"আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন, আমিও আল্লাহকে ভালবাসি"
আল্লাহ তা‘আলা কুল কায়েনাত সৃষ্টি করে তাদের মধ্য হতে মানুষকে “সর্বোত্তম সৃষ্টি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا
“নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি” [সূরা বনী ইসরাঈল-৭০]আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানের মাঝেও কিছু গুণাবলীর কারণে কতককে আর কতকের উপর সম্মান-মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ.
নিশ্চয় আল্লাহ্র কাছে তোমাদের মধ্যে সব-চাইতে সম্মানিত সেইজন যে তোমাদের মধ্যে সব- চাইতে বেশি পরহেগার। [হুজুরাত- ১৩]আরো কিছু বিশেষ মানুষের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে আল্লাহপাক “ভালবাসেন” বলেছেন।
যেমন: "যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করেন", "যারা আল্লাহর রাস্তায় শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় অটল থেকে যুদ্ধ করেন", "যারা অধিক তওবা করেন, যারা অধিক পবিত্রতা অর্জন করেন", "যারা এহসান করেন", তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভালবাসেন। -এদের ব্যাপারে “ভালবাসা” শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা নিজের পক্ষ থেকে ও তাদের পক্ষ থেকে, অর্থাৎ উভয় দিক থেকে "আল্লাহপাক তাদের ভালবাসেন তারাও আল্লাহকে ভালবাসে" উল্লেখ করেছেন। আর তাঁরা হচ্ছেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীগণ।
নিম্নে উল্লিখিত আয়াতে ছয়টি সিফাত বর্ণিত হয়েছে, যা পূর্ণাঙ্গভাবে সেই মুজাহিদগণের প্রতি ইঙ্গিত করে।
يآ أيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا مُنْ يَّرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِيْنِه فَسَوْفَ يَأْتِي اللهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّوْنَه أَذِلَّةٍ عَلَى المُؤْمِنِيْنَ أَعِزَّةٍ عَلَى الكَافِرِيْنَ يُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَلَا يَخَافُوْنَ لَوْمَةَ لَائِمٍ، ذلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيْهِ مَنْ يَّشَاءُ
.
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্যে থেকে যে কেউ তার ধর্ম থেকে ফিরে যায়, আল্লাহ্ তবে শীঘ্রই নিয়ে আসবেন একটি সম্প্রদায় – তাদের তিনি ভালবাসবেন ও তারা তাঁকে ভালবাসবে, মুমিনদের প্রতি বিনীত, অবিশ্বাসীদের প্রতি কঠোর, তারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করবে, আর ভয় করবে না কোনো নিন্দুকের নিন্দা। এই হচ্ছে আল্লাহ্র এক আশিষ – তিনি তা প্রদান করেন যাকে তিনি ইচ্ছে করেন।.
তাদের প্রথম গুণ: “আল্লাহ তাঁদের ভালবাসবেন”
আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এই গুনটি বিশেষভাবে তাঁদের দিকেই সম্বোধন করেছেন।
إنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِه صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَّرْصُوْصٌ .
আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে, যেন তারা সীসাগালানো প্রাচীর। [সূরা সাফ্ফ- ৪]এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে তাদেরকেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ করেছেন, যারা শীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় আল্লাহর রাস্তায় কাতার বন্দি হয়ে যুদ্ধ করছেন।
দ্বিতীয় গুণ: “তাঁরাও আল্লাহকে ভালবাসেন”
আমরা যখন আমাদের বাবা-মা পরিবার পরিজন সন্তান-সন্ততি ধন-সম্পদের পিছে দৌড়াচ্ছি, স্ত্রীদের সাথে আরাম আয়েশ করছি, ঠিক সে সময়ও তারা এগুলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহ ও রাসূল এবং জিহাদকেই তাদের প্রিয় পাত্র বানিয়ে নিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
.
‘‘হে রাসূল, আপনি বলে দিন, ‘যদি তোমাদের মাতা-পিতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, তোমাদের স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ঐ ব্যবসা যার লোকসান হওয়াকে তোমরা অপছন্দ কর, তোমাদের পছন্দনীয় বাড়ী-ঘর, তোমাদের নিকট আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁরই পথে জিহাদ করার চেয়ে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে তোমরা আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।’’ [তাওবা - ২৪].
তৃতীয় গুণ: “মুমিনদের প্রতি সদয় হবেন”
যারা সারা বিশ্বে নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়ে কুফরী অপশক্তির দম্ভকে চুরমার করে দিচ্ছেন, রক্তের বদলা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মুখে হাসি ফুটিয়ে তাদের হৃদয়কে প্রশান্ত করছেন। মুমিনদের প্রতি তাদের চেয়ে বড় সদয়বান আর কে হতে পারে! আর কী-ই-বা হবে?
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنْصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ.
তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আল্লাহ্ তাদের শাস্তি দেবেন তোমাদের হাতে, আর তাদের লাঞ্ছিত করবেন, আর তোমাদের সাহায্য করবেন তাদের বিরুদ্ধে, আর মুমিন সম্প্রদায়ের বুক প্রশমিত করবেন। [তাওবা- ১৪]চতুর্থ গুণ: “কাফেরদের প্রতি অতি কঠোর হবেন”
সকল কুফরী গোষ্ঠী, তন্ত্র-মন্ত্র ও তাদের দোসরদের আতঙ্ক হচ্ছে আল্লাহর রাস্তার একজন লড়াকু সৈনিক। সকল তাগুতি বাহিনীর মোকাবেলায় তাঁরা এতই কঠোর যে, একবার তাদের দিকে পা বাড়ালে এক শ’ বার পিছিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ.
ওহে যারা ঈমান এনছ! অবিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটে রয়েছে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, আর তারা যেন তোমাদের মধ্যে দেখতে পায় কঠোরতা। আর জেনে রেখো – নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ ধর্মপরায়ণদের সাথে রয়েছেন। [তাওবা-১২৩]পঞ্চম গুণ: “তাঁরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন”
যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট রয়েছে মহান পুরস্কার । মু’মিনদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন–প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয় । বরং জিহাদকারীদের ফজিলত অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ
.
"যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে, আর আল্লাহ্র পথে তাদের ধনদৌলত ও তাদের জানপ্রাণ দিয়ে সংগ্রাম করেছে, তারা আল্লাহ্র কাছে মর্যাদায় উন্নততর। আর এরা নিজেরাই সফলকাম। " [তাওবা- ২০].
অন্যত্র এরশাদ করেন,
لايَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ ۚ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً ۚ وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَىٰ ۚ وَفَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ عَلَى الْقَاعِدِينَ أَجْرًا عَظِيمًا﴾
গৃহে উপবিষ্ট মুসলমান-যাদের কোন সঙ্গত ওযর নেই এবং ঐ মুসলমান যারা জান ও মাল দ্বারা আল্লাহর পথে জেহাদ করে,-সমান নয়। যারা জান ও মাল দ্বারা জেহাদ করে, আল্লাহ তাদের পদমর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছেন গৃহে উপবিষ্টদের তুলনায় এবং প্রত্যেকের সাথেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ মুজাহেদীনকে উপবিষ্টদের উপর মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠ করেছেন। [সূরা নিসা- ৯৫]
ষষ্ঠ গুণ: “নিন্দুকের নিন্দার কোনো পরোয়া করে না”
পৃথিবীর সকল কুফরি জোট নানা উপায়ে, বিভিন্ন রঙে-ঢঙে, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ফেতনাবাজ ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে, তাদেরকে উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার এক অপকৌশল করছে। কিন্তু আল্লাহর এই উত্তম পুরুষরা, এদের এই ভর্ৎসনাকে উপেক্ষা করে, পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য, নিরলস বিনিদ্রা কাজ করে যাচ্ছেন। বিইযনিল্লাহ।
আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, এটি আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ। আল্লাহ যাকে চান তাকেই দান করে থাকেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো যাদেরকে যে সমস্ত গুণের কারণে ভালবাসেন সে গুনগুলোও পূর্ণতার সাথে এঁদের মাঝে বিদ্যমান। যেমন সূরা তওবায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাস্তায় জিহাদকারীদের সাথে তাদের জান-মালের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয়ের কথা উল্লেখ করে তাদের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন।
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ ۗ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ
তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কচ্ছেদকারী / সিয়াম পালনকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে। [তাওবা – ১১২]অর্থাৎ তওবাকারী, সিয়াম পালনকারী, পবিত্রতা অর্জনকারী ও অন্যান্য গুণাবলী হিসেবে অন্যদের তুলনায় তাঁরা অধিক শ্রেয় ।
পরিশেষে, আল্লাহর কাছে দু'আ করি। আল্লাহ যেন আমাদেরকে উক্ত গুণসম্বলিত দলের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেন। আমিন।
Comment