ﺑِﺴْــــــــــــــــﻢِﷲِﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦِﺍلرَّﺣِﻴﻢ ️
[১]
গণতন্ত্র আর ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে অনেকদিন নিয়েই অনলাইনে তর্কবিতর্ক চলছে। কিন্তু এই তর্কের কখনো ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। এমন হবার একটা বড় কারণ হল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ইসলামিস্টরা একদিকে তাদের অবস্থানকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখেন, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আপত্তিগুলো তোলা হয় তা নিয়ে সরাসরি আলোচনা তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে। দুটো ক্ষেত্রে এই প্রবণতার প্রভাব সব ভালোভাবে বোঝা যায়।
.
১। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন
২। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন ইসলামী দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় যাবার পর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনার অনুপস্থিতি
.
প্রথম অস্পষ্টতার দিকে তাকানো যাক।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসীরা একেক সময় একেকভাবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। যখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তির কথা আসে, তখন কেবল নির্বাচনের কথা এনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয় - গণতন্ত্র হল নির্বাচনের মাধ্যমে, পপুলার ভোটের মাধ্যমে শাসক বাছাই করার পদ্ধতি। গণতন্ত্রের বিকল্প হল রাজতন্ত্র, বা একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি।
.
যখন ‘ইসলামী গণতন্ত্র’-এর কথা বলা হয় তখন প্রথমে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেন – ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা হয় সার্বভৌমত্ব জনগণের’। তারপর ইসলামী গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়, ‘ইসলামী গণতান্ত্রিক দলগুলো তা মানে না। তারা বিশ্বাস করে সার্বভৌমত্ব এক আল্লাহর’।
.
আবার ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরশাসনের আলোচনায় দেখা যায় গণতন্ত্রের আরেক সংজ্ঞা চলে এসেছে। ‘সকল নাগরিকের সমঅধিকার ও সুরক্ষা, মত প্রকাশ এবং চিন্তার স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন’ – এর মতো অনেক বিষয়ের কথা তখন বলা হয়।
.
এই সংজ্ঞাগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে; বলা যায়, সুবিধা অনুযায়ী, আনা হয়। এবং আলাদা আলাদাভাবে কোনটাই গণতন্ত্রের বাস্তবতা সম্পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলে না।
.
গণতন্ত্র মানে নির্বাচন বলে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় সেটা রিডাকশনিস্ট একটা সংজ্ঞা, এবং গণতন্ত্রের একটা ক্যারিক্যাচার। সুষ্ঠু অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু পৃথিবীতে কেউ গণতন্ত্র = নির্বাচন বলে না। তারচেয়ে বড় কথা এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তিগুলোকে পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা। যারা গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে, তাঁদের আপত্তি কি মৌলিকভাবে পপুলার ভোট নিয়ে?
.
ধরুন, কোন ভূখন্ড ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী শাসিত হয়। এখানে যদি, শরীয়াহর সব শর্ত পূরণ করে, বাছাই করা কিছু ব্যক্তির মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে নতুন শাসক নির্ধারন করা হয় তাহলে, কি গণতন্ত্রেরবিরোধিতাকারীরা সেটাকে কুফর বলবে? যেভাবে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বলে থাকে? অবশ্যই না। কারণ মূল আপত্তি নির্বাচন নিয়ে না। এটুকু গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা মানুষরাও বোঝেন। বুঝেও তারা গণতন্ত্রের একটা সীমিত সংজ্ঞা আর ক্যারিক্যাচার দাড় করিয়ে, সেটার ওপর ভর দিয়ে তর্ক করেন।
.
সার্বভৌমত্বের ওপর ভিত্তি করে দেয়া সংজ্ঞার আলাপ বেশ মজার। কাউকে সার্বভৌম মনে করার বিষয়টা কি শুধু বিশ্বাস করার আর মুখে বলার? নাকি কাজের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য আছে?
কেউ বিশ্বাস করে আল্লাহ একমাত্র সত্য ইলাহ, তিনিই রব, তিনি মালিক। কিন্তু নিজের পীর সাহেবের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সে মাগরিবের সালাত ৩ রাকাতের জায়গায় ৪ রাকাত করে পড়ে। সে কি আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করছে? নাকি আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে অন্য কারও আনুগত্য করছে?
.
অনেক দেশের শাসকরা বেশ আয়োজন করে ক্যামেরার সামনে সালাত আদায় করে। কেউ শুনি তাহাজ্জুদ পড়ে, কেউ কুরআনে হাফিয বলেও শুনি। থিওরেটিকালি তারাও এ কোথায় বিশ্বাস করার কথা যে, ‘আল্লাহ সার্বভৌম’।
.
কিন্তু এই বিশ্বাসের এ দাবি কি যথেষ্ট?
কেউ আল্লাহকে সার্বভৌম মনে করার দাবি করার পর যদি বলে উত্তরাধিকার আইন ইসলামে যা আছে, সেটায় নারীদের সাথে যুলুম হয়েছে, এবং এটা বদলানো দরকার, তাহলে তার এই দাবির গ্রহণযোগ্যতা কতোটুকু?
.
গণতান্ত্রিক শাসনে কি পদে পদে এমন কাজ হচ্ছে না? প্রতিটি ক্ষেত্রে কি ইসলামের বিধানকে সরিয়ে, অকার্যকর করে, অন্য কোন দর্শন, কিতাব বা সত্ত্বার কথামতো নতুন বিধান বানানো হচ্ছে না? শুধু ‘আমি আল্লাহকে সার্বভৌম বলে বিশ্বাস করি’ বললে কি এ সব কিছু দূর হয়ে যাচ্ছে?
.
অন্যদিকে যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলেন, তারা এসব মূল্যবোধের অনুমিত মহত্ব নিয়ে লম্বা আলোচনা আনলেও এগুলোর সাথে ইসলামের কোন সাংঘর্ষিকতা আছে কি না, সেই আলাপ সযত্নে এড়িয়ে যান। অথচ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তির বড় একটা জায়গা এটা। গণতান্ত্রিক শাসন কোন ধরণের আইন নিয়ে কাজ করে, কোন ধরণের সমাজ তৈরি করে, কোন ধরণের সংস্কৃতি তৈরি করে, কোন ধরণের মানুষ/নাগরিক তৈরি করে – এর সাথে ইসলামের অবস্থানের সংঘর্ষ আছে কি না, থাকলে কোন মাত্রায় আছে, সেই সংঘর্ষের সমাধান করা সম্ভব কি না – এই আলোচনা না করে, ইসলামের আর গণতন্ত্রের ‘সমন্বয়’/জোড়াতালির চেষ্টা করা সম্ভব না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটাই ঘটে।
.
এভাবে একেক সময় একেক সংজ্ঞা আনা হয়, অস্পষ্ট, ঘোলাটে, কিংবা ঢালাও কিছু কথাবার্তা এনে মূল আপত্তির জায়গাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিষয় এতোবার, এতো বিভিন্নভাবে ঘটে যে, একে কাকতালীয় মনে করা বেশ কঠিন। বরং এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে গণতন্ত্রের প্রবক্তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই মূল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছেন।
[২]
উপরে গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর আদর্শ এবং পদ্ধতিগত দুটো অস্পষ্টতার কথা বলা হলো। প্রথম অস্পষ্টতা গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন নিয়ে। দ্বিতীয় অস্পষ্টতা, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা ঠিক কীভাবে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে। অন্য আরেকটা অস্পষ্টতার দিকে তাকানো যাক।
প্রথম প্রশ্ন–পদ্ধতি নিয়ে। সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে ইসলামী শাসনে যাওয়া, পসিটিভ ল’ এর বদলে শরীআহতে ফিরে যাওয়া, শুধু সরকার পরিবর্তনের বিষয় না। বরং এটা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন দল কীভাবে এই পরিবর্তন করবে? কতোটুকু ভোট পেলে এধরণের আমূল পরিবর্তন করা সম্ভব?
.
ধরুন কোন গণতান্ত্রিক ইসলামী দল ৬০% ভোট পেয়ে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। এ অবস্থায় তারা কি এই পরিবর্তন আনতে পারবে? যদি নির্বাচিত সরকার এমন করতে চায় তাহলে কি রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য অংশ তাদের সমর্থন দেবে? প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, বিভিন্ন বাহিনী যদি বেঁকে বসে, বাঁধা দেয় – তাহলে কী হবে? গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় যাবার পরের কর্মকান্ডের যেসব উদাহরণ মিসর, তিউনিশিয়া ইত্যাদি জায়গাতে আছে, সেগুলো তেমন সুখকর না। এই পরিবর্তন কীভাবে হবে এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট উত্তর গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর কাছে পাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হয় অনুপস্থিত, অথবা অস্পষ্ট।
.
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ফিসিবিলিটি নিয়ে। এই দলগুলোর আসলে এককভাবে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কতোটুকু? গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনে পারফরম্যান্স কেমন? আমি অল্প কিছুটা খোঁজার চেষ্টা করলাম -
.
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (১৯৯১) - ১৯ আসন (জামাআতে ইসলামী ১৮, ইসলামী ঐক্যজোট ১),
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (১৯৯৬) - ৪ আসন (জামাআতে ইসলামী ৩, ইসলামী ঐক্যজোট ১),
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০১) – ১৯ আসন (জামাআতে ইসলামী ১৭, ইসলামী ঐক্যজোট ২। একটা প্রতিবেদনে দেখলাম ০১-এ ইসলামী ঐক্যজোট ৪টি আসন পেয়েছে। এই মূহুর্তে যাচাই করতে পারছি না। )
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০০৮) – ২ আসন (জামাআতে ইসলামী ২)
.
উল্লেখ্য, ইসলামী ঐক্যজোট প্রাথমিকভাবে ছয়টি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামী দল নিয়ে গঠন হয়। দলগুলো হল - খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন। বর্তমানে ঐক্যজোট বেশ অনেকগুলোভাগে বিভক্ত। ভাগগুলোর হিসেব রাখা মুশকিল।
.
এই তথ্যগুলো কেবল একনজরে মূল ছবিটা দেখার জন্য। মূল প্রশ্ন হল, এই হারে, আনুমানিক কতো বছর এই দলগুলো এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার আশা করে? রিয়ালিস্টিকালি? ৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ১৭ বছরে তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যায় না। ২০০৮ থেকে গতো ১২ বছরের অবস্থা কেমন ছিল তা সবার সামনেই আছে। তাই ৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের ট্রেন্ডের দিকে তাকালে আগামী ৩০ কিংবা ৫০ বছরে কি বড় কোন অগ্রগতি আসা করা যায়? বিশেষ করে এই দলগুলোর কাজের পদ্ধতি, অ্যাপ্রোচ, মেসেজিং এ যেহেতু তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি? দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনে সবচেয়ে সফল জামাআতে ইসলামী। দলটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সুসংগঠিতও। তাদেরও সর্বোচ্চ আসনসংখ্যা ১৮। যদি জামাআতে ইসলামীর এ অবস্থা হয় তাহলে অসংখ্য ভাগে বিভক্ত কওমি রাজনৈতিক দলগুলোর সম্ভাবনা কেমন?
.
দুই সেক্যুলার জোটের কোন একটার অংশীদার হয়ে সরকারে যাওয়া ছাড়া নির্বাচনী রাজনীতিতে অন্য কোন বড় অর্জনের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা অন্তত আগামী ৩০ বছরের জন্য এ দলগুলোর সামনে দেখা যাচ্ছে না। এসব জোটের অংশ হয়ে নিশ্চিতভাবেই তারা ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। জোটে থেকে কী কী অর্জন হতে পারে তার বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। চার-দলীয় জোটে ইসলামী ঐক্যজোটের সদস্য দলগুলো ছিল। মহাজোটে নাকি ৭০টার কাছাকাছি ইসলামী দল আছে। এসব জোটে অংশ নিয়ে কিছু টোকেন বিষয় ছাড়া আর তেমন কোন অর্জন হয়নি। এই অর্জনগুলোকে কোন অর্থেই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগতি বলা যায় না। এই দলগুলো বড়জোর সেক্যুলার জোটের জুনিয়র পার্টনার হিসেবে ক্ষমতায় গিয়ে অল্প কিছু বিষয়ে সরকারী পলিসিকে সামান্য প্রভাবিত করতে পারে। খুব বেশি হলে দু-একটা মন্ত্রনালয় হয়তো কয়েক বছরের জন্য পেতে পারে।
.
‘এটুকু অর্জন কি কম?’
এ প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু প্রশ্নটা হওয়া উচিৎ, এটুকু অর্জন কমবেশি যাই হোক – এটাকে কি ইসলাম কায়েমের পথ ও পদ্ধতি বলা যায়?
জামাআতে ইসলামী থেকে শুরু করে ঐক্যজোট – সবাই দাবি করেন তারা বিকল্প না পেয়ে এই পন্থায় ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমরা দেখছি সেক্যুলার জোটের জুনিয়র পার্টনার হওয়াটাই গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত লক্ষ্য। এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এর বেশি কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নেই। মনে রাখবেন, যদি ৩০ কিংবা ৫০ বছর পর এ দলগুলো এককভাবে ক্ষমতায় যেতেও পারে, তবুও কিভাবে সংসদীয় গণতন্ত্র আর পসিটিভ ল’-কে বিলুপ্ত করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেটা নিয়েও কোন স্পষ্ট উত্তর তাদের কাছে নেই। অর্থাৎ ক্ষমতায় গিয়ে কীভাবে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, তা নিয়েও স্পষ্ট বক্তব্য নেই। আবার এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনও বাস্তবসম্মত সম্ভাবনাও দেখা যায় না। তাই এধরণের গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলো বেশি হলে, এক ধরণের মাইনরিটি প্রেশার গ্রুপ বা লবির ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু এটাকে ইসলাম কায়েমের পদ্ধতি কেন বলা হচ্ছে?
.
এ দলগুলো সরাসরি যদি বলতো –আমরা এই সিস্টেমে অংশগ্রহণ করে কিছু নির্দিষ্ট স্বার্থসংরক্ষণের চেষ্টা করছি, কিছু বাতিলের পথ বন্ধ করতে চাচ্ছি। সেক্যুলার দলগুলোকে কিছুটা প্রেশারাইয করছি - তাহলে তাদের দলের নেতাকর্মীদের কোন ভুল ধারণা থাকতো না। তারা বুঝতো আসলে তারা কীসের জন্য কাজ করছেন। কীসের জন্য কুরবানী করছেন। এই স্বচ্ছতা থাকলে এই দলগুলোর কাজকে সম্মান করাও হয়তো কিছুটা সহজ হতো। কিন্তু তারা এটা বলছেন না। তারা জোরালোভাবে বলছেন যে এটা ইসলাম কায়েমের পথ। তারা এই পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েমের জন্য কাজ করছেন। অথচ এই দাবিগুলোর কোন বাস্তবতা নেই। এই ভুল দাবির কারণে বিশাল একটা অংশ মূল সমস্যার সমাধান নিয়ে কিছু করছে না, সমাধান নিয়ে চিন্তাও করছে না। তারা ধরে নিয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তারা সাওয়াবের কাজ করছেন! অনেকে তো হাস্যকরভাবে একে ‘জি হা দ’-ও বলছেন!
.
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও শাসন, মৌলিকভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। জনগনের ভোটে সংসদ সদস্যদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া এবং মানবরচিত আইন দিয়ে শাসন মৌলিকভাবে তাওহিদ ও ইমানের সীমালঙ্ঘন করে। এর ফলে আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইন দিয়ে শাসন, আল্লাহর আইনকে বাতিল করে অন্য আইন প্রণয়ন, হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করা এবং মানুষকে তাগুতের কাছে বিচার-ফায়সালা চাইতে বাধ্য করার মতো বিভিন্ন কুফর ও শিরক আকবর সংঘটিত হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মতো ঐচ্ছিক বিষয়ের ক্ষেত্রে বাধ্যতা, অপারগতার অজুহাত দেয়া যায় না, যেহেতু বিষয়গুলো শিরক ও কুফরের। একই সাথে কল্পিত ‘বৃহত্তর কল্যাণ’-এর যুক্তিও এখানে খাটে না, যেহেতু আদতে এসব করে কী ‘কল্যাণ’ এসেছে তিন দশক ধরে তা মানুষ দেখছেন। তবে, এই গুরুতর আকীদাগত বিষয়গুলোকে তর্কের খাতিরে সাময়িকভাবে একপাশে রেখে আলোচনা করা হলেও, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তকদের কথা, কাজ, পদ্ধতি এবং বাস্তবতার মধ্যে কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক ইসলামী দলগুলোর পথ, পদ্ধতি ও আদর্শ নিয়ে অস্পষ্টতার কোন সুরাহাও হয় না।
[৩]
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতির দুটো দিক দিয়ে আলোচনা হলো। এখন কিছু প্রশ্ন তুলে ধরছি।
.
“ইসলামপন্থী ভাইদের মধ্য থেকে যারা পার্লামেন্টভিত্তিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন কিংবা যারা এই পদ্ধতিকে সমর্থন করছেন, তাদের জন্য ছয়টি প্রশ্ন -
.
১। এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে আপনাদের মূল উদ্দেশ্য কিংবা লক্ষ্য কী?
.
২। শুরুতে কী কী ছাড় আপনারা দিয়ে এসেছেন? অন্যভাবে বললে, কোন কোন মাফসাদা বা ক্ষতি আপনারা গ্রহণ করে নিয়েছেন?
.
৩। কী কী অর্জন করতে বা কোন কোন কল্যাণের দিকে তাকিয়ে আপনারা এই ক্ষতিগুলোকে গ্রহণ করে নিয়েছেন?
.
৪। প্রথম থেকে যা অর্জন করার আশা আপনাদের ছিল সেই আশা কি এখনো অপরিবর্তিত আছে? নাকি ধীরে ধীরে আপনাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষার পরিধি সংকীর্ণ হয়ে আসছে?
.
৫। যদি উত্তর হয় – অর্জনের প্রত্যাশা কমে আসছে – তাহলে আপনারা এর বিনিময়ে ছাড় দেয়ার পরিমাণও কি কমিয়ে ফেলেছেন? যাতে অর্জন ও ছাড় দেয়ার মাঝে ভারসাম্য তৈরী হয়?
.
৬। যারা ইসলামপন্থী আছেন, তারা বর্তমান পার্লামেন্টকেন্দ্রিক রাজনীতিতে শক্তিশালী নাকি দুর্বল?
.
আমি আশা করি, আমাদের যে ভাইয়েরা নির্বাচনকেন্দ্রিক, পার্লামেন্টকেন্দ্রিক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন কিংবা তাদের যারা সমর্থন করেন, তারা এসব প্রশ্নের উত্তর দেবেন।”
সূত্র: ইসলাম প্রতিষ্ঠা: সমকালীন ভাবনায় সৃষ্ট ভ্রান্তি নিরসন, ড. ইয়াদ আল কুনাইবি হাফিজাহুল্লাহ্
.
.
“ইসলামের কল্যানে কাজ করতে চাওয়া কোন সংগঠনের কর্মীরা যদি শরীয়তের মূলনীতির ব্যাপারেই কোন ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তে না এসে থাকে, তা হলে তাদের উচিৎ নিজেদের কয়েকটি প্রশ্ন করা।
.
১। আমাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী?
২। আমরা কী বিশ্বাস করি?
৩। আমরা যা বিশ্বাস করি, তা কীভাবে বিশ্বাস করি?
৪। আমাদের লক্ষ্য কী?
৫। এ লক্ষ্য অর্জনে আমাদের কর্মপদ্ধতি কী?
৬। আমাদের চলার পথের পাথেয় কী হবে?
৭। আমরা কাদের সাথে মিত্রতা করবো?
৮। আমাদের শত্রু-ই বা কারা?
৯। আমাদের এই জমায়েতে কারা যোগ দিতে পারবে?
১০। আমরা আমাদের সাথে কাদেরকে নেব না এবং কেন?
.
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এসব প্রশ্নের উত্তর কেবল ইসলাম থেকেই গ্রহণ করতে হবে। সেই ইসলাম, যা আল্লাহ ওহির মাধ্যমে রাসূল ﷺ-কে জানিয়েছেন। যেভাবে রাসূলের ﷺ সাহাবীগণ (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুম) তা বুঝেছেন। যেভাবে আমাদের সালফে সালেহীনগণ আমাদেরকে শিখিয়েছেন। আমরা যদি সঠিক কাজ করি, তা হলে তা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে। আর আমরা যদি ভুল করে থাকি, তাহলে তা আমাদের দোষ। নিশ্চয় সব প্রশংসা আল্লাহর।”
সূত্র: আল্লাহর সন্তুষ্টির সন্ধানে, ড. নাজীহ ইবরাহীম, আসিম আবদুল মাজিদ ও ইসামুদ্দিন দারবালাহ।
.
প্রশ্নগুলোর জবাব আমাকে বা অন্য কাউকে আলাদা করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। এ প্রশ্নগুলো উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চিন্তা থেকে অস্পষ্ট ঘোলাটে অংশগুলো দূর করা। ইন শা আল্লাহ প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীরভাবে, আল্লাহর সাথে এবং নিজের সাথে সৎ হয়ে চিন্তা করলে, অনেকগুলো বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
Collected
Comment