Announcement

Collapse
No announcement yet.

আবেগসংযম ও বাস্তবচেতনা এবং কৌশল

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • আবেগসংযম ও বাস্তবচেতনা এবং কৌশল

    আবেগসংযম ও বাস্তবচেতনা এবং কৌশল


    জীবনের প্রতিটি পর্যায়েই মানুষ যুদ্ধ করছে—কখনো বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে, কখনো নিজের ভিতরের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে। কিন্তু এসব যুদ্ধের ভেতরেও রয়েছে এক মৌলিক বিভাজন—কেউ লড়ছে শুধু তাৎক্ষণিক সমস্যার বিরুদ্ধে, আবার কেউ ভাবছে—এই লড়াই শেষ পর্যন্ত তাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

    সত্যিকারের কৌশলচিন্তা শুরু হয় তখনই, যখন আমরা তাৎক্ষণিক দ্বন্দ্ব ও আবেগময় মুহূর্তগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে বড় চিত্রটি দেখার ক্ষমতা অর্জন করি। যুদ্ধক্ষেত্রের ধুলোমলিন, উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ থেকে নিজেকে সাময়িকভাবে সরিয়ে এনে, পুরো অভিযানটিকে এক মানচিত্রের মতো চোখের সামনে মেলে ধরতে পারলে—তখনই জন্ম নেয় পরিপূর্ণ কৌশল নির্ধারণের সামর্থ্য।

    এই "ঊর্ধ্বে ওঠা" কোনো শারীরিক উচ্চতায় নয়; এটি এক মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক উত্থান—যার সূচনা ঘটে আত্মসংযম দিয়ে। আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মধ্য দিয়েই শুরু হয় একজন প্রকৃত কৌশলবিদের যাত্রা।

    যুদ্ধ কখনো কেবল অস্ত্রের সংঘর্ষ নয়, বরং এটি এক কঠিন আত্মনিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা। মানুষের আবেগ—রাগ, ভয়, অহংকার, আত্মবিশ্বাস—এই পাঁচ(চার)টি শক্তিশালী অনুভূতি, যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে তা যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশল ভেঙে দেয়, এমনকি ধ্বংসের দ্বারও খুলে দেয়।


    🔴 রাগ

    ইসলাম রাগকে অন্তরের রোগ হিসেবে দেখে, যা মানুষকে সঠিক বিচারবোধ ও কৌশল থেকে বিচ্যুত করে। কুরআন ও হাদীসে বহুবার রাগ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের কথা এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

    “শক্তিশালী সে ব্যক্তি নয় যে কুস্তিতে অপরকে পরাস্ত করে, বরং প্রকৃত শক্তিশালী সে, যে রাগের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।” (সহীহ বুখারী)

    রাগ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করলে আমরা কৌশল ভুলে যাই, পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু যে ব্যক্তি রাগ দমন করতে পারে, সে দীর্ঘমেয়াদি জয় নিশ্চিত করে।


    🔴 অহংকার

    অহংকার এক মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি। এটি মানুষকে নিজের সীমাবদ্ধতা ভুলিয়ে দেয় এবং কৌশলগত সাবধানতাকে দুর্বল করে তোলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,

    “অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান, ৩১:১৮)

    চিন্তা করুন হুনাইনের যুদ্ধের কথা। এই যুদ্ধে মুসলিমরা সংখ্যায় ছিল অনেক। অনেকেই ধারণা করেছিল, এমন বিশাল বাহিনী থাকলে বিজয় তো অবধারিত। কিন্তু এই আত্মবিশ্বাস একপর্যায়ে গর্বে রূপ নেয়। ফলাফল কী হয়েছিল? যুদ্ধের সূচনাতেই মুসলিম বাহিনী চমকে যায়, ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, বিভ্রান্তি ও বিপদের মুখোমুখি হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,

    “বস্তুতঃ আল্লাহ তোমাদেরকে বহু যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন আর হুনায়নের যুদ্ধের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি, যমীন সুপ্রশস্ত হওয়া সত্বেও তা তোমাদের নিকট সংকীর্ণই হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে।” (সূরা তাওবা, ৯:২৫)

    মূলত অহংকারের কারণেই মুসলিমরা প্রথমে বিপদে পড়ে গিয়েছিল। পরে, তারা ফিরে আসে ঈমান ও কৌশলের আশ্রয়ে। এখান থেকে আমরা মৌলিক যেই শিক্ষাটা পায়; তা হলো, কৌশল নির্ভর করে আল্লাহর উপর ভরসা ও আত্মসচেতনতার উপর, অহংকার ও আত্মতুষ্টির উপর নয়।


    🔴 ভয়

    ভয় একটি স্বাভাবিক মানবীয় অনুভূতি। কিন্তু ইসলামী দৃষ্টিকোণে ভয় তখনই গঠনমূলক, যখন তা ঈমান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকে। অন্যথায়, এটি একজন মানুষের কৌশলগত চিন্তা ও দায়িত্ব পালনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিয়ন্ত্রণহীন ভয় মানুষকে দুর্বল করে তোলে, শত্রুর শক্তিকে অতিমূল্যায়ন করায় এবং অনেক সময় তা ভুল সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। ইসলামের শিক্ষা হলো—একজন প্রকৃত মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহ ছাড়া আর কারও প্রতি ভয় স্থান পায় না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন,

    “তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর, যদি তোমরা মু’মিন হও।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৭৫)

    বদর যুদ্ধের দিন—তিনশত তের মুসলিম মুখোমুখি হয়েছিল প্রায় এক হাজার সশস্ত্র কুরাইশ বাহিনীর। বাহ্যিকভাবে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবীরা ভয়ের পরিবর্তে ঈমানকে বুকের ভেতর ধারণ করেছিলেন। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে—যখন ভয়কে ঈমান দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়, তখন বিজয়ের নিয়ামক হয়ে ওঠে ধৈর্য, কৌশল ও দৃঢ়তা, আর বাহ্যিক শক্তি তখন ম্লান হয়ে যায় আল্লাহর সাহায্যের কাছে।


    🔴 আত্মবিশ্বাস

    আত্মবিশ্বাস একটি গুণ, তবে যখন তা বাস্তবতা বিবর্জিত ও অহংকার/আত্মতুষ্টির মতো হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা ধ্বংস ডেকে আনে। ইসলাম শেখায়—আত্মবিশ্বাস হোক আল্লাহর উপর ভরসা থেকে, নিজের শক্তির উপর নয়।

    “মু’মিনদের উচিত আল্লাহর উপর ভরসা করা।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১২২)

    উহুদের যুদ্ধের সূচনালগ্নে মুসলিমরা কুরাইশ বাহিনীকে সফলভাবে পেছনে ঠেলে দিয়েছিল। তখন অনেক সাহাবীর মনে হলো—বোধহয় যুদ্ধ শেষ। পাহাড়ের ওপর অবস্থানরত তীরন্দাজদের উদ্দেশে রাসুলুল্লাহ (সা.) বারবার নির্দেশ দিয়েছিলেন: যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান ছেড়ে নামা যাবে না।

    কিন্তু কিছু সাহাবী বিজয়ের ধারা দেখে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে পড়েন। সেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায় কিছুটা লোভ ও আবেগ। ফলে তাঁরা তাঁদের অবস্থান ত্যাগ করেন। আর ঠিক তখনই শত্রুপক্ষ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করে। মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে, এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এক কঠিন বিপর্যয়ের দিকে।

    এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়—অন্ধ আত্মবিশ্বাস মানুষকে কৌশল ও নির্দেশ মানার জায়গা থেকে বিচ্যুত করে। বাস্তবতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করা এবং নেতৃত্বের নির্দেশনা অমান্য করার আকাঙ্খা জাগায়।

    উপরের প্রতিটি দিক—রাগ, অহংকার, ভয় ও আত্মবিশ্বাস—এসব থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছেন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.)। তিনি প্রতিটি যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব ও সংকটে আবেগের দাস হননি, বরং দূরদৃষ্টি, পরামর্শ, ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর উপর ভরসা দিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর জীবনই কৌশলগত চিন্তার শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন এক আদর্শ কৌশলবিদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যিনি আবেগকে দাস করে ঈমানকে নেতা বানিয়েছিলেন।


    আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা ধরনের সংকট ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই—পারিবারিক সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পেশাগত চাপ কিংবা সামাজিক অন্যায়। এইসব পরিস্থিতিতে আবেগ থাকবেই, কিন্তু প্রশ্ন হলো—আমরা কীভাবে সেই আবেগকে পরিচালনা করছি?

    বর্তমান সময়ের আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো, সোস্যাল মিডিয়ার অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে আমরা দিন দিন আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। প্রতিটি পোস্ট, মন্তব্য বা রিঅ্যাকশন আমাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করছে। আমরা ধীরে ধীরে ধৈর্য, পরিমিতি বোধ ও কৌশলগত চিন্তার ক্ষমতা হারাচ্ছি। ফলে সামান্য সমস্যার প্রতিক্রিয়াতেও আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, ভুল সিদ্ধান্ত নেই, এবং ক্ষণিকের অনুভূতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি মূল্য দেই।

    এই পরিস্থিতিতে কুরআন, সুন্নাহ ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে—কীভাবে আবেগকে দাস বানিয়ে ঈমান, যুক্তিবোধ ও কৌশলকে নেতা বানানো যায়। কারণ, আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়া হয়তো একটি মুহূর্ত জিতে দেয়, কিন্তু কৌশল ও সংযমই নিশ্চিত করে দীর্ঘমেয়াদি বিজয়—হোক তা ব্যাক্তিজীবনে বা কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে।


    Last edited by Rakibul Hassan; 1 week ago.

  • #2
    জাযাকাল্লাহ খাইরান ভাই
    আল্লাহ তাআলা আপনার ইলম ও হায়াতে বারাকাহ দান করুন, আমীন
    বছর ফুরিয়ে যাবে এতো রিসোর্স আছে https://gazwah.net সাইটে

    Comment


    • #3
      বর্তমান সময়ের আরেকটি বড় বাস্তবতা হলো, সোস্যাল মিডিয়ার অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে আমরা দিন দিন আরও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। প্রতিটি পোস্ট, মন্তব্য বা রিঅ্যাকশন আমাদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করছে। আমরা ধীরে ধীরে ধৈর্য, পরিমিতি বোধ ও কৌশলগত চিন্তার ক্ষমতা হারাচ্ছি। ফলে সামান্য সমস্যার প্রতিক্রিয়াতেও আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, ভুল সিদ্ধান্ত নেই, এবং ক্ষণিকের অনুভূতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি মূল্য দেই।​
      বাস্তব কথা বলেছেন ভাই শের খাঁ
      জাযাকাল্লাহু খাইরান
      ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

      Comment

      Working...
      X