বিকল্প?
সেক্যুলারিসমের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন এবং সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিকল্প সম্ভাব্য পদ্ধতি হতে পারে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। আদর্শিক এ যুদ্ধের অক্ষ চারটি:
১। সমাজের মানুষের ইসলাহ,
২। যেসব ধারণা, মতবাদ ও মতাদর্শকে ব্যবহার করে সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন টিকিয়ে রাখে, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান এবং চ্যালেঞ্জ করা
৩। সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের বয়ানের বিপরীতে, সেক্যুলারিসমের বিকল্প হিসেবে সামগ্রিকভাবে ইসলামের বয়ানকে উপস্থাপন করা
৪। জনসংযোগ ও গণমুখী কর্মসূচীর মাধ্যমে সামাজিকভাবে ইসলামী দাওয়াহ এবং ইসলামের আদর্শকে শক্তিশালী করা
এই চারটি অক্ষের ব্যাপারে কিছু কথা যুক্ত করা হল।
ইসলাহ: সমাজের বর্তমান মর্মান্তিক বাস্তবতা এবং গুনাহর ব্যাপক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়টি থেকে মানুষের ইসলাহের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতা স্পষ্ট। চলমান ইসলাহী কর্মকান্ডগুলো নিজ নিজ পরিসরে ভূমিকা পালন করলেও তা যথেষ্ট না। নববী মেজাজে, তাজদীদি লক্ষ্য নিয়ে সমাজে প্রচলিত মুনকারগুলো নিয়ে সরাসরি এবং ব্যাপকভাবে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। এটিই নবীর ওয়ারিশদের দায়িত্ব ও উত্তরাধিকার। মসজিদ কমিটির দৌরাত্ম্য কিংবা ওয়াজ-মাহফিলে বাঁধার কারণে যদি কথাগুলো বলা না যায়, তাহলে নিজস্ব উদ্যোগে আলাদাভাবে দাওয়াতী সফর এবং উদ্যোগ নিতে হবে। আর এ পদ্ধতি অপরিচিত কিছু না, এর উদাহরণ এ ভূখন্ডের নেককার পূর্বসূরীদের মাঝে রয়েছে।
সেক্যুলার ধারণা, মতবাদ ও বয়ানকে প্রত্যাখ্যান: সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর ব্যবহৃত ধারণা, মতবাদ ও মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান ও চ্যালেঞ্জ করা আবশ্যক, কারণ এটিই তাদের সামাজিক আধিপত্যের বুনিয়াদী ভিত্তি। এগুলোর মাধ্যমেই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তারা শুধু দ্বীন ইসলামের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে না, বরং বুনে চলেছে ইসলামবিদ্বেষ ও অবক্ষয়ের বীজও। সেক্যুলারদের মতবাদ কিংবা ঐতিহাসিক বয়ানের ‘ইসলামীকরণ’-এর চেষ্টা অবধারিতভাবে ব্যর্থ হবে। শুধু তাই না, এই ব্যর্থ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে অনেক মুসলিমের নিজের ইমান ও আকীদাহও। এখানে একমাত্র কার্যকরী পন্থা হল, এইসব ধারণা ও মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করা, এবং সেগুলোর বৈধতা প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা। ফিরাউনের জাদুকরদের জাদুর নিস্ফলতা সাধারণ মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া আবশ্যক।
বিদ্যমানতার বিকল্প হিসেবে ইসলামের সামগ্রিক উপস্থাপনা: একইসাথে প্রয়োজন সেক্যুলার ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে ইসলামের সামগ্রিক উপস্থাপনা। যতোক্ষণ মানুষ ইসলামকে শুধু ‘আসমানের ওপরের আর যমিনের নিচের’ আলোচনা হিসেবে দেখবে ততোক্ষণ ইসলামী ব্যবস্থা অধিকাংশের কাছে তাত্ত্বিকতা হিসেবেই থেকে যাবে। বাস্তব সমাধান হিসেবে ইসলামের কথা তারা চিন্তা করবে বা চিন্তা করতে পারবে না। তাই ঈমানী, আমলী, এবং আকাইদী বিষয়ের আলোচনার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোকে ইসলাম কিভাবে ব্যাখ্যা ও মোকাবেলা করতে শেখায় তা মানুষের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। আকীদাহ, মাসায়েল, তাযকিয়াতুননাফসের মত বিষয়গুলো যেমন ইসলামের অংশ। তেমনি সমাজ, শাসন, অর্থব্যবস্থা ইত্যাদি কিভাবে চলবে, এই আলোচনাগুলোও ইসলামের অংশ। আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর আলোচনা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব না।
দুঃখজনকভাবে গতো আট-নয় দশক ধরে অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলন আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর আলোচনার দিকে খুব একটা মনোযোগী হয়নি বা হতে পারেনি। আজ দ্বীনি শিক্ষা, ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালনের দাওয়াহ এবং সাদাকাহ-যাকাত সংক্রান্ত কিছু উদ্যোগের মধ্যেই আমাদের অধিকাংশ কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে, একথা বললে ভুল বলা হবে না। কারণ যাই হোক, সমাজের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নেতিবাচক। এর ফলে মানুষের চিন্তার জগতে নিজে থেকেই এক ধরণের বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ ধরেই নিয়েছে অর্থনীতি, সামাজিক সমস্যা, শাসন, যুলুমের মোকাবেলার মত বিষয়গুলোর সমাধানের পথ হল সেক্যুলার রাজনীতি। এগুলোর জন্য যেতে হবে সেক্যুলার রাজনীতির পথে। আর ইসলামী ব্যক্তিত্ব বা সংগঠনগুলোর কাছে মিলবে কেবল “ধর্মীয়” বিষয়ের সমাধান।
এই ধরণের চিন্তার অবধারিত ফলাফল হল সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রন সেক্যুলার-প্রগতিশীল শ্রেণীর হাতে চলে যাওয়া। গত আট-নয় দশকে উপমহাদেশে ঠিক তাই ঘটেছে। আর বিভিন্ন সেক্যুলার দল ও গোষ্ঠী তাদের আকীদাহ এবং এজেন্ডা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রকে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ইসলামী দাওয়াহকে সত্যিকারভাবে সামাজিক শক্তিতে পরিণত করতে হলে ব্যক্তিগত অঙ্গন থেকে একে বের করে আনতে হবে। আর তা করার অন্যতম উপায় হল আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও সমস্যা নিয়ে ইসলামের অবস্থান থেকে আলোচনা নিয়ে আসা।
জনসংযোগ ও গণমুখী কর্মসূচী: সবশেষে এই পুরো দাওয়াহকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া এবং মানুষকে এর সাথে সংযুক্ত করার জন্য প্রয়োজন জনসংযোগ ও গণমুখী নানা কর্মসূচী ও উদ্যোগ, যেখানে মাদ্রাসার ছাত্রশিক্ষকদের পাশাপাশি সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার ছাত্ররাও সংযুক্ত হয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবে। যেখানে আলিমগণের দিকনির্দেশনায়, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দ্বীনদার মুসলিমরা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাতে পারবে দ্বীন ইসলামের কল্যাণে। এধরণের দাওয়াতি কর্মসূচী শহর ও গ্রামের সাধারণ মুসলিমদের সামনে ইসলাম জীবন্ত একটি আদর্শ ও ব্যবস্থা হিসেবে ইন শা আল্লাহ আবারও উপস্থিত করবে। এই সব কিছু হবে ইমানী-আমলী, আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অক্ষকে কেন্দ্র করে, রাজনৈতিক কোন অক্ষ এর মাঝে থাকবে না। মাযহাব-মাসলাকভিত্তিক মতপার্থক্য এবং ঐতিহাসিক তর্কগুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে। বর্তমান অবস্থায় এসব অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব আমাদের দুর্বলতাকে বাড়াবেই কেবল, কমাবে না।
এই চার অক্ষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আদর্শিক এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য সামাজিক শক্তি অর্জন। সামাজিক শক্তি শব্দটি এখানে পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান শাস্ত্রে আসা নির্দিষ্ট অর্থকে বোঝানো হচ্ছে। পারিভাষিক অর্থে সামাজিক শক্তি হল:
“...এমন সব ধরণের প্রভাব ও চাপপ্রয়োগের সক্ষমতার সমষ্টি যা (সমাজের) কোন এক গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর প্রয়োগ করে। এই শক্তি প্রয়োগ করা হয় অন্যদের আচরণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে, অথবা সামষ্টিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই গোষ্ঠীর নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে”। [Gene Sharp, How Non-Violent Struggle Works]
[Gene Sharp, How Non-Violent Struggle Works]
***
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের এ পদ্ধতি সহজ না। গত কয়েক দশক ধরে গতানুগতিক যেসব কর্মসূচীতে ইসলামী ঘরানাগুলো অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সে তুলনায় এধরণের কাজ তুলনামূলকভাবে বেশি চ্যালেঞ্জিং। তবে একই সাথে এটিও সত্য যে, এ পদ্ধতি সুন্নাহ এবং নেককার পূর্বসুরীগণের পথের অধিকতর নিকটবর্তী। আমাদের সোনালী অতীতে এ পদ্ধতির দৃষ্টান্তও আছে প্রচুর। তাই তাওয়াক্কুল, ইখলাস ও ইস্তিকামাতের সাথে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা হলে, উত্তম ফলাফল আসা সম্ভব। উলামায়ে কেরাম যদি এমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যদি ইখলাসের সাথে এ কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে আল্লাহ চাইলে সফলতা আসবে নিশ্চয়। বর্তমানের দুর্বলতা অতিক্রম ইসলাম এ মাটিতে সামাজিকভাবে আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
আমরা সব সময় ইসলাম পূর্ণাংগ জীবনব্যবস্থা। শ্রেষ্ঠ জীবনব্যবস্থা। আজ সময় এসেছে এই বিশ্বাসকে মুখে, কিংবা কাগজে সীমাবদ্ধ না রেখে, মানুষের সামনে আবারো জীবন্ত সত্য হিসেবে উপস্থাপন করার। এটি নিছক তাত্ত্বিকতা বা কল্পকথা না। এই ব্যবস্থা প্রবল প্রতাপের সাথে একসময় বিশ্বকে শাসন করেছে, জন্ম দিয়েছে হাজার বছরের চোখধাঁধানো সভ্যতার। এবং আজো এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নযোগ্য। আসমান ও যমীনসমূহের মালিক আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:
إِنَّ الَّذِينَ يُحَادُّونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَٰئِكَ فِي الْأَذَلِّينَ
كَتَبَ اللَّهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِي ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে তারাই সবচেয়ে বেশী লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ লিখে দিয়েছেন, ‘আমি ও আমার রাসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব।’ নিশ্চয় আল্লাহ মহা শক্তিমান, মহা পরাক্রমশালী।
সূরা আল-মুজাদালা
(এটি কেবল একটি প্রস্তাবনা, তবে আল্লাহ চাইলে এটি নতুন চিন্তা এবং উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সাফল্য কেবল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং তিনিই সর্বাধিক জ্ঞাত।)
(সমাপ্ত)
প্রথম পর্বের লিংক
https://dawahilallah.com/forum/%E0%A6%AE%E0%A7%82%E0%A6%B2-%E0%A6%AB%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AE/%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A 6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AF/189623-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AA%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A 6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%B6-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A 6%AC%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A 6%AA-%E0%A6%AA%E0%A6%A5-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A7%A7