সেক্যুলার স্বৈরতন্ত্রের আড়ালে: নিপীড়ন ও পাশ্চাত্যের সমর্থন - প্রথম পর্ব
বিশ্ব রাজনীতিতে সেক্যুলার শাসন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। ইতিহাস বলছে, সেক্যুলার শাসকরাও মানবাধিকার লঙ্ঘন আর স্বৈরতন্ত্রে পিছিয়ে নেই। কিন্তু মজার বিষয় হলো, পশ্চিমা দেশগুলো প্রায়ই এসব এড়িয়ে যায় বা সাপোর্ট করে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব স্বঘোষিত সেক্যুলার শাসক একনায়কতন্ত্র চালিয়েছে, তারা ভয়াবহ নিপীড়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু পশ্চিমারা এসব নিয়ে কিছু বলে না, যেন কিছু দেখেনি! অন্যদিকে, 'সর্বক্ষেত্রে ইসলামি শাসন' এর নাম শুনলেই তারা 'একনায়কতন্ত্র' নিয়ে ভয় ছড়ায়।
.
আসলে এই ভয় দেখিয়ে তারা আসল সমস্যা ঢাকার চেষ্টা করে। ইসলামপন্থী শাসন নিয়ে এত হইচই, অথচ সেক্যুলার শাসনের স্বৈরতন্ত্র নিয়ে কেউ মুখ খুলে না। এটা তাদের দ্বিমুখী নীতির একদম পরিষ্কার উদাহরণ।
.
সেক্যুলার চিন্তাধারায় ধর্ম আর রাষ্ট্রকে আলাদা করে রাখা হয়, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার আর বাকস্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। শুনতে বেশ ভালো লাগে, তাই না? কিন্তু বাস্তবে কী হয়? ইতিহাস বলছে, সেক্যুলার শাসকেরা প্রায়ই একনায়ক হয়ে ওঠেন। তখন শুরু হয় চরম নিপীড়ন আর অন্যায়। এই সেক্যুলার শাসনের নিপীড়নের সময় পাশ্চাত্যের বড় বড় দেশগুলো বেশিরভাগ সময়ই চুপ থাকে, বা নীরবভাবে সমর্থন করে। আর সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে গেলেই তাদের উপর আরও বেশি দমন-পীড়ন নেমে আসে। সেক্যুলার শাসনের এই দ্বিমুখী চেহারাটা আসলে অনেক কিছুই বলে দেয়।
.
সেক্যুলার একনায়কদের নিপীড়নের কিছু উদাহরণ
.
- সিরিয়ায়তে, হাফেজ ও বাশার আল-আসাদঃ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিল হাফেজ আল-আসাদ। ‘বাথ পার্টি’র মাধ্যমে সেক্যুলার মতবাদ চালু করে সে পুরো দেশটাকে নিজের মতো করে চালিয়েছে। ১৯৮২ সালে হামা শহরে বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ। তখনকার ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো কার্যত দেশছাড়া হয়ে গিয়েছিল, আর হাফেজ পুরো দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এত বড় ঘটনা ঘটলেও কথিত মানবাধিকার রক্ষাকারীরা কিছু লোক দেখানো প্রতিবাদ ছাড়া তেমন কিছুই করেনি। এসব দেখে আসলে পরিষ্কার বোঝা যায়, মানবাধিকার নিয়ে তাদের আসল মনোভাব কেমন।
.
২০০০ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিল বাশার আল-আসাদ। ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে, জনগণের আন্দোলন দমন করতে সে তার বাহিনীকে ব্যবহার করেন। সেই সময় তার বাহিনী আম মানুষের বিরুদ্ধে গণগ্রেফতার, নির্যাতন এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে ( UN Independent International Commission of Inquiry on the Syrian Arab Republic, ২০১২-বর্তমান)। ২০১১ থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, কিন্তু কেউ আসাদকে থামাতে কিছু করেনি। কারো কারো মতে ১০ লক্ষের বেশি বরং তখন দেখা গেছে, আসাদ বিরোধী ইসলামি বিভিন্ন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোই সবার প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই ঘটনাগুলো আসলে অনেক কিছুই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
.
- সংযুক্ত আরব আমিরাতে, মোহাম্মদ বিন জায়েদঃ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহইয়ান, যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট, নিজেকে উদারপন্থী বা সেক্যুলার হিসেবে তুলে ধরে, বিশেষ করে বিনোদন আর পর্যটনের ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সংযুক্ত আরব আমিরাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা একেবারে চোখে পড়ার মতো। Amnesty International-এর ২০১৯ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, সেখানে রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ২০১৪ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের কার্যক্রম সন্ত্রাসী আইনের আওতায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ইসলামী দলগুলোকে নির্মূল করার কাজ চালাচ্ছে। আর পশ্চিমা দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থের কারণে এসব দমননীতি একেবারে চুপচাপ মেনে নেওয়া হয়। শুধু দেশেই নয়, ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদানসহ আরো অনেক দেশে মুক্তিকামীদের দমনে মোহাম্মদ বিন জায়েদ ব্যাপক অর্থ খরচ করে আর্মি আর মিলিশিয়ার মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মোহাম্মাদ বিন জায়েদ এটাও বলেছে যে, শুধু দায়েশই সন্ত্রাসী নয়, বরং এমন প্রত্যেক ইসলামি দলই সমস্যাজনক যারা কোনো না কোনোভাবে খেলাফতের কথা বলে।
.
- মিশরে, আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিঃ ২০১৩ সালে মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে অন্যায়ভাবে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে আল-সিসি মিশরের রাষ্ট্রপতি হয়ে বসে। নিজেকে “সেক্যুলার আর মধ্যপন্থী” হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও, মুরসির সমর্থক আর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাদের ওপর যে দমননীতি চালিয়েছে, তা বর্ণনাতীত। Amnesty International-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গণ-মামলা, মৃত্যুদণ্ড আর গুরুতর নির্যাতনের মাধ্যমে পুরো মুরসি সমর্থকদের নিঃশেষ করার চেষ্টা চালিয়েছে সিসি। পশ্চিমা দেশগুলো সব সময় সিসিকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে আসছে। সে যে কত বড় জালিম, তা বোঝার জন্য শুধু 'রাবা ম্যাসাকার'-এর ঘটনাটা একবার খুঁজে দেখলেই যথেষ্ট। ঐ একদিনে প্রায় ৩ হাজার মুরসি সমর্থককে হত্যা করা হয়েছিল। আহত আর গুম হওয়া মানুষের সংখ্যা তো হিসেবের বাইরে। এই সেক্যুলার সিসির দমননীতির লিস্ট এতটাই বড় যে, তার কাজগুলো দেখে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়। যারা নিজেদের “মানবাধিকার রক্ষক” দাবি করে, তারা সিসির এসব অন্যায়ের প্রতি নীরব সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এখনো।
.
- ইরাকে, সাদ্দাম হোসেনঃ সাদ্দাম যদিও জনসমক্ষে ইসলামিক রীতির নানা বার্তা দিত, আসলে তাঁর শাসন ছিল পুরোপুরি সেক্যুলার আর আরব ন্যাশনালিজমের উপর ভিত্তি করে। Araque-এর গবেষণায় (Saddam’s Ba’ath: Pan-Arab & Secular Roots, 2008) এই বিষয়টা পরিষ্কার। শিয়া আর কুর্দি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে তাঁর নির্মমতা ছিল ভয়াবহ। ১৯৮৮ সালের আল-আনফাল অভিযানের সময় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা তার প্রমাণ। Human Rights Watch-এর রিপোর্টে (1993) এ নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো প্রথমে সাদ্দামকে সমর্থন দিয়েছে তাদের স্বার্থে। কিন্তু পরবর্তীতে নিজেদের স্বার্থেই তাকে শত্রু বানিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, সাদ্দাম যে একজন সেক্যুলার, এ বিষয়ে পশ্চিমা মিডিয়া একেবারে চুপ থেকেছে। ইচ্ছে করেই বিষয়টা তারা চেপে যায়। সাদ্দামের এই দ্বিমুখী ভূমিকা আর পশ্চিমাদের স্বার্থান্বেষী আচরণ আসলে একটাই শিক্ষা দেয় – রাজনীতিতে কেউ কারও বন্ধু নয়, আর সেক্যুলার শাসন মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তা কিন্তু একেবারেই নয়।
.
- লিবিয়ায়, মুয়াম্মার গাদ্দাফিঃ গাদ্দাফি নিজেকে 'ইসলামী সমাজতন্ত্রের' প্রচারক বলে দাবি করলেও, আসলে তার শাসন পুরোপুরি সেক্যুলার টাইপ কঠোর কর্তৃত্ববাদী ছিল। তার 'গ্রীন বুক' এর আদলে সে ধর্ম আর রাষ্ট্রকে আলাদা করে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিল। ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সে চরমভাবে নির্মম ছিল। Amnesty International-এর ১৯৮৮ সালের রিপোর্টসহ আরও অনেক রিপোর্টে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে গাদ্দাফির সম্পর্ক কখনো ভালো, কখনো খারাপ ছিল। কিন্তু তার শাসনের সময় পশ্চিমারা তার নিপীড়ন নিয়ে তেমন কিছু করেনি। বরং তারা নিজের স্বার্থ অনুযায়ী তার সাথে সম্পর্ক রেখেছে। এখন কল্পনা করুন, যদি গাদ্দাফি নিজেকে ইসলামপন্থী শাসক বলে ঘোষণা করত, তাহলে কি হতো? হয়তো এখন তাকে কেউ গাদ্দাফি নামে তেমন চিনতেই পারত না। শুরুতেই হয় কোন ক্যু এর মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হতো, অথবা মুরসির মতো তাকে অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলা হতো। এটা হলো পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ।