আল্লাহ তাআলার সাথে মোহাব্বত
আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা, মালিক এবং রিজিকদাতা। আল্লাহ তাআলা মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদত জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
"وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون"
"আমি সৃষ্টি করেছি জিন জাতি এবং মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য" ( সূরা যারিয়াত আয়াত: ৫৬)
ওলামায়ে একরামের(কেরামের) মতে মানুষের কোন কাজে এবাদতে পরিণত হয় না, যতক্ষণ না সে কাজের নিম্নের তিনটি গুণ না পাওয়া যায়,
১- চূড়ান্ত বিনয় ও নম্রতা
২-চূড়ান্ত ইখলাস বা একনিষ্ঠতা
৩- চূড়ান্ত ভয় ও ভীতি
সুতরাং আল্লাহর এবাদত বন্দেগী নিজেই একথা কামনা করে, যেখানে আল্লাহ তাআলার সামনে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা হবে, তার আজাব ও গজবের ভয় অনুভূত হবে, সেখানে তার সাথে প্রচন্ড মোহাব্বত ও আশা সৃষ্টি করতে হবে, সূরা আম্বিয়া ইরশাদ করেন,
"انهم كانوا يسارعون في الخيرات ويدعوننا رغبا ورهبا وكانوا لنا خاشعين"
"তারা সৎকর্মের প্রতিযোগিতা করত তারা আমাকে ডাকতো আশা ও ভীতির সহিত এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত" (সূরা আম্বিয়া আয়াত:৯০)
অর্থাৎ আম্বিয়ায়ে কেরামের ইবাদতের মধ্যে বিনয়ের সাথে মহব্বত ও আশা ছিল, যা আকিদা আল ওয়ালার ভিত্তি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের এ গুন বর্ণনা করেছেন যে, তারা দুনিয়াযর সকল বস্তুর উপর আল্লাহ তাআলাকে মহাব্বত করে।
আল্লাহ এরশাদ করেন,
"والذين امنوا اشد حبا لله"
"যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় তারা সুদৃঢ়"(সূরা বাকারা আয়াত: ১৬৫)
সুতরাং আল্লাহ তালাকে মহব্বত করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজে আইন, এ মহব্বত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকেও অধিক, পিতা-মাতা, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য সকল বন্ধু-বান্ধবের থেকেও অধিক, আল্লাহ তাআলার পরে যে সব বস্তুর মোহাব্বত হবে সেটিও আল্লাহ তাআলার অনুগামী। রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে মহব্বতের মত আরো যত কাঙ্ক্ষিত মহব্বত সেটিও মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে। পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এর সাথে যতটুকু মহব্বত থাকা প্রয়োজন সেটি এজন্য হবে যে এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ।ধন-সম্পদ ঘরবাড়ি ও অন্যান্য বস্তুর প্রতি শুধু এতোটুকুই মহব্বত থাকবে যতটুকু আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন।
অনুরূপ মানুষের সর্বপ্রকার মহব্বতের মূল উৎস ও কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহর তাআলার পবিত্রতায় হাওয়া উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মোহাম্মদ মহাব্বত আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে বেশি হবে না,পিতা মাতা স্ত্রী-সন্তান ও অন্যান্য আল্লাহর উপর প্রাধান্য পাবে না। ঘরবাড়ি ধন-সম্পদ ও পদ-পদবী এর মোহাব্বত আল্লাহ তাআলার প্রতিবন্ধক হবে না।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজের পিতাকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, বাবা রাগনিত(রাগান্বিত) হয়ে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে শুধু পরিবার থেকেই নয়, একেবারে বাড়িছাড়া করলেন, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম আল্লাহর মহব্বত ও বন্ধুত্বের পথে পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন ধন-সম্পদ ও ঘরবাড়ি এর মোহাব্বত কে এক মুহূর্তের জন্যেও প্রতিবন্ধক হতে দেননি, বরং বাবার কাছ থেকে পৃথক হয়ে গেছেন।
আল্লাহর একত্ববাদের এর দাওয়াত দেয়ার অপরাধে যখন বাদশা ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম কে আগুনে নিক্ষেপ এর আদেশ দিলেন, তখন তিনি অবিচলতার মাঝে বিন্দুমাত্র পিছুটান দেননি, ৮০ বছরের বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাকে সন্তান দান করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন স্ত্রী সন্তানকে একা লোকালয়হীন মরুভূমিতে রেখে আসেন, তখনো ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ পালনে একটুও চিন্তা ভাবনা করেন নি, কয়েক বছর পরে আল্লাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম এর কিশোর পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন, তখনোও পুত্রের মোহাব্বত আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন, ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম এটাই প্রমান(প্রমাণ) করেছেন যে তার জীবনে আল্লাহর মহব্বত অন্য সকল বস্তুর মহব্বতের উপর বিজয়ী,তখন আল্লাহ তাআলা হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন এভাবে,
وابراهيم الذي وفى
"এবং ইব্রাহিমের কিতাবে যে পালন করেছিল তার দায়িত্ব" (সূরা নাজম আয়াত ৩৭)
তাইফের সফরের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আহত অবস্থায় নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম শহরের বাইরে একটি আঙ্গুর বাগান আশ্রয় নিয়ে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, যখন বিশ্রাম নেওয়া শেষ হলো, তখন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দোয়া করলেন, এভাবে যে
"হে আল্লাহ আমার উপর যদি আপনি অসন্তুষ্ট না হোন, তাহলে আমার এ দুঃখ কষ্টের কোন পরোয়া নাই, আপনার নিরাপত্তায় আমার আশ্রয় আমি আপনার সেই উজ্জ্বল তাওয়াজ্জুহর আশ্রয় চাচ্ছি, যার সাহায্যে অন্ধকার সমূহ আলোকিত হয় এবং ইহকাল ও পরকালের আচার-আচরণ সঠিক হয়ে যায়,আপনি যদি আমার উপর লা'নত করেন, আপনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হন, আমার তো স্রেফ আপনার সন্তুষ্টিই কাম্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। দুঃখ কষ্টের কঠিন মুহূর্তেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর কন্ঠ মোবারক থেকে বের হওয়া বাক্যগুলো আল্লাহ তা'আলার সাথে অসীম মহব্বতের বহিরপ্রকাশ।যা কেবল রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম এর বৈশিষ্ট্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম দোয়া বলেছিলেন,
"اللهم اجعل حبك احب الي من نفسي ومالي واهلي ومن الماء البارد"
"হে আল্লাহ আমার অন্তরে আপনার মহব্বত, আমার জীবন, আমার সম্পদ, আমার পরিবার ও ঠান্ডা পানি থেকেও অধিক বৃদ্ধি করে দিন" (সুনানে তিরমিজি ৩৪৯০)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নিজের শিক্ষাদিক্ষা ও কর্মপদ্ধতির ধারা সাহাবায়ে কেরামের মহতি জামায়াতের মাঝে আল্লাহর মহব্বত, এমনতর প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বড় থেকে বড় কাফেরের নির্যাতন অসহ্যনীয় শম্কা ও বিপদসংকুল পরীক্ষাতেও তিনি আল্লাহর মহব্বত এর মাঝে অন্যতম চির ধরাতে পারিনি, কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হলো:
১|হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু যখন মুসলমান হলেন, তখন তার ওপর যেন নির্যাতনের খড়গ নেমে এলো। তার মালিক ও উমাইয়া দিন খালফ প্রচন্ড রোদে চিত করে বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখত, যেন নাড়াচাড়া করতে না পারে। আর বিদ্রুপ করে বলতো যতক্ষণ না মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ধর্ম অস্বিকার করে, রাত উজ্জার এবাদত করবে, ততক্ষণ এভাবেই পড়ে থাকবে, উত্তরে হযরত বেলাল (রাঃ) শুধু আহাদ আহাদ জবতে থাকতেন। এতে মালিক আরো প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়তো। এরপর কাফেররা তাকে রশি দিয়ে বেঁধে মক্কার অলিতে-গলিতে টেনে হেঁচড়ে ঘুরাতন। কখনো উত্তপ্ত বালুর উপর ফেলে রাখতো এবং তার উপর পাথরের স্তুপ চাপা দিয়ে ফেলে রাখতো এবং আর বলতো, বল আমার রব লাত আর উদযা। হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাবে শুধু একটি কথাই বলতেন আহাদ আহাদ।
২|ইয়াসির গোত্র বনু মাখযুম এর গোলাম ছিল। হযরত সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহ তারা আনহা বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কাফেররা লৌহার বর্ম পড়িয়ে তাকে উত্তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে রাখতো, তার পাশে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ করে বলতো, নাও এবার মোহাম্মদের দীনের স্বাদ গ্রহণ করো। তার স্বামী হযরত ইয়াসির (রা ও তার ছেলে হযরত আম্মার (রা কে আগুনের ছ্যাকা দেওয়া হতো, পানিতে ডুবিয়ে, উত্তপ্ত বালুর উপর ফেলে রাখা হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যখন কাফেরদের নির্যাতন আর অসহায় ইয়াসির গোত্রের ধৈর্য ও সহনশীলতার দেখতেন, তখন বলতেন হে ইয়াসির গোত্র ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। আর হযরত সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার লজ্জাস্থানে বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়, (ইন্নালিল্লাহি ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)
পাঠকদের এ কথার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত যে, আমরা সকলেই আল্লাহর মহব্বতের দাবিদার। সাহাবা একরামের(কেরামের) জীবন চরিত্র কে সামনে রেখে, আমরা আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করা উচিত যে, আমরা আমাদের এই দাবির প্রতি কতটুকু সত্যবাদী, যদি আমরা আল্লাহর তাআলার দিনের জন্য কোন কোরবানি দিয়ে থাকি কিংবা কোনো ত্যাগ স্বীকার করে থাকি তাহলে তা কিছুটা হলেও আমরা আমাদের দাবিতে সত্যবাদী এবং আল্লাহর নিকট মায়া ও দয়ার আশা করতে পারি, পক্ষান্তরে যদি আল্লাহ তা'আলার সাথে মহব্বতের এ দাবি হয় যে, শুধু মুখে মুখে এবং বাস্তবে আল্লাহর মোকাবেলায় আমাদের নিজের জীবন, সহায় সম্পদ, মান-মর্যাদা, নিজের দেশ, নিজের আরাম-আয়েশের বাসস্থান, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, প্রিয় হয়, তাহলে আমরা যেন আল্লাহ তাআলার সেই বিধানকে ভুলে না যায়, যে আল্লাহকে মহব্বত করে না আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করে, তাদের স্থলাভিষিক্ত এমন লোকদের কে নিয়ে আসবেন, যারা আল্লাহকে মোহাব্বত করবেন এবং আল্লাহও তাদের মোহাব্বত করবেন আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
يا ايها الذين امنوا من يرتد منكم عن دينه فسوف ياتي الله بقوم يحبهم ويحبونه اذلة على المؤمنين اعزة على الكافرين يجاهدون في سبيل الله ولا يخافون لومة لاءم ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء والله واسع عليم
"হে মুমিনগণ তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাকে ভালবাসবে, তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করিবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ" (সূরা মায়েদা আয়াত:৫৪)
(লেখাটা একটি কিতাব থেকে নেওয়া হয়েছে এবং তা পরিমার্জিত করা হয়েছে)
আল্লাহ মানুষের স্রষ্টা, মালিক এবং রিজিকদাতা। আল্লাহ তাআলা মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদত জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন,
"وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون"
"আমি সৃষ্টি করেছি জিন জাতি এবং মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছি আমার ইবাদতের জন্য" ( সূরা যারিয়াত আয়াত: ৫৬)
ওলামায়ে একরামের(কেরামের) মতে মানুষের কোন কাজে এবাদতে পরিণত হয় না, যতক্ষণ না সে কাজের নিম্নের তিনটি গুণ না পাওয়া যায়,
১- চূড়ান্ত বিনয় ও নম্রতা
২-চূড়ান্ত ইখলাস বা একনিষ্ঠতা
৩- চূড়ান্ত ভয় ও ভীতি
সুতরাং আল্লাহর এবাদত বন্দেগী নিজেই একথা কামনা করে, যেখানে আল্লাহ তাআলার সামনে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা হবে, তার আজাব ও গজবের ভয় অনুভূত হবে, সেখানে তার সাথে প্রচন্ড মোহাব্বত ও আশা সৃষ্টি করতে হবে, সূরা আম্বিয়া ইরশাদ করেন,
"انهم كانوا يسارعون في الخيرات ويدعوننا رغبا ورهبا وكانوا لنا خاشعين"
"তারা সৎকর্মের প্রতিযোগিতা করত তারা আমাকে ডাকতো আশা ও ভীতির সহিত এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত" (সূরা আম্বিয়া আয়াত:৯০)
অর্থাৎ আম্বিয়ায়ে কেরামের ইবাদতের মধ্যে বিনয়ের সাথে মহব্বত ও আশা ছিল, যা আকিদা আল ওয়ালার ভিত্তি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের এ গুন বর্ণনা করেছেন যে, তারা দুনিয়াযর সকল বস্তুর উপর আল্লাহ তাআলাকে মহাব্বত করে।
আল্লাহ এরশাদ করেন,
"والذين امنوا اشد حبا لله"
"যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় তারা সুদৃঢ়"(সূরা বাকারা আয়াত: ১৬৫)
সুতরাং আল্লাহ তালাকে মহব্বত করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজে আইন, এ মহব্বত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকেও অধিক, পিতা-মাতা, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও অন্যান্য সকল বন্ধু-বান্ধবের থেকেও অধিক, আল্লাহ তাআলার পরে যে সব বস্তুর মোহাব্বত হবে সেটিও আল্লাহ তাআলার অনুগামী। রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে মহব্বতের মত আরো যত কাঙ্ক্ষিত মহব্বত সেটিও মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে। পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এর সাথে যতটুকু মহব্বত থাকা প্রয়োজন সেটি এজন্য হবে যে এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ।ধন-সম্পদ ঘরবাড়ি ও অন্যান্য বস্তুর প্রতি শুধু এতোটুকুই মহব্বত থাকবে যতটুকু আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন।
অনুরূপ মানুষের সর্বপ্রকার মহব্বতের মূল উৎস ও কেন্দ্রবিন্দু আল্লাহর তাআলার পবিত্রতায় হাওয়া উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মোহাম্মদ মহাব্বত আল্লাহর মহব্বতের চেয়ে বেশি হবে না,পিতা মাতা স্ত্রী-সন্তান ও অন্যান্য আল্লাহর উপর প্রাধান্য পাবে না। ঘরবাড়ি ধন-সম্পদ ও পদ-পদবী এর মোহাব্বত আল্লাহ তাআলার প্রতিবন্ধক হবে না।
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজের পিতাকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, বাবা রাগনিত(রাগান্বিত) হয়ে ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে শুধু পরিবার থেকেই নয়, একেবারে বাড়িছাড়া করলেন, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম আল্লাহর মহব্বত ও বন্ধুত্বের পথে পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন ধন-সম্পদ ও ঘরবাড়ি এর মোহাব্বত কে এক মুহূর্তের জন্যেও প্রতিবন্ধক হতে দেননি, বরং বাবার কাছ থেকে পৃথক হয়ে গেছেন।
আল্লাহর একত্ববাদের এর দাওয়াত দেয়ার অপরাধে যখন বাদশা ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম কে আগুনে নিক্ষেপ এর আদেশ দিলেন, তখন তিনি অবিচলতার মাঝে বিন্দুমাত্র পিছুটান দেননি, ৮০ বছরের বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ তাকে সন্তান দান করেছেন এবং নির্দেশ দিয়েছেন স্ত্রী সন্তানকে একা লোকালয়হীন মরুভূমিতে রেখে আসেন, তখনো ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ পালনে একটুও চিন্তা ভাবনা করেন নি, কয়েক বছর পরে আল্লাহ ইব্রাহিম আলাইহিস সাল্লাম এর কিশোর পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন, তখনোও পুত্রের মোহাব্বত আল্লাহর নির্দেশের সামনে মাথা পেতে দিয়েছেন, ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম এটাই প্রমান(প্রমাণ) করেছেন যে তার জীবনে আল্লাহর মহব্বত অন্য সকল বস্তুর মহব্বতের উপর বিজয়ী,তখন আল্লাহ তাআলা হযরত ইব্রাহিম আলাই সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন এভাবে,
وابراهيم الذي وفى
"এবং ইব্রাহিমের কিতাবে যে পালন করেছিল তার দায়িত্ব" (সূরা নাজম আয়াত ৩৭)
তাইফের সফরের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল, আহত অবস্থায় নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম শহরের বাইরে একটি আঙ্গুর বাগান আশ্রয় নিয়ে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন, যখন বিশ্রাম নেওয়া শেষ হলো, তখন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দোয়া করলেন, এভাবে যে
"হে আল্লাহ আমার উপর যদি আপনি অসন্তুষ্ট না হোন, তাহলে আমার এ দুঃখ কষ্টের কোন পরোয়া নাই, আপনার নিরাপত্তায় আমার আশ্রয় আমি আপনার সেই উজ্জ্বল তাওয়াজ্জুহর আশ্রয় চাচ্ছি, যার সাহায্যে অন্ধকার সমূহ আলোকিত হয় এবং ইহকাল ও পরকালের আচার-আচরণ সঠিক হয়ে যায়,আপনি যদি আমার উপর লা'নত করেন, আপনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হন, আমার তো স্রেফ আপনার সন্তুষ্টিই কাম্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি আমার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। দুঃখ কষ্টের কঠিন মুহূর্তেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর কন্ঠ মোবারক থেকে বের হওয়া বাক্যগুলো আল্লাহ তা'আলার সাথে অসীম মহব্বতের বহিরপ্রকাশ।যা কেবল রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম এর বৈশিষ্ট্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম দোয়া বলেছিলেন,
"اللهم اجعل حبك احب الي من نفسي ومالي واهلي ومن الماء البارد"
"হে আল্লাহ আমার অন্তরে আপনার মহব্বত, আমার জীবন, আমার সম্পদ, আমার পরিবার ও ঠান্ডা পানি থেকেও অধিক বৃদ্ধি করে দিন" (সুনানে তিরমিজি ৩৪৯০)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নিজের শিক্ষাদিক্ষা ও কর্মপদ্ধতির ধারা সাহাবায়ে কেরামের মহতি জামায়াতের মাঝে আল্লাহর মহব্বত, এমনতর প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বড় থেকে বড় কাফেরের নির্যাতন অসহ্যনীয় শম্কা ও বিপদসংকুল পরীক্ষাতেও তিনি আল্লাহর মহব্বত এর মাঝে অন্যতম চির ধরাতে পারিনি, কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হলো:
১|হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু যখন মুসলমান হলেন, তখন তার ওপর যেন নির্যাতনের খড়গ নেমে এলো। তার মালিক ও উমাইয়া দিন খালফ প্রচন্ড রোদে চিত করে বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখত, যেন নাড়াচাড়া করতে না পারে। আর বিদ্রুপ করে বলতো যতক্ষণ না মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর ধর্ম অস্বিকার করে, রাত উজ্জার এবাদত করবে, ততক্ষণ এভাবেই পড়ে থাকবে, উত্তরে হযরত বেলাল (রাঃ) শুধু আহাদ আহাদ জবতে থাকতেন। এতে মালিক আরো প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়তো। এরপর কাফেররা তাকে রশি দিয়ে বেঁধে মক্কার অলিতে-গলিতে টেনে হেঁচড়ে ঘুরাতন। কখনো উত্তপ্ত বালুর উপর ফেলে রাখতো এবং তার উপর পাথরের স্তুপ চাপা দিয়ে ফেলে রাখতো এবং আর বলতো, বল আমার রব লাত আর উদযা। হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাবে শুধু একটি কথাই বলতেন আহাদ আহাদ।
২|ইয়াসির গোত্র বনু মাখযুম এর গোলাম ছিল। হযরত সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহ তারা আনহা বৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও কাফেররা লৌহার বর্ম পড়িয়ে তাকে উত্তপ্ত মরুভূমিতে ফেলে রাখতো, তার পাশে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপ করে বলতো, নাও এবার মোহাম্মদের দীনের স্বাদ গ্রহণ করো। তার স্বামী হযরত ইয়াসির (রা ও তার ছেলে হযরত আম্মার (রা কে আগুনের ছ্যাকা দেওয়া হতো, পানিতে ডুবিয়ে, উত্তপ্ত বালুর উপর ফেলে রাখা হতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যখন কাফেরদের নির্যাতন আর অসহায় ইয়াসির গোত্রের ধৈর্য ও সহনশীলতার দেখতেন, তখন বলতেন হে ইয়াসির গোত্র ধৈর্যধারণ করো, নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। আর হযরত সুমাইয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার লজ্জাস্থানে বর্শা দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়, (ইন্নালিল্লাহি ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)
পাঠকদের এ কথার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত যে, আমরা সকলেই আল্লাহর মহব্বতের দাবিদার। সাহাবা একরামের(কেরামের) জীবন চরিত্র কে সামনে রেখে, আমরা আমাদের দাবি বাস্তবায়ন করা উচিত যে, আমরা আমাদের এই দাবির প্রতি কতটুকু সত্যবাদী, যদি আমরা আল্লাহর তাআলার দিনের জন্য কোন কোরবানি দিয়ে থাকি কিংবা কোনো ত্যাগ স্বীকার করে থাকি তাহলে তা কিছুটা হলেও আমরা আমাদের দাবিতে সত্যবাদী এবং আল্লাহর নিকট মায়া ও দয়ার আশা করতে পারি, পক্ষান্তরে যদি আল্লাহ তা'আলার সাথে মহব্বতের এ দাবি হয় যে, শুধু মুখে মুখে এবং বাস্তবে আল্লাহর মোকাবেলায় আমাদের নিজের জীবন, সহায় সম্পদ, মান-মর্যাদা, নিজের দেশ, নিজের আরাম-আয়েশের বাসস্থান, পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, প্রিয় হয়, তাহলে আমরা যেন আল্লাহ তাআলার সেই বিধানকে ভুলে না যায়, যে আল্লাহকে মহব্বত করে না আল্লাহ তাআলা তাদের ধ্বংস করে, তাদের স্থলাভিষিক্ত এমন লোকদের কে নিয়ে আসবেন, যারা আল্লাহকে মোহাব্বত করবেন এবং আল্লাহও তাদের মোহাব্বত করবেন আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
يا ايها الذين امنوا من يرتد منكم عن دينه فسوف ياتي الله بقوم يحبهم ويحبونه اذلة على المؤمنين اعزة على الكافرين يجاهدون في سبيل الله ولا يخافون لومة لاءم ذلك فضل الله يؤتيه من يشاء والله واسع عليم
"হে মুমিনগণ তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন হতে ফিরে গেলে, নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং যারা তাকে ভালবাসবে, তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করিবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ" (সূরা মায়েদা আয়াত:৫৪)
(লেখাটা একটি কিতাব থেকে নেওয়া হয়েছে এবং তা পরিমার্জিত করা হয়েছে)
Comment