লেখাটি অবৈধ দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকানদের সমর্থনের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। তারপরেও লেখাটি এজন্য পড়া যেতে পারে, যাতে ইসরাইলের প্রতি আমেরিকানদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পাঠকরা জানতে পারেন। কারণ, শত্রু চেনা যুদ্ধের অর্ধেক। পড়ার সময় এই বিষয়টি খেয়াল করে পড়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। - মডারেটর
দ্য ইজরায়েল লবি অ্যাণ্ড ইউ.এস. ফরেন পলিসি
পর্ব ২
...
..
.
[
আজ আপনাদের সামনে "দ্য ইজরায়েল লবি অ্যাণ্ড ইউ.এস. ফরেন পলিসি" বইয়ের ভূমিকা অংশের পুরো অনুবাদ উপস্থাপন করছি। আজকের লেখাটি তুলনামূলকভাবে একটু বড় তাই হাতে সময় নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল অথবা আপনারা চাইলে এই লেখাটি কপি করে নিজের নোটবুকে সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন, যাতে সময় হলে পরে পড়তে পারেন।
]
...
ভূমিকা
ভূমিকা
...
আমেরিকা একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছরে প্রবেশ করতে চলেছে। যদিও এই পর্যায়ে ফলাফল অনুমান করা অসম্ভব, তবে প্রচারণার কিছু বৈশিষ্ট্য সহজেই অনুমান করা যায়। প্রার্থীরা অনিবার্যভাবে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ বিষয়—স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভপাত, সমলিঙ্গের বিবাহ, কর, শিক্ষা, অভিবাসন—সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করবেন এবং পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন প্রশ্নেও জোরালো বিতর্ক নিশ্চিতভাবেই শুরু হবে। ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত? দারফুর সংকট, ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ন্যাটোর প্রতি রাশিয়ার বৈরিতা এবং চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রতি সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া কী? জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের মতো জটিল প্রশ্নেও থাকবে তীব্র মতপার্থক্য। এসব বিষয় নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে যে উত্তপ্ত বিতর্ক দেখা দেবে, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
তবে একটি বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে প্রার্থীরা একই সুরে কথা বলবেন। ২০০৮ সালে, পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর মতোই, দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী গুরুত্বপর্ণ প্রার্থীরা একটি বিদেশী রাষ্ট্র—ইসরায়েল—এর প্রতি তাদের গভীর ব্যক্তিগত অঙ্গীকারের পাশাপাশি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অটল সমর্থন বজায় রাখার দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করতে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালাবেন। প্রতিটি প্রার্থী জোর দিয়ে বলবেন যে তারা ইসরায়েলের মুখোমুখি হওয়া অসংখ্য হুমকি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন এবং স্পষ্ট করবেন যে, নির্বাচিত হলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে। কোনো প্রার্থীই ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্যভাবে কোনো সমালোচনা করার বা এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আরও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করা উচিত এমন পরামর্শ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। যারা এমনটি করবেন, সম্ভবত তারা নির্বাচনী লড়াই থেকে ছিটকে পড়বেন।
এই পর্যবেক্ষণটি কোনো সাহসী ভবিষ্যদ্বাণী নয়, কারণ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা ২০০৭ সালের গোড়ার দিকেই ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করছিলেন। প্রক্রিয়াটি জানুয়ারিতে শুরু হয়েছিল, যখন চারজন সম্ভাব্য প্রার্থী ইসরায়েলের বার্ষিক হার্জলিয়া নিরাপত্তা সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। জোশুয়া মিটনিক ইহুদি উইকে যেমনটি রিপোর্ট করেছেন, তারা "স্পষ্টতই প্রতিযোগিতা করছিলেন যে ইহুদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় কে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে পারেন।" স্যাটেলাইট লিঙ্কের মাধ্যমে উপস্থিত হয়ে, ২০০৪ সালের ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন এডওয়ার্ডস তার ইসরায়েলি শ্রোতাদের বলেন যে "আপনাদের ভবিষ্যৎ আমাদের ভবিষ্যৎ" এবং বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে "বন্ধন কখনও ভাঙবে না।" সাবেক ম্যাসাচুসেটস গভর্নর মিট রমনি বলেন, “আমি এমন একটি দেশে এসেছি, যাকে আমি ভালোবাসি, এমন মানুষদের মাঝে, যাদের আমি ভালোবাসি।” তিনি ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে ইসরায়েলের গভীর উদ্বেগের প্রতি লক্ষ্য রেখে ঘোষণা করেন, “এখন সময় এসেছে বিশ্বকে তিনটি সত্য বলার: (১) ইরানকে থামাতে হবে, (২) ইরানকে থামানো সম্ভব, (৩) ইরানকে থামানো হবেই!” সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেন, “ইসরায়েল রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপসের সুযোগ নেই।” অন্যদিকে, প্রাক্তন হাউস স্পিকার নিউট গিংরিচ বলেন, “১৯৬৭ সালের বিজয়ের পর এই প্রথমবারের মতো ইসরায়েল তার অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় হুমকির মুখোমুখি।”
এর কিছুদিন পরেই, ফেব্রুয়ারীর শুরুতে, সিনেটর হিলারি ক্লিনটন নিউইয়র্কে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (AIPAC) এর স্থানীয় শাখার এক সভায় ভাষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন যে ইসরায়েলের জন্য "এই কঠিন সময়ে, এই বিপদের মুহূর্তে, সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো—আমরা যেন আমাদের মিত্র ও বন্ধু রাষ্ট্রের পাশে থাকি এবং নিজেদের নীতিমালার প্রতিও আস্থাশীল থাকি। ইসরায়েল হচ্ছে ন্যায়ের এক আলোকবর্তিকা, এমন এক অঞ্চলে, যা মৌলবাদ, চরমপন্থা, স্বৈরতন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদের অন্ধকারে আচ্ছন্ন।" ডেমোক্রেটিক মনোনয়নের জন্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন, সিনেটর বারাক ওবামা, এক মাস পরে শিকাগোতে AIPAC শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা দেন। যদিও ওবামা, অতীতে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার প্রতি কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন এবং ২০০৭ সালের মার্চে একটি প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানে ফিলিস্তিনিদের "দুর্ভোগ" সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্যও করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি AIPAC শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতার সময় ইসরায়েলের প্রশংসায় ছিলেন দ্ব্যর্থহীন এবং স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন যে তিনি মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন করবেন না। সিনেটর স্যাম ব্রাউনব্যাক এবং নিউ মেক্সিকোর গভর্নর বিল রিচার্ডসন সহ অন্যান্য রাষ্ট্রপতি পদপ্রত্যাশীরাও সমান বা তার চেয়ে বেশি আগ্রহের সাথে ইসরায়েলপন্থী মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
এই আচরণের কারণ কী? যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের মধ্যে গভীর মতবিরোধ রয়েছে এবং যখন আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি মারাত্মকভাবে ভুল পথে চলেছে বলে স্পষ্ট, তখন ইসরায়েলকে নিয়ে তাদের মধ্যে এতটা একমত কেন? যখন ইসরায়েলের নিজস্ব নাগরিকরাই প্রায়শই এর বর্তমান নীতির তীব্র সমালোচনা করে এবং যখন এই একই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীরা অন্যান্য দেশের অনেক কাজের সমালোচনা করতেও দ্বিধা করেন না, তখন ইসরায়েল কেন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের কাছ থেকে এত ছাড় পায়? কেন শুধুমাত্র ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এতটা সম্মান ও শ্রদ্ধা পায়?
কেউ কেউ বলতে পারেন যে এটি এ কারণে যে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অত্যাবশ্যক কৌশলগত সম্পদ, এমনকি "সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে" এক অপরিহার্য অংশীদার। আরও অনেকে যুক্তি দেবেন, ইসরায়েলই হলো ওই অঞ্চলের একমাত্র দেশ, যে আমাদের মূল্যবোধের অংশীদার; ফলে তাকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ার একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি আছে। কিন্তু এই যুক্তিগুলোর কোনোটিই নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে টিকে থাকে না। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জেরুজালেমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সন্ত্রাসবাদ দমনকে সহজ করে তোলে না—বরং তা আরও জটিল করে তোলে; পাশাপাশি, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক এবং মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর, ইসরায়েল কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত বোঝায় পরিণত হয়েছে। তবুও, কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনীতিক জনসমক্ষে এই সত্য উচ্চারণের সাহস দেখান না—এমনকি তার সম্ভাবনাটুকুও প্রকাশ করেন না।
ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার অবিবেচক এবং আপসহীন সম্পর্কের জন্য কোনো জোরালো নৈতিক যুক্তিও নেই। ইসরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে একটি দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে, এবং যদি কখনও ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিপদের মুখে পড়ে, তখন তাকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকারের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের দ্বারা অধিকৃত ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে নির্মম আচরণ করা হয়েছে, তা বিবেচনা করলে—নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বরং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হতো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন, উভয় পক্ষের প্রতি আরও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা; এমনকি কখনো কখনো ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান নেওয়াটাও যৌক্তিক হতে পারত। তবুও, যারা প্রেসিডেন্ট হতে চান, কিংবা কংগ্রেসে একটি আসন দখলের ইচ্ছা পোষণ করেন—তাদের কারও মুখে এমন মত প্রকাশের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
আসলে, আমেরিকান রাজনীতিকরা ইসরায়েল প্রসঙ্গে এতটা বিনয়ী ও আনুগত্যশীল হওয়ার প্রকৃত কারণ হলো—ইসরায়েলপন্থী লবির রাজনৈতিক প্রভাব। এই লবি একটি শিথিল জোট, যা বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকে ইসরায়েলমুখী পথে পরিচালিত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে। আমরা পরে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করব, তবে এখনই বলার মতো বিষয় হলো—এটি কোনো একক, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নয়; এর কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই, এবং এটি মোটেই এমন কোনো ষড়যন্ত্রমূলক গোষ্ঠী নয় যারা আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে “নিয়ন্ত্রণ” করে। এটি একটি প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী মাত্র—যার সদস্যদের মধ্যে ইহুদি যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন অ-ইহুদিরাও। এই লবির ঘোষিত উদ্দেশ্য হলো—যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ইসরায়েলের স্বার্থকে তুলে ধরা এবং এমনভাবে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করা, যাতে ইসরায়েল উপকৃত হয়—এমনটাই তারা বিশ্বাস করেন। এই লবির মধ্যে থাকা বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সব বিষয়ে একমত নাও হতে পারেন, তবে তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি “বিশেষ সম্পর্ক” বজায় রাখার ইচ্ছায় একত্র। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক লবি কিংবা স্বার্থভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর মতোই, ইসরায়েল লবির কার্যক্রমও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বৈধ রূপ—এবং এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের স্বার্থ-গোষ্ঠীনির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইসরায়েলপন্থী লবি ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ায়, উচ্চপদপ্রার্থী রাজনীতিকরা এর ইচ্ছাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। এই লবির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো ইসরায়েলকে গভীরভাবে ভালোবাসে, এবং তারা চান না যে কোনো মার্কিন রাজনীতিক ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করুন—এমনকি যদি সেই সমালোচনার যথার্থতা থাকে কিংবা তা ইসরায়েলের স্বার্থেই প্রয়োজনীয় হয়। এর পরিবর্তে, তারা চান যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা ইসরায়েলকে যেন "একান্নতম রাজ্য" হিসেবেই বিবেচনা করেন। ডেমোক্র্যাট হোন বা রিপাবলিকান—সব পক্ষের নেতারাই এই লবির প্রভাবকে ভয় পান। কারণ, তারা সবাই জানেন—এই লবির অবস্থানের বিরোধিতা করলে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
...
লবি এবং মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতি
...
ইসরায়েলপন্থী লবির রাজনৈতিক প্রভাবের তাৎপর্য কেবল এই কারণে নয় যে, এটি নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের বক্তব্যকে প্রভাবিত করে—বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, এটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ওপর, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত নীতিগুলোর ওপর গভীর প্রভাব রাখে। এই অস্থির অঞ্চলে আমেরিকার পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে সেখানে বসবাসকারী মানুষের জন্য, বিশাল পরিণতি ডেকে আনে। বুশ প্রশাসনের ইরাকে ভুলভাবে পরিচালিত যুদ্ধের ফলে সেই বিধ্বস্ত দেশের দীর্ঘ-দুর্ভোগী মানুষদের ওপর কী প্রভাব পড়েছে তা একবার ভাবুন: হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, লাখ লাখ মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে এবং একটি মারাত্মক সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ চলছে যার শেষ দেখা যাচ্ছে না। এই যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও একটি কৌশলগত বিপর্যয় ছিল এবং যা এই অঞ্চলের ভেতরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই মার্কিন মিত্রদের আতঙ্কিত ও বিপন্ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন তার হাতে থাকা বিপুল ক্ষমতা প্রয়োগ করে, তা ভালো কিংবা মন্দ যেভাবেই হোক না কেন—তার প্রভাব কতটা বিস্তৃত ও ভয়াবহ হতে পারে, তার এর চেয়ে স্পষ্ট বা মর্মান্তিক উদাহরণ কল্পনা করা কঠিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রজাতন্ত্রের প্রথম দিন থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে জড়িত ছিল, যার বেশিরভাগ কার্যকলাপ শিক্ষামূলক কর্মসূচি বা ধর্মপ্রচারমূলক কাজের উপর কেন্দ্র করে ছিল। কারো কারো জন্য, বাইবেল দ্বারা অনুপ্রাণিত পবিত্র ভূমির প্রতি মুগ্ধতা এবং এর ইতিহাসে ইহুদি ধর্মের ভূমিকা ইহুদি জনগণকে সেখানে একটি জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনার ধারণার প্রতি সমর্থনের জন্ম দেয়, যা কিছু ধর্মীয় নেতা এবং সাধারণভাবে, কয়েকজন মার্কিন রাজনীতিবিদ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলের মার্কিন ভূমিকার মূল কারণ হিসেবে এই সীমিত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার ইতিহাসকে দেখা ভুল হবে, বিশেষত ইসরায়েলের সাথে এর আজকের অসাধারণ সম্পর্ককে। দুইশো বছর আগে বারবারি জলদস্যুদের বিতাড়নের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ভূমিকা পালন করেনি এবং মার্কিন নেতারা তেমন আকাঙ্ক্ষাও করেননি। উড্রো উইলসন ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণাপত্র (যা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেনের সমর্থন প্রকাশ করেছিল) সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু উইলসন এই লক্ষ্য পূরণে কার্যত কিছুই করেননি। আসলে, এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ১৯১৯ সালে প্যারিস শান্তি সম্মেলন থেকে পাঠানো একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন। আমেরিকান হেনরি চার্চিল কিং এবং চার্লস ক্রেনের নেতৃত্বে এই মিশনটি মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে দেখেছিল। তাদের সিদ্ধান্তে আসে যে, স্থানীয় মানুষ জায়নবাদী অনুপ্রবেশের বিরোধিতা করছে এবং তারা একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র তৈরির বিপক্ষে মত দেয়। তবে, যেমনটা ঐতিহাসিক মার্গারেট ম্যাকমিলান বলেছেন, "কেউই এই রিপোর্টের দিকে সামান্যতম মনোযোগও দেননি।" যদিও খুব অল্প সময়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে মার্কিন শাসনের (ম্যান্ডেট) সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। এর পরিবর্তে, তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের ওই অংশগুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ইস্যুতে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্রমবর্ধমান ভূমিকা পালন করেছে, যা প্রাথমিকভাবে তেল, তারপর কমিউনিজম-বিরোধীতা এবং সময়ের সাথে সাথে ইসরায়েলের সাথে এর ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের দ্বারা চালিত হয়েছে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা রাজনীতিতে আমেরিকার প্রথম উল্লেখযোগ্য সংশ্লিষ্টতা ছিল ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি সৌদি আরবের সাথে একটি উদীয়মান অংশীদারিত্ব (উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চলে ব্রিটিশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করা), এবং এর প্রথম আনুষ্ঠানিক জোট প্রতিশ্রুতি ছিল ১৯৫২ সালে ন্যাটোতে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি এবং ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত-বিরোধী বাগদাদ চুক্তি। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা সমর্থন করার পর, মার্কিন নেতারা ইসরায়েল ও আরবদের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করেন এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার ভয়ে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে যান। পরবর্তী দশকগুলিতে এই পরিস্থিতির ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটে, যা ছয় দিনের যুদ্ধ, বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে সোভিয়েত অস্ত্র বিক্রি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের মতো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঘটেছিল। এই অঞ্চলে আমেরিকার ভূমিকার এই নাটকীয় পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে—বিশেষ করে ইসরায়েলকে দেওয়া বিপুল সমর্থনের ব্যাখ্যায়—পুরনো যুগের ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা অতীতের একেবারে ভিন্নধর্মী মার্কিন সম্পৃক্ততার দৃষ্টান্ত টেনে আনা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বর্তমান ‘বিশেষ সম্পর্ক’ কোনোভাবেই অবশ্যম্ভাবী বা পূর্বনির্ধারিত ছিল না।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, এবং বলা চলে কেন্দ্রবিন্দু, ছিল ইসরায়েলের সঙ্গে তার সম্পর্ক। গত চার দশক ধরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে এমন মাত্রার বস্তুগত ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে যা অন্যান্য দেশকে দেওয়া সমর্থনের তুলনায় অনেক বেশি। এই সাহায্য মূলত শর্তহীন: ইসরায়েল যাই করুক না কেন, সমর্থনের মাত্রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপরিবর্তিত থাকে। বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করে এবং খুব কম ক্ষেত্রেই ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যেন তারা পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণ ও সড়ক তৈরি বন্ধ করে। যদিও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রকাশ্যে একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন, তবে কেউই সেই ফলাফলকে বাস্তবে রূপ দিতে আমেরিকান প্রভাব ব্যবহার করতে রাজি ছিলেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যেও এমন নীতি গ্রহণ করেছে যা ইসরায়েলের পছন্দকে প্রতিফলিত করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইরান-নীতি ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলি সরকারের ইচ্ছার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান একাধিকবার ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের এবং দ্বিপাক্ষিক বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সমর্থকেরা এই সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনাকে বারবার বাধা দিয়েছে এবং উভয় দেশের মধ্যে দূরত্ব অটুট রেখেছে। আরেকটি উদাহরণ হলো ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে ইসরায়েলের লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় বুশ প্রশাসনের আচরণ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ ইসরায়েলের বোমা হামলা অভিযানের তীব্র নিন্দা করেছিল – যে অভিযানে এক হাজারেরও বেশি লেবানিজ নিহত হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক – কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা (নিন্দা) করেনি। পরিবর্তে, এটি ইসরায়েলকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সাহায্য করেছিল, উভয় রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট সদস্যরা প্রকাশ্যে ইসরায়েলের আচরণকে সমর্থন করেছিল। ইসরায়েলের প্রতি এই দ্ব্যর্থহীন সমর্থন বৈরুতের আমেরিকানপন্থী সরকারকে দুর্বল করে, হেজবুল্লাহকে শক্তিশালী করে, এবং ইরান, সিরিয়া ও হেজবুল্লাহকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে, যা ওয়াশিংটন বা জেরুজালেম কারো জন্যই ভালো ছিল না।
ইসরায়েলের পক্ষে পরিচালিত অনেক নীতি এখন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবিরাম সমর্থন এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী দখলের সম্মিলিত প্রভাব আরব ও ইসলামিক বিশ্বজুড়ে আমেরিকান-বিরোধী মনোভাবকে উস্কে দিয়েছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ওয়াশিংটনের জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার মতো অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলা করা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র গোটা অঞ্চলে এতটাই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছে যে, যেসব আরব নেতা স্বাভাবিক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে একমত হতেন, তারাও এখন প্রকাশ্যে সহায়তা করতে অনিচ্ছুক। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে আঞ্চলিক নানা সঙ্কট মোকাবিলায় দুর্বল করে দিচ্ছে এবং তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে কার্যত ভেঙে পড়ার মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অতুলনীয় এই পরিস্থিতি মূলত ইসরায়েল লবির কার্যকলাপের কারণে ঘটেছে। কিউবান আমেরিকান, আইরিশ আমেরিকান, আর্মেনিয়ান আমেরিকান এবং ইন্ডিয়ান আমেরিকানদের প্রতিনিধিত্বকারী জাতিগত লবি সহ অন্যান্য বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীগুলো যদিও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে তাদের পছন্দের দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছে, তবে কোনো জাতিগত লবি এতটা দূর পর্যন্ত সেই নীতিকে বিচ্যুত করতে পারেনি, যেমনটি করেছে ইসরায়েল লবি। ইসরায়েল লবি সফলভাবে অনেক আমেরিকানকে বিশ্বাস করিয়েছে যে আমেরিকান এবং ইসরায়েলি স্বার্থ মূলত অভিন্ন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তা নয়।
যদিও এই বইটি প্রাথমিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর লবির প্রভাব এবং আমেরিকান স্বার্থের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের উপর আলোকপাত করে, তবে লবির কার্যক্রম ইসরায়েলের জন্যও অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্ষতিকর হয়েছে। ইসরায়েলের বসতিগুলোর কথাই ধরুন, এমনকি লিওন উইসেলটিয়ারের মতো একজন ইসরায়েল-সহানুভূতিশীল লেখকও সম্প্রতি এটিকে "ঐতিহাসিক মাত্রার একটি নৈতিক ও কৌশলগত ভুল" বলে অভিহিত করেছেন। ইসরায়েলের পরিস্থিতি আজ আরও ভালো হত যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই তার আর্থিক ও কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ইসরায়েলকে পশ্চিম তীর ও গাজায় বসতি স্থাপন বন্ধ করতে রাজি করাত এবং পরিবর্তে ইসরায়েলকে সেই জমিগুলোতে একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র তৈরি করতে সাহায্য করত। তবে ওয়াশিংটন তা করেনি, মূলত যেকোনো প্রেসিডেন্টের জন্য এই চেষ্টা রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হত। উপরে উল্লিখিত হিসাবে, যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বলত যে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধের জন্য তার সামরিক কৌশল ব্যর্থ হতে বাধ্য, এবং তাদের সেই পথে না হাঁটতে উৎসাহ দিত, তবে ইসরায়েলের অবস্থা অনেক ভালো হত। ইসরায়েলের আচরণকে সমালোচনা করা এবং তার কিছু অকার্যকর নীতি পরিবর্তন করার জন্য চাপ দেওয়া মার্কিন সরকারের পক্ষে কঠিন থেকে অসম্ভব করে তোলার মাধ্যমে, লবি এমনকি ইহুদি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনাকেও বিপন্ন করতে পারে।
...
লবির কার্যপদ্ধতি (মোডাস অপারেন্ডি)
...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার গণমাধ্যমে ইসরায়েল লবির মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর প্রভাব নিয়ে কথা বলা কঠিন, কারণ এটি করলে প্রায়শই ইহুদি-বিরোধীতার অভিযোগ আনা হয় অথবা "স্বঘৃণিত ইহুদি" হিসেবে তকমা দেওয়া হয়। একইভাবে, ভদ্র সমাজে ইসরায়েলের নীতিমালার সমালোচনা করা বা যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলপ্রীতির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সমানভাবে কঠিন। ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকার উদার ও শর্তহীন সমর্থন খুব কমই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কারণ লবির বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে নিশ্চিত করে যেন জনপরিসরে তাদের বিশেষ সম্পর্কের পক্ষে কৌশলগত ও নৈতিক যুক্তিগুলোই প্রতিধ্বনিত হয়।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের 'প্যালেস্টাইন: পিস নট অ্যাপারথাইড' বইটি এই ঘটনাটির নিখুঁত দৃষ্টান্ত। এই বইটি মূলত একটি ব্যক্তিগত আবেদন, যেখানে কার্টার গত তিন দশকে তার অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও শান্তি প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তিবাদী ব্যক্তিরা হয়তো তার উপস্থাপিত তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন বা তার সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এই দুই জাতির মধ্যে একটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা, এবং কার্টার দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসরায়েলের শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বেঁচে থাকার অধিকারকে সমর্থন করেন। তবুও, যেহেতু তিনি ইঙ্গিত করেন যে অধিকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলের নীতিগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের মতো এবং প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠীগুলো মার্কিন নেতাদের জন্য ইসরায়েলকে শান্তি স্থাপনে চাপ দেওয়া কঠিন করে তোলে, তাই এই একই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি তার বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক অপপ্রচার অভিযান চালায়। কার্টারকে কেবল প্রকাশ্যে ইহুদি-বিরোধী এবং "ইহুদি-বিদ্বেষী" হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়নি, কিছু সমালোচক এমনকি তাকে নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেও অভিযুক্ত করেন। যেহেতু লবি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সম্পর্ক যেভাবে রয়েছে, তা অপরিবর্তিত রাখতে চায় এবং যেহেতু এই সম্পর্কের পক্ষে তাদের কৌশলগত ও নৈতিক যুক্তি খুব দুর্বল, তাই তারা প্রায়শই গঠনমূলক বা গভীর আলোচনা দমন করা অথবা তাকে প্রান্তিক করে দেওয়ার পথই বেছে নেয়।
তবুও লবির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমেরিকান—প্রায় ৪০ শতাংশ—স্বীকার করেন যে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন বিশ্বজুড়ে আমেরিকান-বিরোধীতার অন্যতম প্রধান কারণ। অভিজাতদের মধ্যে, এই সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। উপরন্তু, অপ্রত্যাশিত সংখ্যক আমেরিকান বোঝেন যে লবির মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, যদিও তা সবসময় ইতিবাচক নয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে পরিচালিত একটি জাতীয় জরিপে, ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন যে তারা বিশ্বাস করেন "কংগ্রেস এবং বুশ প্রশাসনের উপর ইসরায়েলি লবির কাজ ইরাক যুদ্ধে যাওয়া এবং এখন ইরানের মুখোমুখি হওয়ার একটি মূল কারণ।" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের ২০০৬ সালের একটি জরিপে, ৬৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন তারা এই বিবৃতিতে একমত যে "ইসরায়েল লবির মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর খুব বেশি প্রভাব রয়েছে।" আমেরিকান জনগণ সাধারণত ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও, তাদের অনেকেই ইসরায়েলের নির্দিষ্ট নীতির সমালোচক এবং ইসরায়েলের কার্যকলাপ যদি মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে হয় তবে আমেরিকান সাহায্য বন্ধ করতে ইচ্ছুক।
অবশ্যই, যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও উন্মুক্ত আলোচনা হত, তবে আমেরিকান জনগণ লবির প্রভাব সম্পর্কে আরও সচেতন হত এবং ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এর বিশেষ সম্পর্ক নিয়ে আরও কঠোর মনোভাবাপন্ন হত। তবুও, কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, লবি এবং ইসরায়েল সম্পর্কে জনসাধারণের নির্দিষ্ট মতামত থাকা সত্ত্বেও, রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকরা ইসরায়েলের সমালোচনা করতে এবং ইসরায়েলের জন্য প্রদেয় সাহায্যকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ভিত্তি করে শর্তাধীন করতে এত অনিচ্ছুক কেন। নিশ্চিতভাবে আমেরিকান জনগণ তাদের রাজনীতিবিদদের কাছে ইসরায়েলকে পুরোপুরি সমর্থন করার দাবি করছে না। সারসংক্ষেপে, বৃহত্তর জনসাধারণ ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে যেভাবে চিন্তা করে এবং ওয়াশিংটনের শাসকবর্গ আমেরিকান নীতি যেভাবে পরিচালনা করে, তার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে।
এই ব্যবধানের প্রধান কারণ হলো 'বেল্টওয়ে'র (ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র) অভ্যন্তরে লবির ভয়ঙ্কর রকমের খ্যাতি। এটি শুধু ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিকান উভয় প্রশাসনে নীতি প্রক্রিয়ার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে না, বরং ক্যাপিটল হিলে এটি আরও বেশি শক্তিশালী। সাংবাদিক মাইকেল ম্যাসিং রিপোর্ট করেছেন যে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন কংগ্রেসের কর্মচারী তাকে বলেছেন, "আমরা আশা করতে পারি হাউসের অর্ধেকেরও বেশি সদস্য (২৫০ থেকে ৩০০) নিশ্চিতভাবে AIPAC যা চায় তা প্রতিবিম্বিতভাবে করবে।" একইভাবে, স্টিভেন রোজেন, প্রাক্তন AIPAC কর্মকর্তা (যাকে ইসরায়েলের কাছে শ্রেণীবদ্ধ সরকারি নথি পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে), নিউ ইয়র্কারের জেফরি গোল্ডবার্গকে একটি ন্যাপকিন সামনে রেখে AIPAC এর ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, "চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে, আমরা এই ন্যাপকিনে সত্তুর জন সিনেটরের স্বাক্ষর পেতে পারি।" এগুলো কথার কথা নয়। যেমনটি স্পষ্ট হবে, যখন ইসরায়েল সম্পর্কিত বিষয়গুলো সামনে আসে, কংগ্রেস প্রায় সবসময় লবির অবস্থানকে সমর্থন করার জন্য ভোট দেয় এবং সাধারণত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে।
...
ইসরায়েল লবি নিয়ে কথা বলা এত কঠিন কেন?
...
যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বহুত্ববাদী গণতন্ত্র যেখানে বাক স্বাধীনতা এবং সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, তাই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা অনিবার্য ছিল। অভিবাসীদের একটি দেশ হিসেবে, এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর কিছু জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করাও সমানভাবে অনিবার্য ছিল। কিউবান আমেরিকানরা কাস্ত্রোর শাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা বজায় রাখার জন্য লবিং করেছে, আর্মেনিয়ান আমেরিকানরা ওয়াশিংটনকে ১৯১৫ সালের গণহত্যা স্বীকার করতে এবং সম্প্রতি আজারবাইজানের সাথে মার্কিন সম্পর্ক সীমিত করতে চাপ দিয়েছে, এবং ইন্ডিয়ান আমেরিকানরা সাম্প্রতিক নিরাপত্তা চুক্তি এবং পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তিগুলিকে সমর্থন করার জন্য একত্রিত হয়েছে। এই ধরনের কার্যকলাপগুলো দেশের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আমেরিকান রাজনৈতিক জীবনের একটি কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য, এবং এগুলোর উল্লেখ করা কদাচিৎ বিতর্কিত হয়।
তবুও, আমেরিকানদের জন্য ইসরায়েল লবি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা স্পষ্টতই কঠিন। এর কারণ আংশিকভাবে লবি নিজেই, লবি তার প্রভাব প্রচার করতে আগ্রহী এবং যদি কেউ তার প্রভাবকে খুব বেশি বা মার্কিন স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে ইঙ্গিত করে তার বিরুদ্ধেও দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আগ্রহী। তবে, ইসরায়েল লবির প্রভাব সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা কঠিন হওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে।
প্রথমেই বলা দরকার, ইসরায়েল লবির কাজকর্ম ও প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুললে কিছু মানুষ মনে করতে পারে যে এটা আসলে ইসরায়েলের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যেহেতু কিছু দেশ এখনও ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না এবং ইসরায়েল ও লবির কিছু সমালোচক এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাই ইসরায়েলের অনেক সমর্থক, এমনকি ভালোভাবে করা সমালোচনাকেও ইসরায়েলের টিকে থাকার জন্য একরকম হুমকি হিসেবে দেখতে পারেন। ইসরায়েলের প্রতি অনেক মানুষের গভীর অনুভূতি রয়েছে। বিশেষ করে হলোকাস্ট থেকে বেঁচে আসা ইহুদি শরণার্থীদের জন্য এটি একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান ইহুদি পরিচয়ের একটি প্রধান প্রতীকও এটি। তাই, যখন মানুষ ভাবে যে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বা বৈধতা ঝুঁকির মুখে, তখন তাদের মধ্যে একটি প্রতিকূল ও আত্মরক্ষামূলক মনোভাব তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েলের নীতি এবং এর আমেরিকান সমর্থকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা ইসরায়েল-বিরোধী পক্ষপাতিত্ব বোঝায় না, ঠিক যেমন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ রিটায়ার্ড পারসনস (AARP) এর রাজনৈতিক কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা বয়স্ক নাগরিকদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বোঝায় না। আমরা ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করছি না বা ইহুদি রাষ্ট্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। এমন কিছু লোক আছে যারা মনে করে যে ইসরায়েল কখনই তৈরি হওয়া উচিত ছিল না, অথবা যারা ইসরায়েলকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র থেকে একটি দ্বি-জাতিগত গণতন্ত্রে রূপান্তরিত দেখতে চায়। আমরা তেমনটা মনে করি না। । বরং, আমরা বিশ্বাস করি যে ইহুদি জনগণের ইতিহাস এবং জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নিয়ম একটি ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য যথেষ্ট যুক্তি সরবরাহ করে। আমরা মনে করি যে যদি ইসরায়েলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে প্রস্তুত থাকা উচিত এবং যদিও আমাদের প্রাথমিক মনোযোগ ইসরায়েল লবির মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাবের উপর, আমরা এও নিশ্চিত যে এর প্রভাব ইসরায়েলের জন্যও ক্ষতিকর হয়েছে। আমাদের মতে, উভয় প্রভাবই দুঃখজনক।
একটি স্বার্থগোষ্ঠী, যার বেশিরভাগ সদস্যই ইহুদি, তাদের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ওপর শক্তিশালী, এমনকি নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে—এই দাবিটি নিশ্চিতভাবে কিছু আমেরিকানকে গভীরভাবে অস্বস্তিতে ফেলবে এবং সম্ভবত ভীত ও ক্ষুব্ধ করবে। এর কারণ হলো, এই ধরনের দাবি 'প্রোটোকলস অফ দ্য এল্ডার্স অফ জিওন' (Protocols of the Elders of Zion) নামক কুখ্যাত ইহুদি-বিদ্বেষী জালিয়াতির অভিযোগের মতোই শোনায়। এই জালিয়াতিটি দাবি করেছিল যে, একটি সর্বশক্তিমান ইহুদি চক্র গোপনে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ইহুদিদের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে যেকোনো আলোচনা শুরু করার আগে তাদের দীর্ঘ দুই হাজার বছরের ইতিহাস মনে রাখা জরুরি, বিশেষ করে ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষের ভয়াবহতা। ক্রুসেডের সময় খ্রিস্টানরা হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করেছিল। এরপর ১২৯০ থেকে ১৪৯৭ সালের মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয় এবং অনেক স্থানে তাদের বস্তিতে আটকে রাখা হয়। স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের সময় ইহুদিদের ওপর চালানো হয়েছিল অকথ্য নির্যাতন। এছাড়া পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় অসংখ্যবার ইহুদি নিধনযজ্ঞ কার্যক্রম চালানো হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ইহুদি বিদ্বেষী মনোভাব সমাজে বিদ্যমান ছিল। এই লজ্জাজনক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি ছিল নাৎসি হলোকাস্ট, যেখানে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়। আরব বিশ্বের কিছু অংশেও ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছিল, যদিও তা ইউরোপের মতো তীব্র ছিল না। নির্যাতনের এই দীর্ঘ ইতিহাস আমেরিকান ইহুদিদের মধ্যে গভীর সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে। স্বাভাবিকভাবেই, কোনো নীতি ভুলের জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে এমন কোনো যুক্তি তাদের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হয়। এই সংবেদনশীলতা আরও বাড়ে "প্রোটোকল" এর মতো ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর স্মৃতির কারণে। ডেভিড ডিউকের মতো কুখ্যাত কু ক্লাক্স ক্ল্যান নেতা এবং অন্যান্য চরমপন্থীদের দ্বারা প্রচারিত "ইহুদি প্রভাব" সংক্রান্ত ভয়ংকর সতর্কবার্তাগুলো ইহুদি সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে।
ইহুদি-বিদ্বেষী অভিযোগগুলোর একটি প্রধান দিক হলো এই দাবি যে ইহুদিরা ব্যাংক, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান 'নিয়ন্ত্রণ' করে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে। তাই, যখন কেউ বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যম ইসরায়েলের পক্ষে বেশি খবর প্রচার করে, তখন কিছু মানুষের কাছে এটি সেই পুরোনো অপবাদ এর মতো শোনায় যে 'ইহুদিরা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে'। একইভাবে, যখন কেউ বলেন যে আমেরিকান ইহুদিদের মধ্যে জনহিতকর ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অর্থ দান করার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে, তখন মনে হতে পারে যেন তারা বোঝাতে চাইছেন যে 'ইহুদি অর্থ' গোপনে বা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব কিনছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে কেউ রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ দান করে, তার পেছনে কোনো না কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। প্রায় সব স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীই জনমতকে প্রভাবিত করতে চায় এবং গণমাধ্যমে তাদের পক্ষে অনুকূল প্রচার পেতে আগ্রহী হয়। যেকোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর নির্বাচনী প্রচারণা, তদবির এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভূমিকা মূল্যায়ন করা একটি স্বাভাবিক এবং বিতর্কমুক্ত বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু অতীতের ইহুদি-বিদ্বেষের কারণে, ইসরায়েল লবি নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে ওষুধ শিল্প লবি, শ্রমিক ইউনিয়ন, অস্ত্র প্রস্তুতকারক, বা ভারতীয়-আমেরিকান গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ে কথা বলা অনেক সহজ। এই ঐতিহাসিক সংবেদনশীলতা বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা সৃষ্টি করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-পন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করাটা জটিল হয়ে দাঁড়ায় একটি পুরোনো অভিযোগের কারণে: 'দ্বৈত আনুগত্য'। এই ধারণা অনুযায়ী, প্রবাসে থাকা ইহুদিরা নাকি চিরকালই বহিরাগত ছিল, যারা কখনো নিজেদের দেশের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যেতে বা সত্যিকার দেশপ্রেমিক হতে পারেনি; কারণ তারা যে দেশে বাস করত, তার চেয়ে নিজেদের গোষ্ঠীর প্রতিই বেশি অনুগত ছিল। আজকের দিনে এই ভয়ের মূল কারণ হলো, ইসরায়েলকে সমর্থনকারী ইহুদিদের যেন 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে দেখা না হয়। আমেরিকান জিউইশ কমিটির প্রাক্তন ওয়াশিংটন প্রতিনিধি হাইম্যান বুকবাইন্ডার যেমন একবার বলেছিলেন, "ইসরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থনকে যখন 'দেশপ্রেমহীন' বলে ইঙ্গিত করা হয়, তখন ইহুদিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়।" এই সংবেদনশীলতা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে আসে, যেখানে ইহুদিদের আনুগত্য নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমরা এই সমস্ত ইহুদি-বিদ্বেষী দাবিগুলিকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করি।
আমাদের মতে, যেকোনো আমেরিকানের পক্ষে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি গভীর টান অনুভব করাটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমেরিকান নাগরিকদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখার এবং এমনকি বিদেশি সেনাবাহিনীতে কাজ করার অনুমতিও আছে, যদি না সেই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধরত থাকে। যেমনটা আমরা আগে দেখেছি, আমেরিকায় এমন অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে যারা তাদের নিজস্ব উৎস দেশের প্রতি প্রবল টান অনুভব করে। এই গোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং দেশের সাধারণ মানুষকে বোঝাতে কঠোর পরিশ্রম করে, যাতে তারা সেই বিদেশি রাষ্ট্রকে সমর্থন করে। স্বাভাবিকভাবেই, বিদেশি সরকারগুলোও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এই জাতিগোষ্ঠী-ভিত্তিক দলগুলোর কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত থাকে। তারা এদের ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রভাবিত করতে এবং নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়। এই দিক থেকে দেখলে, ইহুদি আমেরিকানরা তাদের অন্য সহনাগরিকদের থেকে কোনো অংশেই ভিন্ন নয়।
ইসরায়েল লবি কোনো গোপন চক্র বা ষড়যন্ত্রের অংশ নয়। এটি পুরোনো ধাঁচের সেই স্বার্থগোষ্ঠী রাজনীতিরই একটি অংশ, যা আমেরিকান সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েল-পন্থী গোষ্ঠীগুলো ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (NRA), এএআরপি (AARP) বা আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের মতো পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মতোই কাজ করে। এই সংগঠনগুলোও কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্রপতির অগ্রাধিকারগুলো প্রভাবিত করতে কঠোর পরিশ্রম করে এবং এদের বেশিরভাগই প্রকাশ্যে কাজ করে থাকে।
কিছু ব্যতিক্রম বাদে, যা পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে আলোচনা করা হবে, লবির কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে বৈধ।
আমরা মনে করি না যে ইসরায়েল লবি খুব ক্ষমতাশালী, বা তারা যুক্তরাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। পরের অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখব, এমন অনেক সময় এসেছে যখন তারা যা চেয়েছে, তা পায়নি। তবুও, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই লবির বেশ বড় প্রভাব আছে। আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (AIPAC), যা ইসরায়েলকে সমর্থন করা সবচেয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে অন্যতম, তারা একসময় তাদের ওয়েবসাইটে নিজেদের ক্ষমতা নিয়ে গর্ব করত। তারা শুধু নিজেদের সাফল্যের তালিকা দিত না, বড় বড় রাজনীতিবিদদের বক্তব্যও তুলে ধরত। এসব বক্তব্যে বলা হতো, কিভাবে তারা ইসরায়েলের স্বার্থে বিভিন্ন ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের ওয়েবসাইটে আগে হাউস সংখ্যালঘু দলের প্রাক্তন নেতা রিচার্ড গেফার্ডের একটি কথা ছিল। তিনি AIPAC এর এক সভায় বলেছিলেন, "আপনাদের নিয়মিত সমর্থন এবং মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য আপনাদের প্রতিদিনের লড়াই ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।" এমনকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক অ্যালান ডেরশোভিটস, যিনি ইসরায়েলের সমালোচকদের প্রায়ই ইহুদি-বিদ্বেষী বলেন, তিনিও তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে "আমাদের প্রজন্মের ইহুদিরা... গণতন্ত্রের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে কার্যকর লবিং এবং টাকা তোলার কাজে যুক্ত হয়েছিল। আমরা সত্যিই দারুণ কাজ করেছিলাম, যতটা আমরা করতে পেরেছিলাম এবং আমাদের করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।"
ইহুদি সাপ্তাহিক পত্রিকা 'দ্য ফরওয়ার্ড' এর সম্পাদক এবং 'Jewish Power: Inside the American Jewish Establishment' বইয়ের লেখক জে. জে. গোল্ডবার্গ খুব সুন্দরভাবে ইসরায়েল লবি নিয়ে কথা বলার জটিলতা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন: "মনে হয় যেন আমাদের দুটো কঠিন ধারণার মধ্যে একটা বেছে নিতে হচ্ছে — হয় ইহুদিরা অনেক ক্ষমতাশালী আর খারাপভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করে, অথবা ইহুদিদের কোনো প্রভাবই নেই।" গোল্ডবার্গ আরও বলেছেন, "আসলে এর মাঝামাঝি একটা সত্যি আছে, যা নিয়ে কেউ কথা বলতে চায় না। সেই সত্যিটা হলো, 'ইহুদি সম্প্রদায়' বলে কিছু আছে, যা কিছু সংগঠন আর পরিচিত মানুষদের নিয়ে গঠিত। তারা আসলে রাজনীতির স্বাভাবিক খেলাধুলায় অংশ নেয়।" তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, "অন্য সবার মতো এই খেলায় অংশ নেওয়াতে কোনো সমস্যা নেই।" আমরা তার এই কথার সাথে পুরোপুরি একমত। তবে, আমরা মনে করি, এই ধরনের "রাজনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠীর তৎপরতা" আমেরিকা এবং বিশ্বের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখাটা খুবই জরুরি।
...
আমরা কীভাবে আমাদের যুক্তি স্থাপন করি
...
আমাদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য, আমাদের তিনটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। নির্দিষ্ট করে বললে, আমাদের পাঠকদের বোঝাতে হবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অসাধারণ বস্তুগত সাহায্য এবং কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে, এই সমর্থনের প্রধান কারণ হলো লবি, এবং এই অবিবেচক ও শর্তহীন সম্পর্ক আমেরিকান জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। এটি করার জন্য, আমরা নিম্নোক্তভাবে অগ্রসর হই।
অধ্যায় ১, যার নাম "The Great Benefactor", সরাসরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছে। এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে কী ধরনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেয়, এবং শান্তি বা যুদ্ধ — উভয় পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে কীভাবে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হয়েছে। এসব নীতি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ইসরায়েলকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যা এই গভীর সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
অধ্যায় ২ এবং ৩ এ আমরা সেই মূল যুক্তিগুলো খতিয়ে দেখব, যা সাধারণত ইসরায়েলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া অসাধারণ পরিমাণ সমর্থনকে ন্যায্যতা বা ব্যাখ্যা করার জন্য তুলে ধরা হয়। এই সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ পদ্ধতিগতভাবে খুবই জরুরি। কারণ, ইসরায়েল লবির প্রভাবকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে, আমাদের অবশ্যই অন্যান্য সম্ভাব্য কারণগুলো যাচাই করতে হবে যা দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান এই "বিশেষ সম্পর্ককে" ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়।
অধ্যায় ২, যার শিরোনাম "Israel Strategic Asset or Liability?", একটি প্রচলিত যুক্তির গভীরে প্রবেশ করেছে: ইসরায়েল নাকি এতটাই মূল্যবান কৌশলগত সম্পদ যে এর ব্যাপক সমর্থন প্রাপ্য। আমরা এই অধ্যায়ে দেখিয়েছি যে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় ইসরায়েল হয়তো একটি সম্পদ ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি ক্রমশ একটি কৌশলগত বোঝায় পরিণত হচ্ছে। ইসরায়েলকে এত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করার ফলে আমেরিকার সন্ত্রাসবাদের সমস্যা আরও বেড়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যে যে অন্যান্য জটিল সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলোর মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের প্রতি শর্তহীন সমর্থন বিশ্বের আরও অনেক দেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে জটিল করে তোলে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, ইসরায়েলকে সমর্থন করার ব্যয় ক্রমাগত বাড়লেও এর থেকে প্রাপ্ত সুবিধা কমেছে। তারপরও ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকান সমর্থন বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, কেবল কৌশলগত প্রয়োজন ছাড়াও অন্য কিছু কারণ রয়েছে ইসরায়েলের প্রতি এই অবিচ্ছিন্ন সমর্থনের পেছনে।
অধ্যায় ৩, যার নাম "A Dwindling Moral Case", ইসরায়েলি ও তাদের আমেরিকান সমর্থকরা ইহুদি রাষ্ট্রকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের পেছনে যে বিভিন্ন নৈতিক যুক্তি ব্যবহার করে, তা পরীক্ষা করে। বিশেষ করে, আমরা এই দাবিটি যাচাই করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত "গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের" কারণে ইসরায়েলকে সমর্থন করে। কিছু মানুষ মনে করে, ইসরায়েল একটি দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ ডেভিডের মতো, যা শক্তিশালী আরব গোলিয়াথের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে, তাই তাকে সমর্থন করা উচিত। আবার অন্যদের যুক্তি হলো, ইসরায়েলের অতীত ও বর্তমান আচরণ তার প্রতিবেশীদের চেয়ে বেশি নৈতিক ও দায়িত্বশীল। এমনকি বলা হয়, ইসরায়েল সবসময় শান্তির পক্ষে থাকলেও তার প্রতিবেশীরা প্রায়শই যুদ্ধ বেছে নিয়েছে। এই মূল্যায়ন এই কারণে করা হচ্ছে না যে, ইসরায়েলের প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ আছে বা আমরা মনে করি এর আচরণ অন্যান্য রাষ্ট্রের চেয়ে খারাপ। বরং, এই নৈতিক দাবিগুলো প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলকে ব্যতিক্রমী মাত্রায় সাহায্য প্রদান করে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। পর্যালোচনা শেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য একটি শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি থাকলেও, এটিকে এত উদার এবং মূলত শর্তহীন সমর্থন দেওয়ার জন্য নৈতিক যুক্তি ততটা জোরালো নয়। আবারও, একটি ক্রমহ্রাসমান নৈতিক ভিত্তি এবং ক্রমবর্ধমান মার্কিন সমর্থনের এই সহাবস্থান ইঙ্গিত দেয় যে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ কাজ করছে।
কৌশলগত স্বার্থ বা নৈতিক যুক্তি কোনোটাই ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনকে সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করতে পারে না—এই বিষয়টি প্রমাণ করার পর, আমরা আমাদের মনোযোগ সেই অন্য কিছুর দিকে ফিরিয়েছি। অধ্যায় ৪, যার শিরোনাম "What Is the 'Israel Lobby?", লবির বিভিন্ন অংশকে চিহ্নিত করেছে এবং ব্যাখ্যা করেছে কীভাবে এই শিথিল জোটটি সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে এটি কোনো একক বা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নয়। এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট বিষয়ে মতবিরোধ দেখা যায়। এই লবিতে ইহুদি এবং অ-ইহুদি উভয় সদস্যই অন্তর্ভুক্ত, যার মধ্যে তথাকথিত খ্রিস্টান জায়নবাদীরাও রয়েছে।
এই অধ্যায়ে আরও আলোচনা করা হয়েছে যে আরব-আমেরিকান গোষ্ঠীগুলো, তথাকথিত তেল লবি, অথবা ধনী আরব তেল উৎপাদকরা ইসরায়েল লবির একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিপক্ষ কিনা, অথবা এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির পেছনে প্রকৃত চালিকা শক্তি কিনা। উদাহরণস্বরূপ , অনেক লোক মনে করেন, ইরাক আক্রমণ মূলত তেল নিয়ে ছিল এবং কর্পোরেট তেলের স্বার্থই সেই দেশে মার্কিন আক্রমণের সিদ্ধান্তের প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। এটি এমন নয় – যদিও তেলপ্রাপ্তি স্পষ্টতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ, তবুও যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে কেন আরব আমেরিকান, তেল কোম্পানি এবং সৌদি রাজপরিবারের মার্কিন বৈদেশিক নীতির ওপর ইসরায়েল লবির চেয়ে অনেক কম প্রভাব রয়েছে।
অধ্যায় ৫ ("Guiding the Policy Process") এবং অধ্যায় ৬ ("Dominating Public Discourse") এ, আমরা ইসরায়েলের স্বার্থকে যুক্তরাষ্ট্রে এগিয়ে নিতে লবির বিভিন্ন কৌশল বর্ণনা করেছি। ক্যাপিটল হিলে সরাসরি লবিংয়ের পাশাপাশি, লবি মূলত নির্বাচনী প্রচারণার অনুদান প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার মাধ্যমে রাজনীতিবিদদের পুরস্কৃত বা শাস্তি দেয়। লবির অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলো নির্বাহী বিভাগের ওপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে। এর মধ্যে একটি প্রধান পদ্ধতি হলো এমন সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কাজ করা, যাঁরা তাদের মতামতের প্রতি সহানুভূতিশীল। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লবি ইসরায়েল সম্পর্কে জনমত গঠনে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে গণমাধ্যম ও শিক্ষাবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং প্রভাবশালী বৈদেশিক নীতি বিষয়ক থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোতে দৃশ্যমান উপস্থিতি তৈরি করা অন্যতম। জনমত গঠনের প্রচেষ্টার মধ্যে প্রায়শই ইসরায়েলের সমালোচকদের ইহুদি-বিদ্বেষী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, যা বর্তমান সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জকারী যে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন ও প্রান্তিক করার একটি কৌশল।
এই কাজগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর, দ্বিতীয় অংশটি সাম্প্রতিক মার্কিন মধ্যপ্রাচ্য নীতি গঠনে লবির ভূমিকা তুলে ধরে। এটি জোর দিয়ে বলা উচিত যে, আমাদের যুক্তি এমন নয় যে এই বিষয়গুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণে লবিই একমাত্র প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান। এটি (লবি) সর্বশক্তিমান নয়, তাই প্রতিটি বিষয়ে এটি তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। তবে ইসরায়েল এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের প্রতি মার্কিন নীতিকে এমনভাবে রূপ দিতে এটি অত্যন্ত কার্যকর যা ইসরায়েলের উপকারের উদ্দেশ্যে তৈরি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও উপকারে আসবে বলে বিশ্বাস করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, এটি সফলভাবে উৎসাহিত করেছে এমন নীতিগুলি প্রকৃতপক্ষে মার্কিন স্বার্থের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে এবং ইসরায়েলের জন্যও ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।
একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর, সপ্তম অধ্যায়ে ("The Lobby Versus the Palestinians") দেখানো হয়েছে কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষা দমন বা সীমিত করার ইসরায়েলি প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছে। এমনকি যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা ইসরায়েলের উপর ছাড় দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন অথবা ইসরায়েলের নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন—যেমন ১১ সেপ্টেম্বরের পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বেশ কয়েকবার এমন চেষ্টা করেছিলেন—তখনও লবি হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের আবার নিজেদের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। এর ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি খারাপ হয়েছে, ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি বিভাজনের উভয় দিকেই দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ দেখা দিয়েছে। এই প্রবণতাগুলোর কোনোটিই আমেরিকা বা ইসরায়েলের স্বার্থের অনুকূল নয়।
অধ্যায় ৮ ("Iraq and Dreams of Transforming the Middle East") এ, আমরা দেখাই যে লবি – এবং বিশেষত এর মধ্যে থাকা নব্য-রক্ষণশীলরা – ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের বুশ প্রশাসনের সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। আমরা জোর দিয়ে বলি যে লবি একা যুদ্ধের কারণ ছিল না। ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা বুশ প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি এবং সাদ্দাম হুসেইনকে উৎখাত করার সিদ্ধান্তে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু লবির প্রভাব না থাকলে, প্রায় নিশ্চিতভাবেই কোনো যুদ্ধ হত না। যে যুদ্ধ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত বিপর্যয় এবং ইসরায়েলের সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানের জন্য এক সুযোগ। এই যুদ্ধের পেছনে লবির ভূমিকা ছিল অপরিহার্য তবে একমাত্রকারণনয়।
নবম অধ্যায়ে ("Taking Aim at Syria") সিরিয়ার আসাদ শাসনের সাথে আমেরিকার জটিল সম্পর্কের বিবর্তন বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা নথিভুক্ত করেছি কিভাবে লবি ওয়াশিংটনকে সিরিয়ার প্রতি সংঘাতমূলক নীতি (যার মধ্যে মাঝে মাঝে শাসন পরিবর্তনের হুমকিও অন্তর্ভুক্ত) গ্রহণে উৎসাহিত করেছে, যখন ইসরায়েলি সরকার এটি চেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, লবির প্রভাব না থাকলে, ইসরায়েল এবং সিরিয়ার মধ্যে হয়তো ইতোমধ্যেই একটি শান্তি চুক্তি থাকত, এবং দামেস্ক হয়তো লেবাননে হিজবুল্লাহকে সমর্থন করত না, যা ওয়াশিংটন এবং জেরুজালেম উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক হতো।
দশম অধ্যায়ে ("Iran in the Crosshairs"), আমরা ইরানের প্রতি মার্কিন নীতিতে লবির ভূমিকা অনুসন্ধান করেছি। ১৯৭৯ সালের শাহ বিরোধী বিপ্লবের পর থেকে ওয়াশিংটন ও তেহরানের সম্পর্ক বরাবরই কঠিন ছিল। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং হিজবুল্লাহর মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থনের কারণে ইরানকে তাদের সবচেয়ে গুরুতর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে আসছে। তদনুসারে, ইসরায়েল এবং লবি বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাপ দিয়েছে এবং সম্পর্ক শিথিল করার জন্য পূর্বের বেশ কয়েকটি সুযোগ নষ্ট করতে কাজ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, এর ফলে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরও চরমপন্থী গোষ্ঠী (যেমন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ) ক্ষমতায় এসেছে, যা একটি কঠিন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
একাদশ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হলো লেবানন ("The Lobby and the Second Lebanon War"), এবং এক্ষেত্রেও চিত্রটি প্রায় একই রকম। আমরা যুক্তি দিচ্ছি যে, ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে হিজবুল্লাহর অযৌক্তিক উস্কানির জবাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া কৌশলগতভাবে নির্বোধ এবং নৈতিকভাবে ভুল উভয়ই ছিল। কিন্তু লবির প্রভাবের কারণে মার্কিন কর্মকর্তাদের পক্ষে ইসরায়েলকে জোরালো সমর্থন দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই ঘটনাটি আমেরিকান এবং ইসরায়েলি স্বার্থের উপর লবির দুঃখজনক প্রভাবের আরেকটি ক্লাসিক উদাহরণ প্রদান করে: মার্কিন নীতি নির্ধারকদের পক্ষে যখন ইসরায়েলি প্রতিপক্ষদের সৎ ও সমালোচনামূলক পরামর্শ দেওয়া প্রয়োজন ছিল, তখন লবি সেই সুযোগকে কঠিন করে তোলে। এর ফলে এমন একটি নীতির জন্ম হয় যা আমেরিকার ভাবমূর্তিকে আরও কলঙ্কিত করে, বৈরুতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে দুর্বল করে এবং হিজবুল্লাহকে শক্তিশালী করে।
শেষ অধ্যায়ে ("What Is to Be Done?") এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি কীভাবে উন্নত করা যায়, তা আলোচনা করা হয়েছে। আমরা প্রথমে আমেরিকার মূল মধ্যপ্রাচ্যীয় স্বার্থগুলো চিহ্নিত করি, এরপর একটি কৌশলগত রূপরেখা (যা আমরা অফশোর ব্যালেন্সিং নামে অভিহিত করেছি) তুলে ধরি, যা এই স্বার্থগুলোকে আরও কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারে। আমরা ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি ত্যাগের কথা বলছি না; প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েলের অস্তিত্ব যদি কখনো বিপন্ন হয়, তবে তাকে সাহায্য করার বিষয়টিকে আমরা স্পষ্টভাবে সমর্থন করি। তবে আমরা যুক্তি দিই যে, এখন সময় এসেছে ইসরায়েলকে একটি স্বাভাবিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করার এবং মার্কিন সাহায্যকে দখলদারিত্বের অবসান এবং ইসরায়েলের নীতিগুলোকে আমেরিকান স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার শর্তাধীন করার। এই পরিবর্তন আনতে লবির রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং তার বর্তমান নীতিগত কর্মসূচির মোকাবিলা করা প্রয়োজন। লবির প্রভাবকে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ের জন্য আরও উপকারী করে তোলা যায়, সে বিষয়ে আমরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছি।
...
যাদের কাছ থেকে আমরা শিখেছি
...
কোনো লেখকই বিচ্ছিন্ন নন, আর তাই আমরা আমাদের আগে যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন, সেই সকল পণ্ডিত ও লেখকের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। শুরুতেই বলতে হয়, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিয়ে যে বিশাল অ্যাকাডেমিক সাহিত্য রয়েছে, তা আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে কিভাবে ছোট কিন্তু সুসংগঠিত আন্দোলনগুলো জনসংখ্যায় তাদের প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। একইভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির ওপর জাতিগোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়েও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, যা নিশ্চিত করে যে ইসরায়েল লবির মৌলিক কার্যকলাপগুলো অনন্য নয়, বরং এর অস্বাভাবিক মাত্রার প্রভাবই এটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
দ্বিতীয় যে সাহিত্যিক ধারাটি আমাদের সহায়ক হয়েছে, তা হলো লবিকে নিয়ে লেখা বইপত্র। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক, পণ্ডিত এবং প্রাক্তন রাজনীতিবিদ এই লবি সম্পর্কে লিখেছেন। সমালোচনামূলক এবং সহানুভূতিশীল উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখা এই কাজগুলোতে লবি কিভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছে, সে সম্পর্কে প্রচুর দরকারি তথ্য রয়েছে। আমরা আশা করি আমাদের এই বিবরণ পূর্ববর্তী লেখকদের আলোকিত পথকে আরও প্রসারিত করবে।
আমরা আরও অসংখ্য গবেষণা থেকে অনেক কিছু শিখেছি, যা এখানে সম্পূর্ণ তালিকাভুক্ত করা সম্ভব নয়। এসব গবেষণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক, অথবা নির্দিষ্ট নীতিগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। যদিও স্টিভেন স্পিগেলের "দ্য আদার আরব-ইসরায়েলি কনফ্লিক্ট: মেকিং আমেরিকাস মিডল ইস্ট পলিসি ফ্রম ট্রুম্যান টু রিগান" এবং ওয়ারেন বাসের "সাপোর্ট এনি ফ্রেন্ড: কেনেডিস মিডল ইস্ট অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ দ্য ইউ.এস.-ইসরায়েল অ্যালায়েন্স"-এর মতো কিছু কাজ লবির প্রভাবকে ছোট করে দেখানোর প্রবণতা রাখে, তবুও এই ধরনের গুরুতর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজগুলোতে লবির প্রভাব এবং বিশেষ করে এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান।
এছাড়াও আরও কিছু সাহিত্যকর্ম রয়েছে যা ইসরায়েল, লবি, এবং ইহুদি রাষ্ট্রের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। আমরা এখানে গত বিশ বছরে ইসরায়েল থেকে প্রকাশিত তথাকথিত 'নতুন ইতিহাস' এর কথা বলছি। শ্লোমো বেন-আমি, সিমহা ফ্লাপান, বারুচ কিমারলিং, বেনি মরিস, ইলান পাপে, টম সেগেভ, আবি শ্লাইম, এবং জিভ স্টার্নহেলের মতো ইসরায়েলি পণ্ডিতরা ব্যাপক আর্কাইভ গবেষণার মাধ্যমে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি এর পরবর্তী নীতি বিষয়ক প্রচলিত ধারণাকে কার্যকরভাবে উল্টে দিয়েছেন। অন্যান্য দেশের পণ্ডিতরাও ঐতিহাসিক রেকর্ডকে সঠিক পথে আনতে অবদান রেখেছেন। সম্মিলিতভাবে এই ব্যক্তিরা ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রচলিত, অত্যন্ত রোমান্টিক ধারণাকে দুর্বল করে দিয়েছেন, যেখানে সাধারণত ইহুদিদের 'সাদা টুপি' (ভালো) এবং আরবদের 'কালো টুপি' (খারাপ) হিসেবে চিত্রিত করা হতো। উপরন্তু, এই কাজগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে ইসরায়েল স্বাধীনতা লাভের পর ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরবদের প্রতি সাধারণ ধারণার চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক আচরণ করেছিল।
এই ঐতিহাসিকদের মধ্যে অবশ্যই বিভিন্ন মতপার্থক্য রয়েছে এবং আমরা তাঁদের প্রতিটি যুক্তির সঙ্গে একমত নই। তবুও, তাঁরা সম্মিলিতভাবে যে ইতিহাস তুলে ধরেন, তা কেবল গবেষণার বিষয় নয়। বস্তুত, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলকে সমর্থন করার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে এটি গভীর চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়। এটি আরও বুঝতে সাহায্য করে যে কেন আরব ও ইসলামিক বিশ্বের এত মানুষ ইসরায়েলকে এত উদারভাবে এবং শর্তহীনভাবে সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীরভাবে ক্ষুব্ধ।
...
উৎস সম্পর্কে একটি নোট
...
সামনে এগোনোর আগে উৎস প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এই গবেষণার একটি বড় অংশ—বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্ব—সাম্প্রতিক ইতিহাস অথবা এমন সব ঘটনা নিয়ে লেখা হয়েছে যার চূড়ান্ত ফলাফল এখনো অনিশ্চিত। যেহেতু সমসাময়িক ঘটনাবলী সম্পর্কিত সরকারি নথি সাধারণত গবেষকদের জন্য সহজলভ্য নয়, তাই আমাদের অন্যান্য উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে: সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, গবেষণামূলক প্রবন্ধ, বই, মানবাধিকার সংস্থাগুলির প্রতিবেদন, রেডিও ও টেলিভিশনের প্রতিলিপি এবং আমাদের পরিচালিত ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার। কিছু ক্ষেত্রে, আমাদের ঘটনার অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে হয়েছে, যা আমরা স্বীকার করি। যদিও আমরা মনে করি এর সম্ভাবনা কম, তবুও সরকারি নথিগুলো সহজলভ্য হলে আমাদের গল্পের কিছু অংশ ভিন্ন দেখাতে পারে।
আমাদের বিভিন্ন যুক্তি সঠিক কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য, আমরা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একাধিক সূত্র দিয়ে যাচাই করেছি, যার ফলে এই বইয়ের শেষে বিস্তারিত টীকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমরা হারেৎজ এবং জেরুজালেম পোস্টএর মতো ইসরায়েলি উৎসের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছি, পাশাপাশি ইসরায়েলি পণ্ডিতদের লেখাও ব্যবহার করেছি।
...
উপসংহার
...
আমাদের বিশ্লেষণ শুরু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে যে বস্তুগত ও কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করে, তার বিবরণ দিয়ে। আমেরিকা যে ইহুদি রাষ্ট্রকে উল্লেখযোগ্য সমর্থন দেয়, তা হয়তো কোনো নতুন খবর নয়, তবে পাঠকরা জেনে অবাক হতে পারেন যে এই উদারতা আসলে কতটা ব্যাপক ও বিচিত্র। এই সমর্থনের বিস্তারিত বিবরণই পরবর্তী অধ্যায়ের বিষয়।
***
Comment