আমরা কেনো জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে যাই।
বিংশ শতাব্দীর সূর্য উদিত হয়েছিলো ইসলাম বিরোধীদের জয়ের বার্তা নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর উপর আঘাত হানা কালো রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। কিন্তু রাত যতই দীর্ঘ হোক তাকে তো ভোরের আলো নিয়ে পোহাতেই হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলিম উম্মাহ তার বুক চিড়ে হীরার টুকরো বীর সন্তানগুলোকে উন্মুক্ত করতে শুরু করে। ফলে আল্লাহর এই জমিনের উপর দিয়ে জিহাদের এক শীতল হওয়া বয়তে শুরু করে। জিহাদের এই শীতল হওয়ায় বাংলার জমিনে অবস্থানরত মুমিনদেরও অন্তরগুলো সজিব ও সতেজ হয়ে উঠে। ফলে মুমিনদের চোখগুলো অশ্রুতে ছলছল করতে শুরু করে। সপ্ন দেখতে শুরু করে দ্বীনের মুজাহিদ হবে, পরিবার ছেড়ে জিহাদে যাবে, আল্লাহর বাস্তায় শহীদ হবে। আর যাই হোক তাদের মানসিক প্রস্তুতি ছিলো খুবই প্রবল। কিভাবে তারা মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সদ্য হাঁটতে শেখা ছেলেকে রেখে জিহাদে যাবে তার প্রস্তুতি তারা ভালোমতই নিয়ে ছিলো। মনের মাঝে এসব নিয়ে কত সপ্ন বুনেছে, কতবার তাদের দুই চোখ আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। আজ হয়তো তারা তা ভুলে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছে দ্বীনের মুজাহিদ হওয়ার সপ্প, ভুলে গিয়েছে শহীদ হওয়ার সপ্ন, ভুলে গিয়েছে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবাদের মতো হওয়ার সপ্ন। কিন্তু কেন তারা জিহাদের এ পথ থেকে ঝরে গেলো?
আজও দেখা যায় কিছু ভাই মনের মাঝে তিলতিল করে গড়া জিহাদ করার সপ্ন ভুলে দুনিয়াবী কাজে ব্যস্থ হয়ে পড়েছে। কিভাবে ছয় মাস, এক বছর বা পাঁচ বছর যেতেই এ সপ্ন অন্তর থেকে ভ্যানিস হয়ে যেতে পারে। এটা কি দুনিয়াবী সপ্নের মতো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়! কখনও ডাক্তার, কখনও ইঞ্জিনিয়ার, সর্বশেষে বিসিএস ক্যাডার। এ সপ্ন তো দুনিয়াবী সপ্নের মতো নয় ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হবার। এ আবেগ তো দুনিয়াবী আবেগের মতো নয় ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়ার। এই সপ্ন তো আল্লাহ ও তার রাসূলের (সাঃ) সাথে জড়িত। তাহলে কেনো আমাদের অন্তর থেকে এ সপ্ন ভ্যানিস হয়ে যায়? আর কেনোই বা আমরা জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে যাই! আমরা আজ এর উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করবো, ইনশা-আল্লাহ।
প্রথম কারণ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ সবচাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গ্রহণ না করা। পৃথিবীতে বসবাস করতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের আনজাম দিতে হয়। রিজিকের অনুসন্ধান করা, ঋণ পরিশোধ করা, পড়াশোনা করা, পরিবারের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করা, সন্তানকে পড়াশোনা করানো, বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশোনা করা, পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনায়ন করা। আমরা সবাই দুনিয়ার এমন একাধিক কাজে লিপ্ত। আর এটাই বাস্তবতা। কিন্তু অবাস্তবতা হলো দুনিয়াবী এসব কাজের আনজাম দিতে গিয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন: নামাজ, জিহাদ এসব বাদ দিয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্থ হয়ে যাওয়া। আবার আমরা কেউ কেউ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি “এ ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলে তখন নিয়মিত নামাজ পড়বো বা পূরিপূর্ণ ভাবে জিহাদের কাজে লেগে যাবো” কিন্তু এ দুনিয়ায় তো ঝামেলা শেষ হওয়ার কথা নয়।
অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন কাজের প্রাইউরিটির ধারাবাহিকতা সেট না করার জন্য আমরা বরকতময় এই জিহাদের পথ থেকে ঝরে পড়ছি। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ধারাবাহিকতার প্রাইউরিটি সেট সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ উদাহরণ রয়েছে। একদিন একজন প্রফেসর তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি এক্সপেরিমেন্ট করেন। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে প্রফেসর একটি খালি প্লেট নিলেন এবং প্লেটে কয়েকটি গলফ বল রাখলেন। তারপর শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলেন প্লেট কি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে? শিক্ষার্থীরা বলল, জ্বী স্যার। প্রফেসর কিছু পাথর কুচি নিয়ে প্লেটে ঢেলে দিলেন, এতে পাথর কুচিগুলো গলফ বলের ফাঁকা স্থান গুলো দখল করে নেয়। প্রফেসর আবার জিজ্ঞেস করলেন, প্লেটটি কি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে? শিক্ষার্থীরা বলল, জ্বী স্যার এবার পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রফেসর এবার কিছু বালি প্লেটে ঢেলে দেয়। তারপর প্রফেসর আবার জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি পূর্ণ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলল, স্যার এবার কিন্তু প্লেট সত্যি সত্যিই পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রফেসর শিক্ষার্থীদের অবাক করে দিয়ে পানি ঢেলে দেয়।
এরপর প্রফেসর আরও একটি খালি প্লেট নিলেন এবং ধারাবাহিক ভাবে পানি, বালি, পাথর ঢেলে দেয়। এতে প্লেটটি প্রায় অর্ধপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে গলফ বল রাখার পর্যাপ্ত স্থান থাকে না। এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে প্রফেসর বললেন, আমরা যদি কমগুরুত্বপূর্ণ কাজ দ্বারা ২৪ ঘন্টাকে খালি প্লেটের মতো পানি, বালি ও পাথর দিয়ে ভরে ফেলি তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার সুযোগ পাবো না। কিন্তু আমরা যদি প্রথমে অধিকগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করি তবে কমগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার ঠিকই সময় পাবো। আজ মুসলিম বিশ্বে অগ্রাধীকার যোগ্য প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জিহাদ। অথচ আমরা জিহাদকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গ্রহণ করছি না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اۨلَّذِيۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِيَارِهِمۡ بِغَيۡرِ حَقٍّ اِلَّاۤ اَنۡ يَّقُوۡلُوۡا رَبُّنَا اللّٰهُ ؕ وَلَوۡلَا دَ فۡعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعۡضَهُمۡ بِبَـعۡضٍ لَّهُدِّمَتۡ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَّصَلٰوتٌ وَّمَسٰجِدُ يُذۡكَرُ فِيۡهَا اسۡمُ اللّٰهِ كَثِيۡرًا ؕ وَلَيَنۡصُرَنَّ اللّٰهُ مَنۡ يَّنۡصُرُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَقَوِىٌّ عَزِيۡزٌ ٤٠
অর্থ: যাদেরকে তাদের নিজ বাড়ী-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’। আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খৃস্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইয়াহূদীদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সূরা হজ্জ: ৪০)
...
আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করতে গিয়ে জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ি। অধিকাংশ আমরা জিহাদের চেয়ে আর্থিক সচ্ছলতাকে প্রাইউরিটি লিষ্টের প্রথমে রাখি। যা একটি মারাত্মক ভুল এবং শয়তানের সূক্ষ্ম ফাঁদ। বাস্তব একটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ব্যবসায়ী এক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর নামাজ কাজা করবে না এবং সময়ের নামাজ সময়ের মধ্যেই আদায় করবে। ফলে শয়তান তাকে ফাঁদে ফেলার সকল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির। ব্যবসায়ীকে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। তুমি দোকান নামাজের সময় বন্ধ রাখলে দিনে অন্তত তিন বার বন্ধ রাখতে হবে। ক্রেতা দোকান বন্ধ পেয়ে বিরক্তবোধ করবে বেচাকেনা কমে যাবে। পরিবার কি দিয়ে চালাবে? সন্তানের পড়ালেখার খরচ ও আবদার কিভাবে মেটাবে?
ব্যবসায়ী শয়তানের ধোঁকায় পা না দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে সময় মতো নামাজ পড়া শুরু করে। ফলে সত্যি সত্যিই তার বেচাকেনা কমতে শুরু করে এবং নিয়মিত ক্রেতারা অভিযোগ করতে শুরু করে, আপনার দোকান অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। ক্রেতাদের অভিযোগ এড়াতে দোকানী একটি সাইন বোর্ড তৈরি করে, “নামাজের সময় হওয়ায় দোকান বন্ধ রয়েছে”। সময়ের সাথে সাথে তার পোশাক, কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। ব্যবসায়ী ক্রেতা মহলে বিশ্বস্ত হতে শুরু করে। দোকান বন্ধ থাকলে ক্রেতারা তার অপেক্ষায় থাকে। ফলে ব্যবসায়ীর বেচাকেনা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ فِی السَّمَآءِ رِزۡقُكُمۡ وَ مَا تُوۡعَدُوۡنَ
অর্থঃ আকাশে রয়েছে তোমাদের রিযকের উৎস ও প্রতিশ্রুত সবকিছু। (সূরা জারিয়াতঃ ২২)
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الۡقُوَّۃِ الۡمَتِیۡنُ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহই রিযকদাতা, তিনি শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সূরা জারিয়াতঃ ৫৮)
রিজিক আমাদের নির্ধারিত। হ্যা, আপনি সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তবে আপনি ধর্য্য ধরলে পূর্বের চেয়ে ভালো অবস্থানে যাবেন। তেমনই হয়তো জিহাদকে প্রাইউরিটি লিস্টের প্রথমে রাখার জন্য সাময়িক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তবে দিন শেষে এমন কিছু পাবেন যার আশা আপনি করতেন না। (ইনশা-আল্লাহ)
…
পরিবেশের প্রভাবেও জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা ঝরে পড়ি। মুসলিম উম্মাহর যুবকরা সবচেয়ে বেশি জিহাদের কাঁটাযুক্ত বরকতময় পথে পা বাড়ায়। তবে অল্প কিছু যুবক জিহাদের এই বরকতময় পথে টিকে থাকতে পারে। আর ঝড়ে পড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো পরিবেশের প্রভাব। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যুবকরা পড়াশোনার তাগিদে যুবক বয়সের একটি বড় সময় মেস বা হোস্টেলে কাটায়। সেকুলার রাষ্ট্রে মেস জীবন যুবকদের জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকারময় জীবন। একটি মেসে যদি দশজন যুবক থাকে এবং তারা যদি দুনিয়াদার হয়। মুভি, গেম, হারাম রিলেশন, হাসি-ঠাট্রায়, অতি-ভোজনে ব্যস্থ সময় পার করে এমন পরিবেশে একজন দ্বীনদার যুবক হয় দুনিয়াদারে পরিণত হবে নয়তো দুনিয়াদারেরা দ্বীনদারে পরিণত হবে। এই অবস্থা নির্ভর করে কে বেশি শক্তিশালী দুনিয়াদার নাকি দ্বীনদার।
দুঃখজনক হলেও সত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন পরিবেশে একজন দ্বীনদার ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। সমাজে শক্তিশালী ইমানদার নেই বললেই চলে, যার সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ফলে বা ইমানদারের আখলাক ও চরিত্র দেখে দশজন ব্যক্তি ইমানদার হয়ে যাবে। আবার আমরা যারা বাবা-মার সাথে বাসায় থাকছি তারা দুনিয়াদার বন্ধুর সাথে উঠা-বসা, আড্ডা, হাসি-ঠাট্রায় লিপ্ত হওয়ার কারণে হারিয়ে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের উচিত এমন মেস, বন্ধু বা রুমমেট নির্ধারণ করা যাদের সাথে থাকলে আখিরাতের কথা স্মরণ হয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ كُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ
অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা তাওবাঃ ১১৯)
…
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে আমরা অনেকেই জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে পড়ছি। আমরা যখন জিহাদের কাঁটা যুক্ত পথ পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আল্লাহ আমাদের বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিতে শুরু করেন। আমাদেরকে এই কাঁটা যুক্ত পথ চলতে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। আল্লাহ তা’আলা দেখতে চান আমরা কি সত্যিই বলছি জিহাদ করবো নাকি সামান্য বিপদেই পিছনে দৌড় দিবো।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
অর্থঃ আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। (সূরা বাকারাঃ ১৫৫)
হঠাৎ মনে হয় কেউ যেনো ফলো করতেছে, জিহাদী সাইট ভিজিট করার পর, একের পর এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসতেছে। আবার বাস বা বাইক চেক পোস্টে চেক করার সময় তো দম বন্ধ হয়ে যায়। এসব পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে আমরা এমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি যে, জিহাদের চিন্তা তো দূরের কথা আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠে। আবার তাগুতের সামান্য ধমক, “অনলাইন আমাদের নজরদারিতে রয়েছে”। এতেই আমাদের প্যান্ট ভিজে যায়।
…
ব্যক্তি জীবনে আমল বৃদ্ধি এবং পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা না থাকার কারণেও জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা ঝরে যাই। আমরা যদি জিহাদের এই কাঁটাময় পথে টিকে থাকতে চাই তাহলে পর্যাক্রমে ব্যক্তি জীবনে আমল বৃদ্ধি করতে হবে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন চরিত্রের মান একই করতে হবে। আর পাপ কমিয়ে দিতে হবে তবেই আমরা আল্লাহর পক্ষ থকে সাহায্য প্রাপ্ত হবো। আর আমাদের মনে রাখতে হবে তাকওয়া হলো সকল আমলের প্রাণ। প্রাণহীন আমল করে আল্লাহর সাহায্য আশা করা যায় না। আর পাপ আমাদের হৃদয়কে রোগাক্রান্ত করে। রোগাক্রান্ত হৃদয় জিহাদের এই কঠিন পথে টিকে থাকতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা অন্তরের ইসলাহ বা সংশোধনের জন্য কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। অথচ আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি না। অন্তরের সু্স্থতা ও পরিশুদ্ধতা হলো সকল কল্যাণের মূল এবং দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির মাধ্যম।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ لَاَجۡرُ الۡاٰخِرَۃِ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ كَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ
অর্থঃ আর যারা ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আখিরাতের প্রতিদানই উত্তম। (সূরা ইউসুফঃ ৫৭)
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡكِتٰبَ وَ الۡحِكۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ كَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
অর্থঃ অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। (সূরা আল ইমরানঃ ১৬৪)
…
মুজাহিদিনের সাথে সম্পর্ক গড়ে না উঠার কারণেও আমরা জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে যাই। আমহামদুলিল্লাহ, আমাদের অনেকেরই সপ্ন থাকে আল্লাহর রাস্তার জিহাদ করবো। কিন্তু মুজাহিদদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা দূরের কথা তাদেরকে অনেকে ফলোও করি না। বলা যায় নিজের মনের মাঝে শুধু জিহাদের ফ্যান্টাসি তৈরি করি। এমনও হয় যে, অফলাইনে মুজাহিদদের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকার পরও অবহেলা করি। দেখা করবো, করছি করতে করতে সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। মুজাহিদিনের সাইটগুলো নিয়মিত ভিজিট করি না, বৈশ্বিক জিহাদের খবর রাখি না। মুজাহিদ ভাইদের জন্য দোয়া করি না। তাদের কষ্টে কাতর হই না, তাদের আনন্দে আনন্দিত হই না। তাহলে কি করে একজন ব্যক্তির অন্তরে জিহাদ করার তামান্না বেঁচে থাকতে পারে!
আপনি যদি মুজাহিদ হতে চান তাদের তো মুজাহিদদের ফলো করতে হবে। মুজাহিদের ইতিহাস জানতে হবে। তারা কতটা প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে জীবনযাপন করছে জানতে হবে। মুজাহিদরা তো দ্বীনের অতন্দ্রপহরী। তারা মুসলিম উম্মাহর আইডল। যখন আপনি এসব থেকে দূরে থাকবেন। জিহাদ করার তামান্না আপনার মন থেকে আস্তে আস্তে দূর হতে থাকবে।
বিংশ শতাব্দীর সূর্য উদিত হয়েছিলো ইসলাম বিরোধীদের জয়ের বার্তা নিয়ে। মুসলিম উম্মাহর উপর আঘাত হানা কালো রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। কিন্তু রাত যতই দীর্ঘ হোক তাকে তো ভোরের আলো নিয়ে পোহাতেই হবে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলিম উম্মাহ তার বুক চিড়ে হীরার টুকরো বীর সন্তানগুলোকে উন্মুক্ত করতে শুরু করে। ফলে আল্লাহর এই জমিনের উপর দিয়ে জিহাদের এক শীতল হওয়া বয়তে শুরু করে। জিহাদের এই শীতল হওয়ায় বাংলার জমিনে অবস্থানরত মুমিনদেরও অন্তরগুলো সজিব ও সতেজ হয়ে উঠে। ফলে মুমিনদের চোখগুলো অশ্রুতে ছলছল করতে শুরু করে। সপ্ন দেখতে শুরু করে দ্বীনের মুজাহিদ হবে, পরিবার ছেড়ে জিহাদে যাবে, আল্লাহর বাস্তায় শহীদ হবে। আর যাই হোক তাদের মানসিক প্রস্তুতি ছিলো খুবই প্রবল। কিভাবে তারা মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও সদ্য হাঁটতে শেখা ছেলেকে রেখে জিহাদে যাবে তার প্রস্তুতি তারা ভালোমতই নিয়ে ছিলো। মনের মাঝে এসব নিয়ে কত সপ্ন বুনেছে, কতবার তাদের দুই চোখ আবেগে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। আজ হয়তো তারা তা ভুলে গিয়েছে। ভুলে গিয়েছে দ্বীনের মুজাহিদ হওয়ার সপ্প, ভুলে গিয়েছে শহীদ হওয়ার সপ্ন, ভুলে গিয়েছে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবাদের মতো হওয়ার সপ্ন। কিন্তু কেন তারা জিহাদের এ পথ থেকে ঝরে গেলো?
আজও দেখা যায় কিছু ভাই মনের মাঝে তিলতিল করে গড়া জিহাদ করার সপ্ন ভুলে দুনিয়াবী কাজে ব্যস্থ হয়ে পড়েছে। কিভাবে ছয় মাস, এক বছর বা পাঁচ বছর যেতেই এ সপ্ন অন্তর থেকে ভ্যানিস হয়ে যেতে পারে। এটা কি দুনিয়াবী সপ্নের মতো ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়! কখনও ডাক্তার, কখনও ইঞ্জিনিয়ার, সর্বশেষে বিসিএস ক্যাডার। এ সপ্ন তো দুনিয়াবী সপ্নের মতো নয় ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হবার। এ আবেগ তো দুনিয়াবী আবেগের মতো নয় ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়ার। এই সপ্ন তো আল্লাহ ও তার রাসূলের (সাঃ) সাথে জড়িত। তাহলে কেনো আমাদের অন্তর থেকে এ সপ্ন ভ্যানিস হয়ে যায়? আর কেনোই বা আমরা জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে যাই! আমরা আজ এর উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করবো, ইনশা-আল্লাহ।
প্রথম কারণ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ সবচাইতে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গ্রহণ না করা। পৃথিবীতে বসবাস করতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের আনজাম দিতে হয়। রিজিকের অনুসন্ধান করা, ঋণ পরিশোধ করা, পড়াশোনা করা, পরিবারের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করা, সন্তানকে পড়াশোনা করানো, বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশোনা করা, পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনায়ন করা। আমরা সবাই দুনিয়ার এমন একাধিক কাজে লিপ্ত। আর এটাই বাস্তবতা। কিন্তু অবাস্তবতা হলো দুনিয়াবী এসব কাজের আনজাম দিতে গিয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন: নামাজ, জিহাদ এসব বাদ দিয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্থ হয়ে যাওয়া। আবার আমরা কেউ কেউ আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি “এ ঝামেলা থেকে মুক্তি পেলে তখন নিয়মিত নামাজ পড়বো বা পূরিপূর্ণ ভাবে জিহাদের কাজে লেগে যাবো” কিন্তু এ দুনিয়ায় তো ঝামেলা শেষ হওয়ার কথা নয়।
অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন কাজের প্রাইউরিটির ধারাবাহিকতা সেট না করার জন্য আমরা বরকতময় এই জিহাদের পথ থেকে ঝরে পড়ছি। দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ধারাবাহিকতার প্রাইউরিটি সেট সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ উদাহরণ রয়েছে। একদিন একজন প্রফেসর তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি এক্সপেরিমেন্ট করেন। শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে প্রফেসর একটি খালি প্লেট নিলেন এবং প্লেটে কয়েকটি গলফ বল রাখলেন। তারপর শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলেন প্লেট কি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে? শিক্ষার্থীরা বলল, জ্বী স্যার। প্রফেসর কিছু পাথর কুচি নিয়ে প্লেটে ঢেলে দিলেন, এতে পাথর কুচিগুলো গলফ বলের ফাঁকা স্থান গুলো দখল করে নেয়। প্রফেসর আবার জিজ্ঞেস করলেন, প্লেটটি কি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে? শিক্ষার্থীরা বলল, জ্বী স্যার এবার পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রফেসর এবার কিছু বালি প্লেটে ঢেলে দেয়। তারপর প্রফেসর আবার জিজ্ঞেস করলেন, এবার কি পূর্ণ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলল, স্যার এবার কিন্তু প্লেট সত্যি সত্যিই পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রফেসর শিক্ষার্থীদের অবাক করে দিয়ে পানি ঢেলে দেয়।
এরপর প্রফেসর আরও একটি খালি প্লেট নিলেন এবং ধারাবাহিক ভাবে পানি, বালি, পাথর ঢেলে দেয়। এতে প্লেটটি প্রায় অর্ধপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে গলফ বল রাখার পর্যাপ্ত স্থান থাকে না। এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে প্রফেসর বললেন, আমরা যদি কমগুরুত্বপূর্ণ কাজ দ্বারা ২৪ ঘন্টাকে খালি প্লেটের মতো পানি, বালি ও পাথর দিয়ে ভরে ফেলি তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার সুযোগ পাবো না। কিন্তু আমরা যদি প্রথমে অধিকগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করি তবে কমগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার ঠিকই সময় পাবো। আজ মুসলিম বিশ্বে অগ্রাধীকার যোগ্য প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জিহাদ। অথচ আমরা জিহাদকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে গ্রহণ করছি না।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اۨلَّذِيۡنَ اُخۡرِجُوۡا مِنۡ دِيَارِهِمۡ بِغَيۡرِ حَقٍّ اِلَّاۤ اَنۡ يَّقُوۡلُوۡا رَبُّنَا اللّٰهُ ؕ وَلَوۡلَا دَ فۡعُ اللّٰهِ النَّاسَ بَعۡضَهُمۡ بِبَـعۡضٍ لَّهُدِّمَتۡ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَّصَلٰوتٌ وَّمَسٰجِدُ يُذۡكَرُ فِيۡهَا اسۡمُ اللّٰهِ كَثِيۡرًا ؕ وَلَيَنۡصُرَنَّ اللّٰهُ مَنۡ يَّنۡصُرُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَقَوِىٌّ عَزِيۡزٌ ٤٠
অর্থ: যাদেরকে তাদের নিজ বাড়ী-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’। আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধস্ত হয়ে যেত খৃস্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইয়াহূদীদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ- যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। (সূরা হজ্জ: ৪০)
...
আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করতে গিয়ে জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ি। অধিকাংশ আমরা জিহাদের চেয়ে আর্থিক সচ্ছলতাকে প্রাইউরিটি লিষ্টের প্রথমে রাখি। যা একটি মারাত্মক ভুল এবং শয়তানের সূক্ষ্ম ফাঁদ। বাস্তব একটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ব্যবসায়ী এক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর নামাজ কাজা করবে না এবং সময়ের নামাজ সময়ের মধ্যেই আদায় করবে। ফলে শয়তান তাকে ফাঁদে ফেলার সকল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হাজির। ব্যবসায়ীকে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে। তুমি দোকান নামাজের সময় বন্ধ রাখলে দিনে অন্তত তিন বার বন্ধ রাখতে হবে। ক্রেতা দোকান বন্ধ পেয়ে বিরক্তবোধ করবে বেচাকেনা কমে যাবে। পরিবার কি দিয়ে চালাবে? সন্তানের পড়ালেখার খরচ ও আবদার কিভাবে মেটাবে?
ব্যবসায়ী শয়তানের ধোঁকায় পা না দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে সময় মতো নামাজ পড়া শুরু করে। ফলে সত্যি সত্যিই তার বেচাকেনা কমতে শুরু করে এবং নিয়মিত ক্রেতারা অভিযোগ করতে শুরু করে, আপনার দোকান অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। ক্রেতাদের অভিযোগ এড়াতে দোকানী একটি সাইন বোর্ড তৈরি করে, “নামাজের সময় হওয়ায় দোকান বন্ধ রয়েছে”। সময়ের সাথে সাথে তার পোশাক, কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। ব্যবসায়ী ক্রেতা মহলে বিশ্বস্ত হতে শুরু করে। দোকান বন্ধ থাকলে ক্রেতারা তার অপেক্ষায় থাকে। ফলে ব্যবসায়ীর বেচাকেনা পূর্বের চেয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ فِی السَّمَآءِ رِزۡقُكُمۡ وَ مَا تُوۡعَدُوۡنَ
অর্থঃ আকাশে রয়েছে তোমাদের রিযকের উৎস ও প্রতিশ্রুত সবকিছু। (সূরা জারিয়াতঃ ২২)
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الۡقُوَّۃِ الۡمَتِیۡنُ
অর্থঃ নিশ্চয় আল্লাহই রিযকদাতা, তিনি শক্তিধর, পরাক্রমশালী। (সূরা জারিয়াতঃ ৫৮)
রিজিক আমাদের নির্ধারিত। হ্যা, আপনি সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তবে আপনি ধর্য্য ধরলে পূর্বের চেয়ে ভালো অবস্থানে যাবেন। তেমনই হয়তো জিহাদকে প্রাইউরিটি লিস্টের প্রথমে রাখার জন্য সাময়িক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। তবে দিন শেষে এমন কিছু পাবেন যার আশা আপনি করতেন না। (ইনশা-আল্লাহ)
…
পরিবেশের প্রভাবেও জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা ঝরে পড়ি। মুসলিম উম্মাহর যুবকরা সবচেয়ে বেশি জিহাদের কাঁটাযুক্ত বরকতময় পথে পা বাড়ায়। তবে অল্প কিছু যুবক জিহাদের এই বরকতময় পথে টিকে থাকতে পারে। আর ঝড়ে পড়ার অন্যতম একটি কারণ হলো পরিবেশের প্রভাব। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যুবকরা পড়াশোনার তাগিদে যুবক বয়সের একটি বড় সময় মেস বা হোস্টেলে কাটায়। সেকুলার রাষ্ট্রে মেস জীবন যুবকদের জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকারময় জীবন। একটি মেসে যদি দশজন যুবক থাকে এবং তারা যদি দুনিয়াদার হয়। মুভি, গেম, হারাম রিলেশন, হাসি-ঠাট্রায়, অতি-ভোজনে ব্যস্থ সময় পার করে এমন পরিবেশে একজন দ্বীনদার যুবক হয় দুনিয়াদারে পরিণত হবে নয়তো দুনিয়াদারেরা দ্বীনদারে পরিণত হবে। এই অবস্থা নির্ভর করে কে বেশি শক্তিশালী দুনিয়াদার নাকি দ্বীনদার।
দুঃখজনক হলেও সত্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন পরিবেশে একজন দ্বীনদার ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। সমাজে শক্তিশালী ইমানদার নেই বললেই চলে, যার সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ফলে বা ইমানদারের আখলাক ও চরিত্র দেখে দশজন ব্যক্তি ইমানদার হয়ে যাবে। আবার আমরা যারা বাবা-মার সাথে বাসায় থাকছি তারা দুনিয়াদার বন্ধুর সাথে উঠা-বসা, আড্ডা, হাসি-ঠাট্রায় লিপ্ত হওয়ার কারণে হারিয়ে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের উচিত এমন মেস, বন্ধু বা রুমমেট নির্ধারণ করা যাদের সাথে থাকলে আখিরাতের কথা স্মরণ হয়।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ كُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ
অর্থঃ হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা তাওবাঃ ১১৯)
…
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে আমরা অনেকেই জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে পড়ছি। আমরা যখন জিহাদের কাঁটা যুক্ত পথ পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আল্লাহ আমাদের বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা নিতে শুরু করেন। আমাদেরকে এই কাঁটা যুক্ত পথ চলতে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। আল্লাহ তা’আলা দেখতে চান আমরা কি সত্যিই বলছি জিহাদ করবো নাকি সামান্য বিপদেই পিছনে দৌড় দিবো।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ بِشَیۡءٍ مِّنَ الۡخَوۡفِ وَ الۡجُوۡعِ وَ نَقۡصٍ مِّنَ الۡاَمۡوَالِ وَ الۡاَنۡفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ ؕ وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیۡنَ
অর্থঃ আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। (সূরা বাকারাঃ ১৫৫)
হঠাৎ মনে হয় কেউ যেনো ফলো করতেছে, জিহাদী সাইট ভিজিট করার পর, একের পর এক অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসতেছে। আবার বাস বা বাইক চেক পোস্টে চেক করার সময় তো দম বন্ধ হয়ে যায়। এসব পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে আমরা এমন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি যে, জিহাদের চিন্তা তো দূরের কথা আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠে। আবার তাগুতের সামান্য ধমক, “অনলাইন আমাদের নজরদারিতে রয়েছে”। এতেই আমাদের প্যান্ট ভিজে যায়।
…
ব্যক্তি জীবনে আমল বৃদ্ধি এবং পাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা না থাকার কারণেও জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে আমরা ঝরে যাই। আমরা যদি জিহাদের এই কাঁটাময় পথে টিকে থাকতে চাই তাহলে পর্যাক্রমে ব্যক্তি জীবনে আমল বৃদ্ধি করতে হবে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন চরিত্রের মান একই করতে হবে। আর পাপ কমিয়ে দিতে হবে তবেই আমরা আল্লাহর পক্ষ থকে সাহায্য প্রাপ্ত হবো। আর আমাদের মনে রাখতে হবে তাকওয়া হলো সকল আমলের প্রাণ। প্রাণহীন আমল করে আল্লাহর সাহায্য আশা করা যায় না। আর পাপ আমাদের হৃদয়কে রোগাক্রান্ত করে। রোগাক্রান্ত হৃদয় জিহাদের এই কঠিন পথে টিকে থাকতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা অন্তরের ইসলাহ বা সংশোধনের জন্য কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। অথচ আমরা কোরআন তেলাওয়াত করি না। অন্তরের সু্স্থতা ও পরিশুদ্ধতা হলো সকল কল্যাণের মূল এবং দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির মাধ্যম।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ لَاَجۡرُ الۡاٰخِرَۃِ خَیۡرٌ لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ كَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ
অর্থঃ আর যারা ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আখিরাতের প্রতিদানই উত্তম। (সূরা ইউসুফঃ ৫৭)
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡكِتٰبَ وَ الۡحِكۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ كَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
অর্থঃ অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসূল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়। যদিও তারা ইতঃপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল। (সূরা আল ইমরানঃ ১৬৪)
…
মুজাহিদিনের সাথে সম্পর্ক গড়ে না উঠার কারণেও আমরা জিহাদের এই বরকতময় পথ থেকে ঝরে যাই। আমহামদুলিল্লাহ, আমাদের অনেকেরই সপ্ন থাকে আল্লাহর রাস্তার জিহাদ করবো। কিন্তু মুজাহিদদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা দূরের কথা তাদেরকে অনেকে ফলোও করি না। বলা যায় নিজের মনের মাঝে শুধু জিহাদের ফ্যান্টাসি তৈরি করি। এমনও হয় যে, অফলাইনে মুজাহিদদের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকার পরও অবহেলা করি। দেখা করবো, করছি করতে করতে সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। মুজাহিদিনের সাইটগুলো নিয়মিত ভিজিট করি না, বৈশ্বিক জিহাদের খবর রাখি না। মুজাহিদ ভাইদের জন্য দোয়া করি না। তাদের কষ্টে কাতর হই না, তাদের আনন্দে আনন্দিত হই না। তাহলে কি করে একজন ব্যক্তির অন্তরে জিহাদ করার তামান্না বেঁচে থাকতে পারে!
আপনি যদি মুজাহিদ হতে চান তাদের তো মুজাহিদদের ফলো করতে হবে। মুজাহিদের ইতিহাস জানতে হবে। তারা কতটা প্রতিকূল পরিবেশে কিভাবে জীবনযাপন করছে জানতে হবে। মুজাহিদরা তো দ্বীনের অতন্দ্রপহরী। তারা মুসলিম উম্মাহর আইডল। যখন আপনি এসব থেকে দূরে থাকবেন। জিহাদ করার তামান্না আপনার মন থেকে আস্তে আস্তে দূর হতে থাকবে।
Comment