্ধবিরতির পর প্রথম আক্রমণের প্রথম বুলেটটি যেন আমাদের পাঠানো টাকায় কেনা হয় ।
আয়ানের চোখের অশ্রু এখনো থামেনি । তার চোখে এখনো পানি । কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না এই অশ্রু কি নতুন আনন্দের না পুরনো দুঃখের ??
বি:দ্র: লেখাটির চরিত্রগুলো কাল্পনিক । আবেগ ও কষ্টের চিত্রটি বাস্তব । পরিচিত এক ভাইয়ের জীবন থেকে নেওয়া । আল্লাহ তাআলা আমাদের এই কষ্টের ঈদগুলো আনন্দের ঈদ দ্বারা দ্রুত পরিবর্তন করে দিন । সেদিনই হবে আমাদের আনন্দের ঈদ যে ঈদে উম্মাহর সিংহরা থাকবেন মুক্ত স্বাধীন । ইসলামের হারানো ভূখন্ডগুলোতে আবার উড়বে কালিমা খচিত পতাকা । উম্মাহর প্রতিটি সদস্য যেদিন মুক্ত স্বাধীনভাবে শ্বাস নিবে আল্লাহর যমীনে । ততদিন পর্যন্ত .......
তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম । ওয়া আ'আদাল্লাহু ইলাইনাল খিলাফাহ ।
Comment